জেনারেল উবানের ভাষ্য মুজিব বাহিনী
এবার আমরা আসবাে মুজিব বাহিনীর সংগঠক মেজর জেনারেল এস, এস উবানের নিজের কথায়,মুজিব বাহিনীর গঠন, তার উদ্দেশ্য এবং কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণীতে তা তুলে ধরা হচ্ছে তার লেখা “ফ্যানটমস অব চিটাগং : দ্য ফিপথ আর্মি ইন বাংলাদেশ” গ্রন্থ হতে পুরােটা নয়, অংশবিশেষ।
“মুক্তিবাহিনী “
হাজার হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের কোম্পানি ও ব্যাটালিয়নে সংগঠিত করে মুক্তিবাহিনী নামকরণ করা হয়। এদের ভেতর বেঙ্গল রাইফেলসের নিয়মিত ইউনিটও ছিল । তারা ভারতীয় বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করে কিন্তু নিজেদের নেতৃত্বেই লড়ে যেখানে নেতৃত্ব ভালাে ছিল, সেখানে চমৎকার লড়েছে। সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় তারা লক্ষ্য নির্ধারণ করতাে। এবং কমান্ডাে কায়দায় আক্রমণ চালাতাে। কিন্তু এই ধরনের কার্যক্রমের জন্য তারা তেমন প্রশিক্ষণ পায়নি কিংবা যুদ্ধ উপকরণও পর্যাপ্ত ছিল না। প্রায়শই এমন ধরনের ক্ষয়ক্ষতিও হতাহতের সম্মুখীন হতাে তারা, যা চেষ্টা করলে এড়ানাে যেতাে।
এদেরকে দেশের অভ্যন্তরে পাঠাবার প্রচেষ্টা নেয়া হয় কয়েকবার কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলাে, বড় বড় দলে পাঠানাে হয় । একেকটি দলে কখনাে কখনাে দু’শয়ের ওপর মুক্তিযােদ্ধা দেয়া হতাে। ফলে ছােট ছােট গ্রাম এত বড় বড় দলের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করতে পারতাে না। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ অতি সহজেই তাদের উপস্থিতির খবর পেয়ে যেতাে এবং অপারেশন শেষে তাদের চলে আসার পর পাকসামরিক কর্তৃপক্ষ, ওই গ্রামগুলােতে চালাতে হত্যা, ধর্ষণ এবং ধবংসের তাণ্ডব । কেননা, তারা মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিল। এতে গ্রামবাসীদের কাছে মুক্তিযােদ্ধাদের আগমনের ব্যাপারটি অপ্রিয় হয়ে দাঁড়ায়। হাজার হাজার তরুণ প্রশিক্ষণ নেবার জন্য স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসে। খাটি যারা তাদেরকে চিহ্নিত করার কোন উপযুক্ত ব্যবস্থা ছিল , শিক্ষার্থীদের লক্ষ্যও নির্দিষ্ট ছিল না। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলি জাতীয় পরিষদ সদস্যদের (এমএনএ) ওপর নির্ভরশীল ছিল। শিক্ষার্থীদের সঠিক পরিচিতি সত্যায়নের জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে নিয়ােগ করেন। বাঙালি অফিসাররা যে তালিকা নিয়ে আসতেন, এমএনএ’রা সেটাই অন্ধের মত সত্যায়ন করতেন। এদের কারাে কারাে ভেতর ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে নিজস্ব রাজনৈতিক মতলব ছিল । সেহেতু, কয়েকটি দল অস্ত্রশস্ত্রসহ বাংলাদেশের ভেতরে গিয়ে হাওয়া হয়ে যায় । কিছু দল ফিরে আসে অস্ত্র ভেতরে লুকিয়ে রেখে এবং রিপাের্ট করে শত্রুর সঙ্গে সংঘর্ষে অস্ত্রশস্ত্র তাদের খােয়া গেছে। এই অশুভ তৎপরতা নিমূলে একটি নিচ্ছিদ্র প্রস্তাব দেয়া হয় । কিন্তু উচ্চতর পদ সৃষ্ট জ্ঞানবানদের উন্নাসিকতার কাছে এ প্রস্তাব গ্রহণযােগ্য হয়ে উঠতে পারে না।
“মুজিব বাহিনী “
ওই অশান্ত সময়ে একদল উৎসর্গীকৃত প্রাণ তরুণ নেতৃত্বের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। তাদের নাম সারা বাংলাদেশে অত্যন্ত পরিচিত। তারা হলেন শেখ ফজলুল হক মণি (শেখ মুজিবের এক ভাগ্নে), তােফায়েল আহমদ, সিরাজ এবং আবদুর রাজ্জাক। প্রথম পরিচিতিতে তাদের সম্পর্কে আমার এই ধারণা হয় যে তারাই একমাত্র নেতৃত্ব, যারা ভাল কিছু দিতে পারেন। মনে হলাে, লক্ষ্য সম্পর্কে তারা প্রচণ্ডভাবে প্রেরণাদীপ্ত এবং তা অর্জনে অকুতােভয়। তাদের নেতৃত্ব বাংলাদেশের ভেতরে-বাইরে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে যে প্রতিষ্ঠিত, তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলাে, তাদের অবস্থান মেনে নেয়ার মেজাজে ছিলেন না অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার। এদেরকে তারাই প্রশিক্ষণ দিতে চেয়েছিলেন এবং চেয়েছিলেন মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বাধীনে যুদ্ধ করাতে। অথচ ওই ধরনের প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যাপারে এই তরুণ নেতাদের ঘাের আপত্তি ছিল। মুজিবের প্রতি প্রগাঢ় আনুগত্য এবং তার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে (তারা সবাই মুজিবের সঙ্গে পাক-সামারিক কর্তৃপক্ষের কারা নির্যাতন ভােগ করেছেন) এরা নিজেদেরকে ‘মুজিব বাহিনী’ নামে অভিহিত হতে পছন্দ করেন। এরা তাদের পুরােনাে সহকর্মীদের ভেতর থেকে ক্যাডার নির্বাচিত করে সত্যায়নপত্র। প্রদান করেন। তারা বাংলাদেশ থেকে দৃঢ়চেতা, নিবেদিতপ্রাণ বিশ্বস্ত লােকদের নির্বাচিত করে নিয়ে আসেন ট্রেনিং দেবার জন্যে। বলেন, মুক্তিবাহিনী কমান্ডাে পদ্ধতির প্রশিক্ষণ পাচ্ছে, তা থেকে তাদের লােকদের আলাদা ধারায় অপ্রচলিত যুদ্ধের ট্রেনিং পাওয়া উচিত। মনে হল, তারা একটি রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্বে আছেন এবং প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ শহর, তহশিল এবং থানায় তাদের সংগঠনের শাখা রয়েছে।
সেনাবাহিনী যে হাজার হাজার তরুণ মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, তাদের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে তাদের (যুবনেতাদের) সন্দেহ ছিল এবং আওয়ামী লীগের যুব সংগঠনের সঙ্গে এরা (মুক্তিযােদ্ধারা) সম্পর্কিতও ছিল না। তাই মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে তারা তাদের সংগঠন সেলগুলাের গােপনীয়তা রক্ষায় সাবধানতা অবলম্বন করতাে । “কর্নেল ওসমানী যৌথ অধিনায়কত্বের ওপর জোর দেন । অবশ্যিই যে কোন যুদ্ধে এটা কাক্ষিত বিষয় আওয়ামী লীগের কিছু সিনিয়র নেতা, যারা অস্থায়ী সরকার গঠন করেছিলেন, তারাও তাদের যুব শাখার এই নেতাদের ব্যাপারে মােটেই খুশি ছিলেন না, যা একটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করে। এ বিষয়ে কোন আপােস বা অন্য কিছু করার সুযােগ ছিল না। ভারতীয় সেনাবাহিনী কেবলমাত্র অস্থায়ী সরকারের মতামত গ্রহণ করতাে। সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের মাধ্যমে । অন্য কোনাে কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দিতে দল ফিরে আসে অস্ত্র ভেতরে লুকিয়ে রেখে এবং রিপাের্ট করে শত্রুর সঙ্গে সংঘর্ষে অস্ত্রশস্ত্র তাদের খােয়া গেছে। এই অশুভ তৎপরতা নিমূলে একটি নিচ্ছিদ্র প্রস্তাব দেয়া হয় । কিন্তু উচ্চতর পদ সৃষ্ট জ্ঞানবানদের উন্নাসিকতার কাছে এ প্রস্তাব গ্রহণযােগ্য হয়ে উঠতে পারে না।
“মুজিব বাহিনী “
ওই অশান্ত সময়ে একদল উৎসর্গীকৃত প্রাণ তরুণ নেতৃত্বের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। তাদের নাম সারা বাংলাদেশে অত্যন্ত পরিচিত। তারা হলেন শেখ ফজলুল হক মণি (শেখ মুজিবের এক ভাগ্নে), তােফায়েল আহমদ, সিরাজ এবং আবদুর রাজ্জাক। প্রথম পরিচিতিতে তাদের সম্পর্কে আমার এই ধারণা হয় যে তারাই একমাত্র নেতৃত্ব, যারা ভাল কিছু দিতে পারেন। মনে হলাে, লক্ষ্য সম্পর্কে তারা প্রচণ্ডভাবে প্রেরণাদীপ্ত এবং তা অর্জনে অকুতােভয়। তাদের নেতৃত্ব বাংলাদেশের ভেতরে-বাইরে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে যে প্রতিষ্ঠিত, তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলাে, তাদের অবস্থান মেনে নেয়ার মেজাজে ছিলেন না অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার। এদেরকে তারাই প্রশিক্ষণ দিতে চেয়েছিলেন এবং চেয়েছিলেন মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বাধীনে যুদ্ধ করাতে। অথচ ওই ধরনের প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যাপারে এই তরুণ নেতাদের ঘাের আপত্তি ছিল। মুজিবের প্রতি প্রগাঢ় আনুগত্য এবং তার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে (তারা সবাই মুজিবের সঙ্গে পাক-সামারিক কর্তৃপক্ষের কারা নির্যাতন ভােগ করেছেন) এরা নিজেদেরকে ‘মুজিব বাহিনী’ নামে অভিহিত হতে পছন্দ করেন। এরা তাদের পুরােনাে সহকর্মীদের ভেতর থেকে ক্যাডার নির্বাচিত করে সত্যায়নপত্র। প্রদান করেন। তারা বাংলাদেশ থেকে দৃঢ়চেতা, নিবেদিতপ্রাণ বিশ্বস্ত লােকদের নির্বাচিত করে নিয়ে আসেন ট্রেনিং দেবার জন্যে। বলেন, মুক্তিবাহিনী কমান্ডাে পদ্ধতির প্রশিক্ষণ পাচ্ছে, তা থেকে তাদের লােকদের আলাদা ধারায় অপ্রচলিত যুদ্ধের ট্রেনিং পাওয়া উচিত। মনে হল, তারা একটি রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্বে আছেন এবং প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ শহর, তহশিল এবং থানায় তাদের সংগঠনের শাখা রয়েছে।
সেনাবাহিনী যে হাজার হাজার তরুণ মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, তাদের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে তাদের (যুবনেতাদের) সন্দেহ ছিল এবং আওয়ামী লীগের যুব সংগঠনের সঙ্গে এরা (মুক্তিযােদ্ধারা) সম্পর্কিতও ছিল না। তাই মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে তারা তাদের সংগঠন সেলগুলাের গােপনীয়তা রক্ষায় সাবধানতা অবলম্বন করতাে । “কর্নেল ওসমানী যৌথ অধিনায়কত্বের ওপর জোর দেন । অবশ্যিই যে কোন যুদ্ধে এটা কাক্ষিত বিষয় । আওয়ামী লীগের কিছু সিনিয়র নেতা, যারা অস্থায়ী সরকার গঠন করেছিলেন, তারাও তাদের যুব শাখার এই নেতাদের ব্যাপারে মােটেই খুশি ছিলেন না, যা একটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করে। এ বিষয়ে কোন আপােস বা অন্য কিছু করার সুযােগ ছিল না। ভারতীয় সেনাবাহিনী কেবলমাত্র অস্থায়ী সরকারের মতামত গ্রহণ করতাে। সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের মাধ্যমে । অন্য কোনাে কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত ছিল না তা যতই ফলপ্রসু হােক কিংবা তাদের স্বদেশ প্রেম যতই তীব্র হােক কেন। “এই পরিস্থিতিতে স্পষ্টতই সুসংগঠিত, প্রতিষ্ঠিত, আত্মােৎসর্গীকৃত এবং তীব্র প্রেরণাদীপ্ত একটি তরুণ গ্রুপের গুরুত্ব আমি অনুধাবন করতে পারছিলাম । এই ধরনের একটি সংগঠন কি কারণে গােপনীয়তা অবলম্বন করে চলছে, তাও আমি বুঝতে পারছিলাম । কেননা, অবস্থা যেখানে এরকম, যে কেউ মুক্তিযােদ্ধার পােশাক পরে ট্রেনিং নিতে পারে এবং কাধে অস্ত্র ঝুলিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে চলে যেতে পারে। এই সাধারণ বােধ নির্দেশ করে যে মুজিব বাহিনীকে আমরা সমর্থন দেব এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে এর সম্পর্ক সহজতর করে তুলতে যা করণীয়, তা আপ্রাণ করবাে ।
কেননা, মুক্তিবাহিনী, যারা সরাসরি মিঃ তাজউদ্দীনের অধিনায়কত্বে রয়েছে, তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং তিনি অস্থায়ী সরকারের প্রধান হিসেবে সংশ্লিষ্ট সকল মহলে স্বীকৃত। “ক্যাবিনেট সেক্রেটারিয়েটের সেক্রেটারি মি, আর এন কাও১ ছিলেন আমার বেসামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগ যুব শাখার এই সংগঠনটি এবং এর নেতৃত্ব সম্পর্কে খুঁটিনাটি খোঁজখবর করার সুবিধা ছিল তার। একই সাথে তার এই বিশ্বাস জন্মে যে একমাত্র তারাই ভাল কিছু দিতে পারেন এবং এই কারণে তিনি যুবনেতাদের আমার হাতে তুলে দেন। এও মনে করেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর রাজনৈতিক এলাকায় কাজ করার সুযােগদানের জন্য তাদেরকে বিশেষ। ধরনের মর্যাদা দেয়া দরকার। তাছাড়া যুব নেতাদের প্রতি অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীদের ঈর্ষাপরায়ণতার বিষয়টি তার অগােচরে ছিল না। কেননা, যুবনেতারা ছিলেন মাথা গরম ধরনের এবং আপােসহীন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন । কিন্তু তাদের মন্ত্রীরা ছিলেন উচ্চাভিলাষী ও মতলববাজ । আর তিনি (কাও) তার আয়ত্তের মধ্যে থেকে পরিস্থিতিকে সহজ করার। চেষ্টা করেন কিন্তু সমালােচনার হুল আমাকেই সহ্য করতে হতাে। যেহেতু আমি ছিলাম তাদের অধিনায়ক এবং তাদের প্রশিক্ষণদান ও কাজে লাগানাের দায়িত্ব ছিল আমার ওপরেই অর্পিত। “আমার সমস্যা আরাে বেড়ে গেল যখন এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মি. ডি পি ধর। আমাদের প্রাত্যহিক কাজ কর্মের খতিয়ান নেয়া শুরু করলেন। এর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সম্পর্কে কিছু কথা বলা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
“শেখ ফজলুল হক মণি “
হাল্কা পাতলা দেহের এক অগ্নিপুরুষ । মনে হল, এদের জন্য তিনি প্রকৃতি সৃষ্টনেতা । বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রচণ্ড রকমের আত্মােৎসর্গী প্রাণ এবং যে কোনাে ধরনের ত্যাগ স্বীকারের জন্য ছিলেন প্রস্তুত। প্রায়শই অসুস্থ থাকতেন কিন্তু
কদাপিও
———————–
১. ‘র’-এর ডাইরেক্টর
কাজ থেকে বিরত থাকতেন না। সীমান্তের কাছাকাছি থাকতেন বলে সেখানে ডাক্তার পাঠিয়ে তার চিকিৎসা করানাে আমার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তথাপি যদুর করণীয় ছিল আমার পক্ষে, তা করতাম। “বন্ধুদের প্রতি তিনি ছিলেন আন্তরিক এবং অনুগত, শেখ মুজিবের প্রতি ছিলেন সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন রাজনীতি সচেতন, ধীর, সতর্ক, চিন্তাশীল এবং নামকরা সাংবাদিক আমি মনে করি, তিনি বাংলাদেশে তথ্য ও প্রচার মন্ত্রী হিসেবে ভাল করবেন । কিন্তু মনে হয় তার আকাক্ষা আরাে ওপরের দিকে। “তিনি আমাকে বলেন, এই তরুণ নেতাদের কাছে আমি শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণ করেছি।
“তােফায়েল আর রাজ্জাক তাকে শ্রদ্ধা করতেন। শ্রদ্ধা করতেন সিরাজও। তবে তার শ্রদ্ধা ছিল সীমিত পরিসরে। তাদের আলােচনা প্রায়শই উত্তপ্ত হয়ে উঠতাে। সিরাজ আপােসহীন হয়ে উঠতেন কিন্তু সর্বদাই কাজ করতেন একটি টিম হিসেবে। যৌথ নেতৃত্বের একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন তারা। “সিরাজ “প্রগতিবাদী (রেডিক্যাল) চিন্তাধারাকে তিনি লালন করতেন এবং ছিলেন আপােসহীন। যুদ্ধ করতেন ব্যাঘ্রের মতন, কাজ করতেন জান কবুল দাসের মত। একাদিক্রমে কয়েকদিন না খেয়ে না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারতেন। শুধু চায়ের ওপর বেঁচে থাকতে পারতেন। খেতে বসলে প্রচুর খেতেন। মুরগি মাংস আর ভাত ছিল তার প্রিয় খাদ্য। “আমার প্রতি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাবান। স্বাধীনতার পর পর ঢাকার একটি আন্তর্জাতিক হােটেলে যেদিন তিনি আমার সাথে দেখা করতে আসেন, সেদিনের কথা ভুলতে পারব না। গায়ে জ্বর ছিল বেশ। তথাপি জোরাজুরি করেন তাকে আমার রুমে নিয়ে আসতে, এমন কি তিনি সােজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলেন না। দু’জন তাকে ধরে রেখেছিল। অসুস্থ শরীরে আমার সঙ্গে দেখা করতে নিজের রুম ছেড়ে চলে আসার জন্য আমি তাকে বকাঝকা করলাম। তাতে তিনি বললেন “যিনি আমাদের এবং আমাদের দেশের জন্য এত করেছেন, সেই ব্যক্তিটির প্রতি শ্রদ্ধা জানানাের সুযােগ হাতছাড়া করি কি করে? বিশেষত স্বাধীনতার পর আপনি যখন ঢাকায়।” “তােফায়েল আহমদ “তার কারিশমা হচ্ছে, জন্মগতভাবে তিনি অকৃত্রিম এবং রাজনৈতিক কাজে কঠিন পরিশ্রমী । কাজ করেছেন শেখ মুজিবের অনুচর হয়ে। “তার পত্নী এবং অন্যান্য ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন তখন বাংলাদেশে। আমি তাদেরকে নিয়ে আসার একটি পরিকল্পনা দিলাম । জবাবে তিনি বলেন আল্লাহর
—————————–
২. সিরাজুল আলম খান।
হাতে তাদের নিরাপত্তার ভার ছেড়ে দেই না কেন আমরা? লাখাে লাখাে বাঙালি একই রকমের বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে সবাই তাে আসতে পারে না।” “আবদুর রাজ্জাক “সেই অগ্নিগর্ভ চার নেতার মধ্যে তিনিই ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ় চরিত্রের মানুষ । এর অর্থ এই নয় যে অন্যদের ভেতর দৃঢ়তার অভাব ছিল। ধীর স্থির ধরনের মানুষ তিনি এবং অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ নন। ছিলেন বিচারবােধসম্পন্ন এবং গভীর চিন্তাশীল। কোন পরিকল্পনায় নামার আগে সেটা নিয়ে ভাবতেন দীর্ঘ সময় । উৎকর্ষ অর্জনই ছিল তার লক্ষ্য। তাই প্রতিটি বিষয়ের খুঁটিনাটি দিক দেখতেন ভাল করে। “এই চার নেতা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসেন এবং এমন একজনকে খুঁজছিলেন যিনি তাদেরকে অস্ত্র সহায়তা দিয়ে তাদের দেশ মুক্ত করায় সাহায্য করতে পারেন। ভারতে তাদের কেউ চিনতাে না। তাদের প্রবাসী অস্থায়ী সরকার তখন গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল এবং অস্থায়ী সরকারের লােকজন তাদেরকে অযৌক্তিক গুরুত্ব দেয়ার পক্ষপাতিও ছিলেন না। “আমরাও এমনই কিছু যুবনেতা খুঁজছিলাম, যাদের দেশের ভেতর প্রভাব রয়েছে । কয়েকদিন আলােচনার পর আমরা উপলব্ধি করলাম তারাই খাঁটি দেশপ্রেমিক। সারা বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে তাদের সংগঠনের শাখা রয়েছে। এবং ভাল কাজ দিতে পারবে। তারা দ্রুতগতিতে বাংলাদেশের ভেতর এবং বাইরে থেকে তরুণদের জড় করে। এমন সব তরুণদের আনে, যাদেরকে তারা ভাল চেনে এবং জানে। গেরিলা। যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে গঠিত ট্রেনিং সেন্টারে তাদেরকে আমরা প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করি। “প্রাথমিক পর্যায়ে শারীরিক দিক দিয়ে তারা দুর্বল ছিল ।
পাহাড়ি অঞ্চলের ঠাণ্ডা তাদের কাহিল করে তােলে ।ভাল খাবার ও ভিটামিন সরবরাহে দ্রুত তারা গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। ট্রেনিং সেন্টার ছেড়ে যাবার আগে সবার ওজন যায় বেড়ে… “রাজনৈতিক কোন্দল “…সেনাবাহিনী কেবল নিয়মিত ও কমান্ডাে পদ্ধতি অপারেশনের ট্রেনিং দিতে পারে আর এই প্রশিক্ষণ নিতে এগিয়ে আসে হাজারাে তরুণ এবং একটি বাহিনী গঠনে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছিল, যাকে মুক্তিবাহিনী নামে অভিহিত করা হয়। এই নেতারা (যুবনেতারা) আমাদের জানান, অনেক অবাঞ্ছিত লােক, যারা বাংলাদেশে নকশালদের সমতুল্য, তারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, অস্ত্র পাচ্ছে। তারা আমাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এই সব অস্ত্র পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না। এগুলাে তারা স্বাধীনতা উত্তরকালের জন্য বাংলাদেশের ভেতরে জমা রাখছে নকশাল ধরনের শাসন কায়েমের লক্ষ্যে। তারা কিছু চীনাপন্থী কমিউনিস্ট নেতার নাম বলেন- যারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসারের আত্মীয় এবং এখন এই অফিসাররা মুক্তিবাহিনীতে। এদের সাহায্য ও সম্মতিতে তারা তাদের নিজস্ব কমিউনিস্ট ক্যাডারদের দলে দলে ভর্তি করাচ্ছে, প্রশিক্ষণ দেওয়াচ্ছে এবং অস্ত্রে সজ্জিত করাচ্ছে।
“এ বিষয়টি অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সরাসরি তুলে ধরা হয়। স্পষ্টতই তা ফলােৎপাদনে ব্যর্থ হয়। মুক্তি বাহিনীর ভেতর আরেক ধরনের মুক্তিযােদ্ধা ছিল, যারা সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানপন্থী স্বাধীনতা অর্জিত হবার পর তারা তাদের অস্ত্র বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের হাতে যে তুলে দেবে না, এ ব্যাপারে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। গােলযােগ সৃষ্টির মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল। তাদের। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে নৃশংসতা সংঘটিত করে, তার কারণে এই সময়ে। তাদের সংখ্যা বেশি ছিল না। তৃতীয় আরেকটি দল-ফ্রি ল্যান্স মুক্তিযােদ্ধা; এরা ছিল। ডাকাত। এই সময়কে এরা আধুনিক অস্ত্র প্রাপ্তির এবং ভারতীয় খরচায় প্রশিক্ষণ নেবার এক মহা সুযােগ হিসেবে গ্রহণ করে। “আমি স্পষ্ট ভাষায় আমার সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলি যে মুক্তিবাহিনীর এই তিন ধরনের লােকেরা ঐক্যবদ্ধ হবে, লুকিয়ে রাখা অস্ত্র ব্যবহার করে স্বাধীন বাংলাদেশে গােলযোেগ পাকাবে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। “মুজিব বাহিনী নেতাদের সঙ্গে আলােচনা করে আমি মুক্তিবাহিনী সদস্য বাছাইয়ে একটি নিখুঁত প্রস্তাব দেই। প্রতিদিন মুজিব বাহিনী নেতারা আমার কাছে আসতে থাকে নতুন নতুন প্রমাণসহ । তাদের অস্তিত্বের পক্ষে ঘনায়মান বিপদ সম্পর্কে অভিযােগ তুলতে থাকে। একইভাবে তাদের আমি আশ্বাস দিয়ে বলি যে, এ বন্ধের জন্য আমার যা করণীয়, তা আপ্রাণ কষ্ট করব ।
কিন্তু আমি জানতাম, আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি সেখানে এটা করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ব্যাপকহারে মুক্তিবাহিনী যােদ্ধাদের ট্রেনিং প্রদানের চাপ ক্রামগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। সংখ্যার ওপর জোর দেয়া হচ্ছিল, পাওয়াও যাচ্ছিল চাহিদা অনুযায়ী। পূর্বতন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের দু’জন বাঙালি সদস্যকে মনােনীত করা হয়েছিল খাটি লােকদের সত্যায়নের জন্য। তারা সেটা করতেন তাড়াহুড়াের ভেতর। স্বার্থান্বেষী মহল তাদের সামনে তালিকা পেশ করতাে এবং সেগুলাে, এমন কি হালকা ধরনের কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই সে তালিকা আওয়ামী লীগের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সত্যায়ন করে দিতেন। একবার সই হয়ে গেলে এবং তাতে যদি কোন ভুলও থেকে যেতাে, সেটা তারা স্বীকারই করতেন না। পুরাে ব্যাপারটা এত বেশি তাৎক্ষণিক ছিল যে মনে হতাে এমএনএরা হয় স্বার্থন্বেষী মহল প্রেরিত না হয় স্বাধীন হবার পর দেশের কী হবে না হবে, তা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। | “অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার মানেই অপরিহার্যভাবে মি, তাজউদ্দীন। তিনি মুজিব বাহিনী নেতাদের সহ্য করতে পারতেন না। তাদের প্রতিটি অভিযােগকে বাজে কথা বলে উড়িয়ে দিতেন । কর্নেল ওসমানী অস্থায়ী সরকারের কাছ থেকে নিজের নির্দেশ গ্রহণ করতেন। মুজিব বাহিনী নামে আলাদা একটি বাহিনীর অস্তিত্বকে তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি এবং সেই বাহিনীও সামগ্রিকভাবে তার অধিনায়কত্বে ছিল না ।
যদিও বাহ্যিকভাবে এর নেতাদের প্রতি বন্ধুতার ভাব দেখাতেন। জেনারেল আরােরা পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সকল অপারেশন সমম্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন। যেহেতু মুজিব বাহিনী সরাসরি তার অধিনায়কত্বে ছিল না, সে কারণে তিনিও এদের ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। এতদসত্ত্বেও মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক—সৈনিক হিসেবে আমি তাকে এই আশ্বাস দেই যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তার দেয়া যে কোন দায়িত্ব মুজিব বাহিনী পালন করবে এবং তার (জেনারেল আরােরা) সঙ্গে আমি সর্বক্ষণ যােগাযােগ রক্ষা করে চলবাে । যাবতীয় তথ্য তার জ্ঞাতার্থে পেশ করবাে। এতে তিনি মােটেই খুশি হননি। কেননা, আমাকে তার অধিনায়কত্বে দেয়া হয়নি। আমি জেনারেল আরােরাকে বােঝানাের আপ্রাণ চেষ্টা করেছি তথাপি তিনি এই বিশেষ ধরনের অধিনায়কত্বের বৈশিষ্ট্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন।.
বিক্ষুব্ধ হবার মূল কারণ
“যুব নেতারা সর্বদাই অভিযােগ করতেন যে জেনারেল আরােরা ও মি, তাজউদ্দীনের মধ্যে একটি রাজনৈতিক সমঝােতা রয়েছে। যে কারণে দু’জনেই চাপ প্রয়ােগ করে চলেছিলেন যে যুব নেতাদের অধিনায়কত্বে নয়, তাদের অধিনায়কত্বে থাকবে মুজিব। বাহিনী। কেননা, মি. তাজউদ্দীনের প্রতি এই যুব নেতাদের কোন আনুগত্যই ছিল না। আমি জানতাম যুব নেতারা মি, তাজউদ্দীনকে দু’চোখে দেখতে পারতেন না। তারা। অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামের প্রতি সর্বদাই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীনকে শ্রদ্ধা করতেন না। “আমি এই ভুল বােঝাবুঝি অপনােদনের চেষ্টায় ক্রটি রাখিনি কিন্তু এর সৃষ্টি অতীতে । পুরােনাে দাগ মােছা তাই সম্ভব হয় না। “যুব নেতারা প্রাক্তন এমএনএ ও এমপিএদের প্রভাবিত করেন মি, তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে এই রকম প্রচারণা চালিয়ে যে তিনি জবর দখলের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তাদের মতে, প্রধানমন্ত্রিত্ব ন্যায়ত অন্য কারাে পাওয়া উচিত ছিল। আমার মনে হয়, সৈয়দ নজরুল ইসলামই ছিলেন তাদের পছন্দসই ব্যক্তি। তারা যদি মি, তাজউদ্দীনের ব্যপারে তাদের প্রভাব কার্যকর করতে নামতেন, তাহলে এক বিশ্রী। পরিস্থিতির সৃষ্টি হত । অস্থায়ী সরকারের ভেতরে যদি বিভক্তি দেখা দিত, তবে তা সমগ্র সংগ্রামের জন্য বিপর্যয়কর হয়ে দাঁড়াতাে আমি মনে করি, এই নেতাদের আমি বােঝাতে সক্ষম হই যে তাদের পদক্ষেপ লক্ষ্য অর্জনের পথে হবে বিপজ্জনক। আর তা হলাে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
তাছাড়া স্বাধীনতার পর এর ফলাফল হবে আরাে মারাত্মক। সৌভাগ্যবশত তারা আমার সাথে একমত পােষণ করেন। অবশ্যি ভেতরে ভেতরে তারা মি, তাজউদ্দীনকে চিবিয়ে খেতেন। আমার মত কয়েকজন বন্ধু ছাড়া। বাইরের আর কেউ এ বিষয়টি জানতেন না। আমার মনে হয়, সৈয়দ নজরুল ইসলামও তাদেরকে সতর্ক করে দেন। এইভাবে একটি মারাত্মক রাজনৈতিক সঙ্কট পরিহার করা। গেল।
“আরাে একটি এবং সম্ভবত সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় ছিল সেটা, তার প্রতি মনােযােগ দেবার আবশ্যকতা জরুরি হয়ে পড়ে। এই যুব নেতারা কয়েকজন পরিচিত বাংলাদেশী নকশালের সঙ্গে ভারতীয় কর্মকর্তাদের গল্পগুজব করতে দেখেছেন ভারতের কোন কোন বিলাসবহুল হােটেলে। তাদের মনে হয়েছে, ওই সব হােটেলে তারা আস্তানা গেড়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আইন বলবৎ থাকাকালে যুবনেতারা এইসব লােকদের দেখেছে তাদের শত্রু হিসেবে। অনিবার্য কারণেই এদের মােকাবেলায় আওয়ামী লীগকে তার যুব শাখা গড়ে তােলার কাজ শুরু করতে হয়। অতএব, এটা তাদের বােধগম্যের বাইরে, কেন ভারত সরকার তাদের জাত শক্রর সঙ্গে পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। তাই এ রকম ভুল সিদ্ধান্তে তারা উপনীত হন যে আমাদের সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে কমিউনিস্ট সরকার না হােক অন্তত কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়া । তারা বিশ্বস্ত সূত্রে আরাে জানতে পান, মার্কসবাদীদের হাতে অস্ত্র দেয়া হয়েছে। দেয়া হয়েছে মওলানা ভাসানীর অনুসারীদের হাতে। তাদেরকে আলাদাভাবে প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে। “এটা তাদের কাছে অসহ্যই বটে এবং স্বভাবতই তারা হতাশ হয়ে পড়েন। ছুটে আসেন আমার কাছে। এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে কথাবার্তা হয় এই রকম ‘যুব নেতারা “স্যার, আমরা আপনাদের কাছ থেকে আশা করি না যে গত পঁচিশ বছরে আমরা যা অর্জন করেছি, নকশালী ও মার্কসবাদীদের ট্রেনিং ও তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে সেটা শেষ করে দেবেন।” বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম আমি । রাগে চোখ মুখ আমার লাল হয়ে গেল। বললাম, “বলতে চাইছেন কী আপনারা।” ‘যুব নেতারা “আপনি বলতে চান আপনারা (জায়গার নাম উল্লেখ করে) নকশালদের ট্রেনিং দিচ্ছেন এবং অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছেন, সেটা আপনি জানেন না? ভারতীয় নেতারা তাদেরকে দামি হােটেলে রাখছে, তাদের সঙ্গে দহরম-মহরম করছে, বলতে চান তাও আপনি জানেন না?” “আমি এ ধরনের বাজে কথা আগে কখনাে শুনিনি।
আমি সব সময় ভেবেছি কিছু শক্র এজেন্ট ভেতরে বিভক্তির চেষ্টা করবে। এখন বলুন, আপনাদের মাঝে এই গুজব কে ছড়িয়েছে? “যুব নেতারা “আমরা স্বচক্ষে দেখেছি, স্বকর্ণে শুনেছি। এ ব্যাপারে ভুল হবার কোন সুযােগ নেই। এতে আমরা রীতিমত হতাশ এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবার চিন্তাভাবনা করছি। আমরা কখনােই আপনার কাছ থেকে কোন কিছু গােপন করবাে আমাদের লক্ষ্যের প্রতি আপনার আন্তরিকতার জন্য সব সময়ই আপনাকে ভালবেসে এসেছি। যেহেতু আপনি ধর্মভীরু লােক, সে কারণে আমাদের ভালবাসা আপনার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আপনার সরকার এ ব্যাপারে আপনার ওপর আস্থা রাখেননি। এইভাবে তারা (ভারত সরকার) কিন্তু বিদেশী শক্তিকে সহযােগিতা করতে চান, খুশি করতে চান। অনুগ্রহ করে খোঁজ নিন। আপনার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরকে জানান। আমাদের দেশের রুশপন্থী কমিউনিস্ট পাটিকে আমরা জানি এবং বুঝি । এরা শুধু কাগজেই আছে। আবার সক্রিয় করা হয়েছে। কিন্তু চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি কেন?”
“আমি অবাক হয়ে গেলাম । মুখ থেকে কোন কথা সরলাে না আমার। একমাত্র ঈশ্বর জানেন আমার দেশে এ ধরনের কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে কিনা এবং আমি সে বিষয়ে কিছুই জানি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি রাশিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল । কেননা, আমাদের প্রয়ােজন কালে সে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমার দেশের প্রশাসনে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যিনি বাংলাদেশে চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবেন। “যুব নেতাদের মতামত মি, আর এন কাওকে বলাতে তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে জানান যে মওলানা ভাসানীর নকশালীরা বাস্তবিকই ট্রেনিং পাচ্ছে কোথাও কোথাও। “মি, কাও বললেন “অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমরা কিছু করিনি। তারা ভাসানীর অনুসারীদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক ধরনের বড় শক্তি বলে মনে করেন । তাদের পরামর্শ আমরা উপেক্ষা করি কীভাবে । আপনার যুবনেতাদের গিয়ে বলুন, এদরকে তারা যদি পছন্দ নাও করেন তবু সহ্য করতে হবে। আমরা তাদেরকে (মুজিব বাহিনী) সামগ্রিক পরিকল্পনার একটি অঙ্গ হিসেবে সমর্থন দেব, স্বতন্ত্র রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ নয়। আমাদের সঙ্গে তারা একমত না হলে আমাদের করার কিছুই থাকবে না। এতে তারা যেখানে খুশি যেতে অথবা যা খুশি বলতে পারে, তাতে আমাদের কিছু আসবে যাবে না।” “আমি যুবনেতাদের বলি যে কর্তৃপক্ষ তাদেরই সাহায্য করছে যারা বাংলাদেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। আর এদের সুপারিশ করেছে তাদেরই অস্থায়ী সরকার । কিছু অবাঞ্ছিত লােকজনের পক্ষে এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি পুরােপুরি সুযােগ নেয়া সম্ভব ।
এবং তাদেরকে অতিমাত্রায় সতর্ক থাকতে হবে। “যুবনেতাদের মনে সন্দেহ থেকে গেল। সুতরাং তারা তাদের সেল, আস্তানা। অথবা চলাচলের খবরাখবর একমাত্র আমাকে ছাড়া আর কাউকে দেবার ব্যাপারে সাবধানী হয়ে গেল। আমি তাদের কথা দিয়েছিলাম যে তাদের সংগঠন বা কারাে সম্পর্কে তারা যা-ই আমাকে বলুক, তা কারাে কাছে প্রকাশ করবাে না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা প্রকাশ করছে। তথ্যগুলাে আমার জন্য অপরিহার্য ছিল কেননা আমি তাদের সহযােগিতায় সব পরিকল্পনা প্রণয়ন করতাম। একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমার প্রতি তাদের গভীর বিশ্বাস জন্মে । এতে নিজেকে আমি সম্মানিত বােধ করতাম এবং কোন অবস্থাতেই বিশ্বাস ভঙ্গ করিনি। “তারা তাদের নিজস্ব গােপনীয় বিষয়াবলি নিজেদের প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে ফাঁস করতেন না এই সন্দেহে যে দেশ স্বাধীন হবার পর তাজউদ্দীন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করবেন এবং নিজেই তা কুক্ষিগত করবেন। পরে তারা খােলাখুলিভাবে আমাকে বলেন “তাজউদ্দীন আপনাদের কমিউনিস্ট মন্ত্রী ডি পি ধরের সঙ্গে যােগসাজশে আছেন । আমরা দুজনের কাউকেও বিশ্বাস করি না। এমন কী আপনার সরকারও জানেন এই। দু’জন স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের পরিকল্পনা তৈরি করেছেন।” “তারা কর্নেল ওসমানীকেও কোন তথ্য দেবেন না। কেননা, তিনিও মি, তাজউদ্দীনের হাতে হাত মিলিয়েছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল আরােরাকেও কোন খবরাখবর দিতে চান না তারা। তাদের হিসেব অনুযায়ী, তিনিও তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে খেলছেন। এর কারণ তারা অনুধাবন করতে পারেন না। তারা প্রায়শই আমাকে বলতেন: “জেনারেল আবােরা তাজউদ্দীনকে অনুরােধ করেছেন মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে এবং বলতে যে, মুজিব বাহিনীর অধিনায়কত্ব যেন তাকে প্রদান করা হয়।”
“মুক্তিবাহিনী-মুজিব বাহিনী : নামকরণ জটিলতা
যুবনেতারা বাংলাদেশের বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে থাকা তাদের সংগঠন থেকে খবর পান যে কিছু কিছু মুক্তিবাহীনী ইউনিট অবাঞ্ছিত কাজ করছে। কোন কোন ইউনিট লুট করছে, সন্ত্রাসিত করছে সাধারণ মানুষকে। আর অন্যেরা ব্যক্তিগত শত্রুতার প্রতিশােধ। নিচ্ছে। আগেই বলা হয়েছে, সকল ধরনের লােক এসেছে মুক্তিবাহিনীতে এবং যােদ্ধ। বাহিনী হিসেবে মুক্তিবাহিনী চমৎকার কাজ দেখিয়েছে। কিন্তু কিছু লােক ছিল নিন্দনীয় । তারাই এই বাহিনীর জন্য দুর্নাম বয়ে আনে। তাই যুবনেতারা দৃঢ়তার সাথে এই অভিমত ব্যক্ত করে যে তাদের বাহিনীর গেরিলা নেতা যারা হবে, তাদের সকলকেই হতে হবে ব্যক্তিগতভাবে তাদের পরিচিত । মুক্তিবাহিনী থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্য সে বাহিনীর নাম হবে ‘মুজিব বাহিনী। “এই নামকরণের পক্ষে তাদের যুক্তি হল, ‘মুজিব বাহিনী’ নামটি বাংলাদেশে পবিত্র বিবেচিত। ফলে কেবল তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকেই নয়, সাধারণ মানুষও তাদের সহায়তা দেবে । “আমরা দশ হাজার মুজিব বাহিনী সদস্যকে প্রশিক্ষক হবার মত করে বিভিন্ন গেরিলা কৌশলের ওপর ট্রেনিং দেই। ধরে নেয়া হয়, তারা বাংলাদেশের ভেতরে। অবস্থানকারী সংগঠনের লাখ লাখ সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেবে এটা একটি প্রতিষ্ঠিত এবং নির্ভরযােগ্য সংগঠন, যার নেতারা প্রাথমিক পর্যায়ে কাজ করেছেন শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে এবং পরে জানতে পাই যে, এদের ওপর তার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। এর অর্থ সমগ্র জাতির আস্থা রয়েছে তাদের ওপর।
“আমি এই বিশেষ বাহিনীর নাম মুজিব বাহিনী’ রাখার প্রস্তাব দেই। কিন্তু উর্ধ্বতন কমান্ড আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেন না। তাদের মতে, এই নামকরণ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে এবং মুক্তি বাহিনী ও মুজিব বাহিনীর ভেতর ভাঙনও ধরাতে পারে। আমি যুবনেতাদের ওপর কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারলাম তারা বললেন “যে যা-ই বলুক, বাংলাদেশে এই ছেলেরা ‘মুজিব বাহিনী’ নামে পরিচিত হবে। এতে নামকরণ নিয়ে সকল বিতর্কের অবসান ঘটে । আমার করণীয় কিছু আর থাকে না। কিন্তু সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কমান্ড কোন আলাদা সংগঠনের অস্তিত্ব মেনে নিতে রাজি ছিলেন না, তা সে সংগঠনের উদ্দেশ্য যাই-ই থাক না কেন। শুধু নামই নয়, তাদের পরিচিতির প্রশ্নটিও ছিল বিচার্য বিষয় । লেফটেন্যান্ট জেনারেল আরােরা বললেন, মি, তাজউদ্দীন জানতে চান এই সংগঠনটি কে গড়ে তুলছে এবং কী এর উদ্দেশ্য । আমার ব্যাখ্যা ছিল, এটা একান্তভাবে নিবেদিতপ্রাণ যুবনেতাদের সংগঠন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরের আওয়ামী লীগের এই যুব সংগঠনের বিকাশ সাধন এবং গেরিলা যুদ্ধ কার্যক্রম চালানােই এদের লক্ষ্য। আমার ব্যাখ্যা তাকে (জেনারেল আরােরা) সন্তুষ্ট করতে পারলাে না। সবকিছুই নিজের অধিনায়কত্বে আনার প্রতি তার সকল মনােযােগ ছিল নিবিষ্ট । তাই যে কোন যুক্তিই ছিল তার কাছে অবান্তর ।
চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল মানেকশ স্বাভাবিক কারণেই তার পরামর্শ মতাে চলতেন এবং কলকাতার এক বৈঠকে তিনি আমার প্রতি রুঢ় আচরণ করেন। উপলদ্ধি করি, কেউ তাকে বুঝিয়েছে আমি স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়ে আমার ব্যক্তিগত অধিনায়কত্বে এই যুবনেতাদের নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তুলছি। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল মহল যুবনেতাদের সঙ্গে কথা বলার এবং তাদের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা কয়েকবারই করে। অন্তত পক্ষে নির্দেশাদি আমার কাছ থেকে নয়, সরাসরি সেনাবাহিনী হাই কমান্ড থেকে যাতে নেয়, সে চেষ্টাও করা হয়। এ জাতীয় প্রস্তাব তারা অগ্রাহ্য করেন। চাপের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ়তা এ সম্পর্কিত চেষ্টায় যতি টানে। আর যেহেতু আমি চাকরিতে ছিলাম, সে কারণে আমার ওপর চাপ ছিল অনবরত। | “মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর দায়িত্ব নির্ধারণ সম্পর্কিত বিতর্ক অবসানের লক্ষ্যে আমি লেফটেন্যান্ট জেনারেল আরােরার সঙ্গেও কথা বলি। তিনি জানান, মুক্তিবাহিনী সীমান্তের বিশ মাইল পর্যন্ত আক্রমণ হানার দায়িত্বে থাকবে আর মুজিব বাহিনী যাবে অভ্যন্তরে । যুব নেতারা এটাই চাইছিলেন। কিন্তু জেনারেল অরােরা চাইছিলেন তারা তার অধিনায়কত্বে থাকবে । যুবনেতারা এই প্রশ্নে তার সাথে একমত ছিলেন না।
“আরেকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ছিল। সেটা বাংলাদেশের ভেতরে অনুপ্রবেশের পদ্ধতি সংক্রান্ত । সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে সীমান্ত দখল করে রেখেছিল মুক্তিবাহিনী। “আমার ছেলেরা যে সব এলাকা দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করতাে, যে সব পথ দিয়ে তাদের চলাচল এবং তাদের আস্তানা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চান। লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরােরা। এর জন্যে চাপাচাপিও করতে থাকেন। সীমান্তে তাদের অনুপ্রবেশ এলাকা সম্পর্কে অবহিত করায় কোন আপত্তি ছিল না যুবনেতাদের । কেননা, সেখানে অবস্থানরত সেনাবাহিনী ইউনিটকে তাদের অনুপ্রবেশে অনুমতি দানের জন্য আগে ভাগেই জানান দেয়া যেতাে। কিন্তু তাদের অনুপ্রবেশ করিডর, আস্তানা এবং পরিকল্পনার কোন কিছুই প্রকাশ করতে রাজি ছিলেন না তারা। কেননা, মুক্তিবাহিনী নেতাদের মধ্যে কিছু লােকের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে তারা সন্দেহ পােষণ করতেন এবং তারা ছিল তাদের রাজনৈতিক শত্রু।
“সেনাবাহিনী স্থাপনাকেও ওই সব তথ্য তারা দিতে চান না। কারণ, তাদের অধিনায়কত্বে রয়েছে মুক্তিবাহিনী। তারা নিশ্চয়ই মুক্তিবাহিনীর কাছে সকল তথ্য পাচার করে দেবে। “বড় ধরনের ঝামেলা কাটিয়ে একটি আপােসমূলক সমাধানে পৌছানাে গেল সম্মত সিদ্ধান্ত হলাে, মুজিব বাহিনী নেতারা কেবলমাত্র তাদের অনুপ্রবেশ এলাকা সম্পর্কে স্থানীয় সেনা ইউনিট কমান্ডারকে জানাবেন এবং তিনি তাদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেবেন। কমান্ড সদর দফতর সব সেনা ইফনিটকে গৃহীত এই ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত করবে। “জেনারেল কে কে সিং (ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেটরস) সেনাবাহিনী। প্রধানের পক্ষ থেকে মুজিব বাহিনীর অধিনায়কত্ব ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে একটি স্পষ্ট নােট পাঠান জেনারেল অরােরার কাছে। এই বাহিনীর ওপর কি ধরনের কাজের দায়িত্ব অর্পিত, তাও উল্লেখ করেন। নােট প্রদান সত্ত্বেও কোন্দল চলতেই থাকে, মনের আগুন জ্বলতে থাকে ধিকিধিকি।
আমাকে ডেকে পাঠানাে হলাে “পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে পরিণত হবার সম্ভাবনা প্রতীয়মান হওয়ায় ভারত সরকার আমাকে অপ্রচলিত যুদ্ধের (গেরিলা যুদ্ধ) একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ডেকে পাঠান। বলা হলাে, সীমান্ত এলাকা সফরের মাধ্যমে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে এবং বিভিন্ন ধরনের লােকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রিপাের্ট পাঠাতে । আমি দ্রুত সীমান্ত এলাকা সফর করি এবং বাংলাদেশের কতিপয় যুবনেতার সঙ্গে আলাপ করে রিপাের্ট পাঠাই। “…যখন খুঁটিনাটি নিয়ে ভাবছিলাম তখন আমার এক বন্ধুর বাড়িতে কালােপানা পেটা শরীরের এক যুবকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।
মনে হয় মাসটি ছিল মে। যুবকটি তােফায়েল আহমদ। তিনি তার অপর তিন সহকর্মীর কথা বলেন। তাদের দু’জন সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হন। একজন রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের যুবনেতা আরেকজন সিরাজ আলম,— একটি অগ্নিগর্ভ যুবক। শেখ ফজলুল হক মণির সঙ্গে দেখা হয় পরে । মণির সঙ্গে দেখা হবার পর আমি নিশ্চিত হই যে শ্রদ্ধা করার মত গুণাবলি এই চতুষ্টয়ের মধ্যে বিদ্যমান । তাদের অতুলনীয় আত্মনিবেদন মঙ্গল আনবে এবং দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে তাদের ওপর। | “এই যুবনেতারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রেখে আসা তাদের নিবেদিত প্রাণ রাজনৈতিক কর্মীদের সাংগঠনিক রূপরেখা নিয়ে খােলাখুলি আলােচনা করেন। জানান। তারা সাহসী এবং রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ক। তাদের যা প্রয়ােজন তা হলাে। গেরিলা/কমান্ডাে ধরনের ট্রেনিং ও উপযুক্ত অস্ত্র। আলােচনায় তারা কিছু কমিউনিস্ট ক্যাডার এবং গোঁড়া সাম্প্রদায়িকদের ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধবাদিতার কথাও উল্লেখ করেন। বলেন, এই কমিউনিস্ট ও সাম্প্রদায়িকরা চীন ও পাকিস্তানে তাদের পৃষ্ঠপােষকদের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। এদের সঙ্গে কোনক্রমেই সহযােগিতা করা।
যাবে না। এর অর্থ যদি হয় স্বাধীনতা আরাে কয়েক বছর পিছিয়ে যাওয়া এবং অধিকতর আত্মত্যাগ- তাতেও সহযােগিতা নয়। তারা জানান, বাংলাদেশে তাদের এই বিরুদ্ধবাদীরা ছিল সুযােগ সন্ধানী এবং নীতির বালাইও ছিল না তাদের। মােজাফফর গ্রুপে (রুশপন্থী কমিউনিস্ট) তাদের কিছু বন্ধু আছে । কিন্তু তাদের মতে, শ্রমিক ও ছাত্রদের মধ্যে এই গ্রুপের অনুসারী তেমন নেই । পরে মি. ডি। পি ধরের অনুরােধে আমি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদের সঙ্গে দেখা করি। বাংলাদেশের এই দুর্বার গেরিলা বাহিনী গঠন ও প্রশিক্ষণদানের রাজনৈতিক এবং সাময়িক দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হলাে। বাহিনীর সদস্য সংগ্রহ করবেন যুবনেতারা। নেতাদের সঙ্গে আলােচনা করেই গেরিলা অপারেশন কার্যক্রম প্রণীত করতে হবে এবং সমগ্র পরিকল্পনার তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে আমাকেই। এর চেয়ে সন্তোষজনক কিছু আর আমি চাইতে পারি না। “…পরে মুজিব বাহিনী “শ্যামের ছেলেরা নামে অভিহিত হয়। জেনারেল শ্যাম মানেকশ’র নামে এই নামকরণ হয় । তিনি,—জেনারেল মানেকশ, মি, তাজউদ্দীন আহমদকে বলেন যে সেনাবাহিনীর বিশেষ দায়িত্ব সম্পাদনের লক্ষ্যে তিনি নিজেই গড়ে তুলেছেন এ বাহিনী। তার ওই কথায় পুরােনাে সেই বিতর্ক— মুজিব বাহিনী কে গঠন করেছে এবং কী উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়, তার অবসান ঘটে।৩
—————————————–
৩, ফ্যানটমস অব চিটাগং : দ্য ফিথ আর্মি ইন বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা: ১৯-৪৩, ৫৭-৬১
সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র এবং সিআইএ – মাসুদুল হক