আগ্রাবাদ কলােনির ট্রান্সফর্মার অপারেশন
গেরিলা যুদ্ধের নীতি অনুসারে মুক্তিযােদ্ধারা ট্রান্সফর্মার অকেজোকরণের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানি সরকারকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ফেলে মনােবল দুর্বল করে দিতে চেয়েছিলেন। তা ছাড়া তারা জনগণ ও নিজেদের মনােবল, আস্থা বৃদ্ধি করার প্রয়াসে এ ট্রান্সফর্মারে অপারেশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে নিজেদের সরব ও শক্তিশালী উপস্থিতির প্রমাণ দিতেও তারা ইচ্ছুক ছিলেন। নুরুল আলম মন্টু আগ্রাবাদ কলােনির ট্রান্সফর্মার সন্নিহিত এলাকাটি অপারেশনের পূর্বে বেশ কয়েক বার পর্যবেক্ষণ করে বিস্তারিত তথ্যসগ্রহ করেন। পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কেসি-২ গ্রুপের অধিনায়ক ডা. মাহফুজ ঐ অপারেশনের মূল পরিকল্পনা করেন এবং নুরুল আলম মন্টুকে তা পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করেন। দায়িত্ব বুঝে নেয়ার পর আগ্রাবাদের বেপারীপাড়ার আশ্রয় কেন্দ্র থেকে নুরুল আলম মন্টুর নেতৃত্বে আরও দুজন সহযােদ্ধা অপারেশনের দিন প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাত আনুমানিক আটটার দিকে অপারেশন স্থলের দিকে যাত্রা শুরু করেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা ট্রান্সফর্মারের কাছে পৌছেন। তারা অপারেশন শুরু ও শেষ করার এবং শত্রুর উপস্থিতি বােঝানাের জন্য সিগন্যাল হিসেবে পাখির বিভিন্ন আওয়াজ ঠিক করে রাখেন। অপারেশন শেষে নিরাপদে ফিরে যাওয়ার জন্য তারা পিছনের কচুক্ষেতের আইলগুলাে আগে থেকেই দেখে নিয়েছিলেন। অপারেশন স্থলে পেীছে ট্রান্সফর্মারের পাইলনটিতে বিস্ফোরক লাগান দল নেতা।
নুরুল আলম মন্টু। অন্য ২জন তাকে সহযােগিতা করেন। বিস্ফোরক লাগানাে সম্পন্ন করে দ্রুত ফিউজে অগ্নিসংযােগ করা হয়। ৫ মিনিটের মধ্যে বিকট শব্দে ট্রান্সফর্মারটি বিস্ফোরিত হয়। তারপর তারা বেপারীপাড়ার আশ্রয় কেন্দ্রে ফিরে আসেন। এ অপারেশনে তারা ১টি রিভলভার, বিস্ফোরক (২টি টিএনটি স্ল্যাব) ফিউজ ও দিয়াশলাই ব্যবহার করেন। এটি মন্টু গ্রুপের প্রথম ও সফল অপারেশন। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আলম মন্টু। সম্পাদকের টীকা: সাক্ষাৎকার ছাড়া এ অপারেশন সম্পর্কিত ডা. মাহফুজুর রহমান রচিত, বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বইয়ের ৩৬৫ পৃষ্ঠায় প্রাপ্ত তথ্য: আগ্রাবাদ কলােনি সন্নিহিত বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মারটি ধ্বংস করেন ডা, জাহাঙ্গীর কবির ও তাঁর সাথীরা।
রাজাকার আবুল হাকিমকে হত্যা
কুখ্যাত পাকিস্তানি সহযােগী রাজাকার আবুল হাকিম আনােয়ারা থানার চানখালী এলাকায় পাকিস্তান সরকারের ইনফর্মার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী নানা ধরনের কুকর্মে লিপ্ত ছিল। সে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং এলাকা রাজাকার মুক্ত করার উদ্দেশ্যে। রাজাকার আবুল হাকিমকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। মুক্তিযােদ্ধা এনামুর রশিদ চৌধুরী অধিনায়ক শাহজাহান ইসলামাবাদীর নির্দেশে ছদ্মবেশে আবুল হাকিমের বাড়ি পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি রাজাকারের বাড়িতে প্রবেশের সহজ রাস্তা, তার চলাচল প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য জোগাড় করেন। এনামুর রশিদের কাছ থেকে। পর্যবেক্ষণ রিপাের্ট পাওয়ার পর অধিনায়ক ইসলামাবাদী রাজাকার হাকিম হত্যার। পরিকল্পনা করেন। তিনি ঠিক করেন, পরের শুক্রবার (জুন মাসের এদিনে রাজাকার হাকিমের মেয়ের বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছিল) মুক্তিযােদ্ধারা বরযাত্রীর ছদ্মবেশে অন্যদের সাথে বাড়িতে ঢুকে সবাই চারদিকে অবস্থান নেবে, এবং সুযােগমতাে হাকিমকে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হবে।
অপারেশনের আগের দিন ৩০-৪০জনের মতাে মুক্তিযােদ্ধারা প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে হাকিমের বাড়ির পার্শ্বস্থ এক হিন্দু মুক্তিযােদ্ধা সহযােগীর বাড়িতে আশ্রয় নেন।
পরদিন অর্থাৎ শুক্রবার বেলা ২টার দিকে তারা বরযাত্রীর ছদ্মবেশে অন্য বরযাত্রীদের ভিড়ে নিরাপদে হাকিমের বাড়িতে ঢুকে পড়েন। তারপর দ্রুত বাড়ির চারদিকে অবস্থান নেন। এক পর্যায়ে নিজেদের দলের একজন রাজাকার হাকিমকে দেখিয়ে দিলে মুক্তিযােদ্ধা বশর ও হাবিব তার ওপর অতর্কিত আক্রমণ ‘চালান। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাকিম ঘটনাস্থলে লুটিয়ে পড়ে এবং পরে মারা যায়। সন্ত্রস্ত বরযাত্রীরা ভয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা নিরাপদে অধিনায়ক ইসলামাবাদীর ক্যাম্প চন্দনাইশের আড়ালিয়া চরে ফিরে আসেন। এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধারা ৭৮টি রাইফেল, ৩-৪টি গ্রেনেড ও ১টি এসএলআর ব্যবহার করেন। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা এনামুর রশিদ চৌধুরী ও মাে, জানে আলম।
চিড়িঙ্গি ফরেস্ট বিটে অপারেশন
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে চিড়িঙ্গি ফরেস্ট বিটে গেরিলা অপারেশন পরিচালিত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের এটি ছিল প্রয়ােজনীয় পর্যবেক্ষণ এবং তথ্যসগ্রহভিত্তিক একটি পরিকল্পিত প্রতিরক্ষা অবস্থান। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণও ছিল পরিকল্পিত। এটি ছিল দুই পক্ষের জন্যই প্রকৃত যুদ্ধস্বরূপ। পূর্বপশ্চিমে প্রবহমান কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণ পাড়ে ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বিএলএফ গ্রুপের (সাতকানিয়া, পটিয়া, বােয়ালখালী, বাঁশখালী, আনােয়ারা) সাথে এখানে যােগ দেয় রাঙ্গুনিয়া গ্রুপ। রাঙ্গুনিয়া গ্রুপের প্রধান ছিলেন আবু সালেহ। সবার নেতৃত্বে ছিলেন তঙ্কালীন রাকসু জিএস নুরুল। আলম। মুক্তিবাহিনীর মােট জনবল ছিল ৩০-৪০জন। পরিকল্পনা মতাে প্রতিরক্ষা অবস্থানের দুই পাশে মুক্তিযােদ্ধারা এক মাইলব্যাপী। অ্যাসল্ট লাইন ফর্মে অস্ত্রসহ অবস্থান নেন। উদ্দেশ্য, শত্রুর সব আগমন পথ মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রের আওতায় রাখা এবং নদীর এপারে আসা ঠেকিয়ে দেওয়া। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের যৌথ অবস্থান ছিল নদীর উত্তর পাড়ে বাওয়ানি জুট মিল এলাকায়। ওরা ভারী অস্ত্র সজ্জিত ২টি গানবােটসহ দুই দিক থেকে একসাথে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। মুক্তিযােদ্ধাদের কা%