ছয় দফা
১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ভেঙে ন্যাপ তৈরি হলে দলের অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী ন্যাপে চলে যান। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হলে রাজনীতিবিদদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। শেখ মুজিব নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। সামরিক শাসন উঠে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেননি। সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের ভার শেখ মুজিবকে প্রায় একাই বয়ে বেড়াতে হয়েছে। দলে বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ নেতার আকাল পড়েছিল। ওই সময় শেখ মুজিবের প্রধান অবলম্বন ছিল ছাত্রলীগের তরুণ নেতা-কর্মীরা। ওই সময় ছাত্রলীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ (পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক) দুটো পুস্তিকা লিখেছিলেন—বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে তখন দারুণ অর্থকষ্টে পড়তে হয়েছিল। শেখ মুজিবের আলফা ইস্যুরেন্স কোম্পানিতে একটা চাকরি ছিল। সিরাজুল আলম খান ঢাকার কাছে কেরানীগঞ্জের আটি স্কুলে একটা কামরায় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের কোচিং করিয়ে কষ্টেসৃষ্টে টাকা জোগাড় করতেন। কিন্তু এ দিয়ে ছাত্রলীগের টাকার চাহিদা মেটানাে কোনােক্রমেই সম্ভব ছিল না। টাকার জন্য তাকে প্রায়ই যেতে হতাে তার নেতা শেখ মুজিবের কাছে। ওই সময় শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং সরকার থেকে প্রচার করা হতাে, শেখ মুজিব দুর্নীতি করে অনেক টাকা কামিয়েছেন। রাজনীতি দিয়ে মােকাবিলা করতে না পেরে তার নামে নানান অপবাদ দেওয়া হতাে। শেখ মুজিব প্রচণ্ড পরিশ্রম, ত্যাগ ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ছাত্রলীগের তরুণেরাই ছিলেন তার প্রধান সহায়। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি বিরাট একটা বােমা ফাটালেন—ছয় দফা।
১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়া নিয়ে নানা রকম তথ্য পাওয়া যায়। কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ছিল। যুদ্ধ চলে ১৭ দিন। সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের দূতিয়ালিতে তাসখন্দে পাকিস্তান-ভারত শীর্ষ বৈঠক শুরু হয় ১৯৬৬ সালের ৪ জানুয়ারি। ১০ জানুয়ারি একটা সমঝােতা চুক্তিতে সই দেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। তাসখন্দ চুক্তিতে ভারতের কাছে পাকিস্তানের স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই অভিযােগে পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব খান সমালােচিত হন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ভূমিকা ছিল রহস্যময়। ভুট্টো পাকিস্তানকে যুদ্ধে নামিয়ে আইয়ুব খান ও সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করতে চেয়েছিলেন বলে আইয়ুব খানের ঘনিষ্ঠ সহযােগী তথ্যসচিব আলতাফ গওহর ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় প্রেসিডেন্টের এডিসি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (পরবর্তী সময়ে স্কোয়াড্রন লিডার ও রাষ্ট্রদূত) আরশাদ সামি খানের বিবরণ থেকে :
দিল্লিতে পাকিস্তানের হাইকমিশনার মিয়া আরশাদ হােসেনের একটা একান্ত গােপনীয় টেলিগ্রাম সম্পর্কে গােয়েন্দা বিভাগ নিশ্চিত হয়েছে। গােয়েন্দা অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওয়াঘা সীমান্ত দিয়ে ভারত লাহাের আক্রমণের পরিকল্পনা করছে, টেলিগ্রামটিতে এমন তথ্য ছিল। এটা পাঠানাে হয়েছিল পররাষ্ট্রসচিব আজিজ আহমদের কাছে। তিনি টেলিগ্রামটি নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলেন। গােপনীয় টেলিগ্রামটি যেন কারও হাতে না পড়ে, এমনকি প্রেসিডেন্টের কাছেও, তার ব্যবস্থা হয়। তথ্যটি আগেভাগে জানা গেলে ভারতীয় বাহিনীর লাহাের আক্রমণের আকস্মিকতায় বিমূঢ় হতে হতাে না। লাহাের রক্ষা পেয়েছিল, তবে অনেক প্রাণের বিনিময়ে। টেলিগ্রামটি গােপন করার কারণে লাহাের ভারতীয়দের দখলে চলে যেতে পারত। এটা সন্দেহাতীতভাবেই একটা বড় রকমের বেইমানি। প্রেসিডেন্ট দুজনের বিরুদ্ধেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি ভেবেছিলেন। তিনি আলতাফ গওহরকে বলেন, ‘আমি বুঝি, ভুট্টো ও আজিজ আহমদ সম্ভবত কী চেয়েছিলেন।
বিষয়টি কীভাবে মােকাবিলা করা যায়, সে ব্যাপারে আমি তােমার পরামর্শ চাই।” তাসখন্দ চুক্তি পর্যালােচনা করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের বিরােধীদলীয় রাজনীতিবিদেরা ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহােরে একটি জাতীয় সম্মেলন ডাকেন। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নসরুল্লাহ খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবুর রহমানকে এ সম্মেলনে যােগ দিতে বলেন। শেখ মুজিব যেতে চাননি। তিনি শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কয়েকজনকে লাহােরে পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেন। দৈনিক ইত্তেফাক এর সম্পাদক মানিক মিয়া শেখ মুজিবকে বললেন, ‘মুজিবর মিয়া, যদি যেতেই হয়, আপনিই যান। আর আপনার মনে এতকাল যে কথাগুলাে আছে, সেগুলাে লিখে নিয়ে যান। ওরা শুনুক না শুনুক, এতে কাজ হবে।’
