চট্টগ্রামের নৌ-কমান্ডাে অপারেশন
স্থলভাগে মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন কার্যকর গেরিলা অপারেশন পাকিস্তানি সেনাদের। ব্যতিব্যস্ত করে তুললেও বাংলাদেশের জলপথ ছিল তাদের জন্য নিরাপদ। ফলে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নদী ও সমুদ্রবন্দরগুলা অস্ত্র খালাস ও সৈন্য অবতরণের ক্ষেত্রে নির্বিঘ্নে ব্যবহার করে আসছিল। নদী ও সমুদ্রবন্দরগুলাের। অবাধ ব্যবহার এবং এসব স্থানে তাদের বিচরণ বন্ধ করা মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য। অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সহযােগিতায় অকুতােভয় মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে। গঠন করে দুঃসাহসিক এক নৌ-কমান্ডাে বাহিনী। এ বাহিনীর অসীম সাহস, ত্যাগ আর বীরত্বের গাথায় পরিপূর্ণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত। মুক্তিযুদ্ধের গতিতে দ্রুততা ও কার্যকারিতা এবং প্রকৃতিতে ভয়াবহতা এনেছিল। নৌ-কমান্ডােদের সফল ও তাৎপর্যপূর্ণ নৌ অভিযান।
আন্তর্জাতিক প্রচারের ক্ষেত্রে। প্রায় স্তিমিত এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অনিবার্য কারণে খানিকটা ঝিমিয়ে পড়া। মুক্তিযুদ্ধের গতিতে তড়িৎপ্রবাহের সৃষ্টি করে নৌ-কমান্ডােদের চমক লাগানাে। অভিযানগুলাে। তাদের কার্যকর অভিযানগুলাে বিজয় অর্জনের গতিকে ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি নতুনত্বে ঐশ্বৰ্য্যমণ্ডিত করে। এ প্রসঙ্গে নৌ-কমান্ডাে মাে. খলিলুর রহমান বলেন মধ্য আগস্ট থেকে বিজয় অর্জন পর্যন্ত নৌ-কমান্ডােরা বাংলাদেশের। জলসীমায় ৪৫টি দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে শত্রু বাহিনীর প্রায় ৭৫ হাজার মেট্রিক টন যুদ্ধাস্ত্র ও সামগ্রী সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত এবং প্রায় ১ লক্ষ টন আংশিক বা প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেন। এ ক্ষতির পরিমাণ নয় মাসের যুদ্ধে দখলদার বাহিনীর সম্পূর্ণ ক্ষতির অর্ধেকের সমান (মাে. খলিলুর রহমান, ১৯৯৭: ৫০)। নৌ-কমান্ডােদের অবদান সম্পর্কে Capt. S.K Garg উল্লেখ করেন: …By August 1971, the Mukti Bahini’s frogmen operations had turned the East-Bengal waters into a zone of peril for hostile shipping, which was ferrying war materials, especially to Chittagong and Chalna. Here, limpet mines had been freely planted. In September, two British ships, CHAKDINA a 10,000 ton freighter and TEVIOT – a 16,000 ton tanker, were badly damaged by sabotage operations. In those operations, the saboteurs were always far away from their bases. Many others ships were also damaged or sunk in Chittagong and Chalna ports (Palit, 1972, p.59). On 12 October, naval guerrillas performed a daring feat by steering out a Mukti Bahini gunboat into the open sea, all by itself, with no river craft accompanying it and singly attacked a British cargo boat, the 7,000 ton CITY OF ST. ALBANS, peppering out its hull. It was finally forced to limp back to Calcutta (Garg, 1984: 126-127).
