রক্ষী বাহিনী ও গণবাহিনীর যুদ্ধ
গােপন সাত দফা চুক্তি মােতাবেক বাংলাদেশে একটি আধাসামরিক বাহিনী তৈরির প্রস্তুতি আগেভাগেই ছিল ভারতের এবং ‘র’ মনােনীত ব্যক্তি তৈরি হয়েই বসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে ডাক আসার অপেক্ষায়। তিনি মুজিব বাহিনীর সংগঠক আমাদের পূর্ব পরিচিত মেজর জেনারেল এমএস উবান বিশেষ ধরনের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী তৈরির অভিজ্ঞতায় যিনি সমৃদ্ধ রক্ষী বাহিনী গঠন করে দিতে জেনারেল উবানকে বাংলাদেশে প্রেরণের জন্য শেখ মুজিব ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর কাছে অনুরােধ জানিয়ে চিঠি পাঠালে উবান বিলম্ব মাত্র না করে চলে আসেন ঢাকায় রক্ষী বাহিনীতে জেনারেল উবানের সম্পৃক্ত হবার বিষয়টি তার নিজের ভাষায় তুলে ধরা হচ্ছে : একদিন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসার আমার নামে একটি বার্তা পাঠালেন। বার্তায় বলা হয় যে শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরােধে প্রধানমন্ত্রী আমাকে শেখ-এর ব্যক্তিগত উপদেষ্টা হিসেবে ঢাকায় পাঠাতে সম্মত হয়েছেন এবং আমি যেন সেই মতাে তৈরি হই।” “আমার নামে ওই বার্তা, যাতে শেখ মুজিবের উপদেষ্টা করা হয়েছে আমাকে এবং তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি ওই সময় সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় খবরে পরিণত হয়েছেন, আমার জন্য সেই বার্তাটি ছিল এক বিরল সম্মানের বস্তু। ঢাকায় পৌছলে শেখ-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. সামাদ আমাকে বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা জানান। শহরে যাবার আগে বিমান বন্দরে বসে এক কাপ চা পান করে যাবার জন্যে তিনি জোরাজুরি করতে থাকেন।”
“শেখ সাহেব আমাকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করলেন। বললেন, তাদের সঙ্গে তার সরকারি বাসভবনেই যেন আমি থেকে যাই। আমি তার অনুরােধ বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দেই। তার বাসভবনে খালি রুম ছিল না। তথাপি এতে আমার কোন সন্দেহ নেই যে, তার এবং তার পরিবারের সকলের সাথে থাকলে তিনি খুশিই হতেন। কেননা, তার পরিবারের সবাই আমাকে ইতােমধ্যে ভালােভাবে জেনেছেন। ” “বিখ্যাত শিল্পপতি আদমজির বাসভবনে আমাকে রাখা হল আমি নিরামিষভােজী সেই মতাে আমার খাবার-দাবারের চমৎকার ব্যবস্থা করা হলাে।” “তিনটি ব্যাপারে মুজিব সে সময় উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন। একটি হলাে, একটি বিশেষ গ্রুপের লােকদের অস্ত্র সমর্পণ না করা। সুযােগ এলেই এরা সরকারের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহার করবে। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় এই তথাকথিত মুক্তিযােদ্ধারা অস্ত্র ও গােলাবারুদ লুকিয়ে রাখার জন্য প্রচুর গােপন গুদামঘর তৈরি করেছিল এবং শেখ মুজিব সে সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন ।
“তৃতীয়টি হলাে, খাটি যুব ক্যাডারদের পুনর্বাসন, যাদেরকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ভালাে প্রশিক্ষণ দেন এবং অন্ত্রে সজ্জিত করেন। এদের সকলেই ছিলেন বেকার তার (শেখ মুজিব) ছােট্ট সেনাবাহিনীতে এদের আত্মীভূত করার স্থানও ছিল না। তিনি ঠিক জানতেন না এদের সর্বোত্তম ব্যবহার হবে কিভাবে । “শেখ একটি নতুন বাহিনী গঠনের চিন্তাভাবনা করছিলেন, যাতে তার ভেতর মুক্তি বাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ এবং মুজিব বাহিনীর সদস্যদের আত্মীভূত করা যায় । “নিজের এই চিন্তাভাবনা নিয়ে তিনি (শেখ মুজিব) আমার সঙ্গে আলাপ করেন এবং আমি ঐকমত্য পোষণ করাতে তিনি নতুন একটি বাহিনী গঠনের আদেশ দেন। এর নামকরণ করেন জাতীয় রক্ষী বাহিনী (জে আর বি অথবা ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্স) প্রাথমিক পর্যায়ে এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা হবে অফিসার নিয়ে বার হাজার । বাহিনীর সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য অধিনায়কত্ব রাখেন নিজেরই হাতে এবং ঢাকাকে মুখ্য কেন্দ্র করেন। এক সুদক্ষ অফিসার, নাম কর্নেল নুরুজ্জামান, তাকে করেন এই বাহিনীর কমান্ডার আর এই বাহিনী গঠনে, প্রশিক্ষণ দান এবং অস্ত্র সজ্জিতকরণে সহায়তা দানে আমাকে অনুরােধ করেন।” রক্ষী বাহিনীর প্রশিক্ষণদানকারী ভারতীয় সেনা অফিসারদের মধ্যে ছিলেন মেজর মালহােত্রা। তানদুয়া মুজিব বাহিনী ট্রেনিং ক্যাম্পে সমাজতন্ত্রের ওপর বক্তৃতা প্রদান বন্ধের আদেশ দেন যে কর্নেল, তার সঙ্গেও ছিলেন মেজর মালহােত্রা। তার কথা আবদুর রাজ্জাক আমাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন। সুতরাং বুঝে নিতে বেগ পেতে হয় না যে, রক্ষী বাহিনী সর্বপ্রথম ঝাপিয়ে পড়ে বামপন্থী এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের বামপন্থী চিন্তাধারায় অনুবর্তী কর্মীদের ওপর এবং আক্রমণ হানে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধীদের ওপর।”
নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালাবার অবাধ লাইসেন্স পেয়ে যায় রক্ষী বাহিনী। কেননা, এই বাহিনী তার কার্যকলাপের জন্য একমাত্র প্রধানমন্ত্রী, পরে প্রেসিডেন্টের (শেখ মুজিব) কাছেই দায়ী ছিল । কোন আদালতে রক্ষী বাহিনীর কার্যকলাপ চ্যালেঞ্জ করে মামলা দায়েরের কোন সুযােগই ছিল না। যখন যাকে খুশি গ্রেফতার করতে পারতাে একজন রক্ষী বাহিনীর সদস্য। গুম করে দিলেও তার গায়ে আঁচড় কাটার ক্ষমতা ছিল কারােরই। বলা হয়, কর্যক্রম শুরুর কাল থেকে ভেঙ্গে দেয়ার আগ পর্যন্ত রক্ষী বাহিনী প্রায় দশ হাজার লােক হত্যা করে। শেখ মুজিব নিহত হবার পর রক্ষী বাহিনীর নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের বিবরণ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আসতে শুরু করে। ওই বিবরণ পাঠককে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞকইে স্মরণ করিয়ে দেয় । শেখ মুজিবের জীবৎকালেই বিদেশী
—————————————–
১. মেজর জেনারেল এস এস উবান ফ্যান্টমস অব চিটাগং ‘ফিপথ আর্মি ইন বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা ১৩৮-১৩৯।
পত্র-পত্রিকায় নির্যাতনের নানা বিবরণ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত একটি রিপাের্টে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এক বিদেশী সাংবাদিকের ওপর। তার জন্য বাংলাদেশ নিষিদ্ধ হয়ে । যায়। বিদেশী পত্র-পত্রিকায় রক্ষী বাহিনীর নির্যাতনের ওপর যেসব রিপাের্ট বের হয়, তার কয়েকটি তুলে ধরা হচ্ছে : মার্কিন মাসিক রিডারস ডাইজেস্ট-এর ১৯৭৫ সালের মে মাসের সংখ্যায় লেখা হয় “শেখ মুজিব দুটি বেসামরিক সংগঠনের ওপর নির্ভরশীল। একটি হচ্ছে তার ভাগ্নের নেতৃত্বাধীন এক লাখ সশস্ত্র একগুঁয়ে যুবকের সংগঠন যুবলীগ । এটি জাতীয় শুদ্ধি অভিযানে নিয়ােজিত অপরটি হচ্ছে, তার নিরাপত্তা বাহিনী । নিষ্ঠুর রক্ষী বাহিনী। শেষােক্ত দলটি যে কোন সময় যখন-তখন বন্দুক উচিয়ে কল-কারখানায় ঢুকে পড়ে, শ্রমিক নেতাদের ওপর খবরদারি করে, গ্রামাঞ্চলে আকস্মিক সান্ধ্য আইন জারি করে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালায়। এরা সাধারণ লােকদের জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় এমন নির্যাতন চালিয়ে থাকে, যার পরিণতিতে এ যাবৎ বহু লােকের মৃত্যু হয়েছে। মার্কিন সাপ্তাহিক নিউজউইক ১৫ জুলাই, ১৯৭৫-এর সংখ্যায় লেখে “রক্ষী বাহিনী নামক একটি আধাসামরিক বাহিনী পুনরায় নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে। বিদেশী সাংবাদিকের কাছে দেশের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আজো পাকিস্তানি আমলের মতােই জনসাধারণ ভয়ে কেঁপে ওঠে। সম্প্রতি এক মন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাওকারী একটি মিছিলের ওপর রক্ষী বাহিনীর মেশিনগানের গুলি বর্ষিত হয় এবং ঠাণ্ডা মাথায় মিছিলের ১৯ জনকে হত্যা করে। পশ্চিম বাংলার ফ্রন্টিয়ার পত্রিকার ভলিউম বি, নম্বর-২’এ প্রকাশিত রিপাের্টে বলা হয় “ময়মনসিংহ জেলার একটি থানাতেই শত শত তরুণ, কৃষক ও ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে। এদের অনেকেই সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির সদস্য ছিল। অন্যদের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দলের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে সন্দেহ করা হয়েছিল।
এমনকি অনেক যুবক, যারা রাজনীতিতে ততটা সক্রিয় ছিল না, তারাও সন্ত্রাসী অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে। “যারা সৌভাগ্যবশত রক্ষী বাহিনী-ক্যাম্প থেকে ছাড়া পেয়েছে, তাদের মুখে মধ্যযুগীয় নির্যাতন পদ্ধতি অনুসৃত হবার কথা শােনা গেছে। নির্যাতনের সাধারণ হাতিয়ার লৌহদণ্ড, সুঁচ, গরম পানি প্রভৃতি বিরােধী রাজনৈতিক দল সম্পর্কে তথ্য উৎঘাটনে এগুলাে যথেষ্ট কার্যকর। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের রাজনীতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর প্রধান দিক হচ্ছে বাংলাদেশের বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম।” রক্ষী বাহিনী কার্যক্রম আরম্ভ করে ১৯৭২ সালের শেষের দিকে। শুরুতেই তাকে কয়েকটি বামপন্থী গ্রুপের সশস্ত্র প্রতিরােধের মুখখামুখি হতে হয় । ১৯৭৪ সালে
————————————–
২. আহমেদ মুসা। ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ, পৃষ্ঠা-২০৬ ৩. প্রাগুক্ত। ৪, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২০৩-২০৪ । এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় সর্বহারা পার্টি নেতা সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর। তাকে ১৯৭৫ সারের ২ জানুয়ারি রক্ষী বাহিনী হত্যা করে।
প্রতিরােধে নামে গণবাহিনী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সশস্ত্র ক্যাডার গ্রুপ । সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে এই ক্যাডার গ্রুপের শত শত তাজা তরুণ অকাতরে জীবন দেয় রক্ষী বাহিনীর স্টেন আর মেশিনগানের গুলিতে । অথচ এই তরুণরা জানতাে না তথাকথিত ডাচ রিলিফ কর্মী পিটার কাসটার্স আর তার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সঙ্গে গণবাহিনীর সম্পর্কের কথা। আর এই সম্পর্কটির আলােকে বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় যে রক্ষী বাহিনীর সঙ্গে গণবাহিনীর লড়াইটি ছিল ‘র’ আর সিআইএ’র লড়াই এবং এ কথাও ঠিক, কোথাও কোথাও বামপন্থীদের সঙ্গে মিলে রক্ষী বাহিনীর প্রতিরােধে নেমেছে গণবাহিনী। এদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতনের অভিযােগও নেই।
উপসংহার
এ যাবত আমরা যা দেখে এসেছি, তাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তির ভূমিকা আমাদের কাছে স্পষ্ট। নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধিতে পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তি ক্ষুদ্র দেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আবেগ আর সংগ্রামী চেতনাকে সে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে কী কৌশলে ব্যবহার করে তাও আমাদের কাছে কম বেশি পরিষ্কার । বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মুজিব বাহিনী রক্ষী বাহিনী এবং গণবাহিনী তার দৃষ্টান্ত বিরােধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলে পরাশক্তি এবং আঞ্চলিক শক্তির এই যে রাজনীতি, এর প্রতিফলন বাংলাদেশের বুকে ঘটে ব্যক্তিগত প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার রাজনীতিতে যার প্রকাশ ঘটে রক্ষী বাহিনী, আওয়ামী যুবলীগের যুববাহিনী এবং লাল বাহিনী তৈরির রাজনীতির মধ্যে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরমত অসহিষ্ণুতা ও প্রতিপক্ষকে কায়িকভাবে বিনাশের যে রাজনীতি আমরা দেখতে পাচ্ছি যা বিষাক্ত সাপের ভয়ঙ্কর নিঃশ্বাসের মতই ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামগঞ্জ শহরের রাজনীতিতে, এ সেই রাজনীতিরই প্রতিফলন।
সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ – মাসুদুল হক