শেখ মুজিব সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি যাবেন লাহােরে কী কী বিষয় নিয়ে আলােচনা করবেন, তার একটা বিষয়সূচি বা টকিং পয়েন্ট’ লিখে দেওয়ার জন্য তিনি বাঙালি সিএসপি কর্মকর্তা রুহুল কুদুসের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। রুহুল কুদুস সাত দফা কর্মসূচির একটা খসড়া তৈরি করে দেন। সাত নম্বর দফায় ছিল প্রদেশে নির্বাচিত গভর্নরের বিধান রাখতে হবে। আওয়ামী লীগ যেহেতু সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করত, তাই দফাটি কেটে বাদ দেওয়া হলাে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের সহযােগিতায় রুহুল কুদুসের খসড়াটি পরিমার্জন করে ছয় দফায় আনা হয়। ছয় দফার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ড. কামাল হােসেনের একটা ভাষ্য পাওয়া যায়। তার মতে, মানিক মিয়া লাহােরে বিরােধী দলের সম্মেলনে যােগ দিতে শেখ মুজিবকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি শেখ মুজিবকে বলেছিলেন, তিনি যেন। স্বায়ত্তশাসনের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেন। একপর্যায়ে অনেকের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া হয় এবং এগুলাের তালিকা থেকেই ছয় দফা লেখা হয়। এর একটি ইংরেজি ভাষ্য তৈরি করা হয় লাহােরের সম্মেলনে উপস্থাপন করার জন্য। বাঙালি সিএসপি কর্মকর্তা রুহুল কুদ্স ইংরেজিতে খসড়াটি তৈরি করে। দিয়েছিলেন। মানিক মিয়া প্রথমে ছয় দফা প্রচার করতে চাননি। শেখ মুজিব ইত্তেফাক-এর বার্তা সম্পাদক সিরাজউদ্দিন হােসেনকে বলে যান, লাহােরে ছয় দফা আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করার পর তা যেন ভালােভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। তার আশঙ্কা ছিল যে সরকার ছয় দফার প্রচারে বাধা দিতে পারে। ৪ ফেব্রুয়ারি তাজউদ্দীন আহমদ ও নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে নিয়ে শেখ মুজিব লাহােরের উদ্দেশে রওনা হলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২১ জন রাজনীতিবিদ এ সম্মেলনে যােগ দেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৬০০ জনের বেশি প্রতিনিধি লাহাের সম্মেলনে অংশ নেন।
৫ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৬) চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর বাসায় কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি সৈয়দ মােহাম্মদ আফজালের সভাপতিত্বে সম্মেলন শুরু হয়। সাবজেক্ট কমিটির সভায় শেখ মুজিব একটি ছয় দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উপস্থিত অন্য সবার আপত্তির মুখে শেখ মুজিবের প্রস্তাব সম্মেলনের এজেন্ডায় রাখা হলাে না। শেখ মুজিব ক্ষুব্ধ হয়ে সম্মেলন থেকে ওয়াকআউট করলেন। পরে সাংবাদিকদের কাছে তিনি ছয় দফার কথাগুলাে তুলে ধরেন। ১০ ফেব্রুয়ারি লাহােরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বললেন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সঙ্গে আলােচনা না করে এই পর্যায়ে তাসখন্দ চুক্তি সম্বন্ধে তিনি কিছু বলবেন না। ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকা বিমানবন্দরে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে লাহাের সম্মেলনে সাবজেক্ট কমিটিতে দেওয়া প্রস্তাবের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, তার দেওয়া ছয় দফা অন্তর্ভুক্ত করে। আন্দোলনের জন্য কোনাে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হলে তিনি তার সঙ্গে থাকবেন।” লাহােরে যাওয়ার আগে মতিঝিলে শেখ মুজিবের কর্মস্থল আলফা ইস্যুরেন্স কোম্পানির যে ঘরে বসে তিনি ছয় দফার খসড়া নিয়ে কাজ করেছিলেন, সেখান থেকে তার একটা কপি সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর হাতে আসে। তিনি এটা ঢাকার সান্ধ্য দৈনিক আওয়াজ-এ ছাপিয়ে দেন। শেখ মুজিব তখন লাহােরে। ছয় দফা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানাবিধ পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য ছিল। শেখ মুজিবের কাজকর্মের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আতাউর রহমান খান প্রসন্ন ছিলেন না। লাহাের সম্মেলনে শেখ মুজিবের ভূমিকার ব্যাপারে তাঁর মন্তব্য ছিল নেতিবাচক।
তার মতে : অধিবেশন চলাকালে শেখ মুজিব হঠাৎ বােমা নিক্ষেপ করলেন—ছয় দফা। প্রস্তাব বা দাবির আকারে একটা রচনা নকল করে সদস্যদের মধ্যে বিলি করা। হলাে । কোনাে বক্তৃতা বা প্রস্তাব নেই, কোনাে উপলক্ষ নেই, শুধু কাগজ বিতরণ । পরে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। জাতীয় কনফারেন্সে এই দাবি নিক্ষেপ করার কী অর্থ হতে পারে? আতাউর রহমান খানের বক্তব্যের অর্থ হলাে, ছয় দফায় যা-ই থাকুক না কেন এখন এটা বলার সময় নয়। ছয় দফা কেমন করে তৈরি হলাে, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
কিছুসংখ্যক চিন্তাশীল লোেক দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুরবস্থার কথা আলাপ-আলােচনা করেন। আমাদের ইঙ্গিত ও উৎসাহ পেয়ে তারা একটা খসড়া দাবি প্রস্তুত করেন।…তারা ‘সাত দফা’র একটা খসড়া আমাদের দিলেন। এই খসড়ার নকল বিরােধীদলীয় প্রত্যেক নেতাকেই দেওয়া হয়। শেখ মুজিবকেও দেওয়া হয়। খসড়া রচনার শেষ বা সপ্তম দফা আমরাও সমর্থন করিনি। শেখ মুজিব সেই দফা কেটে দিয়ে ছয় দফা তারই প্রণীত বলে চালিয়ে দিলেন। লাহাের কনফারেন্স বানচাল হয়ে গেল। নেতারা শেখ মুজিবকেই এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী করেন। তারা অভিযােগ করেন, শেখ মুজিব সরকারের পক্ষ থেকে প্ররােচিত হয়ে এই কর্ম করেছেন। লাহােরে পেীছার সঙ্গে সঙ্গে আইয়ুব খানের একান্ত বশংবদ এক কর্মচারী শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কী মন্ত্র তার কানে ঢেলে দেয়, যার ফলেই শেখ মুজিব সব ওলটপালট করে দেন। তারা এও বলেন যে আওয়ামী লীগের বিরাট বাহিনীর লাহাের যাতায়াতের ব্যয় সরকারের নির্দেশে কোনাে একটি সংশ্লিষ্ট সংস্থা বহন করে।
আল্লাহ্ আলিমুল গায়েব।১২ আতাউর রহমান খান যে ইঙ্গিত করেছেন তাতে মনে হতে পারে, ছয় দফা উত্থাপনে আইয়ুব খানের হাত আছে এবং আইয়ুবের তথ্যসচিব আলতাফ গওহরকে দিয়ে তিনি এটি করিয়েছেন লাহােরে বিরােধী দলের সম্মেলনটি বানচাল করে দিতে। আইয়ুব খান হয়তাে তার সমালােচকদের ঐক্য ভেঙে দিয়ে তাদের নজর তাসখন্দ চুক্তির ‘ভুল’ থেকে সরিয়ে ছয় দফার দিকে আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন।১৩ ছয় দফা হঠাৎ করে আসমান থেকে পড়েনি। দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এর তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি হচ্ছিল। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবির ১৯ নম্বর দফায় ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সংক্ষিপ্ত রূপ দেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে তৈরি হয়েছিল রাজনীতিবিদদের সঙ্গে অর্থনীতিবিদদের যুগলবন্দী, স্বাধিকারের দাবিতে যারা এক মােহনায় মিলেছিলেন। ১৯৬৪ সালের ৫ জুন এগারাে দফা দাবির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের যে ম্যানিফেস্টো লেখা হয়, তাতে ছয় দফার কথাগুলাে বলা হয়েছিল। সঙ্গে অন্যান্য দাবিও ছিল। ছয় দফা এসেছে ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে। সময়ের সঙ্গে দাবিগুলাে পরিমার্জিত হয়েছে। এর সঙ্গে সমান্তরালভাবে উঠে এসেছে দুই অর্থনীতির তত্ত্ব। পাকিস্তানের দুই অংশে যে দুটি অর্থনীতি বিরাজ করছে, এ ধারণা প্রথম ভােলা হয় ১৯৫৬ সালে। | পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৫৬-১৯৬০) জন্য উন্নয়ন কৌশল তৈরির লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদেরা ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে ঢাকায় একটি সম্মেলনের আয়ােজন করেছিলেন। ১০ জন অর্থনীতিবিদ ওই সম্মেলনে পাকিস্তানের দুটি অংশের বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি ও স্বাক্ষর করে ১৯৫৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান প্ল্যানিং কমিশনের কাছে পাঠান।
সম্মেলনে অনুমােদিত এই প্রতিবেদনটি যৌথভাবে তৈরি করেছিলেন এম এন হুদা, মাজহারুল হক, আবদুর রাজ্জাক, নুরুল ইসলাম, আবদুস সাদেক, আবদুল্লাহ ফারুক, এ এন এম মাহমুদ, সাইফুল্লাহ মুহাম্মদ হােসেন ও শফিকুর রহমান। ১৯৬১ সালের মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার দাওয়াত পান। এই দলে ছিলেন এম এন হুদা, এ এফ এ হুসেইন, আবদুল্লাহ ফারুক (মাজহারুল হকের অনুপস্থিতিতে) ও নুরুল ইসলাম। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলােচনার পর তাদের বিশ্লেষণ, সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন নুরুল ইসলাম। দলের সবাই একমত হয়ে অনুমােদন করার পর প্রতিবেদনটি প্রেসিডেন্টের সচিবের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে সুপারিশ হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছিল, কেন্দ্রের হাতে স্রেফ তিনটি বিষয় থাকবে—প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি এবং দুই অংশের মধ্যে যােগাযােগের কয়েকটি দিক।১৪ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক নুরুল ইসলাম ও রেহমান সােবহান কার্জন হলে ১৯৬১ সালের জুন মাসে দুই অর্থনীতির ওপর একটা সেমিনারের আয়ােজন করেছিলেন। সম্মেলনে পাকিস্তান প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চিফ হাবিবুর রহমান অংশ নিয়েছিলেন। সম্মেলনে নুরুল ইসলাম ও রেহমান সােবহান দুই অর্থনীতির ওপর আলােচনা করেন। পরদিন পাকিস্তান অবজারভার-এর পঞ্চম পাতার সংবাদ শিরােনাম ছিল ‘রেহমান সােবহান সেইজ পাকিস্তান হ্যাজ টু ইকোনমিজ’। ওই দিনই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকা ছেড়ে চলে যান। যাওয়ার সময় কয়েকজন সাংবাদিক দুই অর্থনীতির ওপর তার মন্তব্য জানতে চান। পরদিন পাকিস্তান অবজারভারু-এর প্রথম পাতায় খবরটি ছাপা হয়েছিল এভাবে : ‘আইয়ুব খান সেইজ পাকিস্তান হ্যাজ অনলি ওয়ান ইকোনমি’। পাকিস্তান প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান সৈয়দ হাসান রেডিওতে প্রচারিত এক ভাষণে আঞ্চলিক বৈষম্যকে বলেছিলেন ‘ডেড হর্স’ (মৃত ঘােড়া, অর্থাৎ এর অস্তিত্ব নেই) এবং বাঙালি অর্থনীতিবিদদের তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, এরা “বিদেশি শক্তির নিচুমানের গােলাম’।
এর জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক আবু মাহমুদ, আনিসুর রহমান ও রেহমান সােবহান ঢাকা টাইমস্ লিখেছিলেন, ‘ডিসপ্যারিটি : ডেড হর্স অর আ লাইভ প্রবলেম’ (বৈষম্য : মৃত ঘােড়া না জীবন্ত সমস্যা)। তারা সৈয়দ হাসানের যুক্তি খণ্ডন করেছিলেন।১৫ ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভা হওয়ার কথা ছিল। শেখ মুজিবের সন্দেহ ছিল, কার্যকরী কমিটি তাকে সমর্থন না-ও দিতে পারে। তবে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের কর্মী এবং সাধারণ মানুষ যে তাকে সমর্থন জানাবে, এ ব্যাপারে তিনি আস্থাশীল ছিলেন। কার্যকরী কমিটিতে ছয় দফা উত্থাপনের ঝুঁকি তিনি ওই সময় নিতে চাননি। লাহাের রওনা দেওয়ার আগে কার্যকরী কমিটির বৈঠকটি স্থগিত করা হয়েছিল। ছাত্রলীগের তরুণ নেতারা শেখ মুজিবের পাশে ছিলেন। লাহােরে ছয় দফা উপস্থাপনের আগে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির এক বর্ধিত সভায় একই ধরনের দাবিসংবলিত প্রস্তাব পাস হয়। পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য শিরােনামে একটি নিবন্ধ ছাত্রলীগ পুস্তিকা আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। এর ভূমিকা লেখেন ছাত্রলীগের সভাপতি মাযহারুল হক বাকী ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক। ভূমিকায় বলা হয়, বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ঔপনিবেশিক সম্পর্কের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য গ্রহণযােগ্য নয়।১৬
সুতরাং বলা চলে, আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির বাইরে শেখ মুজিবের জন্য জমি নিশ্চিতভাবেই তৈরি হয়ে ছিল। তাই কার্যকরী কমিটির অনুমােদনের তােয়াক্কা না করে শেখ মুজিব তাঁর প্রস্তাবগুলাে নিয়ে লাহােরে যাওয়ার ঝুঁকি নেন, যদিও জনগণের অনুকূল মনােভাব সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট আস্থাবান ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবের ধানমন্ডির বাসায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির এক সভায় শেখ মুজিব ছয় দফা পাস করিয়ে নিতে সক্ষম হন। উপস্থিত সদস্যদের সমর্থ আদায়ের জন্য ছাত্রলীগের সদস্যদের নিয়ে সিরাজুল আলম খান পেশিশক্তির মহড়া দিয়েছিলেন।১৭ ছয় দফা নিয়ে একটা চূড়ান্ত ফয়সালার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিব ১৮-১৯ মার্চ (১৯৬৬) ঢাকার হােটেল ইডেন প্রাঙ্গণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভা ডাকেন। সভাপতি মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের অনুপস্থিতিতে সভায় সভাপতিত্ব করেন সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। কাউন্সিল সভায় ছয় দফা অনুমােদন করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি তৈরি করা হয়। কমিটিতে নির্বাচিত অন্যান্য কর্মকর্তার মধ্যে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, হাফেজ হাবিবুর রহমান ও রাজশাহীর মুজিবুর রহমান (সহসভাপতি), মিজানুর রহমান চৌধুরী (সাংগঠনিক সম্পাদক), জহুর আহম্মদ চৌধুরী (শ্রম সম্পাদক), আবদুল মােমেন (প্রচার সম্পাদক), কে এম ওবায়দুর রহমান (সমাজকল্যাণ সম্পাদক), আমেনা বেগম (মহিলা সম্পাদক), মুহম্মদুল্লাহ (দপ্তর সম্পাদক) ও নুরুল ইসলাম চৌধুরী (কোষাধ্যক্ষ)।১৮ ছয় দফা পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে প্রচণ্ড আলােড়ন তৈরি করেছিল।
আওয়ামী লীগ ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ একটা পুস্তিকা প্রকাশ করে। ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে এটা প্রচার করা হয়। শিরােনাম ছিল, “আমাদের বাচার দাবি ছয় দফা কর্মসূচি। ঢাকার পাইওনিয়ার প্রেস থেকে শেখ মুজিবের নামে এটা ছাপা হয়েছিল। দাম রাখা হয়েছিল পঁচিশ পয়সা। এক ফর্মার (ষােল পৃষ্ঠা) এই পুস্তিকার শেষ অংশটি ছিল এ রকম: মজলুম দেশবাসীর বাঁচার দাবির জন্য সংগ্রাম করার চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছু আছে বলিয়া আমি মনে করি না। মরহুম জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ন্যায় যােগ্য নেতার কাছেই আমি এ জ্ঞান লাভ করিয়াছি। তার পায়ের তলে বসিয়াই এতকাল দেশবাসীর খেদমত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। তিনিও আজ বাঁচিয়া নাই, আমিও আজ যৌবনের কোঠা বহু পেছনে ফেলিয়া প্রৌঢ়ত্বে পৌছিয়াছি। আমার দেশের প্রিয় ভাইবােনেরা আল্লার দরগায় শুধু এই দোওয়া করিবেন, বাকি জীবনটুকু আমি যেন তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি
সাধনায় নিয়ােজিত করিতে পারি। শেখ মুজিবের নামে ছাপা হলেও এ পুস্তিকার আসল রচয়িতা হলেন আবুল মনসুর আহমদ। তিনি তখন সক্রিয় রাজনীতি থেকে অনেকটাই নির্বাসিত। তাঁর
কথাটা বিশ্বাস করিতে পারিয়াছেন। আসল সত্য তা নয়। আমি ছয় দফা রচনা করি নাই। ছয় দফার ব্যাখ্যায় বাংলা-ইংরাজি যে দুইটি পুস্তিকা আমাদের বাঁচার দাবিও আওয়ার রাইট টু লিড প্রকাশিত ও বহুল প্রচারিত হইয়াছে, এই দুইটি অবশ্যই আমি লিখিয়াছি এবং বরাবরের মতাে নির্ভুল ছাপা হওয়ার গ্যারান্টিস্বরূপ আমি নিজেই তাদের প্রুফও দেখিয়া দিয়াছি। মুজিবের ভালাের জন্যই এ কথাটা গােপন রাখা স্থির হইয়াছিল। সে গােপনতার হুঁশিয়ারি হিসেবে প্রুফ নেওয়া-আনার দায়িত্ব পড়িয়াছিল তাজউদ্দীনের উপর। মানিক মিয়া, মুজিব, তাজউদ্দীন ও আমি এই চারজন ছাড়া এই গুপ্ত কথাটা আর কেউ জানিতেন না। অথচ অল্প দিনেই কথাটা জানাজানি হইয়া গেল। মুজিব তখন জেলে। আমি ভাবিলাম, মুজিবের কোনও বিরােধী পক্ষ তার দাম কমাইবার অসাধু উদ্দেশ্যে এই প্রচারণা চালাইয়াছে। কাজেই আমি খুব জোরে কথাটার প্রতিবাদ করিতে থাকিলাম। পরে শেখ মুজিবের সহকর্মী মরহুম আবদুস সালাম খ ও জহিরুদ্দিন সাহেবানের মুখে যখন শুনিলাম, স্বয়ং মুজিবই তাদের কাছে এ কথা বলিয়াছেন, তখন আমি নিশ্চিন্ত ও আশ্বস্ত হইলাম।২০ এ ঘটনা থেকে মনে হয়, শেখ মুজিব ঋণ স্বীকার করতে জানতেন। অন্যের কাজ নিজের বলে চালিয়ে দিয়ে বাহবা নেওয়ার স্কুল আকাক্ষা তার মধ্যে তখন ছিল না। অবশ্য তার অনেক অনুসারী এতটা উদার মনের ছিলেন না। তাঁদের অনেকেই দাবি করেন, মুজিবই সবকিছু করেছেন। তারা এটা বুঝতে অক্ষম যে একজন ব্যক্তি একা সব কাজ করতে পারেন না। আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ছয় দফা গৃহীত হওয়ার পর থেকেই সরকার শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে নানা রকমের মামলা দিয়ে হয়রানি করতে থাকে। মুজিব যেখানেই যান, সেখানেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জামিন নিয়ে তিনি আবার প্রচার শুরু করেন। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ ঢাকায় কনভেনশন মুসলিম লীগের সমাপ্তি অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ছয় দফার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন যে দেশের অখণ্ডতাবিরােধী কোনাে প্রচেষ্টা সরকার সহ্য করবে না; প্রয়ােজন হলে ‘অস্ত্রের মুখে তার জবাব দেওয়া হবে। ২৪ এপ্রিল ঢাকার পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের পূর্বনির্ধারিত জনসভা ছিল। এর আগেই শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ায় পল্টনের সভায় উপস্থিত হতে পারেননি। আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা মঞ্চে একটা খালি চেয়ার রেখে জনসভার কাজ চালান। সভাপতির আসনটি শূন্য রেখে আওয়ামী লীগ প্রতীকী প্রতিবাদ জানায়। কয়েক দিন পর মুজিব জামিনে ছাড়া পান। সরকারের আক্রমণাত্মক কথাবার্তায় শেখ মুজিব ও ছয় দফার পক্ষে জনসমর্থন বাড়তে থাকে। দৈনিক ইত্তেফাক ছয় দফার পক্ষে জনমত গড়ে তােলে। অবশেষে মে মাসের ৮ তারিখ ‘পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে’ মুজিবকে।
গ্রেপ্তার করা হয়। কয়েক দিনের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের প্রায় সব প্রধান নেতাকে পুলিশ আটক করে কারাগারে নিয়ে যায়।
৯ মে জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলের নেতা নুরুল আমিন এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেপ্তারকে ‘চিন্তা ও বাকস্বাধীনতার ওপর নগ্ন হামলা বলে মন্তব্য করেন।
বিরােধী দলের উপনেতা শাহ আজিজুর রহমান এই গ্রেপ্তারকে ‘অযাচিত ও জবরদস্তিমূলক’ বলে অভিহিত করে বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের সর্বজনীন দাবি করেছিলেন। | আওয়ামী লীগ ১৯৬৬ সালের ২০ মে কার্যকরী কমিটির সভায় ৭ জুন মঙ্গলবার, সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালনের আহ্বান জানায়। ৭ জুনের হরতালের আগে ঢাকায় ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির একটি সভা হয়েছিল। এ সভায় যাতে হরতালের পক্ষে কোনাে প্রস্তাব পাস না হয়, সে উদ্দেশ্যে আইয়ুব সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ কেন্দ্রীয় সরকারের তিনজন উচ্চ পদের কর্মকর্তা ঢাকায় আসেন। তাদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে ন্যাপ কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন সদস্য ৭ জুনের হরতালের বিরােধিতা করে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এর আগে চীনভক্ত এক জননেতা মােহাম্মদ তােয়াহা, অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন, আবদুল হক ও সুখেন্দু দস্তিদারের নামে জারি করা গ্রেপ্তারি পরােয়ানা বাতিল করার জন্য গভর্নর মােনায়েম। খানের কাছে তাদের নাম পাঠিয়েছিলেন। সুখেন্দু দস্তিদার ‘হিন্দু’, এ কারণে মােনায়েম খান তার ওপর থেকে গ্রেপ্তারি পরােয়ানা তুলে নিতে অস্বীকার করেন।
বাকি তিনজনের পরােয়ানা বাতিল করা হয়। তখন ওই জননেতা মােজাফফর আহমদের নাম পাঠালে মােজাফফর আহমদের ওপর থেকে গ্রেপ্তারি পরােয়ানা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। মােজাফফর আহমদ এটা জানতেন না। ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পিকিংপন্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। তাদের ভােটে কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছয় দফা কর্মসূচির বিরুদ্ধে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল।২৩ ছয় দফা আন্দোলন এবং ৭ জুনের হরতালের আগে আওয়ামী লীগের সামনের সারির অনেক নেতা গ্রেপ্তার হয়ে যান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০ মে (১৯৬৬) হরতালের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আরও নেতা গ্রেপ্তার হন। ২ জুন গ্রেপ্তার হন প্রচার সম্পাদক আবদুল মােমেন, সমাজসেবা সম্পাদক ওবায়দুর রহমান, ঢাকা নগর সভাপতি হাফেজ মােহাম্মদ মুসা, সহসভাপতি শাহাবুদ্দিন চৌধুরী ও সহসম্পাদক রাশেদ মােশাররফ এবং নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মােস্তফা সরােয়ার। চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা মােহাম্মদ তােয়াহার নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন এবং আফতাব আলী ও ফয়েজ আহমদ পরিচালিত
আঞ্চলিক শাখার অধীনে প্রতিটি শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে দুজন করে প্রতিনিধি নিয়ে একটা বর্ধিত সভা ডাকেন। সভায় বিভিন্ন বক্তা আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিববিরােধী বক্তব্য দিলেও অবশেষে রাত দেড়টায় ‘আইয়ুব-মােনায়েম সরকারের জুলুম এবং কলকারখানার মালিকদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ৭ জুন। হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৭ জুন স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল হয়েছিল। ওই দিনের ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে অলি আহাদ লিখেছেন : ৭ জুন ঢাকা শহরে হরতালের প্রথম বেলায় বিশেষ কোনাে সাড়া জাগাতে পারেনি। কিন্তু সমগ্র পরিস্থিতির মােড় ঘুরে যায় তেজগাঁও শিল্প এলাকার মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সকাল ৮টার দিকে তেজগাঁওয়ে অবস্থিত। কোহিনূর কেমিক্যাল কো. (তিব্বত) ও হক ব্রাদার্স কো, সম্মুখস্থ রাজপথের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত একটি চায়ের দোকানে ধর্মঘটী শ্রমিক দল চা-নাস্তা গ্রহণকালে একজন শ্রমিক সাইকেলে তথায় আসিলে দোকানে উপবিষ্ট শ্রমিকদের একজন সাইকেলের হাওয়া ছাড়িয়া দেয়। এমনি আপােষী দৃশ্যে হাসি-কৌতুকের হিল্লোড় বহিয়া যায়। হঠাৎ হরিষে বিষাদ সৃষ্টি করে একটি পুলিশ জিপের আগমন। পুলিশ জিপে আগত পুলিশ শ্রমিকদিগকে লাঠিপেটা আরম্ভ করে, শুরু হয় পাল্টা শ্রমিক প্রতিরােধ। অসহিষ্ণু পুলিশের রিভলবারের গুলিতে তিনজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়। উক্ত তিনজনের মধ্যে সিলেট জেলা নিবাসী বেঙ্গল বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের শ্রমিক মনু মিয়া ঘটনাস্থলে শাহাদৎ বরণ করেন।
উক্ত হৃদয়বিদারক ঘটনার পর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সহস্র সহস্র শ্রমিক লাঠি হাতে মিছিল সহকারে পথে বাহির হইয়া পড়ে। মিছিল তেজগাঁও রেলওয়ে ক্রসিং অতিক্রমকালে উত্তরদিক হইতে আগত ট্রেনকে পথিমধ্যে থামাইয়া দেয়। ট্রেনটি পুনঃ চালাইবার চেষ্টা করিলে উহা লাইনচ্যুত হইয়া যায়। ঘটনার অব্যবহিত পরই পুলিশ ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এর সশস্ত্র বাহিনী রেললাইনের পশ্চিম দিক হইতে রেল লাইনের পূর্বদিকে অবস্থানরত শ্রমিক মিছিল ছত্রভঙ্গ করিবার প্রয়াসে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এমতাবস্থায় আকস্মিকভাবে নােয়াখালী জেলা নিবাসী আজাদ এনামেল এন্ড এলুমিনিয়াম কারখানায় ছাঁটাইকৃত শ্রমিক আবুল হােসেন পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। ইহাতে উত্তেজিত হইয়া আহত আবুল হােসেন বীরদর্পে দাঁড়াইয়া সশস্ত্র বাহিনীকে তাহার বক্ষে গুলি। করিতে আহ্বান জানান। পুলিশের উদ্যত রাইফেলের নির্মম গুলি তাহার বক্ষকে বিদীর্ণ করে। এইভাবে ধরাশায়ী শহীদ আবুল হােসেন স্বীয় তপ্ত শােণিতে মুক্তি সংগ্রামের মৃত্যুঞ্জয়ী ডাক লিখিয়া গেলেন। নারায়ণগঞ্জ শহরে ৭ জুন হরতাল উপলক্ষে কয়েক স্থানে পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ ঘটে । সর্বশেষ বােস কেবিনের নিকট জনতা রেলওয়ে ওয়াগন লুট করিবার চেষ্টা নিলে পুলিশের গুলিতে ৬ জন মৃত্যুবরণ করে।
৭ জুন গুলি করে মানুষ হত্যার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগদলীয় সদস্যরা ৮ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে জাতীয় পরিষদের এবং ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বর্জন করেন। ১৬ জুন দৈনিক ইত্তেফাক-এর সম্পাদক মানিক মিয়াকে তার ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই দিন গভর্নরের আদেশে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে ১ নম্বর রামকৃষ্ণ মিশন রােডে অবস্থিত নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়। এই প্রেস থেকে ইত্তেফাক ছাপা হতাে। ফলে ইত্তেফাক-এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায় । | কমিউনিস্ট পার্টির মতে, ৭ জুনের পর ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের জনগণ ও শ্রমিকদের ভেতর যে ব্যাপক বিক্ষোভ ও উত্তেজনা ছিল এবং সারা পূর্ববঙ্গে তখন যে অবস্থা ছিল, তাতে ওই সংগ্রামকে বিভিন্নভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ৭ জুনের পর জনগণকে আর কোনাে নেতৃত্ব দেয়নি। তাই নেতৃত্বের অভাবে ছয় দফা আন্দোলন আর অগ্রসর হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কার্যকলাপে মনে হয়েছিল, ওই আন্দোলনকে একটা যুক্তিসংগত পরিসমাপ্তিতে নিয়ে যাওয়ার কোনাে পরিকল্পনা তাদের ছিল না। বরং জনসমাবেশ ও দু-একটা হরতাল দ্বারা সরকারকে চাপ দিয়ে আপস করা ছিল তাদের নীতি। কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য আত্মসমালােচনা করেছে। ‘পাকিস্তান হওয়ার পর উহাই ছিল প্রথম ঘটনা যখন জনগণ ও শ্রমিকেরা রাস্তায় নামিয়া নিজেদের দাবির জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হইলেও শ্রমিক শ্রেণির পার্টির কর্মীরা দূরে দাঁড়াইয়া নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।২৬
৭ জুনের হরতালের সময় কমিউনিস্ট পার্টি ও তার অঙ্গসংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন পুরােপুরি নির্লিপ্ত ছিল, এ কথা বলা যাবে না। ছাত্র ইউনিয়ন ইতিমধ্যে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) এবং কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের মস্কোপন্থী অংশটি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রশ্নে আন্তরিক ছিল এবং এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে ঐক্য ও সমঝােতার নীতি গ্রহণ করেছিল। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টি সিদ্ধান্ত নিতে না পারলেও ৭ জুন হরতালের দিন শেষ সময়ে এসে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সক্রিয় সমর্থন দেওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছিল।২৭ | হরতালের দিন ছাত্র ইউনিয়নের কিছু কর্মী ঢাকা শহরে প্রচারে নেমেছিলেন। সকাল সাড়ে আটটার দিকে স্টেডিয়ামের গেটের কাছে জিন্নাহ অ্যাভিনিউ (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) এলাকায় পিকেটিং করার সময় ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, জিল্লুর রহমান মিঠু ও এ বি এম সােহরাবউদ্দিন সিরাজিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে রমনা থানায় নিয়ে যায়। সেখানে। অবাঙালি ম্যাজিস্ট্রেট মি. বখত সংক্ষিপ্ত আদালত বসিয়ে তাঁদের এক মাসের কারাদণ্ড দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেন। পরে আদালতে আপিল করে দুই সপ্তাহ পর তারা জামিন পান।২৮
১৮ জুন প্রাদেশিক পরিষদে বিরােধীদলীয় ও স্বতন্ত্র সদস্যরা একটি মুলতবি ও একটি অধিকার প্রস্তাব ওঠালে স্পিকার আবদুল হামিদ চৌধুরী তা বাতিল করে দেন। এর প্রতিবাদে বিরােধী ও স্বতন্ত্র সদস্যরা অধিবেশন থেকে। কিছুক্ষণের জন্য ওয়াকআউট করেন। তারপর একে একে শেখ ফজলুল হক মণি, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, মােল্লা জালালউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী গ্রেপ্তার হন। ২২ জুন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরীকে চাঁদপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রতিবাদে ২৮ জুন জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলের সদস্যরা দুবার ওয়াকআউট করেন। বিরােধী দলের সদস্য মাহমুদ আলী মিজানুর রহমান চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের বৈধতা সম্পর্কে তার দেওয়া নােটিশের কী হলাে, তা জানতে চান। স্পিকার তা নাকচ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান। নুরুল আমিনের নেতৃত্বে বিরােধী দলের সদস্যরা অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করেন।২৯।
১৯৬৬ সালের ৭ জুনকে অনেকেই এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করেন। বলা হয়, স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়েছিল এই দিনে। ৭ জুন ১০ জন এবং পরে আহত অবস্থায় হাসপাতালে একজন, মােট ১১ জন শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র চারজনের নাম জানা যায়—মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হক ও আবুল হােসেন। অন্যদের নাম জানা বা অনুসন্ধানের কোনাে চেষ্টা আজ অবধি হয়নি। ছয় দফাকে কেন্দ্র করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে বিতর্ক হয়। দলটিতে তখন মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী এ দুই শিবিরে তাত্ত্বিক লড়াই চলছিল এবং এর সহগামী ছাত্র ইউনিয়ন ইতিমধ্যে দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল। ছাত্র ইউনিয়নের মস্কোপন্থী গ্রুপটির অবস্থান ছিল এ রকম : আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবিকে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েমের দাবি বলেই মনে করি। এ দাবিগুলাে ঐতিহাসিক ২১ দফার ১৯ নম্বর কর্মসূচির মধ্যেই রয়েছে। স্বায়ত্তশাসনের দাবি সকল পূর্ব পাকিস্তানবাসীরই দাবি।…এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা ঘােষণা করিতেছি যে আমাদের সংগঠন ছয় দফার বিরুদ্ধে ভূমিকা গ্রহণ করবে না। বরং স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সংগ্রাম গড়ে তােলা এবং ঐক্য।
কায়েমের প্রচেষ্টাই আমরা করব।…সংগঠনের মধ্যে ছয় দফা সম্পর্কে বিভ্রান্তি থাকার ফলেই আমরা এবার স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে তথা ৭ জুনের
ঐতিহাসিক হরতালে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারিনি।” অন্যদিকে পিকিংপন্থী গ্রুপটির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বিপরীত। ১৯৬৭ সালে অনুষ্ঠিত গ্রুপটির বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থাপিত কার্যবিবরণীতে বলা হয় :
বর্তমানে ছয় দফা দাবির প্রবক্তারাও তাদের দাবিতে সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী শােষণ থেকে মুক্তির এবং শ্রমিক, কৃষক ও নিম্ন মধ্যবিত্ত জনগণের কোনাে দাবিকে স্থান না দিয়ে বলে বেড়াচ্ছে যে, ছয় দফা আদায় হলেই সব দাবি পূরণ করা যাবে, এইরূপ স্তোকবাক্যে আমরা আর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারি না । ছয় দফা দাবির নেতারা পূর্ণ সচেতনভাবেই এসব দাবি রাখেননি।…ভুল কর্মসূচির পেছনে আমরা ছুটব না। স্বায়ত্তশাসনের বুলির আড়ালে সাম্রাজ্যবাদের সহযােগী বাঙালি বুর্জোয়া, সামন্তগােষ্ঠীর একনায়কত্ব কায়েম
করতে দেব না। ৭ জুনের হরতালের পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকটাই থিতিয়ে যায় । আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা জেলে বন্দী। আমেনা বেগম ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রায় একাই দলকে নেতৃত্ব দেন। তিনিই ছিলেন নেতাবিহীন আওয়ামী লীগের ওই সময়ের কান্ডারি। এ সময় বিরােধী দলগুলাের মধ্যে একটা জোট বাঁধার চেষ্টা হয়। কয়েকজন নেতা ১৯৬৭ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকায় আতাউর রহমান খানের বাসায় সভা করে পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্ট’ (পিডিএম) নামে একটা জোট তৈরি করেন। জোটের নেতাদের মধ্যে ছিলেন এনডিএফের নুরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী ও আতাউর রহমান
খান; কাউন্সিল মুসলিম লীগের মমতাজ দৌলতানা, তােফাজ্জল আলী ও খাজা খয়েরউদ্দিন; জামায়াতে ইসলামীর মাওলানা তােফায়েল আহমদ, মাওলানা আবদুর রহিম ও অধ্যাপক গােলাম আযম; পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, আবদুস সালাম খান ও গােলাম মােহাম্মদ খান লুখাের এবং পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টির চৌধুরী মােহাম্মদ আলী, মৌলভী ফরিদ আহমদ ও এম আর খান। পিডিএম গঠন করাকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে ভাঙন দেখা দেয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম (ভারপ্রাপ্ত সভাপতি) ও আমেনা বেগমের (ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক) নেতৃত্বে একটি গ্রুপ পিডিএমে যােগ দিতে অস্বীকার করে। অন্যদিকে মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ও রাজশাহীর মুজিবুর রহমান পরিচালিত আওয়ামী লীগের ছয় দফাবিরােধী গ্রুপটি পিডিএমে যােগ দেয়। পিডিএমের পক্ষ থেকে একটা আট দফা কর্মসূচিও ঘােষণা করা হয়।
১৯ আগস্ট (১৯৬৭) ঢাকায় ছয় দফাপন্থী আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয়। দলের মােট ৯৫০ জন কাউন্সিল সদস্যের মধ্যে ৮৮৬ জন যােগ দেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, তারা পিডিএমে যােগ দেবেন না। সভায় দলের ১১ জনের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাও নােটিশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তারা হলেন আবদুস সালাম খান, জহিরুদ্দিন, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, মুজিবুর রহমান (রাজশাহী), আবদুর রহমান খান, এম এ রশিদ, রওশন আলী, মমিনউদ্দিন আহমদ, এস ডব্লিউ লকিতুল্লাহ, সাদ আহমদ ও জামালউদ্দিন খান।৩৩ নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নসরুল্লাহ খান ২৩ আগস্ট (১৯৬৭) ঢাকায় পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির এক সভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ১৯ আগস্টের কাউন্সিল সভাকে অবৈধ বলে ঘােষণা দেন। ওই দিন তিনি মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশকে সভাপতি এবং রাজশাহীর মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একটি অ্যাডহক কমিটি গঠন করেন। কমিটিতে অন্যদের মধ্যে ছিলেন সহসভাপতি মশিউর রহমান (যশাের), কোষাধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম চৌধুরী (ঢাকা) এবং সদস্য আবদুস সালাম খান (ফরিদপুর), মিয়া আবদুর রশিদ ও রওশন আলী (যশাের), আবদুর রহমান খান, ডা. সুলতান আহমদ ও আহমদ আলী (কুমিল্লা), মতিউর রহমান (রংপুর), রহিমউদ্দিন আহমদ ও আবদুর রহমান চৌধুরী। (দিনাজপুর), সাদ আহমদ ও আবদুর রউফ (কুষ্টিয়া), এস ডব্লিউ লকিতুল্লাহ (বরিশাল), মােমিন উদ্দিন আহমদ (খুলনা), আবদুল হাই ও জালালউদ্দিন আহমদ (সিলেট), দেওয়ান শফিউল আলম (ঢাকা), মনসুর আলী (পাবনা), বি।
এম ইলিয়াস (বগুড়া) ও জুলমত আলী (ময়মনসিংহ)। তারা সবাই ছিলেন ছয় দফাবিরােধী।৩৪ ছয় দফাপন্থীরা ২৭ আগস্ট (১৯৬৭) নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটি পুনর্গঠন করেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি এবং আবুল হাসনাত মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে কার্যকরী কমিটির সদস্য হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম (ময়মনসিংহ), মিজানুর রহমান চৌধুরী, খন্দকার মােশতাক আহমদ ও আমেনা বেগম (কুমিল্লা), আমজাদ হােসেন ও হােসেন মনসুর (পাবনা), মেহরাব হােসেন ও আফজাল হােসেন (যশাের), শাহ আজিজুর রহমান (কুষ্টিয়া), এ বি এম নুরুল ইসলাম (ফরিদপুর), আবদুল মালেক উকিল, মুহম্মদুল্লাহ ও নুরুল হক (নােয়াখালী), বাহাউদ্দিন চৌধুরী (বরিশাল), শেখ আবদুল আজিজ (খুলনা), জাকিরুল হক (চট্টগ্রাম), মাহিবুস সামাদ (সিলেট) ও শামসুল হক, হাফেজ মুসা ও তাজউদ্দীন আহমদ (ঢাকা)।৩৫ কমিটিতে মােট ৪৮ সদস্যের মধ্যে ২৪ জন ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের। তাঁদের অন্যতম ছিলেন মালিক হামিদ সরফরাজ, চৌধুরী নাজিরুদ্দিন, সৈয়দ আবু আছিম, সৈয়দ খালিদ আহমদ তিরমিযী, সৈয়দ শাহ বােখারী ও মােহাম্মদ মােরতাজা। ১৮ সেপ্টেম্বর (১৯৬৭) ঢাকায় আওয়ামী লীগ অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে কামারুজ্জামান কমিটি ঘােষণা করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির প্রথম সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে (তখন কারাগারে বন্দী) কামারুজ্জামানকে স্থায়ী আহ্বায়ক নির্বাচন করা হয়।৩৬
এ সময়ের আরেকটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা হলাে ন্যাপের দুই ভাগ হয়ে যাওয়া। পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির মধ্যে উগ্রপন্থার প্রতি একটু ঝোঁক ছিল। ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ স্লোগান দিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সমাজতান্ত্রিক ভারত প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের তত্ত্ব গ্রহণ করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেও সশস্ত্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রবণতা ছিল। এ নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি ও দলাদলি হয়েছে। দলে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হলে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে মেরুকরণ ঘটে।৩৭। ১৯৬৪ সাল থেকেই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন মস্কো ও পিকিং এ দুই শিবিরে ভাগ হতে শুরু করে। ১৯৬৫ সালের ১-৩ এপ্রিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভার শেষ দিনে কমিউনিস্ট পার্টির সহযােগী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে ভাগ হয়ে যায়। ডাকসুর সহসভাপতি রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে পিকিংপন্থী গ্রুপটি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে একটি কমিটি তৈরি করে। মস্কোপন্থী গ্রুপটি ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক হল) আরেকটি কমিটি গঠন করে। এর পর থেকে পিকিংপন্থী গ্রুপটি ‘মেনন গ্রুপ’ এবং মস্কোপন্থী গ্রুপটি মতিয়া গ্রুপ’ নামে পরিচিতি পায়। ছাত্র ইউনিয়নের বিভক্তির প্রক্রিয়ায় ন্যাপও দুই ভাগ হয়। ন্যাপের মস্কোপন্থী অংশটি দলের কাউন্সিল সভা ডাকার অনুরােধ জানিয়ে সভাপতি মওলানা ভাসানীকে চিঠি দেয় । চিঠির জবাব না দিয়ে ভাসানী রংপুরে কাউন্সিল সভা করেন। এবং শৃঙ্খলা ভাঙার অভিযােগে সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হােসেনসহ কয়েকজনকে দল থেকে বের করে দেন। মস্কোপন্থী অংশটি ১৯৬৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় কাউন্সিল সভা করে অধ্যাপক মােজাফফর আহমদকে প্রাদেশিক ন্যাপের সভাপতি নির্বাচন করে।৩৯
সূত্রঃ আওয়ামী লীগ-উত্থান পর্ব-১৯৪৮-১৯৭০ – মহিউদ্দিন আহমদ