নৌ-কমান্ডােদের এ অতুলনীয় সাফল্য, একাগ্রতা, রণকৌশল, দেশপ্রেম ও অনন্য অবদান বাঙালি জাতির ইতিহাসে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। নৌ-কমান্ডাে বাহিনী গঠন ও প্রশিক্ষণ নৌ-কমান্ডাে বাহিনীর গঠন সম্পর্কে হুমায়ন হাসান তার মুক্তিযুদ্ধের জলসীমায় নামক গ্রন্থে বলেন .বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। এ দেশের সর্বত্র অসংখ্য আকাবাকা পথে নদ নদীর বুনন ইতস্তত ছড়িয়ে আছে অক্টোপাসের জালের মতাে। এমন একটি নদীবহুল দেশে সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রশ্নে নৌ-অভিযানের গুরুত্ব অগ্রগণ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটির প্রতি বিশেষ নজর দেয়া সম্ভব হয়নি। যৌক্তিক কারণেই। যার ফলে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্বে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ যখন প্রতিরােধযুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ওই সময়ের মধ্যে পাকিস্তান নৌবাহিনীর যেসব বাঙালী নৌসেনা কিংবা নৌ অফিসার পক্ষ ত্যাগ করে তাদেরকে প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ করতে হয়েছে স্থল মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে মিশে গিয়েই । আলাদা করে কোনাে নৌ ফ্রন্ট খােলা সম্ভব হয়নি। আলাদা বিমান বাহিনী গঠনের ক্ষেত্রেও ছিল একই সমস্যা। নৌ ফ্রন্ট খােলার কথা বাদ দিলেও এপ্রিলের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে নৌ অপারেশন চালানাের মতাে কোনাে গেরিলা কমান্ডাে বাহিনী গঠনের কথাও বিবেচনা করা হয়নি। বস্তুত এটা প্রথম চিন্তা করা হয় তুলন থেকে পালিয়ে আসা সাবমেরিনারদের উৎসাহকে কেন্দ্র করেই (হুমায়ন হাসান, ১৯৯৪: ৫৮)।”
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অগ্রগতির এক পর্যায়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। স্থলবাহিনীর পাশাপাশি একটি নৌবাহিনী গড়ার পরিকল্পনা করে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সমগ্র অভ্যন্তরীণ জলপথ, উপকূলবর্তী এলাকাসহ চট্টগ্রাম ও চালনা সমুদ্রবন্দর নিয়ে গঠিত হয় ১০ নম্বর সেক্টর। এ সেক্টর গঠনের উদ্দেশ্য ছিল জলপথে পাকিস্তানি সেনাদের যাতায়াতে বিপর্যয় ঘটানাে এবং তাদের চলাচল সীমিত করা। এমন পরিস্থিতিতে এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে চাকরিরত ফ্রান্সে একটি সাবমেরিন কোর্সে প্রশিক্ষণরত ১৩জন। বাঙালি নাবিক বিবিসিতে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার খবর পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হন। তাঁরা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বিবিসিতে পাকিস্তান বাহিনীর রােমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে উত্তেজনা আর প্রতিহিংসায় জ্বলে ওঠেন। উদ্বুদ্ধ হন একান্ত জাতীয়তাবাদী চেতনায়। কিন্তু তাঁরা তাঁদের বিপ্লবী চেতনা ও পাকিস্তান বিরােধী মনােভাব এবং নতুন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের। তীব্র আকাক্ষা ঘুণাক্ষরেও পাকিস্তানিদের বুঝতে দেন নি।
সংগােপনে তারা ঠিক করে নেন, কীভাবে পাকিস্তানিদের এ বৃত্ত থেকে বের হয়ে দেশমাতৃকার সেবায় ও স্বাধীনতায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া যায়। এ বিষয়ে তারা পরবর্তী কর্তব্য সম্পর্কে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। তারা ঠিক করেন, যে করেই হােক পাকিস্তানিদের ফাকি দিয়ে ফ্রান্সের এ তুলন নৌ ঘাটির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাবেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়েছে, সরাসরি তাতে যােগ দেবেন। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত প্রশিক্ষণরত বাঙালিরা কয়েক দফা গােপন বৈঠক শেষে গৃহীত পরিকল্পনামাফিক এক দিন তুলন ঘাটি থেকে বেরিয়ে পড়েন। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেওয়া। ১৩জনের মধ্যে ৮জন বাঙালি নাবিক ভারতীয় দূতাবাসের সহযােগিতায় এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে ভারতে এসে পৌঁছেন। নিকটবর্তী যমুনা নদীতে বাংলাদেশ সরকারের আগ্রহ এবং ভারত সরকারের সহযােগিতায় এ ৮জন নাবিককে ২২ এপ্রিল থেকে ৮ মে, ১৯৭১ পর্যন্ত ভারতীয় নৌবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় দিল্লির বিশেষ নেী-প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ।
