বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ৫ জুলাই ১৯৬৪, নারায়ণগঞ্জ
কণ্ঠ – Tahia Tabassum Trena
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেশের জনগণের সম্পদ। এখানে নানান রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস বর্নিত রয়েছে। রয়েছে বাঙালীর ভবিষ্যতের চলার নির্দেশনা। সংগ্রামের নোটবুক বৃহৎ উদ্যোগে এনিয়ে কাজ করছে। প্রায় চারশত ভাষণের সমন্বয়ে তৈরি করেছে ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র’। এখন এগুলো দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। তারই ধারাবাহিকতায় ভাষণগুলো সকলের কাছে সহজবোধ্য করতে যেগুলোতে বঙ্গবন্ধুর অডিও রেকর্ড পাওয়া যায়নি সেগুলো অডিও আকারে প্রকাশ করা হচ্ছে যাতে করে অডিও, ভিডিও বা টেক্সট যে কোন মাধ্যমেই আপনারা শুনতে, দেখতে ও পড়তে পারেন। এই ভাষণের অডিও নীচে যুক্ত করা হল। আর তার নীচে লেখা দেয়া আছে। ভিডিও আকারেও ইউটিউবে দেয়া হয়েছে।
কণ্ঠ দিয়েছেন – Tahia Tabassum Trena
রাজনীতিতে ৪ টি জিনিস প্রয়োজন – নীতি, নেতা, কর্মী ও প্রতিষ্ঠান – নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ কর্মী সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু।
৫ জুলাই ১৯৬৪
নারায়ণগঞ্জ
রাজনীতিতে ৪ টি জিনিস প্রয়োজন – নীতি, নেতা, কর্মী ও প্রতিষ্ঠান। আওয়ামী লীগের নীতি আছ, নীতির মাধ্যমে নেতা আছেন, কর্মী আছেন, প্রতিষ্ঠান আছে। জনগণের জন্য সংগ্রামই আওয়ামী লীগের মূলকথা। সারা দেশে সংগ্রামী ঐতিহ্য বলিতে একমাত্র আওয়ামী লীগেরই আছে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দাবীতে জনগণের পক্ষে সংগ্রাম করিতে গিয়া হাজারে হাজারে কারাবরণ করিয়াছে, নির্যাতিত হইয়াছে, পুলিশের হামলার সামনে বুক পাতিয়া দিয়াছে। আওয়ামী লীগের নেতা, দেশের অবিসংবাদিত নেতা জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামে বিশ্বাসী ছিলেন। অসম সাহসী এই সংগ্রামী পুরুষকে তাই ব্রিটিশ সরকারও কোনোদিন কারাগারে নিক্ষেপের অজুহাত সৃষ্টি করিতে পারে নাই। কিন্তু স্বাধীন দেশের অবিসংবাদিত জননেতার আসনে যখন তিনি সমাসীন, তখন নিজ দেশের সরকারের হাতেও জীবন-সায়াহ্নে তাহাঁকে জনগণের পার্শে দাঁড়াইয়া সংগ্রাম করিতে গিয়া কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইতে হইয়াছে। কারাগার হইতে যে ভগ্ন স্বাস্থ্য লইয়া তিনি বাহিরে আসেন, সেই ভগ্ন স্বাস্থ্যই হয় তার কাল। দেশকে কাঁদাইয়া, দেশবাসীকে কাঁদাইয়া সুদূর বিদেশ বিভূঁইয়ে আত্মীয় পরিজন বর্জিত পরিবেশে তাহাঁকে বিদায় লইতে হইয়াছে। আওয়ামী লীগ নীতিতে বিশ্বাসী বলিয়াই সব কিছু তাহারা মাথা পাতিয়া বরণ করিতে বসিয়াছে।
আমরা বাঙ্গালী, আমরা মুসলমান, তাই সহজেই সব ভুলিয়া যাই। পাকিস্তানের জীবনে সর্বপ্রথম সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা নিয়া দেশে যখন সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা সম্পন্ন তাহারই মাত্র ৪ মাস পূর্বে কেন হঠাৎ দেশ রসাতলে যাওয়ার প্রশ্ন তুলিয়া সামরিক শাসন প্রবর্তন করা হইল সে প্রশ্ন কেহ তুলিল না। হাজার হাজার নেতা ও কর্মী কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইল, সম্পত্তি বাজেয়াফত করা হইল, এসব প্রশ্ন কাহারও মনে দাগ কাটিল না। সামরিক শাসন জারী করিয়া ক্ষমতা দখল করা হইল, সেই আনন্দে সবাই নাচিল। দেশের জন্য যারা সর্বস্ব দিল, জেল-জুলুম, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইল, তারা তাদের কেউ নয়। বাংলার গ্রামে গ্রামে রটিয়া গেল নিউমার্কেটে শেখ মুজিব সিনেমা হল করিয়াছে, সামরিক সরকার তাহাকে পাকড়াও করিয়াছে, এবার নির্ঘাত ফাঁসি। আওয়ামী লীগ মন্ত্রীরা ধরা পড়িয়াছে, চুরি জোচ্চুরি, জারি জুরি এবার সব আইয়ুব সরকারের শ্বেতপত্রে ফাঁস হইয়া যাইবে। ৪ বৎসর যাবত সামরিক শাসন চলিল, কোথায় গেল শেখ মুজিবের সে সিনেমা হল, কোথায় গেল তার ফাঁসি – আর কোথায় গেলোই বা আওয়ামী লীগ মন্ত্রীদের কুকীর্তির সেই ফিরিস্তি। সদাশয় সরকার ‘মাছ না পাইয়া ছিপে’ কামড় দিলেন। দেশবাসীর পক্ষে যাতে কেহ কথা বলিতে না পারে তজ্জন্য মহাজনী পন্থা আবিষ্কার করিলেন। জনগণের যাহারা নেতৃত্ব দিয়াছেন তাহাদের সকলকে এবডো করিয়া রাজনীতি হইতে বিদায় দিয়ে নিজেদের শোষণের পথ নিরঙ্কুশ করা হইল। দেশবাসী সব নীরবে দেখিল।
এই তো আমাদের চরিত্র। এ চরিত্র না বদলাইলে কেবল বাঙ্গালীর নয়, জাতির ভবিষ্যৎও অন্ধকার। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালিরা ৩ টি কাগজই পড়ে – ইত্তেফাক, আজাদ ও সংবাদ। সব কাগজ বাদ দিয়া একের পর এক যা কিছু হামলা চালানো হইতেছে এই তিনটি কাগজের উপর। শ্রমিকরা বাঁচার মত পারিশ্রমিকের দাবী জানাইয়া ব্যার্থ হইলে ধর্মঘটের উদ্যোগ গ্রহণ করিতেই আজ সে ধর্মঘট বেআইনি ঘোষিত হয়। ডাক্তাররা ধর্মঘট করিলে রোগী সাধারণের অবস্থা যা-ই হোক না কেন, সরকার সে ব্যাপারে নির্বিকার। পরে ডাক্তাররা কার্যে যোগদান করিলে তাহাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইলেও সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয় না। স্বভাবতই রোগীর চিকিৎসা ছাড়িয়া আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াইতে তাহাদের সময় চলিয়া যায়।
সরকার বহু খেল দেখাইবার পর সরকারী কর্মচারিদের বেতন বাড়াইলেন। পদস্থদের আঙ্গুল ফুলিয়া কলা হইল, গরিব কর্মচারীদের বেতন বাড়িল না। বিশ্বাস না হয় খাস সেক্রেটারিয়েটের পিওন আর্দালিদের গিয়া জিজ্ঞাসা করুন, তাহারা বলিবে।
দেশে উন্নয়ন নাকি আকাশ ছুঁই ছুঁই করিতেছে। জিজ্ঞাসা করি, বিনা ক্ষতিপূরণে গরিব চাষী মজুরের জমির উপর দিয়া রাস্তার নামে মাটি ফেলিয়া জনসাধারণের নাকি পরম উপকার করা হইয়াছে। বলি, এ পরম উপকারের পাশাপাশি গরিব জনসাধারণের উপর ট্যাক্সের যে বোঝা চালানো হইয়াছে সরকার তাহার হিসাবটি প্রকাশ করেন না কেন? তাহা তাহারা করিবেন না। কারণ কত টাকা ট্যাক্স দিয়া গ্রামের চাষীরা কত টাকার উপকার পাইয়াছে তাহার সব জারি জুরি যে তাহাতে ফাঁস হইয়া যায়। দেশ নাকি শিল্পে ছাইয়া গিয়াছে। অস্বীকার করিনা, দেশের অনেক লক্ষপতি এদের আমলে কোটিপতি বনিয়াছেন। সামরিক বাহিনী ইহাতে দুর্বল হইতেছে কিনা কে জানে? দেশে বহু আকাশচুম্বী ইমারতও উঠিয়াছে। কিন্তু দরিদ্র জনসাধারণের কী হইয়াছে? আজ তাহারা যা বিক্রি করে তাহার দাম কম – যাহা কিনে তাহার দাম বেশী। পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পজাত দ্রব্য বিদেশের বাজারে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াইতে পারেনা। সুতরাং তার বাজার দরকার। অতএব বাংলাদেশকেই বাজার না করিয়া আর উপায় কি? স্বভাবতই পূর্ব পাকিস্তান আজ পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতিদের বাজারে পর্যবসিত।
স্বার্থের রাজনীতি আওয়ামী লীগ করেনা। আওয়ামী লীগ নীতির রাজনীতি করে। তাই কোন সময় পুলিশের গাড়ি আসিয়া ধরিয়া লইবে তাহার জন্য আমরা প্রস্তুত হইয়াই থাকি। যাহাতে পুলিশের লোককে আসিয়া বসিয়া থাকিতে না হয় তাহার জন্য কারাগারে যাওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি লইয়াই আমরা বসিয়া থাকি। তাই আমার সংগ্রামী কর্মী ভাইদের প্রতি আমার অনুরোধ, কেতাদুরস্থ পোশাকে ভূষিত কাহারও দুকথা ইংরেজী-উর্দুর বোলচাল শুনিয়া গলিয়া গিয়া সংগ্রামের পথ ত্যাগ করিবেন না। স্মরণ রাখিবেন, বাংলার মীরজাফরেরা যে কারণেই সংগ্রাম করুন না কেন, আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করে দেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য। ভবিষ্যৎ বংশধররা যাতে গোলামে পরিণত না হয় আমাদের সংগ্রাম তাহার জন্যই। ব্যবসায় আজ বাঙ্গালীর স্থান নাই, চাকুরীতে নাই, বসতিতে নাই – আছে কোথায়?
শরিয়াতুল্লাহ, তিতুমীর, সুভাস, সোহরাওয়ার্দী-নজরুলের দেশের মানুষ (অস্পষ্ট) বদলে (অস্পষ্ট) শাসন চাহে নাই, চাহিয়াছে স্বাধীন দেশে স্বাধীন মানুষের মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত হইতে।
পাকিস্তানের দশ কোটি মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করিতে আজ প্রয়োজন সংঘবদ্ধ সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের। সুশৃঙ্খল দশ হাজার কর্মীর পক্ষে যাহা সম্ভব বিশৃঙ্খল লক্ষ লোকের পক্ষেও তা সম্ভব নয়। এই কথা মনে রাখিয়া কর্মী ভাইদের আমি কার্যক্ষেত্রে ঝাপাইয়া পড়ার আহ্বান জানাই।
সংগ্রামে সবাইকে সঙ্গে লইতে আমরা রাজি। তবে পলাশীর আম্রকাননের ইতিহাস স্মরণ করাইয়া দিয়া আমি বলিব জয় যখন সুনিশ্চিত তখন রাত্রে বিশ্রাম লইয়া ভোরের বেলায় পূর্ণ বিক্রমে ক্লাইভের সৈন্যের উপর আবার আমরা ঝাপাইয়া পড়িব – এমনি কথায় নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে বিভ্রান্ত করার ষড়যন্ত্রী ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করিতে পারেন এমন কাহাকেও সঙ্গে লইতে আমরা রাজী নহি।
কর্মী ভাইদের উদ্দেশে তাই আজ আমার বক্তব্য, আগামী দিনের সর্বাত্নক সংগ্রামের মুখোমুখি দাঁড়াইয়া আজ আপনারা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চেহারা স্মরণ করুন। নীতির জন্য যিনি আজীবন সংগ্রাম করিয়া গিয়াছেন, নীতির জন্য যিনি প্রাণ দিয়াছেন অকুতোভয় যে নির্ভীক বীরকে ইংরেজ সরকারও কারাগারে নিক্ষেপের সাহস পায় নাই, সেই নেতাকেই নিজ দেশের সরকারের হাতে জীবন সায়াহ্নে কারাবরণ করিয়া – নানাভাবে নির্যাতিত লাঞ্ছিত হইয়া সুদূর বিদেশ বিভূঁইয়ে আত্মীয় পরিজন বর্জিত পরিবেশে প্রাণ বিসর্জন দিতে হইয়াছে, সেই নেতার আত্মা কখনো শান্তি পাইতে পারেনা – যদি না আমরা তার সে সংগ্রামকে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাইতে পারি।
Reference:
বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র
দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ জুলাই ১৯৬৪
সাতচল্লিশ থেকে স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ, হাসানুর রশীদ, পৃষ্ঠা – ৭৮৮-৭৮৯, প্রকাশকাল আগস্ট ২০১১