আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের মধ্যে এসব ছিল না। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ, সৃজনী লেখকগােষ্ঠী, উদীচী—এই সংগঠনগুলাে ছিল বামধারার সাংস্কৃতিক চিন্তাধারায় প্রভাবিত। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সংকলন প্রকাশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়ােজন করার ক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ডাকসুর নেতৃত্বে আয়ােজিত একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানমালার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদ তাদের সমস্ত কর্মকাণ্ডে ছায়ানটের সহযােগিতা পেয়েছে। ওই সময় ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদের প্রভাবে দেশের অনেক বরেণ্য লেখক, কবি, সংগীতশিল্পী, আবৃত্তিকার, অভিনয়শিল্পী, আঁকিয়ে ও শিক্ষক প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তারা স্বেচ্ছায় ও নিঃস্বার্থভাবে অংশ নিতেন। তাদের মধ্যে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে আদর্শিক ভালােবাসা কাজ করত। পরে ছায়ানট থেকে বেরিয়ে এসে কামাল লােহানী ‘ক্রান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদেরও একটা ভালাে ভূমিকা। ছিল। বলা চলে, ষাটের দশকে এ দেশে একটি সাংস্কৃতিক জাগরণের জোয়ার বয়ে। যায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি বামধারার এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন এ দ
পাকদর্শন
১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তানের পক্ষে ভােট না দিলে পাকিস্তানের জন্ম হতাে না। পূর্ব পাকিস্তানের জনমানসে পাকিস্তানবাদের শেকড় বেশ ভালােভাবেই গেড়ে বসেছিল। ১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবির পরও পাকিস্তান রাষ্ট্রটির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থায় চিড় ধরেনি। পাকিস্তানের স্থপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ কায়েদে আজম বা মহান নেতা হিসেবে তাঁর আসনটি ধরে রেখেছিলেন অনেক বছর। মাহে-নও ছিল মাসিক সাহিত্য ম্যাগাজিন তথ্য দপ্তর থেকে বের হতাে পাকিস্তানি খবর। প্রথম কাতারের অনেক বাঙালি বুদ্ধিজীবী সরকারি এ দুটো পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। তাদের অনেক লেখায় পাকিস্তান ও জিন্নাহ-বন্দনা ছিল বেশ জোরেশােরেই। ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর সংখ্যা মাহে-নও পত্রিকায় ‘কায়েদে আজমকে’ নামে এক কবিতায় ফজল শাহাবুদ্দীন লেখেন : মাঝে মাঝে দেখিয়াছি প্রভাতের আলােক রঙীন। তবু সেই ঝড় এলাে-মেলাে সেই রাত্রির হাওয়ায়। তুমি এলে হে নাবিক, প্রভাতের পানপাত্র হাতে আঁধার মুখর হলাে জীবনের প্রদীপ্ত শপথে রাত্রির বন্দর থেকে মৌসুমীর হাসিন উষায়। মাহে-নও-এর একই সংখ্যায় জিন্নাহকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ইতিহাস’ নামে একটা কবিতা লিখেছিলেন আবু হেনা মােস্তফা কামাল। তাঁর কবিতার কয়েকটি লাইন ছিল : তােমাকে জেনেছি আকাশের চেয়ে বড় সাগরের চেয়ে অনেক মহত্তরকেননা ক্লান্ত চোখের পাতায় নতুন আলাের ঝড় তুমি এনে দিলে। নতুন জোয়ার ছুঁয়ে গেল বন্দর।
মযহারুল ইসলাম স্রষ্টার প্রতি (কায়েদে আজমকে)’ নামে লিখেছিলেন : সহসা আলাের পরশ লাগলাে প্রাণে প্রাণে এক চেতনা জাগলাে আঁধার দুয়ার খুলে গেল সম্মুখে কে তুমি হে নব-পথ-সন্ধানী আলােকদ্রষ্টা? বেগম সুফিয়া কামাল ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৬ সাল অবধি জিন্নাহকে নিয়ে কমপক্ষে আটটি কবিতা লিখেছিলেন, যা ছাপা হয়েছিল মাহে-নও পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় । জিন্নাহকে জন্মদিনের শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বরে ‘হে মহান নেতা’ শিরােনামে তিনি লিখেছিলেন পঁচিশ লাইনের একটি কবিতা। ভাষা আন্দোলনের প্রায় তিন বছর পর লেখা এ কবিতার প্রথম লাইনগুলাে ছিল : কায়েদে আজম! হে মহান নেতা সাড়া দাও, দাও সাড়া, তােমারে ভােলনি, আজিও ডাকিছে বঞ্চিত সর্বহারা… ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিব ঘােষণা করলেন ছয় দফা দাবিনামা। ৭ জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল হলাে, ঝরে গেল এগারােটি প্রাণ। শেখ মুজিব কারাগারে বন্দী। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানি খবর-এ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে স্মরণীয়’ নামে একটা কবিতা লিখলেন বেগম সুফিয়া কামাল। এর কয়েকটা লাইন ছিল : এইখানে একটি পতাকা। চন্দ্র ও তারকা আঁকা কোটি মানবের নব প্রাণের প্রতীক…৫ শুধু পদ্য নয়, গদ্যেও গদগদ ছিলেন কেউ কেউ। ১৯৬১ সালে সারা দেশ সামরিক শাসনের জঁতাকলে চাপা পড়েছিল। হাসান হাফিজুর রহমান ওই সময় লিখলেন ‘ছােটদের কায়েদে আযম’। তার কয়েকটা লাইন ছিল এ রকম : তিনি গড়ে তুলেছিলেন নতুন এক দেশ, হয়েছিলেন বিরাট এক জাতির মুকুটহীন রাজা। রাজার ছেলে তিনি নন, কিন্তু রাজা বাদশাদের চেয়েও অনেক। বড় কাজ তিনি করে গেছেন। অসম্ভবকে করে গেছেন সম্ভব। ঘর-হারা জাতিকে।
দিয়ে গেছেন চিরকালের অটুট এক ঘর।৬ ঘরটি চিরকাল অটুট থাকেনি। দশ বছরের মধ্যেই জিন্নাহর পাকিস্তান ভেঙে দুই টুকরাে হয়ে গিয়েছিল। বাঙালি বুদ্ধিজীবী মানসে পরিবর্তন এসেছিল ধীরে। ধীরে। ষাটের দশকে বাঙালি স্বাতন্ত্রবােধ ও জাতীয়তাবাদ দানা বাঁধতে শুরু করে। তবে এ যাত্রায় সবাই শামিল হননি। পূর্ব পাকিস্তানে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে ধারাটি কমিউনিস্ট পার্টি এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের একটি অংশ বহমান রেখেছিল, তার সমান্তরাল একটি অসাম্প্রদায়িক, উদার ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনও যুগপৎ চালু ছিল। মূলত বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী এবং দলীয় পরিচয়ের বাইরে মুক্তমনা কয়েকজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিজীবী এই প্রয়াসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে তাদের সম্মিলন ঘটে। এর তাৎপর্য ছিল সুদূরপ্রসারী।
১৯৬১ সালে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মাের্শেদকে সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক খান সারওয়ার মুরশিদকে সাধারণ সম্পাদক করে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি গঠন করা হয়। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানে দেশের প্রথম সারির লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশ ঘটেছিল। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ইমাম হােসেন চৌধুরী। বিচারপতি মাের্শেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ বক্তব্য দেন। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপন নিয়ে কাদা-ছােড়াছুড়ি হয়েছে। ঢাকার দৈনিক আজাদ পত্রিকায় এ নিয়ে কেউ কেউ বিষােদগার করেছেন। প্রবন্ধকার আবদুল হক (পরে বাংলা একাডেমির পরিচালক) ১৯৬১ সালের ৩০ এপ্রিল তার ডায়েরিতে লেখেন, ‘শুচিবায়ুপীড়িত জলাতঙ্কগ্রস্ত আজাদ তার চিরাচরিত কুঅভ্যাস অনুযায়ী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে : রবীন্দ্রনাথ আসলে হিন্দু ছিলেন, তাঁর কাব্য-সাহিত্য আসলে হিন্দু-সাহিত্য, এতে মুসলমানদের কথা নেই, বরং কোথাও কোথাও তাদের প্রতি কটাক্ষপাত করা হয়েছে, কাজেই পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের জন্য যারা আয়ােজন করছে তারা পাকিস্তানবিরােধী অখণ্ড ভারতবাদী।’ রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপনের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৬৩ সালে ঢাকায় ছায়ানট নামে একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি করা হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে বেগম সুফিয়া কামাল ও ফরিদা হাসান। এর প্রধান সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন মােখলেসুর রহমান (সিধু মিয়া), ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন, শামসুন্নাহার রহমান (রােজ), সাইদুল হাসান, আহমেদুর রহমান, মীজানুর রহমান (ছানা), সাইফুদ্দীন আহমেদ (মানিক) প্রমুখ। দেশে পদ্ধতিগতভাবে রবীন্দ্রসংগীত শেখানাের মাধ্যমে রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা ও প্রসারে ছায়ানট অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে।
১৯৬৭ সাল থেকে তারা নিয়মিতভাবে প্রতিবছর (১৯৭১ সাল বাদে) পয়লা বৈশাখে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান করে থাকে। জন্মের শুরু থেকেই ছায়ানট সরকারের কোপানলে পড়েছিল। ছায়ানটের অর্থের উৎস নিয়ে সরকারি পর্যায়ে তদন্ত, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নানাভাবে হয়রানি, সংগীত বিদ্যালয়কে অস্থায়ী আবাস থেকে একাধিকবার উচ্ছেদ ও অনুষ্ঠান পণ্ড করার চেষ্টার মাধ্যমে নানা ষড়যন্ত্র চলে।” পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরস্পরবিরােধী দুটি ধারা বহমান ছিল। একটি হলাে ইসলাম ধর্মের মােড়কে পাকিস্তানি এস্টাবলিশমেন্টের ধারা, যেখানে বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) ক্রমে পাকিস্তানের (পশ্চিম পাকিস্তান) একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল; অন্যটি ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক ধারা, যা বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়াসকে সঞ্জীবনী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করছিল ধীরে ধীরে। বাঙালির এ লড়াইয়ে একটি মস্ত বড় অবলম্বন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং তার সাহিত্য। তাই পাকিস্তানি এস্টাবলিশমেন্ট রবীন্দ্রনাথের ওপর আঘাত হানল। পাকিস্তান সরকারের মালিকানাধীন বাংলা পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান ১৯৬৭ সালের ২৪ জুন একটা খবর ছাপা হলাে, শিরােনাম রেডিও পাকিস্তান থেকে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার করা হবে না। সংবাদটি ছিল এ রকম: কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন গতকাল জাতীয় পরিষদে বলেন যে ভবিষ্যতে রেডিও পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবােধের পরিপন্থী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান প্রচার করা হবে না এবং এ ধরনের অন্যান্য গানের প্রচারও কমিয়ে দেওয়া হবে। রাজশাহী থেকে নির্বাচিত বিরােধীদলীয় সদস্য জনাব মুজিবুর রহমান চৌধুরীর এক অতিরিক্ত প্রশ্নের উত্তরে খাজা শাহাবুদ্দীন উপরিউক্ত মন্তব্য করেন। খবরটি অনেকের চোখ এড়িয়ে গেলেও কারও কারও মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। নাগরিক সমাজের অগ্রগণ্য কিছু সদস্য নিজেদের মধ্যে যােগাযােগ করলেন। বাংলা ও ইংরেজি দুটি ভাষাতেই একটি বিবৃতি তৈরি করা হলাে। দুটিই মুসাবিদা করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের রিডার (সহযােগী অধ্যাপক) মুনীর চৌধুরী। এর পরদিন অর্থাৎ ২৫ জুন দৈনিক পাকিস্তান-এর প্রথম পাতায় ছাপা হলাে রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত—১৮ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি’ ।
