রাঙ্গীপাড়া যুদ্ধ
বৈরাগী বাজার হতে আনুমানিক ৩ কিলােমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে রাঙ্গীপাড়া অবস্থিত। বর্ষা মৌসুমে এ এলাকার চতুর্দিকে জলবেষ্টিত থাকে। তবে দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর দিকে ২-১ মাস পরই পানি কমে যায়। শুধু পশ্চিম দিক বছরের প্রায় সব সময়ই জলবেষ্টিত থাকে। পূর্ব দিকে গহীন জঙ্গলে উপজাতিদের বাস। তাদের একমাত্র উপজীব্য জুমচাষ। সংলগ্ন এলাকার সমতল ভূমিতে ধান ও অন্যান্য সবজির চাষ হতাে। এলাকায় আনুমানিক ৩০০-৪০০ লােকের বসতি ছিল। এর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল পাহাড়ি । এ এলাকার পশ্চিম পাশেই ফরেস্ট অফিস। উত্তর-পূর্ব কোণের পাহাড়ের পাদদেশ থেকে কাকুজ্জাছড়া নামে একটি ছড়া প্রবাহিত হয়ে রাঙ্গীপাড়ার মধ্য দিয়ে পশ্চিমে মাইনী ও লংগদু নদীতে পড়ে। তবে বিশেষ করে শুকনা মৌসুমে দক্ষিণ-পূর্ব, উত্তর-পূর্ব এবং উত্তর দিক হতে সরু পায়ে চলা পথে খুব কষ্টে রাঙ্গীপাড়া আসতে হতাে। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে লংগদু ও মাইনী হতে প্রায় ১০০জন পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের সহযােগী মিজো বাহিনী বৈরাগীবাজার আসে। আনুমানিক ১০-১৫ দিন পর পাকিস্তানি সেনার ১০-১২জনের ১টি দল রাঙ্গীপাড়ায় একটি ক্যাম্প স্থাপন করে এবং চতুর্দিকে পরিখা খনন করে পূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেয়। ২-১ দিন পর আরও প্রায় ৫০-৬০জন পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের সহযােগী মিজো বাহিনী রাঙ্গীপাড়ায় স্থাপিত ক্যাম্পে আসে। তাদের কাছে অন্যান্য অস্ত্র ছাড়াও মটার ছিল।
রাঙ্গীপাড়া এলাকায় যে-সব পাকিস্তানি সেনা এবং মিজো বাহিনী ছিল তাদের বেইস ক্যাম্প ছিল, বৈরাগীবাজারে এবং সদর দপ্তর ছিল লংগদু। স্থানীয় জনসাধারণের কাছ থেকে জানা যায়, ২২জনের একটি মুক্তিবাহিনী দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মােঃ সিরাজুল ইসলাম রব্বানী। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানায়। ২২জনের এ দলটি নিয়ে তিনি ১৯৭১ সালের আগস্ট সেপ্টেম্বরের দিকে পূর্ব ভারতে গিয়েছিলেন এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে ভারতের দেমাগিরি দিয়ে ছােটো হরিণা, নড়ল হেডম্যানপাড়া (পাংকুপাড়া) এবং কাকুজ্জাছড়া হয়ে রাঙ্গীপাড়া আসেন। পাকিস্তানি সেনাদের জনবল বেশি থাকায় তারা পুনরায় ভারতে ফিরে যান। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ৩০-৩৫জন মুক্তিবাহিনী এবং ৭০৭৫জন মিত্র বাহিনীর সদস্যসহ সর্বমােট ১৫০জনের ১টি দল ভারতের দেমাগিরি হতে হরিণা হয়ে গুইছড়ি নামক স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। এখানে তারা চতুর্দিকে পরিখা খনন করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেয়। পুঁইছড়িতে এক দিন অবস্থান করার পর সেখানে ১৫-২০জন মুক্তিবাহিনী রেখে বাকি ১৩০-১৩৫জন মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সদস্য রাঙ্গীপাড়ার দিকে অগ্রসর হয়। আনুমানিক সকাল ৮টায় রাঙ্গীপাড়ার বর্তমান হেলিপ্যাড আর্মড পুলিশ ক্যাম্পের টিলার নিচে পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব দিকে অবস্থান নেয়। আনুমানিক ১ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণের পর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী একই সাথে রাঙ্গীপাড়াস্থ টিলায় অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়।
প্রায় ৩ দিন প্রচণ্ড গােলাগুলির পর পাকিস্তানি বাহিনী রাঙ্গীপাড়া টিলায় অবস্থিত ক্যাম্প হতে পিছু হটে বৈরাগীবাজারে চলে যায় এবং একই দিনে বৈরাগীবাজার ছেড়ে লংগদুতে অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী রাঙ্গীপাড়া ও বৈরাগীবাজার দখল এবং আধিপত্য বিস্তার করে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ১জন সৈনিক মারা যায়। মুক্তিবাহিনীর কেউ হতাহত হন নি। তবে রাঙ্গীপাড়া এলাকার অধিবাসী নূর মােহাম্মদ ও মাে. আইনুল্লাহ নামের ২জন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন। এখানে উল্লেখ্য যে, রাঙ্গীপাড়া ও বৈরাগীবাজার যুদ্ধে ২জন মিজো সৈন্য গুরুতর আহত হয় এবং পরে তাদেরকে লংগদুতে নিয়ে আসার পথে মারা যায়। ঐ ২জন মিজো সৈন্যের কবরের চিহ্ন লংগদু উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সরকারি বাসভবনের সন্নিকটে এখনাে বিদ্যমান। মাইনীমুখে ১জন সুবেদারের নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১০-১২জনের ১টি দল ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত অবস্থান করেছিল। এ দলটি বর্তমান কেপিএম-এর অফিসে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। তা ছাড়া রাঙামাটি থেকে মাঝে মাঝেই উর্ধ্বতন পাকিস্তানি অফিসাররা স্পিডবােটযােগে লংগদু ও মাইনীমুখ আসত। বনবিভাগের রেস্ট হাউজ (মাইনীমুখ বাজারের উত্তর পার্শ্বে) ও মাইনীমুখ বাজারের মধ্যখানে মিজো বাহিনীর প্রায় ১৫০জন সৈন্য ১জন মেজরের নেতৃত্বে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেছিল। মাইনীমুখ বাজারের চতুর্দিকেই মিজো বাহিনী পরিখা খনন করে প্রতিনিয়ত প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত ছিল।
লংগদুতেও মিজো বাহিনীর মেজর পদবির ১জন অফিসারের নেতৃত্বে ২ কোম্পানি সৈন্য অবস্থান করতাে। তারা এখান থেকেই রাঙ্গীপাড়া, বৈরাগীবাজার ও আশপাশের এলাকায় টহল দিয়ে প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করত। বৈরাগীবাজারের পতনের কিছুদিন পর মুক্তিবাহিনী প্রায় নিয়মিতভাবেই লংগদু ও মাইনীমুখ বাজারে মিজো বাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর মর্টারের গােলা নিক্ষেপ করত। এ ব্যাপারে মুক্তিবাহিনীকে সর্বতােভাবে সহায়তা দানকারী তৎকালীন কিশাের এখলাস (বর্তমানে হেডম্যান ও সাংবাদিক) তাঁর স্মৃতিচারণের সময় মিজো বাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের বিষাদময় কাহিনী বর্ণনা করেন। মুক্তিবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের ভয়ে মিজো বাহিনী মাইনীমুখ ও লংগদুর অবস্থান ত্যাগ করে স্থলপথে মহালছড়ির দিকে চলে যায়। যাওয়ার পূর্বে তারা তাদের বিভিন্ন রসদসামগ্রী পানিতে ফেলে নষ্ট করে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে জানা যায়।
সলিয়াদিঘি এলাকায় মুক্তিবাহিনী বেশ দৃঢ়ভাবে প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তােলে। মুক্তিবাহিনীর এ অবস্থানে ১১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি ৭ নভেম্বর ভাের পৌনে পাঁচটায় আক্রমণ চালায়। অগ্রবর্তী ঘাটিতে অবস্থানরত ইপিআর হাবিলদার শহিদ তাঁর প্লাটুন নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরােধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাকিস্তানিদের আকস্মিক তীব্র হামলার মুখে ইপিআর হাবিলদার শহিদসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা বন্দি হন। শেষ পর্যন্ত তারা হাবিলদার শহিদকে বেয়নেটের খােচায় হত্যা করে। দেশ হানাদার মুক্ত হলে হাবিলদার শহীদের সঙ্গে বন্দি তাঁর শ্যালকের কাছ থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। সলিয়াদিঘিতে সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। ৭ নভেম্বর বেলা ৩টায় পাকিস্তানি ২টি জঙ্গিবিমান মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হাতাহাতি সংঘর্ষও হয়।
তথ্যসূত্র: ৩০৫ পদাতিক ব্রিগেড কর্তৃক প্রস্তুতকৃত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক পুস্তিকা।
(রাঙ্গীপাড়া যুদ্ধের নকশাটি ১১৬৮ পাতায়)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড