You dont have javascript enabled! Please enable it! পালাবদল -আইয়ুব খান বড় ধরনের কোনাে উপদ্রব ছাড়াই দেশ শাসন করে যাচ্ছিলেন - সংগ্রামের নোটবুক
পালাবদল
আইয়ুব খান বড় ধরনের কোনাে উপদ্রব ছাড়াই দেশ শাসন করে যাচ্ছিলেন। ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার হার্ট অ্যাটাক হয়। মাস দেড়েক তাঁকে চিকিৎসা নিতে হয়। এ সময় তিনি অফিস করেননি। তখন তাকে জড়িয়ে নানা রকম গুজব ছিল। আইয়ুবের পরিবারের সদস্যরা খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন। একসময় এ রকমও মনে করা হচ্ছিল, আইয়ুব খান আর বাঁচবেন না। তিনি তাঁর মেজ ছেলে গওহর আইয়ুবকে উত্তরাধিকারী হিসেবে তৈরি করছিলেন। আইয়ুবের পরিকল্পনা ছিল, যদি কোনাে অঘটন ঘটেই যায়, পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর ও সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মুসা অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হবেন এবং ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দেবেন। নির্বাচনে গওহর প্রেসিডেন্ট পদে দাড়াবেন এবং তাঁকে জয়ী করা হবে। এ পরিকল্পনার কথা জেনে মুসা খুব নার্ভাস হয়ে পড়েন। এই ঝুঁকি নেওয়ার মতাে সাহস তার ছিল না। নভেম্বর থেকে সারা দেশে আইয়ুববিরােধী আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ১১ নভেম্বর (১৯৬৮) পেশােয়ারের জিন্নাহ পার্কে এক জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় এক তরুণ পাঠান আইয়ুবকে লক্ষ্য করে গুলি ছােড়ে। ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও আন্দোলন মােকাবিলা করার মতাে শক্ত অবস্থান তখন তার দল মুসলিম লীগের ছিল না। সেনাপ্রধান জেনারেল আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকে ডেকে আইয়ুব তাকে (আইয়ুবকে) প্রধান রেখে সামরিক আইন জারি করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে বলেন। ইয়াহিয়া অবশ্য তাৎক্ষণিক জবাবে বলেছিলেন, সশস্ত্র বাহিনী সব শক্তি দিয়ে প্রেসিডেন্টের পাশে দাঁড়াবে। এর পর থেকে প্রায় সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া সেনাবাহিনীর জজ অ্যাডভোেকট জেনারেল ব্রিগেডিয়ার কাজীকে নিয়ে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে যেতেন এবং রুদ্ধদ্বার সভা করতেন।
সপ্তাহে তিন দিন অন্তত দুই ঘণ্টা তারা সলাপরামর্শ করতেন। একদিন সন্ধ্যায় কাজী একা এলেন এবং ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে কয়েকটি প্রস্তাব দিলেন : ১) সংবিধান বাতিল করে প্রেসিডেন্ট সামরিক আইন জারি করবেন; ২) রাষ্ট্রপতির আদেশবলে ইয়াহিয়া খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়ােগ করা হবে; ৩) আইয়ুব দীর্ঘমেয়াদি ছুটিতে যাবেন, যত দিন না দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। ইয়াহিয়ার মতলব বুঝতে আইয়ুব খানের এতটুকু অসুবিধা হলাে না। ১৯৫৮ সালের অভিজ্ঞতা তার মনে আছে। তখন ইস্কান্দার মির্জা তাকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেছিলেন এবং ২০ দিনের মাথায় আইয়ুব মির্জাকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। আইয়ুব খান বিকল্প চিন্তা শুরু করলেন। তিনি তিনটি সম্ভাব্য পদক্ষেপের কথা ভাবলেন : ১) ইয়াহিয়া খানকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং একই সঙ্গে তার সহযােগী আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠিয়ে দেওয়া। কিন্তু এ সময় এটি করা ঠিক হবে না। এতে করে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে এবং প্রেসিডেন্টের দুর্বলতা ধরা পড়ে যেতে পারে। ২) শক্তিশালী রাজনৈতিক একটি দলের সঙ্গে সমঝােতায় আসা। কিন্তু প্রশ্ন হলাে, কোন দলের সঙ্গে? ৩) ইয়াহিয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী অগ্রসর হওয়া। 
আইয়ুব খান তার পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন সদস্য এবং তার অত্যন্ত বিশ্বস্ত তথ্যসচিব আলতাফ গওহরের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কার্যকর সমঝােতায় আসার পক্ষে তারা মত দেন। এ রকম দল বলতে তখন মাত্র দুটো—ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ। দুজনই তখন কারাগারে বন্দী। ভুট্টোর ব্যাপারে আইয়ুব খানের ছিল প্রচণ্ড রকম আপত্তি। রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপ সত্ত্বেও মুজিবকেই তার পছন্দ হলাে। তাঁর মনে হলাে, এ পরিকল্পনায় মুজিবকে হয়তাে পাওয়া যাবে। রাষ্ট্রপতির এডিসি আরশাদ সামি খান অত্যন্ত কাছ থেকে এ রাজনৈতিক নাটকটি মঞ্চস্থ হতে দেখেছেন। তিনি বিষয়টি এভাবে বর্ণনা করেছেন : প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্ত নিলেন, কারাগারে শেখ মুজিবের সঙ্গে যােগাযােগ করে ব্যক্তিগতভাবে তাকে জানানাে দরকার। তিনি আলতাফ গওহরকে শেখ মুজিবের সঙ্গে যােগাযােগ করতে বললেন। আমি নিজে দেখেছি, বেশ কয়েকবার রাতের বেলা মুজিব ছদ্মবেশে আলতাফ গওহরের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট হাউজে এসেছেন। প্রতিবার তারা তিনজন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথাবার্তা বলতেন। মুজিবের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের এ গােপন বৈঠকের খবর কেমন করে জানি বিরােধী পক্ষের কাছে ফাঁস হয়ে যায়।
আইয়ুব খান ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে এবং ফেব্রুয়ারির (১৯৬৯) দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকায় এসেছিলেন। সম্ভবত ওই সময় গােপন বৈঠকগুলাে হয়েছিল । যখন এ বৈঠকগুলাে চলছিল, তখন ঢাকা ছিল উত্তপ্ত ।
মওলানা ভাসানী ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে হরতাল পালিত হচ্ছিল। আলতাফ গওহর অবশ্য এ বৈঠকের বিষয়টি স্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, ১৯৬৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারির আগে আইয়ুবের সঙ্গে শেখ মুজিবের কখনাে দেখা হয়নি।তত দিনে রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল হয়ে পড়েছে। জানুয়ারির (১৯৬৯) দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই এগারাে দফা আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছিল । ১৮ জানুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট শুরু হয়। প্রতিদিনই সভা-মিছিল চলছিল। ধর্মঘটের তৃতীয়। দিনে অর্থাৎ ২০ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি করলে আসাদুজ্জামান নামে ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) একজন সদস্য নিহত হন। আসাদ একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র এবং শহীদুল্লাহ হল শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। এমএ পাস করে তিনি সেন্ট্রাল ল কলেজে আইন পড়তেন। নরসিংদী এলাকার শিবপুর থানার ধানুয়া গ্রামে তার বাড়ি। তার বাবা মাওলানা আবু তাহের শিবপুর হাইস্কুলের প্রধান। শিক্ষক ছিলেন। তিনি ১৯৫৪ সালে নেজামে ইসলাম থেকে নির্বাচনে অংশ। নিয়েছিলেন। পরিবারটি ছিল খুবই গোঁড়া। কিন্তু আসাদ ছিলেন এর উল্টো। বাবার চাপে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে আসমাতুন্নেসা হাইস্কুলে। শিক্ষকতার চাকরি নিয়েছিলেন। স্কুলে যােগ দিয়েই তিনি ঢাকায় চলে আসেন। এবং মিছিলে অংশ নেন।
আসাদের মৃত্যু এগারাে দফা আন্দোলনকে বেগবান করে তােলে। ২১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে তাঁর জানাজা হয়। মিটিং-মিছিল-বিক্ষোভ চলছিল। প্রতিদিন। ২৪ জানুয়ারি গণবিস্ফোরণ ঘটল। ২৫ জানুয়ারি ঢাকার দৈনিক আজাদ আট কলাম ব্যানার হেডিং ছাপল ‘ঢাকায় ২৪ ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন জারি, সেনাবাহিনী তলব। রিপাের্টের অংশবিশেষ ছিল এ রকম: ৫ লক্ষ লােকের সমাবেশে পুলিশের গুলিবর্ষণে অন্ততপক্ষে চারজন নিহত ও বহু আহত। হারিশ ও শহীদুল নামক দুইজন পুলিশের গুলিতে নিহত হইবার পর পুলিশ লাশ লইয়া গিয়াছে বলিয়া দাবি করা হইয়াছে। এ দুইজনকে ধরিলে গুলিতে নিহতের সংখ্যা ছয়জনে দাঁড়ায়। সেক্রেটারিয়েটের ১ নম্বর গেটের নিকট গুলিতে ১, মতিউর রহমান, ১৭ বছর; ২. শেখ রােস্তম আলী, ১৪ বছর; ৩. মকবুল, ১৫ বছর এবং অপর একজন নিহত হয়। চতুর্থ ব্যক্তির লাশ পুলিশ রাস্তা হইতে টানিয়া সেক্রেটারিয়েট ভবনের অভ্যন্তরে লইয়া যায় এবং তাহার খোজ পাওয়া যায় নাই। বিক্ষুব্ধ জনতা অপরাহে ট্রাস্টের সরকার সমর্থক।
ইংরাজি দৈনিক মর্নিং নিউজ ও বাংলা দৈনিক পাকিস্তান অফিসে অগ্নিসংযােগ করিয়া সম্পূর্ণভাবে পােড়াইয়া দিয়াছে। তাহা ছাড়া পয়গাম পত্রিকা অফিসেও জনতা আক্রমণ করে এবং অগ্নিসংযােগের চেষ্টা চালায়। পল্টনে মুসলিম লীগ নেতা এন এ লস্করের বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করা হয়। পল্টন ময়দানে জানাজা শেষ হওয়ার পর লাশ নিয়ে এক বিরাট মিছিল বের হয়। মিছিলটি ইকবাল হলে পৌছালে এক অনির্ধারিত প্রতিবাদ সভায় সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমেদ, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ও মাহবুব উল্লাহ বক্তৃতা করেন। সিরাজুল আলম খানের বক্তব্য ছিল খুবই মর্মস্পর্শী । ছাত্রজনতা তা বিহ্বল হয়ে শুনছিল। সভার পরই জানা গেল, বিক্ষুব্ধ জনতা নবাবপুর রােডে ‘হােটেল আরজু’তে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। কারণ, ওই হােটলের মালিক ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানির সময় শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।  সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করা হয়। রাতে কারফিউ ভেঙে জনতা বিভিন্ন স্থানে মিছিল করে। ২৫ জানুয়ারি কারফিউ থাকা অবস্থায় ইপিআরের গুলিতে নাখালপাড়ায় আনােয়ারা নামের এক গৃহবধূ নিহত হন। তিনি এ সময় তার শিশুসন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলেন।
ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের নেতা সবুর খান ৩১ জানুয়ারি (১৯৬৯) জাতীয় পরিষদে ঘােষণা দেন যে বিরােধী দলের প্রস্তাব বিবেচনার জন্য প্রেসিডেন্ট আইয়ুব একটা গােলটেবিল বৈঠক ডাকবেন।১ ১ ফেব্রুয়ারি এক আনুষ্ঠানিক ঘােষণায় আইয়ুব খান বলেন, পারস্পরিক আলােচনার মাধ্যমে কোনাে সমাধান এলে তা মেনে নেওয়া হবে।”
৫ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) আইয়ুব খান ডাক-এর আহ্বায়ক নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানকে প্রস্তাব দেন, সব রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি গােলটেবিল বৈঠক হবে। এরপর আইয়ুব খান ঢাকা সফরে আসেন এবং ঘােষণা দেন, প্রস্তাবিত গােলটেবিল বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য বিরােধী দলগুলাে যদি শেখ মুজিব ও ভুট্টোকে মনােনীত করে, তাহলে তাদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ১২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান রাওয়ালপিন্ডিতে ফিরে যান।১২ ইতিমধ্যে আইয়ুব খানের প্রস্তাবিত গােলটেবিল বৈঠক বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন ভুট্টো ও ভাসানী। অন্যান্য রাজনৈতিক দল ওই বৈঠকে যােগ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে ডাক-এর উদ্যোগে একটি জনসভার আয়ােজন করা হয়। জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলের নেতা নুরুল আমিনের এ সভায় সভাপতিত্ব করার কথা। ছাত্রলীগের একদল কর্মী পল্টনে হাজির হয়ে ঘােষণা করেন, নুরুল আমিনকে সভাপতিত্ব করতে দেওয়া হবে না। তারা খন্দকার মােশতাক আহমদকে সভাপতিত্ব করার অনুরােধ জানান। মােশতাক এতে রাজি হলেন না। এ সময় ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক আ স ম আবদুর রবের  নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার একটি মিছিল মাঠে এসে উপস্থিত হলাে। রব স্টেজে চড়াও হয়ে মাইক কেড়ে নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, এগারাে দফার সঙ্গে বেইমানি করা চলবে না’ ইত্যাদি। ছাত্রলীগের কর্মীরা মঞ্চ দখল করে নেন। ডাক-এর জনসভা ভণ্ডুল হয়ে যায়। ৮ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) দৈনিক ইত্তেফাক-এর ছাপাখানা নিউ নেশন প্রিন্টিং  প্রেসের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়।
১২ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ জেল থেকে মুক্তি পান। এগারাে দফার সমর্থনে এবং সরকারের নির্যাতনের প্রতিবাদে জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলের সাতজন সদস্য পদত্যাগ করেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি সরকার ঘােষণা করে, ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে জরুরি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরুর দিন জরুরি আইন জারি করা হয়েছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে এমন একটি ঘটনা ঘটে, যা গণ-আন্দোলনে নতুন মাত্রা যােগ করে।
১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে মােহাম্মদপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের ছাত্র কামালউদ্দিন আহমেদ রান্না করা দুই হাঁড়ি হরিণের মাংস নিয়ে এসেছেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সিগন্যাল অফিসার্স মেসে বন্দী আছেন শেখ মুজিবসহ কয়েকজন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা। দূরে আরেকটি ব্যারাকে কয়েকটি কক্ষে আছেন বাকি সবাই। তারা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত। কামাল আগেও অনেকবার এখানে এসেছেন। তার বড় ভাই নৌবাহিনীর সাবেক লিডিং সি-ম্যান সুলতান উদ্দিন আহমদ এ মামলার অন্যতম অভিযুক্ত। তার বড় বােনের স্বামী এ মামলার সরকারপক্ষের একজন সাক্ষী। তাকে ইতিমধ্যে বৈরী ঘােষণা করা হয়েছে। তার নামও কামালউদ্দিন আহমেদ। তখন তিনি মুক্ত।১৪
গেটে পৌছে কামাল দেখলেন পরিস্থিতি কেমন যেন গুমােট, অন্যান্য দিনের মতাে নয়। অবাঙালি সেন্ট্রি তাকে ঢুকতে দিচ্ছে না, কিছু বলছে না। একটু পরে একজন দীর্ঘকায় লােক এক হাতে একটি সাইকেল এবং অন্য হাতে অনেক কাপড়চোপড় নিয়ে গেটের কাছে এলেন। তিনি পরিচয় দিয়ে বললেন যে তিনি লন্ড্রিম্যান। সকালে গােলাগুলি হয়েছে, দুজন বন্দীর গায়ে গুলি লেগেছে। কামাল তার বড় ভাইয়ের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হলেন। লন্ড্রিম্যান বললেন, যে দুজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, তাঁরা বিমানবাহিনীর সার্জেন্ট। একজন ইতিমধ্যে মারা গেছেন। কে মারা গেছেন জানতে চাইলে লন্ড্রিম্যান উত্তর দিলেন, তাঁদের মধ্যে যিনি বেশি শিক্ষিত তিনি নিহত হয়েছেন। মাংস রাখা যাবে না, কেননা গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে সবাই অনশন করছেন। কামাল মাংসের হাঁড়ি নিয়ে বাসায় ফিরে যান। দুলাভাইয়ের কাছে পুরাে ঘটনার বর্ণনা দিলে তিনি বললেন, বেশি শিক্ষিত ব্যক্তিটি মারা গিয়ে থাকলে এ নির্ঘাত ফজলু। অর্থাৎ সার্জেন্ট জহুরুল হক ও সার্জেন্ট ফজলুল হক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, তবে ফজলুল হক মারা গেছেন। এ সংবাদ নিয়ে কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ক্যানটিনে এলেন। সেখানে সিরাজুল আলম খানসহ অনেকেই ছিলেন। কামাল সবকিছু খুলে বললেন। ইতিমধ্যে রাত হয়ে গেছে। ছাত্রলীগের নেতা মােদাচ্ছের আলী সার্জেন্ট ফজলুল হকের রক্ত—বৃথা যেতে দেব না’ স্লোগান দিতে দিতে কয়েকজনকে নিয়ে একটি মিছিল বের করলেন। তােফায়েল আহমেদ কামালকে বকাঝকা করে বললেন, এ রকম কোনাে ঘটনা ঘটেনি। ঘটলে রেডিওতে বলত। সিরাজুল আলম খান চুপচাপ বসে দাত দিয়ে আঙুলের নখ কাটতে থাকলেন। পরদিন সকালে রেডিওর সংবাদে জানা গেল, পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় রক্ষীদের গুলিতে সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত এবং সার্জেন্ট ফজলুল হক আহত হয়েছেন। রেডিওতে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল।
তারা দুজন মােটেও পালানাের চেষ্টা করেননি। স্টুয়ার্ড মুজিব ও সুলতানউদ্দিন আহমদ ব্যারাকের একটি কক্ষে থাকতেন। তারা প্রায়ই বাইরে একসঙ্গে পায়চারি করতেন। তাে একদিন তাদের সঙ্গে অবাঙালি রক্ষীদের কথা-কাটাকাটি হয়। রক্ষীরা বাঙালির জাত তুলে গালাগাল করছিল। স্টুয়ার্ড মুজিব ছিলেন বিশালদেহী, গায়ে প্রচণ্ড শক্তি। তিনি রাগ সামলাতে না পেরে একজন রক্ষীকে দুই হাতে তুলে আছাড় দেন। এতে রক্ষীরা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে যে তারা দেখে নেবে। তাদের চোখ-মুখের ভাষা বুঝতে স্টুয়ার্ড মুজিব আর সুলতান উদ্দিনের এতটুকু অসুবিধা হয়নি। তারা আশঙ্কা করেছিলেন, একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে। ব্যারাকে ফিরে এসে তারা পাশের কক্ষের বন্দীদের সতর্ক করে দেন, পাশের কক্ষের বন্দীরা তাদের পরবর্তী কক্ষের। বন্দীদের একইভাবে সাবধান করে দেন। এভাবেই সতর্কবার্তা দেওয়া চলতে থাকে। সব শেষের কক্ষে থাকতেন দুই সার্জেন্ট। ভুলক্রমে তাদের কক্ষে সতর্কবার্তা পৌছানাে হয়নি। পরদিন সকালে টয়লেটে যাওয়ার জন্য কেউ আর বাইরে এলেন না। ব্যতিক্রম শুধু দুই সার্জেন্ট। তারা বেরােতেই রক্ষীরা তাদের ওপর গুলি করে। ফজলুল হক মড়ার মতাে পড়ে থাকেন। জহুরুল হক গুলি খেয়ে আহত বাঘের মতাে গর্জন করতে থাকলেন। তাঁকে পরপর কয়েকটি গুলি করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য বেয়নেট দিয়ে তার শরীর খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। গােলাগুলি শুনে অনেকেই দৌড়ে আসেন। দুজনকেই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। জহুরুল হক আগেই মারা গিয়েছিলেন। সার্জেন্ট ফজলুল হকের দেহে অস্ত্রোপচার করা হয়। তিনি বেঁচে যান।১৬ 
কর্তৃপক্ষ রাত তিনটার দিকে জহুরুল হকের লাশ তার ভাই অ্যাডভােকেট আমিনুল হকের এলিফ্যান্ট রােডের চিত্রা ভবনে দিয়ে যায়। সকাল নয়টার মধ্যে ছাত্রলীগের অনেক কর্মী ওই বাসার সামনে জড়াে হন। লাশ নিয়ে তারা মিছিল করে পল্টন ময়দানে হাজির হন। বায়তুল মােকাররম মসজিদের ইমাম সাহেবকে অনুরােধ করা হলাে জানাজা পড়ানাের জন্য  ইমাম সাহেব জানালেন, আসরের নামাজের ঠিক আগে জানাজা হবে। বেলা তিনটার মধ্যে পল্টন লােকে লােকারণ্য হয়ে গেল। ইতিমধ্যে মওলানা ভাসানী এসে উপস্থিত হন। তিনি এসেই জানাজায় ইমামতি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাকে বলা হলাে, বায়তুল মােকাররম মসজিদের ইমামের সঙ্গে কথা হয়েছে, তিনি ইমামতি করবেন। ভাসানী ইমাম সাহেবের পাশে দাঁড়ালেন। জানাজা সম্পন্ন হলাে। লাশ নিয়ে মিছিলসহকারে সবাই আজিমপুর গােরস্তানের দিকে হাঁটছেন। মিছিল থেকে কয়েকজন আবদুল গণি রােডে প্রাদেশিক মন্ত্রী সুলতান আহমেদের বাসা থেকে ফুল তুলে আনতে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ে। মন্ত্রীর এক মেয়ে তাদের বাসায় আক্রমণ করা হয়েছে এই ভেবে বন্দুক দিয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে। জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে উল্টো দিকে অবস্থিত প্রাদেশিক মন্ত্রী অংশু প্রু চৌধুরীর বাসায় আক্রমণ চালায়। মিছিল থেকে কয়েকজন পুরানা পল্টন এলাকায় মুসলিম লীগের এক নেতার মালিকানাধীন পেট্রল পাম্পে আগুন ধরিয়ে দেয়।
কাকরাইলের যে অতিথি ভবনে আগরতলা মামলার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান থাকতেন, তাতে আগুন ধরিয়ে। দেওয়া হয়। আরেক দল মিছিলকারী রেসকোর্স মাঠের হাউজি প্যান্ডেলে আগুন দেয়। শাহবাগে প্রাদেশিক মন্ত্রী খাজা হাসান আসকারির বাসায়ও অগ্নিসংযােগ করা হয়। আরেকটি দল পরীবাগে অবস্থিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীনের বাসভবনে আগুন দেয়। সন্ধ্যাবেলা সার্জেন্ট জহুরুল হকের দাফন সম্পন্ন হয়। রাত ১০টায় কারফিউ জারি করা হয়।১৭ শেখ মুজিব ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি আইয়ুবের ডাকা গােলটেবিল বৈঠকে যাবেন। তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মােশতাকসহ একটি অগ্রবর্তী দল ইতিমধ্যে রাওয়ালপিন্ডি চলে গেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, গােলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য তার জামিনের ব্যবস্থা করা। যে অর্ডিন্যান্সের অধীনে আগরতলা মামলার বিচার চলছিল, তাতে জামিনের কোনাে সুযােগ ছিল না। তখন একটি উপায় বের হলাে, মুজিব প্যারােলে মুক্ত হয়ে বৈঠকে যােগ দেবেন। মুজিব রাজি হলেন। তিনি ব্যারিস্টার আমীর-উলইসলামকে প্যারােলের আবেদন করতে নির্দেশ দেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি প্যারােল বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে শুনানি হওয়ার কথা ছিল। এই প্যারােল নিয়ে রীতিমতাে একটি নাটক হয়। যুবনেতা সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক বেগম মুজিবের কাছে ধরনা দেন, যেভাবেই হােক ‘নেতার’ প্যারােলে বের হওয়া ঠেকাতে হবে; কারণ মানুষ এটিকে একটি আপস হিসেবে দেখবে এবং নেতার ‘ইমেজ’ তাতে নষ্ট হবে। মামলার অন্যতম অভিযুক্ত লে, আবদুর রউফ ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেন : শুনলাম, তিনি প্যারােলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আরও শুনলাম যে তিনি এই সিদ্ধান্তের কথা ইতিমধ্যে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন।
শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সন্ধ্যার প্রাক্কালে সামনের রাস্তায় একটি গাড়ি এসে দাঁড়াতে দেখলাম। গাড়ি থেকে নেমে এলেন বেগম মুজিব। শেখ মুজিব উঠে গেলেন এবং তাকে ভেতরে আসতে বললেন। কিন্তু বেগম মুজিব ভেতরে না এসে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘শুনলাম তুমি নাকি প্যারােলে যাচ্ছ। যদি তাই যাও, তাহলে আমিই তােমার বিরুদ্ধে মিছিল করব। আর সেই মিছিলে তােমার পুত্র-কন্যারাও থাকবে।’ এ কথা বলেই বেগম মুজিব দ্রুত গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। এ ঘটনার পর শেখ মুজিব আরও বিপন্নবােধ করতে লাগলেন। মনে হলাে তিনি যেন আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পরদিন সকালে রেডিওর খবরে বলা হলাে, মুজিব প্যারােলে মুক্তি নিয়ে গােলটেবিলে যােগ দিতে যাচ্ছেন। এ খবর শুনেই তিনি চিৎকার করে রুম থেকে বের হয়ে বললেন, ‘ডাকো। তাদের…জিওসিকে খবর দাও। আমাকে জিজ্ঞেস না করে রেডিওতে নিউজ দিল কেন?’ সম্ভবত বেগম মুজিব চলে যাওয়ার পরই শেখ মুজিব প্যারােলে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।২০ একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে আইয়ুব খান ঘােষণা করলেন, তিনি পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাড়াবেন না। ২২ ফেব্রুয়ারি এক ঘােষণায় আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হয়। সব অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়া হয়। ঢাকায় অবস্থিত সেনাবাহিনীর চতুর্দশ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মােজাফফর উদ্দিনের নির্দেশে ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলী (পরে মেজর জেনারেল) ঢাকা সেনানিবাসের বন্দিশালা থেকে শেখ মুজিবকে নিজে গাড়ি চালিয়ে ধানমন্ডির বাসায় পৌছে দেন। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাছে প্রস্তাব আসে শেখ মুজিবকে গণসংবর্ধনা দেওয়ার। ঠিক হয়, রেসকোর্সে (পরে নাম হয় সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভার আয়ােজন করা হবে। কিন্তু সন্ধ্যার মধ্যে সব রাজবন্দী মুক্তি পেলে ছাত্র ইউনিয়ন দাবি করে যে পরদিন রেসকোর্সে সবাইকে একযােগে সংবর্ধনা দেওয়া হােক। ছাত্রলীগ এতে রাজি হয়নি। তাদের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয়, যেহেতু শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে বলে
ইতিমধ্যে ঘােষণা দেওয়া হয়ে গেছে, তাই এটি শুধু শেখ মুজিবেরই সংবর্ধনা হবে। পরে মণি সিংহসহ অন্যদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রলীগের এই ‘সংকীর্ণতা’ সহ্য করতে রাজি ছিল না। ফলে এক জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। এ অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে বলা হয়, যেন ছাত্রলীগের প্রস্তাব মেনে নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঐক্য রক্ষা করা হয় এবং সংবর্ধনা সভায় শেখ মুজিবকে দিয়ে সুস্পষ্টভাবে এগারাে দফা সমর্থন করিয়ে নেওয়া হয়। ফলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঐক্য রক্ষা পায়। কিন্তু সংকীর্ণতা কেবল ছাত্রলীগের নয়। প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিব একাই ওই জনসভায় ভাষণ দিতে চাচ্ছিলেন। তার বক্তব্য ছিল যে এই সভা থেকে ‘আমি জনগণের ম্যান্ডেট লইয়া গােলটেবিল বৈঠকে যাইতে চাই’।২২।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দোহা এ নিয়ে এতটাই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে তিনি ওই সভায় যেতে অস্বীকার করেন। সামসুদ্দোহার বর্ণনামতে, ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে ইকবাল হলের প্রভােস্ট অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরীর অফিসকক্ষে সংগ্রাম পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয় শেখ মুজিব একাই ভাষণ দেবেন এবং মণি সিংহ, মওলানা ভাসানী, মােজাফফর আহমদ প্রমুখ নেতা মঞ্চে থাকবেন। কিন্তু ছাত্রলীগ শেখ মুজিব ছাড়া অন্য কোনাে নেতার মঞ্চে উপস্থিত থাকার বিরােধিতা করে। ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া) সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক এ বিষয়ে কোনাে ছাড় না দিতে সামসুদ্দোহাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেন। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মােহাম্মদ ফরহাদ একটি চিরকুট পাঠান। যেখানে বার্তা ছিল, মঞ্চে অন্য কারও থাকার দরকার নেই। এই চিরকুট পেয়ে সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ছাত্রলীগের প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। এতে সামসুদ্দোহা ক্ষুব্ধ হন। তার ভাষ্য হলাে : মানিক ভাই ছিলেন সংগঠনের সভাপতি, তাই স্বাভাবিকভাবেই তার মতামতই চূড়ান্ত হবে। কিন্তু তিনিই তাে আমাকে শক্ত থাকতে বলেন। যা হােক, আমি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সভা আহ্বান করি এবং সেখানে মানিক ভাইয়ের প্রস্তাব অনুমােদন করি। সারা রাত এবং পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি দুপুর পর্যন্ত না ঘুমিয়ে আর কিছুতেই থাকা যাচ্ছিল না, তদুপরি মানিক ভাইয়ের ওপর ক্ষোভ ও অভিমান খুবই হয় বিধায় ইকবাল হলে আমার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।২৩ ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্সে শেখ মুজিবকে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রচুর জনসমাগম হয়েছিল। ঢাকায় এর আগে সম্ভবত এত বড় জনসভা আর হয়নি। জনসভা আয়ােজনের দায়িত্বে ছিলেন গাজী গােলাম মােস্তফা ও সিরাজুল আলম খান। ওই সভায় শেখ মুজিব ঘােষণা দেন, তিনি গােলটেবিল বৈঠকে যাবেন, বাংলার মানুষের দাবি আদায় করবেন। সভাপতির ভাষণে তােফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে ঘােষণা দেন। এত বড় জনসভা, কিন্তু কোনাে রকম বিশৃঙ্খলা ছিল না। ঢাকার ডেপুটি কমিশনার এম কে আনােয়ারের সঙ্গে যােগাযােগ করা হয়েছিল। তিনি সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলেন। তােফায়েলের বঙ্গবন্ধু’ ঘােষণা নিয়ে কিছুটা তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে সামসুদ্দোহা বলেন : ২২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের সারা রাত ধরে যে মিটিং হয়, সেই মিটিংয়ে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কেউ কোনাে প্রস্তাব দেননি যে শেখ মুজিবুর রহমানের গণসংবর্ধনায় তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করা। হবে ।…বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদানে কোনাে আপত্তি কারােরই ছিল না বা নাই ।
কিন্তু ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাউকে না জানিয়ে যে পদ্ধতিতে তার মতাে নেতাকে এই উপাধি দেওয়া হয়, তা না করে উচিত ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করা। এটি আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংকটের একটি নমুনা হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত থাকবে।…ওই সংকীর্ণতার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। ২৩ ফেব্রুয়ারির জনসভায় তােফায়েল আহমেদ ছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটির ঘােষক। শেখ মুজিবের জন্য এই নাম তৈরি হয়েছিল আগেই। ছাত্রলীগের ঢাকা কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক ৩ নভেম্বর (১৯৬৮) ছাত্রলীগের প্যাডে ‘আজব দেশ’ শিরােনামে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম সম্বন্ধে একটি লিফলেটের খসড়া লিখেছিলেন। মােশতাক ‘সারথি’ ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন। লেখাটির শেষ পৃষ্ঠায় শেখ মুজিব সম্পর্কে তিনি লেখেন, পূর্ব বাংলার নয়নমণি—মুক্তি দিশারি—বঙ্গবন্ধু—সিংহ শার্দুল জনাব শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রস্তাবিত ছয় দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে, আজব ও অভিনব পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি টিকে থাকতে পারে—নতুবা নয়।”২৬ ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত চার পৃষ্ঠার বুলেটিন প্রতিধ্বনির শেষ পৃষ্ঠায় ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি প্রথমবারের মতাে ছাপা হয়। বুলেটিনটি সম্পাদনা করেছিলেন আমিনুর রহমান।২৭ সিরাজুল আলম খান রেসকোর্স ময়দানে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ঘােষণার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন এভাবে :

 

রেজাউল হক মুশতাক আর শেখ কামাল একটা ওয়ালপেপার বের করেছে। আহসানউল্লাহ হলের (প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) ২১৪ নম্বর রুমে থাকতাম আমি। ওরা আমাকে আসতে বলল। গিয়ে দেখি যে বড় একটা পােস্টার, বঙ্গবন্ধু লেখা। এটি লাগাবে, পরামর্শটা চাচ্ছে। কাগজটা মুড়ি দিয়ে বললাম কাউকে কিছু বােলাে না। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্সে যাচ্ছি। গাড়িতে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমি আর তােফায়েল। সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে এসে লিডার কানের কাছে মুখ এনে বললেন যে কী বলবেন-টলবেন। বললাম, আমাদের সব ঠিক আছে। তােফায়েল বলল, ‘কী বলব?” আমি বললাম যে তুমি একটা টাইটেল দেবা। আমি বায়ে ঝুঁকলাম লিডারকে বলার জন্য। তােফায়েল একটা জিনিস দেবে আপনাকে। উনি এটি বুঝলেন, সেন্স করেছেন। জিজ্ঞেসও করলেন না। উনার ওপর আমার একটি বিরাট কনফিডেন্স হলাে। তােফায়েলকে বললাম, তােমার বক্তৃতা শর্ট হবে। এ জায়গায় এটি বলবা, রিসেপশনটা ভালাে হবে। এটি আমরা আনলাম ইঞ্জিনিয়ারিং করে। রাজনীতিতে শেখ মুজিবের একক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। এটি পরে তাঁর নামের অপরিহার্য অংশ করে তােলার চেষ্টা হয়। ফলে রাজনীতিতে ব্যক্তির ‘কাল্ট’ প্রতিষ্ঠার পথে আওয়ামী লীগ এক ধাপ এগিয়ে যায়।
২৪ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব করাচি ও লাহাের হয়ে রাওয়ালপিন্ডি পৌছান। তার ১৭ জন সফরসঙ্গীর মধ্যে আইনজীবী ছিলেন তিনজন—ড. কামাল হােসেন, আমীর-উল-ইসলাম ও মওদুদ আহমদ। অন্যরা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতা।২৯ এই সুযােগে তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এস এ রহমানের সঙ্গে তাঁর বাসায় দেখা করেন। শেখ মুজিবের সৌজন্যবােধ ছিল অসাধারণ। তিনি বিচারপতি রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন যে তাঁর (বিচারপতি রহমান) পক্ষপাতহীন আচরণের জন্যই তিনি (শেখ মুজিব) রক্ষা পেয়েছেন।৩০  ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতেই শেখ মুজিব আইয়ুব খানের সঙ্গে দেখা করেন। আইয়ুব তখনাে মুজিবের সঙ্গে একটি আপসরফার আশা ছাড়েননি। ইতিমধ্যে আলতাফ গওহর ছাড়াও আরও দুজন দৃশ্যপটে হাজির হয়েছেন। তাঁরা হলেন পাকিস্তানের ধনী বাইশ পরিবারের অন্যতম হারুন ভ্রাতৃদ্বয়। হারুনেরা ছিলেন ভুট্টোর ঘাের বিরােধী। ভুট্টো যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তখন তাদের অনেক দুর্ভোগ পােহাতে হয়েছিল । ভুট্টো যখন ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে আইয়ুববিরােধী আন্দোলন। শুরু করেন, আইয়ুব তখন আলতাফ গওহরের মাধ্যমে হারুন ভাইদের পক্ষে টেনে আনেন। মাহমুদ হারুনকে লন্ডনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত করা হয়। ইউসুফ হারুনকে পরে পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর করা হয়েছিল। 
প্রেসিডেন্ট ভবনে গােপন আলােচনা চলল খুবই আন্তরিক পরিবেশে। ঠিক। হলাে, দেশে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার চালু করা হবে। শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে। মুজিবের পছন্দমতাে এম এন হুদাকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করা হবে। আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল থাকবেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি গােলটেবিল বৈঠক শুরু হলে ওই রাতে আইয়ুব খানের সঙ্গে শেখ মুজিবের একান্তে দেখা ও কথা হয়। তারা প্রেসিডেন্ট ভবনে একসঙ্গে রাতের খাবার খান। শেখ মুজিব কথা দেন যে তিনি গােলটেবিল বৈঠক সফল করতে চেষ্টা চালাবেন। তিনি প্রেসিডেন্টকে বলেন, প্রেসিডেন্ট যে পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার ঘােষণা দিয়েছেন, এটি একটি বড় ভুল।৩৩ ২৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব তার ডায়েরিতে লেখেন : কাল রাতে মুজিব আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আমাদের কথাবার্তা ছিল খােলামেলা। তাকে একটু আপসমূলক মনে হলাে। যদিও সে এটি বােঝাতে চেয়েছে যে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের মুকুটহীন রাজা হিসেবে মেনে নিতে হবে। তার কথায় দেওয়া-নেওয়ার কোনাে আভাস ছিল না। তার ওপর তার দলের চরমপন্থীদের প্রচণ্ড প্রভাব ছিল এবং ছাত্ররা ছিল তার নিয়ন্ত্রণের পুরােপুরি বাইরে।৩৪ শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে আইয়ুব খান তার ডায়েরিতে কিছু লেখেননি। ১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর ঢাকায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে আলাপের সময় শেখ মুজিব বলেছিলেন, ১৯৬৯ সালে লাহােরে গােলটেবিল বৈঠক চলাকালে আইয়ুব খান তাকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।৩৫
আইয়ুব-মুজিব আপসরফার ব্যাপারটি সেনাসদরে ভালাে চোখে দেখা হলাে । ভুট্টো তার বন্ধু জেনারেল পীরজাদার মাধ্যমে এ গােপন আলােচনার খবরটি পেয়ে যান। মুজিব খুব বিপন্নবােধ করতে শুরু করলেন। এ রকম অবস্থায় এ ধরনের একটি সমঝােতা করার ঝুঁকি ছিল অনেক। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি তখন খুবই ঘােলাটে। মওলানা ভাসানীর আহ্বানে সর্বত্র চলছে ঘেরাও আন্দোলন। অন্যদিকে আইয়ুব খান ক্ষমতা ধরে রাখার শেষ অবলম্বন হিসেবে মুজিবকে আঁকড়ে ধরে পার পেতে চাইছেন।৩৬ | ভুট্টো চেয়েছিলেন গােলটেবিল বৈঠক বরবাদ হােক। শেখ মুজিব যাতে এই বৈঠকে যােগ না দেন, ভুট্টো সেই চেষ্টা করেছিলেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল গুল হাসান খান (পরে লে. জেনারেল ও
সেনাপ্রধান)। গুল হাসানের বর্ণনা অনুযায়ী :

একদিন সকালে একটি টেলিফোন কল এল করাচি থেকে। লাইনের অপর প্রান্তে জেড এ ভুট্টো বললেন, তিনি ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে চান। শেখ তখনো মুক্তি পাননি। জবাবে বললাম, সে ক্ষেত্রে তাকে ঢাকায় রিং করতে হবে। তিনি বললেন যে ইতিমধ্যেই তা করেছেন। কিন্তু সেখানকার সামরিক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যােগাযােগের অনুমতি দিতে পারেন একমাত্র সিজিএস (চিফ অব জেনারেল স্টাফ) অর্থাৎ আমি। আমি ভুট্টোকে বললাম যে আমার কাছে এটি এক নতুন খবর, যেহেতু আমার দায়িত্ব ও করণীয় কী কী তা বলার সময় কেউ আভাসমাত্রও দেননি যে শেখের জিম্মাদারির ভারও আমার ওপর । ভুট্টোর মেজাজটা যে বিগড়ে গেল তা বুঝতে পারলাম। বললেন যে জরুরি ভিত্তিতে শেখের সঙ্গে তার কথা বলার ব্যবস্থা আমাকেই করে দিতে হবে। কারণ, ব্যাপারটায় জাতীয় গুরুত্ব রয়েছে। বললাম, বিষয়টা যদি অতটা তাৎপর্যপূর্ণ হয়। তাহলে তিনি প্রেসিডেন্টকে রিং করতে পারেন। প্রেসিডেন্ট এ রকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামাল দেন। রেখে দিলাম ফোনটা। জানি না শেখের সঙ্গে তিনি যােগাযােগ করতে পেরেছিলেন নাকি পারেননি। সম্ভবত তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সম্মেলনে যােগ না দেওয়ার জন্য শেখকে রাজি করানাে।৩৭ । ২৫ ফেব্রুয়ারি গােলটেবিল বৈঠক শুরু হয়। ওই দিনই সভা মুলতবি হয়ে যায়। শেখ মুজিব দলবলসহ ঢাকায় ফিরে আসেন। দুদিন পর তিনি ঈদ | উদযাপনের জন্য গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়ায় যান। ৩ মার্চ হেলিকপ্টারে চড়ে ইউসুফ হারুন হঠাৎ টুঙ্গিপাড়ায় এসে হাজির হন, কয়েক ঘণ্টা আলাপ করেন শেখ মুজিবের সঙ্গে। তারপর ফিরে যান। তিনি আইয়ুবকে ধারণা দেন, সব সমস্যা মিটে যাবে।

১০ মার্চ গােলটেবিল বৈঠক আবার শুরু হলে শেখ মুজিব ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব দেন। একই সঙ্গে তিনি এক ব্যক্তি এক ভােট এবং পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট ভেঙে চারটি প্রদেশ পুনর্বহালের প্রস্তাব করেন। তার প্রস্তাবে অনেকেরই আপত্তি ছিল। শেখ মুজিব বৈঠক ছেড়ে চলে যান। ফলে গােলটেবিল বৈঠক ভেঙে যায়। রাজনৈতিক মঞ্চে সেনাবাহিনীর আগমনের আলামত দেখা যাচ্ছিল। আইয়ুব-মুজিব গােপন বৈঠকের কথা সেনাসদরে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। সামরিক জান্তার মুজিববিরােধী অংশটি শেখ মুজিবকে আইয়ুবের কথায় পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় না গিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে সামনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে পরামর্শ দেয়।৩৯ | ১২ মার্চ শেখ মুজিব সেনাপ্রধান ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেছিলেন। তিনি ইয়াহিয়াকে বােঝানাের চেষ্টা করেন যে ছয় দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি বাঙালিদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইয়াহিয়া সহানুভূতির সঙ্গে বলেছিলেন, আইয়ুব ও মােনায়েম খান ছয় দফাকে রাজনৈতিকভাবে মােকাবিলা করে ‘অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেওয়ার মনােভাব দেখিয়ে ভুল করেছেন।৪০

শেখ মুজিব ১৪ মার্চ ঢাকায় ফিরে আসেন। তেজগাঁও বিমানবন্দরে তিনি আচকান-পাঞ্জাবি পরা পূর্ব পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের কঠোর সমালােচনা করেন। মওলানা ভাসানীকে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পরামর্শ দেন। ২২ মার্চ শেখ মুজিব আইয়ুবের কাছে ‘৬২ সালের সংবিধানের কতগুলাে সংশােধনী প্রস্তাব পাঠান। আইয়ুবের মনে হলাে, এগুলাে বাস্তবায়ন করলে পাকিস্তান আর টিকবে না। তার দৃঢ় বিশ্বাস, শেখ মুজিব দলের চরমপন্থীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন। আইয়ুব খান আইনমন্ত্রী আলভিন রবার্ট কর্নেলিয়াস ও তথ্যসচিব আলতাফ গওহরের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন, সংবিধানে দুটি সংশােধনী আনতে হবে। এগুলাে হচ্ছে সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন ও পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা চালু করা । তিনি তাদের অনুরােধ করলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে আলােচনা করতে। দুপুরেই এ আলােচনাপর্ব শেষ হলাে। সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া ক্রমেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলেন। তার মত হলাে, পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সংবিধান পরিবর্তন করে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনা যাবে না। নতুন গভর্নরদের হাতে কোনাে জাদুর কাঠি নেই। সুতরাং তাকেই (ইয়াহিয়া) তার কর্তব্য পালন করতে হবে। এটি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না, ইয়াহিয়া আসলে কী বলতে চাইছেন। আইয়ুব খান অনেক ভেবেচিন্তে দেখলেন, সামরিক আইন জারি করা ছাড়া উপায় নেই। মন্ত্রিসভার শেষ বৈঠকে তিনি তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। সভায় ইয়াহিয়া উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষ হওয়ার পর আইয়ুব আর ইয়াহিয়া একান্তে আলােচনা শুরু করলেন। আইয়ুব জানতে চাইলেন, তিনি ইয়াহিয়ার সমর্থন পাবেন কি না। ইয়াহিয়া সামরিক আইন জারির আগে কয়েকটি বিষয় বাস্তবায়নের কথা বললেন।
এগুলাে হচ্ছে গভর্নরদের বরখাস্ত করতে হবে; জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদগুলাে ভেঙে দিতে হবে; সংবিধান বাতিল করতে হবে। শেষ প্রস্তাবটিতে আইয়ুব খুবই মর্মাহত হলেন। কেননা তার বানানাে সংবিধান তাকেই ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। আইয়ুব বুঝতে পারলেন, তার দিন শেষ হয়ে এসেছে।৪৩ ২৪ মার্চ আইয়ুব জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চিঠির খসড়া তৈরি করেন। পরদিন বেলা ১১টায় তার ভাষণ রেকর্ড করা হয়। ২৫ মার্চ ক্ষমতার পালাবদল হলাে। সাড়ে ১০ বছর প্রবল প্রতাপে ক্ষমতার চূড়ায় বসে। থেকে আইয়ুব খান প্রায় নিঃশব্দে মঞ্চ থেকে সরে গেলেন। গােলটেবিলে দর-কষাকষির জন্য শেখ মুজিব যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এ জন্য তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন বাছাই করা বিশেষজ্ঞ, যারা ছয় দফা এবং পূর্ব বাংলার ন্যায্য অধিকারের ব্যাপারে ছিলেন আন্তরিক। তিনি জানতেন, প্রয়ােজনে আইয়ুব সরকারের ঝানু আমলাদের সঙ্গে তাকে লড়তে হবে। এ ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা তাে আছেনই, যারা তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী।৪৪ কাকতালীয়ভাবে ভুট্টো ও শেখ মুজিব করাচি থেকে একই বিমানে চড়ে লাহােরে গিয়েছিলেন। ভুট্টো তার দলবল নিয়ে প্রথম শ্রেণির এবং মুজিব তাঁর সহযােগীদের নিয়ে ইকোনমি ক্লাসের যাত্রী হন। শেখ মুজিবের বিশেষজ্ঞ দলে যােগ দিয়েছিলেন ড. কামাল হােসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ চৌধুরী, ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মােহাম্মদ আনিসুর রহমান ও অধ্যাপক ওয়াহিদুল হক। অর্থনীতিবিদ ড. নূরুল ইসলামকে তৈরি থাকতে ও অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। প্রাদেশিক অর্থমন্ত্রী অধ্যাপক মির্জা নূরুল হুদা আইয়ুবের দলের সদস্য হিসেবে বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন এবং সরকারপক্ষে কী ঘটছে না ঘটছে সে সম্পর্কে ‘ভেতরের খবর’ সরবরাহ করতেন।
১৯৬৯ সালের ২১ মার্চ আইয়ুব খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এন হুদাকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়ােগ করেন। ২২ মার্চ ড. হুদা ইসলামাবাদ থেকে ঢাকায় পৌছান এবং পরদিন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকীর কাছে গভর্নর হিসেবে শপথ নেন। এরপর তিনি শেরেবাংলা, সােহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন ও মৌলভি তমিজউদ্দিন খানের কবরে ফাতেহা পাঠ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যান। তার আগে গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর শহীদ মিনারে যাওয়ার সাহস কেউ দেখাননি।৪৬ দুপুরের পর ড, হুদা সব প্রটোকল ভেঙে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের। সঙ্গে দেখা করতে শুরু করেন। প্রথমেই দেখা করেন প্রবীণ রাজনীতিক নুরুল আমিনের সঙ্গে। তারপর যান শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাসায়। শেখ মুজিব লাউঞ্জে গাউন পরে আধশােয়া অবস্থায় ছিলেন। নতুন গভর্নরের সঙ্গে তিনি সে অবস্থাতেই হাত মেলান। গভর্নরের এডিসি মেজর জিলানী তাঁর সঙ্গে ছিলেন। কে একজন বলল, তিনি একটু অসুস্থ, তাই…। কিন্তু মেজর জিলানীর মনে হলাে, তিনি বুঝেসুঝেই এ কাজ করেছেন—উপস্থিত লােকদের এটি দেখানাের জন্য যে তিনি কী পরিমাণ ক্ষমতাবান, গভর্নরকে হােড়াই কেয়ার করেন তিনি। ব্যাপারটি অধ্যাপক ড, হুদার জন্য ছিল লজ্জাকর। শেখ মুজিব যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আইনের ছাত্র, ড, হুদা তখন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। ড. হুদা এরপর আতাউর রহমান খান, মৌলভী ফরিদ আহম্মদ, হামিদুল হক। চৌধুরী, আবদুস সালাম খান, অধ্যাপক গােলাম আযম, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, খাজা খয়েরুদ্দিন, নবাব খাজা হাসান আসকারী প্রমুখের সঙ্গে দেখা করেন।
২৪ মার্চ তিনি তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মীদের সরিয়ে দেন, চলার পথে ট্রাফিক সাইরেন বাজানাে নিষিদ্ধ করেন এবং গভর্নর হাউসের সামনের রাস্তা জনসাধারণের চলাচলের জন্য খুলে দেন। সন্ধ্যায় তিনি মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করেন। সন্ধ্যা সােয়া সাতটায় আইয়ুব খান বেতারে সামরিক শাসন জারি। করেন। গভর্নররা বরখাস্ত হন। ড. হুদা গভর্নর হাউস ছেড়ে তার মিন্টো রােডের বাসায় চলে যান। ক্ষমতার এই পালাবদলের পেছনে দুটি বড় ঘটনা ঘটেছিল, যা পরবর্তী সময়ে এ দেশের ইতিহাসের মােড় ঘুরিয়ে দেয়। একটি হলাে, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’, অন্যটি হলাে ১৯৬৮-৬৯ সালের ছাত্র গণ-আন্দোলন। এ দুটি ঘটনার। মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় বীর হিসেবে পরিচিতি পান এবং দেশের রাজনীতিতে প্রধান নেতা হিসেবে তার উত্থান হয় । উনসত্তরের গণআন্দোলন এ দেশের তরুণ সমাজকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়েছিল। ফলে তরুণ সমাজ, বিশেষ করে ছাত্ররা রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন।
ছাত্রদের এগারাে দফা আন্দোলনের ফলে ছাত্রনেতারা দেশব্যাপী পরিচিতি পান। কিন্তু আন্দোলনটি গড়ে তােলা খুব সহজ ছিল না। এর নেপথ্যে ছিলেন অনেকেই, যাদের ভূমিকা নিয়ে তেমন আলােচনা বা লেখাজোকা নেই । ইতিহাসের এই পর্বটির যথাযথ অনুসন্ধান আজও হয়নি। ১৯৬৬-৬৮ সাল ছিল আওয়ামী লীগের জন্য দুঃসময়। বেশির ভাগ নেতা ছিলেন জেলে আটক। যুবনেতাদের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মণি, কে এম ওবায়দুর রহমান ও আবদুর রাজ্জাকও কারাগারে। বলা চলে, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আমেনা বেগম রীতিমতাে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে আওয়ামী লীগ অফিস পাহারা দিতেন, আর বাইরে থেকে আন্দোলনের জোয়ার তৈরির চেষ্টায় ছিলেন। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খান। মূল ভরসা ছিল ছাত্রলীগ। তারাই কোনােমতে দলের নিবু নিবু সলতেটাকে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। এ সময় তাদের পাশে দাড়ান সাইদুর রহমান নামের এক তরুণ ব্যবসায়ী। ওই সময়ের একটি ছবি পাওয়া যায় তার বর্ণনা থেকে। প্রথমে ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফের সঙ্গে তার যােগাযোেগ হয়। রউফ তাকে ইকবাল হলে নিয়ে আসেন। সেখানে পরিচয় হয় সিরাজুল আলম খান ও তােফায়েল আহমেদের সঙ্গে। চারদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাজের তখন সবে শুরু। ছাত্র আন্দোলনের একপর্যায়ে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শেখ ফজলুল হক মণি ও আবদুর রাজ্জাক জেল থেকে ছাড়া পান। তাদের সঙ্গেও সাইদুর রহমানের ঘনিষ্ঠতা হয়। সাইদুর রহমানের ভাষ্য অনুযায়ী ; ওই সময় সমস্ত ইন্টেলিজেন্স উপেক্ষা কইরা এদের হাইডআউটের জন্য দুটি বাড়ি ভাড়া করছিলাম আমি। একটি করছিলাম বাসাবােতে, আরেকটি আদাবরে।
এদের রাত্রিবেলা নিয়া যাওয়ার জন্য আমার ৩১৫৫ ঢাকা-ক ফক্স ওয়াগন তাদের জন্য ইউজ করছি। এরা আমার বাসায় থাকত। পরে ইন্টেলিজেন্স যখন এদের পেছনে লাগল, তখন গাড়িতে—আমার ওয়াইফ থাকত পেছনের সিটে। সিরাজ, মণি, তােফায়েল, রাজ্জাক, রউফ, যেকোনাে একজন বা দুজন পেছনের সিটে আমার ওয়াইফের লগে বইত। আমি তাদের ড্রাইভার। এইভাবে রাত্রিবেলা তাদের নিয়া যাইতাম। আদাবর আর বাসাবােদ পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাইদুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি। হয়েছিল। তিনি শেখ মুজিবের আস্থাভাজন হতে পেরেছিলেন। রাজনীতির নেপথ্যে দূতিয়ালির কাজে তিনি বেশ পারঙ্গম ছিলেন। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের পথ ধরে এ দেশের সমাজ ও রাজনীতি এগিয়েছে অনেকটা ওই আন্দোলনে শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সব অংশের তরুণ সমাজ এককাট্টা হয়েছিল। রক্ত ঝরেছিল অনেক ১৯৬৮ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে যথাক্রমে ৪ ও ১১ জন নিহত হয়েছিলেন। যতই দিন গেছে, নিহত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে নিহত হন ৫৭ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৭ জন এবং মার্চে ৯০ জন শেষ দিকে বিক্ষুব্ধ জনতা অনেক জায়গায় থানা আক্রমণ করে এবং সংঘর্ষে অনেক পুলিশ সদস্যও মারা যান। তাদের অস্ত্রশস্ত্র লুট হয়।
২০ জানুয়ারি নিহত আসাদুজ্জামান ছিলেন প্রদেশে উনসত্তরের আন্দোলনের প্রথম শহীদ। তিনি মৃত্যুর পর তারকাখ্যাতি পান। ২৪ জানুয়ারি ঢাকায় গণঅভুথানে ৬ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক ও কিশাের নিহত হয়েছিল। এদের মধ্যে নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউর ছাড়া আর কেউ গণমাধ্যমে প্রচার পায়নি। ১৫ ফেব্রুয়ারি নিহত হন সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা। পেশাগত কারণেই তাদের প্রচারে ঘাটতি ছিল না। অন্যরা শহীদের তালিকায় অপাঙক্তেয় থেকে যান। আসাদের মৃত্যু এ দেশের মানুষকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। আন্দোলন তাতে বেগবান হয়েছিল সন্দেহ নেই। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে রাজপথে মিছিল হয়েছিল। শামসুর রাহমান আসাদের শার্ট’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। তার শেষ লাইনগুলাে ছিল :
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক,
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।

সূত্রঃ   আওয়ামী লীগ-উত্থান পর্ব-১৯৪৮-১৯৭০ – মহিউদ্দিন আহমদ