বিবৃতিতে বলা হলাে : স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় ২৪ জুন ১৯৬৭ তারিখে মুদ্রিত একটি সংবাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। এতে সরকারি মাধ্যম হতে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার হ্রাস ও বর্জনের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে করি। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে, তার সংগীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও তীক্ষ্ণতা দান করেছে, তা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। সরকারি নীতিনির্ধারণের সময় এ সত্যের গুরুত্বকে মর্যাদা দান করা অপরিহার্য। এই বিবৃতিতে সই দেন ড. মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা, ড. কাজী মােতাহার হােসেন, বেগম সুফিয়া কামাল, জয়নুল আবেদিন, এম এ বারি, অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. খান সারওয়ার মুরশিদ, সিকান্দার আবু জাফর, মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. আহমদ শরীফ, ড. নীলিমা ইব্রাহীম, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন, ড. আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম ও মােহাম্মদ মনিরুজ্জামান। বিবৃতিটি দেখে শেষ সময়ে শহীদুল্লা কায়সারও সই দিয়েছিলেন। তাঁর সই করা বিবৃতি শুধু সংবাদএ ছাপা হয়েছিল।১২
সরকারি নীতির সমর্থনে ১৯৬৭ সালের ২৯ জুন দৈনিক পাকিস্তান-এর প্রথম পাতায় পাশাপাশি দুটি বিবৃতি ছাপা হয়। একটি ছাপা হয় ১৮ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি—বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষক কর্তৃক মতানৈক্য প্রকাশ’ শিরােনামে । এ বিবৃতি যাদের নামে ছাপা হয়েছিল, তারা হলেন সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন (অধ্যক্ষ, ইংরেজি বিভাগ), এম শাহাবুদ্দীন (আইন অনুষদের ডিন), মােহাম্মদ মােহর আলী (ইতিহাস বিভাগের রিডার), এ এফ এম আবদুর রহমান (গণিত বিভাগের রিডার) ও কে এম এ মুনিম (ইংরেজি বিভাগের সিনিয়র লেকচারার)। বিবৃতিতে তারা বলেন : সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে কতিপয় ব্যক্তির বিবৃতিতে ভুল-বােঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে বলে আমরা মনে করি এবং এ বিবৃতি পাকিস্তানবিরােধী প্রচারে ব্যবহৃত হতে পারে। বিবৃতির ভাষায় এ ধারণা জন্মে যে স্বাক্ষরকারীরা। বাংলাভাষী পাকিস্তানি ও বাংলাভাষী ভারতীয়দের সংস্কৃতির মধ্যে সত্যিকারের কোনাে পার্থক্য রয়েছে বলে স্বীকার করেন না। বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সংস্কৃতি সম্পর্কে এ ধারণার সঙ্গে আমরা একমত নই বলেই এ বিবৃতি দিচ্ছি। পাশাপাশি ৪০ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি : রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি মারাত্মক’ শিরােনামে আরেকটি দীর্ঘ বিবৃতি ছাপা হয়। বিবৃতির ভাষা ছিল এ রকম: পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে ঘােষিত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদপত্রে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী মহলের যে বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, ‘রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ এ উক্তির প্রতিবাদ করতে আমরা বাধ্য হচ্ছি এ কারণে যে এ উক্তি স্বীকার করে নিলে পাকিস্তানি ও ভারতীয় সংস্কৃতি যে এক এবং অবিচ্ছেদ্য, এ কথাই মেনে নেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ যে সংস্কৃতির ধারক ও বাহক তা হচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতি—যে সংস্কৃতির মূল কথা হলাে : ‘শক হুন দল পাঠান মােগল এক দেহে হল লীন এবং যে সংস্কৃতি এ উপমহাদেশের মুসলমানদের অভিহিত করে হিন্দু-মুসলমান’ বলে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই প্রথম।
তার এক প্রবন্ধে এ উপমহাদেশের মুসলমানদের হিন্দু-মুসলমান’ বলে। অভিহিত করেন। সংস্কৃতি সম্পর্কে এই যে ধারণা, এর সঙ্গে পাকিস্তানি সাংস্কৃতিক ধারণার আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে এবং বলা যেতে পারে, একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত। যে তামদুনিক স্বাতন্ত্রের ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা, উপরিউক্ত বিবৃতি মেনে নিলে সে ভিত্তিই অস্বীকৃত হয়। এ কারণে উপরিউক্ত বিবৃতিকে আমরা শুধু বিভ্রান্তিকর নয়, অত্যন্ত মারাত্মক এবং পাকিস্তানের মূলনীতির বিরােধী বলেও মনে করি। যে ৪০ জন বুদ্ধিজীবী এ বিবৃতিতে স্বাক্ষর দেন, তারা প্রায় সবাই ছিলেন অতিপরিচিত এবং নিজ নিজ পেশায় প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিত্ব। তাদের মধ্যে নামজাদা সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, শিক্ষক ও শিল্পীর সমন্বয় ঘটেছিল। স্বাক্ষরদাতারা ছিলেন মােহাম্মদ বরকতউল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ, বিচারপতি আবদুল মওদুদ, মুজিবুর রহমান খা, মােহাম্মদ মােদাব্বের, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, ড. কাজী দীন মােহাম্মদ, ড. হাসান জামান, ড. গােলাম সাকলায়েন, ড, আশরাফ সিদ্দিকী, বেনজির আহমদ, মইনুদ্দীন, অধ্যক্ষ শেখ শরফুদ্দীন, আ কা মু আদম উদ্দীন, তালিম হােসেন, শাহেদ আলী, আ ন ম বজলুর রশীদ, মােহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, সানাউল্লাহ নূরী, আবদুস সাত্তার, কাজী আবুল কাশেম, মুফাখখারুল ইসলাম, শামসুল হক, ওসমান গনি, মফিজউদ্দীন আহমদ, আনিসুল হক চৌধুরী, মােস্তফা কামাল, অধ্যাপক মােহাম্মদ মতিউর রহমান, জহুরুল হক, ফারুক মাহমুদ, মােহাম্মদ নাসির আলী, এ কে এম নুরুল ইসলাম, জাহানারা আরজু, বেগম হােসনে আরা, বেগম মাফরুহা চৌধুরী, কাজী আবদুল ওয়াদুদ ও আখতার-উল-আলম।১৪
বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদেও বিতর্ক হয়। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় যােগাযােগমন্ত্রী সবুর খানের মন্তব্য ছিল : এ কথা বলা হচ্ছে যে, ড, রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার প্রভূত উন্নতি সাধন করেছেন। এবং তার কাব্য-বিহনে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা এতিম হয়ে পড়েছেন। এই শ্রেণির মূর্খদের গলাবাজির প্রতি আমার কোনাে সহানুভূতি নেই। জাতীয় পরিষদের বিরােধীদলীয় বাঙালি সদস্যরা এসব উক্তির জোরালাে বিরােধিতা করেছিলেন বলে জানা যায় না। তবে ছাত্র ও সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ নিছক ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির স্বাতন্ত্রবােধের প্রতীক। অনেক চেষ্টা হয়েছিল বাংলা ভাষার আরেক প্রধান কবি কাজী নজরুল ইসলামকে রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানাের । নজরুলকে প্রচার করা হচ্ছিল মুসলমানদের কবি হিসেবে। এমনকি তার কোনাে কোনাে কবিতায় শব্দ বদলে দিয়ে মুসলমানীকরণের চেষ্টা হয়েছিল। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। পূর্ব পাকিস্তান স্কুল টেক্সট বুক বাের্ডের বাংলা পাঠ্যবইয়ে নজরুলের ‘চল্ চল্ চল্ কবিতাটি স্থান পেয়েছিল। ওই কবিতার একটি লাইন ছিল ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’। তাে মহাশ্মশান’ কেটে সেখানে ‘গােরস্তান’ শব্দটি বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় ঢাকায় নজরুল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। কয়েকজন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী সরকারের রবীন্দ্রসংগীত বর্জনের ঘােষণার সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বেদারউদ্দীন আহমদ, আবদুল লতিফ, আবিদ হােসেন খান, আবদুল আলীম, নীনা হামিদ প্রমুখ। এই বিবৃতি দেখে ছাত্রসমাজ ক্ষুব্ধ হয়েছিল।১৬
প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের একপর্যায়ে খাজা শাহাবুদ্দীন তার অবস্থান তুলে ধরেন। জাতীয় পরিষদে ১৯৬৭ সালের ৪ জুলাই তারিখে তিনি মন্তব্য করেন, পত্রিকায় রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। বেতারে রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের ওপর কোনাে নিষেধাজ্ঞার কথা তিনি বলেননি। জনৈক ভারতীয় উর্দু কবি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানের আদর্শ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিবিরােধী কোনাে কিছু বেতারে অনুমােদন করা হবে না । তখন একজন সদস্য তাঁকে প্রশ্ন করেন, এ কথা কি রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যা, যদি তাঁর কোনাে গান পাকিস্তানের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিবিরােধী হয় তাহলে তা বাজানাে হবে না। পাক-বাংলার কালচার নামে পাকিস্তানি শাসকেরা এ দেশে বাংলা ভাষার ইসলামীকরণের চেষ্টা করেছিলেন। এর প্রয়ােজন ছিল না। বাংলা ভাষায় এমনিতেও অনেক আরবি-ফারসি-তুর্কি শব্দ প্রচলিত আছে এবং তা ভাষাকে। আরও সমৃদ্ধ করেছে। ভাষার এ আত্তীকরণ হয়েছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়, এ দেশের সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাপন প্রণালির ধারাবাহিকতায় সেখানে জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়ার পাকিস্তানি প্রবণতার বিরুদ্ধে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশের সচেতন প্রয়াস ছিল। বাঙালিদের যেকোনাে দাবিদাওয়া অগ্রাহ্য করার জন্য শাসকেরা ওই সব দাবিকে সাম্প্রদায়িকতার মােড়কে উপস্থাপন করার চেষ্টা করত। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার অন্যতম শিকার । যে অর্থে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয়, একই অর্থে নজরুলও ছিলেন ভারতীয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির আড়ালে রবীন্দ্রনাথকে বিদেশি বলে প্রচার করা এবং নজরুলকে নিয়ে অতি মাতামাতি ছিল দৃষ্টিকটু।
অনেক বাঙালি কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক এ প্রবণতার জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। এই রবীন্দ্রবিদ্বেষ এবং নজরুলপ্রেম একেবারে নিষ্কাম ছিল না। সরকারি তথ্য বিভাগ, ব্যুরাে অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন (বিএনআর), পাকিস্তান কাউন্সিল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনেক বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে পৃষ্ঠপােষকতা দেওয়া হতাে। বিএনআর তৈরি হয়েছিল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময়। এর প্রথম পরিচালক ছিলেন সিএসপি কর্মকর্তা ও কবি আবু জাফর মােহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ খান। বিএনআরের হয়ে অনেক বাঙালি বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানবাদের পক্ষে লিখতেন এবং এ জন্য তারা অর্থ পেতেন। পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় কাঠামাের ভেতর বাঙালির গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন অনুষঙ্গ হিসেবে। ষাটের দশকের শেষ দিকে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। এ দলের সমর্থনপুষ্ট ছাত্র সংগঠন ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ছিল সবচেয়ে বড় ছাত্রসংগঠন। তারা পালাক্রমে সাধারণ ছাত্রদের ভােটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (ডাকসু) নেতৃত্ব দিত। ছাত্রলীগের প্রধান দুর্বলতা ছিল এই যে, তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের তেমন বিকাশ হয়নি। আওয়ামী লীগের কোনাে সাংস্কৃতিক গণসংগঠন ছিল না। দেশের শিক্ষাঙ্গনে যে কয়টি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল, সেগুলাে ছিল সাধারণভাবে বাম-প্রভাবিত। ওই সব সংগঠনের সদস্য-কর্মীরা রবীন্দ্রসংগীত ও নানা রকম গণসংগীতের চর্চা এবং সংগীতের মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা তৈরির চেষ্টা করতেন।