হুমায়ন হাসানের তথ্য মতে:মি, শর্মার ব্যবস্থাপনায় তাঁরা দিল্লির পার্শ্ববর্তী যমুনা নদীতে বিশেষ নৌপ্রশিক্ষণের প্রস্তুতি নেয়। প্রশিক্ষণ দেবার দায়দায়িত্ব অর্পিত হলাে ভারতীয় নৌবাহিনীর অফিসার এস কে দাসের ওপর। টানা ২০ দিন ধরে চলে কঠোর ও শ্রমসাধ্য এ প্রশিক্ষণ। ২৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে তা শেষ হয় ১৫ মে (হুমায়ন হাসান, ১৯৯৪: ৪৬)।” পরবর্তী সময় আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিসরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য কার্যকর ও উপযােগী একটি নৌ-কমান্ডাে বাহিনী গড়ে তােলার লক্ষ্যে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার পলাশির ভাগিরথী নদীর তীরে ১৯৭১ সালের ১৩ মে ‘C-2-P’ সাংকেতিক নাম দিয়ে একটি নৌক্যাম্প খুলে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের নৌ-কমান্ডাে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবেই ইতিহাসের পলাশি, যেখানে স্বাধীনতার সূর্য এক দিন অস্তমিত হয়েছিল, সেখানেই আবার এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য পুনরুদ্ভবের জন্য। | ভারতীয় অধিনায়ক এম এন আর সামন্তের সহযােগিতায় প্রাথমিকভাবে টাকিপুর, মেলাঘর, অস্পিনগর, কাঠালিয়া, হাতিমারা, বক্সনগর, ৯১ বিএসএফ প্রভৃতি যুবশিবির থেকে ৩৫৭জন সুঠাম দেহী বাঙালি যুবককে নৌ-কমান্ডাে অপারেশনের জন্য মনােনীত করা হয়। এ প্রসঙ্গে হুমায়ন হাসানের তথ্য: ১৫ মে দিল্লির নিকটবর্তী যমুনা নদীতে সংক্ষিপ্ত মেয়াদের নৌ-প্রশিক্ষণ শেষ করেন ফ্রান্সের তুলন থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি নৌসেনারা। তাদেরই প্রত্যক্ষ উদ্যোগে এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী ও ভারতীয় নৌবাহিনীর একান্ত সহায়তায় ওই ঘটনার ১২ দিন পর ২৭ মে পূর্ণাঙ্গ পরিসরে নৌ-প্রশিক্ষণ ক্যাম্প সচল করা হয় পলাশিতে (হুমায়ন হাসান, ১৯৯৪ : ৪৮)।” পলাশি ক্যাম্পের প্রশিক্ষণের প্রাথমিক পর্যায়ে ১,০০০ সদস্যের একটি শক্তিশালী, দক্ষ ও কুশলী নৌ-কমান্ডাে বাহিনী গড়ে তােলার প্রশিক্ষণ শুরু হয়। কিন্তু বাস্তবে কঠোর প্রশিক্ষণ ও দুঃসাহসী এ অভিযান চালানাের জন্য উপযুক্ত মুক্তিযােদ্ধা তাৎক্ষণিকভাবে সংগ্রহ করা সম্ভব না হওয়ায় পূর্বপরিকল্পিত মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হয়। অবশেষে এ সংখ্যা এসে দাড়ায় ৩১৫জনে।
সীমান্তবর্তী ট্রানজিট ক্যাম্পগুলাে থেকে বাছাইকৃত মুক্তিযােদ্ধাদের পলাশী নৌপ্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আনা-নেয়ার জন্য ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি সামরিক ডাকোটা বােয়িং বিমান সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত রাখা হয়। বাছাই পর্ব শেষে এ বিমান হরিণা, অস্পিনগর, টাকিপুর, কাঁঠালিয়া, হাতিমারা, মেলাঘর প্রভৃতি ট্রানজিট ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধাদের বয়ে নিয়ে যাওয়া হতাে কলকাতা পর্যন্ত। নৌ-কমান্ডাে বাহিনী গঠনের ক্ষেত্রে ভারতীয় সামরিক অফিসাররা নেতৃত্ব দিলেও বাংলাদেশের পক্ষে এতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী, মেজর জলিল এবং ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি সাবমেরিনাররা। তবে। ভারতীয় নৌবাহিনীর অফিসার কমান্ডার এম এন আর সামন্ত এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সর্বোচ্চ গােপনীয়তার মধ্য দিয়ে নৌ-কমান্ডােদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। নৌকমান্ডােদের এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ছিল খুবই কঠোর ও শ্রমসাধ্য। দৈনিক প্রায় ১৮ ঘণ্টা তারা প্রশিক্ষণে ব্যয় করতেন। প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে নৌ-কমান্ডােরা বুকে পাথর বেঁধে সাঁতার শেখা, পানির নিচে বিস্ফোরণ ঘটানাের কৌশল, গ্রেনেড ছােড়া, রাইফেল চালানােসহ ব্রিজ ও কালভার্ট ইত্যাদিতে বিস্ফোরণ ঘটানাের কৌশল এবং অস্ত্রবিহীন রণকৌশল প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতেন। প্রতিদিন সূর্যোদয়ের আগেই অন্ধকারে শুরু হতাে নৌ-কমান্ডােদের কঠিন প্রশিক্ষণ পর্ব। কমান্ডােরা প্রথমেই যােগ দিতেন শারীরিক ব্যায়াম অর্থাৎ পিটিতে। তারপর তারা যেতেন কমব্যাট প্রশিক্ষণে।
এ কমব্যাটে জুডাে-কারাতে প্রভৃতি বিষয়ে অনুশীলন করানাে হতাে। এসব প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার মহড়াতেও অংশ নিতে হতাে প্রশিক্ষণার্থী নৌ-কমান্ডােদের। প্রশিক্ষণের শুরুতেই নৌ-কমান্ডােরা সমস্বরে জাতীয় সংগীত ও শপথবাক্য পাঠ করতেন। প্রশিক্ষণের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব শেষ হওয়ার পর তাঁরা ছােটো ছােটো দলে ভাগ হয়ে খরস্রোতা ভাগীরথীর ঘােলা পানিতে নেমে স্রোতের উভয়। দিকেই দীর্ঘক্ষণ ধরে বিভিন্ন ধরনের সাঁতার কাটার অনুশীলন করতেন। এ অনুশীলন শেষ হওয়ার পর বিশ্রাম এবং সকালের নাশতা। তারপর সাঁতারের কৌশল ও বিভিন্ন অপারেশন কৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণের পর দুপুরের বিশ্রাম। দুপুরের খাবারের পর বিকালে আবার শুরু হতাে দ্বিতীয় পর্বের প্রশিক্ষণ এবং এটি ছিল সামগ্রিক প্রশিক্ষণের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। এরই ফাকে ফাকে চলত আক্রমণ মহড়া। ২ মাস ১৭ দিনের প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষ হয় ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট। তবে হুমায়ন হাসানের মতে, প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণের মে নকল ছি ১৯৭১ সালের ২৭ মে থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত। নৌ-ক্যাম্পের এ র ফি হলেন ভরত নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার জর্জ মাটিস, লে, না কর নস, কে কপিল জুনিয়র অফিসার ছিলেন কে সিং, আই সিং, মি, ভ , পি কে গুপ্তা, চমন সিং, কুন্দর সিং, লাল সিং।
একই সাথে অক্লান্ত পরিশ্রম ও যত্ন নিয়ে নৌ-কমান্ডােদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ফ্রান্স থেকে আগত ৮জন। বাঙালি নৌসেনা। ক্যাম্পের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর গােয়েন্দা কর্মকর্তা কমান্ডার সামন্ত। প্রশিক্ষণ বিষয়ে নৌ-কমান্ডাে রহমতউল্লাহ বলেন: The training started in full swing on the concurrence of the Indian authority. The training manual included the following programme: (a) minimum 9 to 10 hours swimming. such as surface swimming, under water swimming, swimming with weight of limpetmine, swimming with fins and without fins; soundless swimming at night, operation tactics; (b) demolition practice; (c) grenade throwing practice; (d) use of small arms; (f) unarmed combat practice; and final 18 hour practice in the river Bhagirathi near Plassey where we lost our independence in 1757 A.D. This historical place inspired our boys to undergo so much hard and tedious training to get back the independence of our beloved motherland. The training life was so miserable that boys even could not be supplied with salt to have their food, nor the Government of Bangladesh could take interest for us. (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড, ১৯৮৪: ৬২৪) পরিকল্পনা। পাকিস্তানি শত্রুদের জাহাজ ও নৌযান ধ্বংস, তাদের নৌ যাতায়াত ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টিসহ সৈন্য চলাচল, রসদ ও যুদ্ধসামগ্রী পরিবহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পরিকল্পনা মাফিক নৌ-কমান্ডােদের পাঠানাে শুরু হয়।
প্রথম ব্যাচের ৩৫৭জন কমান্ডাের মধ্য থেকে বাছাইকৃত ১৬০জন নৌ-কমান্ডােকে বিভিন্ন দলে ভাগ করে একজন সমন্বয়কারীর অধীনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত করা হয়। প্রথম অভিযান চালানাের জন্য নির্ধারিত হয় মংলা, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, চাদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও দাউদকান্দি নদীবন্দর। সমন্বয়ক হিসেবে ছিলেন মংলা ও হীরন পয়েন্টের জন্য সাবমেরিনার কমান্ডাে আহসানউল্লাহ। এ দলে ছিলেন মােট ৬০জন নৌ-কমান্ডাে। চট্টগ্রাম বন্দর অভিযানে ছিলেন সাবমেরিনার আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী। তার তত্ত্বাবধানে এ দলে ছিলেন মােট ৬০জন নৌ-কমান্ডাে। নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর অভিযানে ছিলেন। সাবমেরিনার আবদুর রহমান। এ দলে ছিলেন মােট ২০জন নৌ-কমান্ডাে। এ ২০জনের মধ্য থেকে ৯জন কমান্ডােকে পৃথক করে শাহজাহান সিদ্দিকীসহ দাউদকান্দি ফেরিঘাটে আক্রমণের জন্য আলাদাভাবে পাঠানাে হয়। চাঁদপুর নদীবন্দর অভিযানে নেতৃত্ব দেন সাবমেরিনার মােঃ বদিউল আলম। এ দলে ছিলেন মােট ২০জন নৌ-কমান্ডাে। চট্টগ্রাম সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তু হওয়ায় আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ৬০জনের নৌ-কমান্ডাের গ্রুপটিকে ৩টি উপদলে ভাগ করে এগুলাের দায়িত্ব দেওয়া হয় যথাক্রমে ডা. মােহাম্মদ শাহ আলম, মােঃ মাজাহার উল্লা ও আব্দুর রশীদকে। ঠিক হয়, এঁদের মধ্যে ডা. মােহাম্মদ শাহ আলম, মােঃ মাজাহার উল্লার উপদল ২টি স্থলপথে ১৩ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরে পৌছবে। আর আব্দুর রশীদের নেতৃত্বাধীন দলটি চট্টগ্রামে প্রবেশ করবে জলপথ দিয়ে। পরে ঐ পরিকল্পনা পরিবর্তন করা হয়।
প্রতিটি গ্রুপকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তারা যেন কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত সংকেতের ভিত্তিতে যার যার দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় ১৪ আগস্ট রাত ১২টায় অপারেশন শুরু করে। আরও পরিকল্পনা করা হয়, নৌকমান্ডাে গ্রুপগুলােকে বিভিন্ন গাইড পর্যায়ক্রমে তাদের অপারেশন স্থলে নিয়ে যাবেন। পরিবর্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ওয়াহিদ চৌধুরীকে সমন্বিত দলের নেতৃত্বের পাশাপাশি ২০জনের একটি গ্রুপেরও দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার দায়িত্ব ছিল, তার নেতৃত্বাধীন গ্রুপটিকে সীমান্ত পার করিয়ে চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত পৌছানাে। নৌ-কমান্ডাে অপারেশনের জন্য অন্য ২টি গ্রুপের যাত্রা পথের নেতা নির্বাচন করা হয় ফারুক-ই-আযম ও শাহ আলম নামক অন্য দুজন কমান্ডােকে। এ ৩টি গ্রুপ ভারত সীমান্ত থেকে ৩টি ভিন্ন পথে চট্টগ্রামের নির্ধারিত স্থান কর্ণফুলি নদীর ওপারে চরলৈক্ষার আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে পৌছবে। আরও ঠিক হয়, ৩টি গ্রুপের মধ্যে ২টি গ্রুপ- ১ নম্বর ও ২ নম্বর গ্রুপ স্থলপথে মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড হয়ে চট্টগ্রাম গিয়ে পৌছবে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় যাত্রা পথের আশ্রয় কেন্দ্র থেকে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ছােটো ছােটো দলে ভাগ হয়ে তারা মাঝিরঘাট দিয়ে কর্ণফুলি পার হয়ে চরলৈক্ষায় গিয়ে আশ্রয় নেবে। এখানেই ছিল অপারেশন পূর্ব সর্বশেষ ঘাটি। ২০জন কমান্ডাের তৃতীয় গ্রুপটি শাহ আলমের নেতৃত্বে নৌপথে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একই আশ্রয় কেন্দ্রে পৌছাবে। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট সংকেত অনুযায়ী ৩টি গ্রুপের পুরাে দলটি মূল অপারেশন শুরু করবে।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড