You dont have javascript enabled! Please enable it! নতুন মুরংপাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহতকরণ - সংগ্রামের নোটবুক
নতুন মুরংপাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহতকরণ
প্রেক্ষাপট
ইদগা সেতুতে দ্বিতীয় বারের মতাে সফল অভিযান শেষে মুক্তিযােদ্ধাদের দল আবার তাদের হাইড আউট নতুন মুরংপাড়ায় নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করে। এটা একই সাথে তাদের ট্রেনিং ক্যাম্পও ছিল। মুরংপাড়ার আদিবাসীরা মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য বেশ কয়েকটি ঘর খালি করে দিয়েছিল। ইদগা সেতুতে মুক্তিবাহিনীর হাতে বিপর্যস্ত হওয়ার খবর দ্রুত পৌছে যায় ইপিসিএএফ-এর ৬১তম ব্যাটালিয়ন সদরে। এবার প্রতিশােধ গ্রহণের জন্য ক্ষিপ্ত হয় ওঠে পাকিস্তানি হানাদাররা। তারা এজন্য প্রথমে এলাকার মানুষের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করে সংগ্রহ করে নেয়। মুক্তিযােদ্ধাদের নতুন মুরংপাড়া ক্যাম্প সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় তথ্য। সে অনুসারে পাকিস্তানি বাহিনী মুরংপাড়া মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
ক্যাম্পের বর্ণনা ও তথ্য
নতুন মুরংপাড়া ক্যাম্পটি বর্তমান কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার সীমারেখায় অবস্থিত। বার্মা থেকে দেশে প্রবেশের পর কক্সবাজারের মুক্তিযােদ্ধারা জোয়ারিয়ানালা ও ইদগা সেতুর অপারেশন শেষে নতুন মুরংপাড়া এলাকাকেই তাদের ক্যাম্প হিসেবে নির্বাচন করেন। ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার পর এখান থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ ও অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করেন। নিরাপত্তার প্রয়ােজনে পাহাড়ের ওপর মুরংপাড়াকে ঘিরে চতুর্মুখী প্রতিরক্ষা বাংকার তৈরি করা হয়। উত্তর-পশ্চিম, পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী ৩টি অবজারভেশন পােস্ট তৈরি করা। হয়। তা ছাড়াও ছিল বিভিন্ন ডিউটি ও অ্যালার্ম পােস্ট। ক্যাম্পে অবস্থান করা প্রায় শ’ খানেক মুক্তিযােদ্ধাকে কঠোর সামরিক শৃঙ্খলা মেনে চলতে হতাে। তবে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রধান সমস্যা ছিল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রধান উপকরণ অটোম্যাটিক অস্ত্রের অনুপস্থিতি। প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত এবং পরে বিভিন্ন অপারেশনে দখলকৃত হাতিয়ারগুলাের সবই ছিল সিঙ্গেল শট .৩০৩ অথবা মার্ক ফোর। তা ছাড়া পর্যাপ্ত অ্যামুনিশনেরও ঘাটতি ছিল।
যুদ্ধের বর্ণনা পাকিস্তানি আক্রমণ
১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা ইদগা সেতুর সফল অপারেশন করার পর পাকিস্তানি ইপিসিএএফ ব্যাটালিয়ন নতুন মুরংপাড়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প সম্পর্কে অবহিত হয়ে এতে আক্রমণ করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে মাত্র এক দিন সময় নেয়। ইপিসিএএফ-এর ২টি কোম্পানি এবং বিভিন্ন ইউনিয়নে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা রাজাকার ও পুলিশ নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর জনবল দাঁড়ায় প্রায় ৪০০জন। অটোম্যাটিক ও সাপােটিং অস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ এ আক্রমণকারী দলের নেতৃত্বে ছিল ১জন পাকিস্তানি মেজর। তাকে সহায়তা করে ২জন ক্যাপটেন ও কয়েকজন জেসিও। পাকিস্তানি দলটি মূলত ৩টি ভাগে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্প এলাকার দিকে অগ্রসর হয়। প্রথম দলটি রামু-জোয়ারিয়ানালা-মনিরাজ পাড়া, দ্বিতীয় দলটি রামু-জোয়ারিয়ানালা-ফরেস্ট অফিস-নালা এবং তৃতীয় দলটি রামুইদগা-ইদগড় পথে অগ্রসর হয়। ভাের সাড়ে ৬টা। তখন এক দিন আগে অপারেশনে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলাে পরিষ্কার করছিলেন মুক্তিযােদ্ধারা। পশ্চিমের অবজারভেশন পােস্টে পরিমল বাবু, নুরুল ইসলাম আর সিরাজুল হক দায়িত্ব পালন করছিলেন। হঠাৎ বাইরের নালার পানি প্রবাহের শব্দটা অন্য রকম মনে হয় সিরাজুল হকের কাছে। কিন্তু বিষয়টি আমল দেন নি অন্য ২জন সাথী। এর ৫ মিনিটের মধ্যে অস্ত্রের বাটের সাথে পাথরের আঘাতের শব্দ পাওয়া গেলে দ্রুত চারদিক পর্যবেক্ষণ করেন ৩জন প্রহরী। তারা দেখেন, পাকিস্তানি সৈন্য ক্যাম্পের একেবারে নিচে চলে এসেছে। সবাইকে সতর্ক করার জন্য হাতে সময় কম বিধায় হাতের রিভলভারের একটি গুলি ছােড়েন সিরাজুল হক। উদ্দেশ্য, ক্যাম্পের সবাই অন্তত এতে সতর্ক হবে। সাথে সাথে সতর্ক হলাে সব কয়টি পােস্ট। হাবিলদার সােবহানের নেতৃত্বে ৪জন এনসিও পােস্টগুলাের কাছে দ্রুত এসে পৌছান। উদ্দেশ্য, শক্রর গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা নেয়া এবং করণীয় স্থির করা।
প্রতিরােধ যুদ্ধ
প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে বােঝা যায় ক্যাম্প দখলের জন্য ত্রিমুখী আক্রমণ করতে যাচ্ছে পাকিস্তানিরা। এর মাঝেই শত্রু মর্টার হামলা শুরু করে। দ্রুত নির্দিষ্ট বাংকারগুলােয় অবস্থান নেন মুক্তিযােদ্ধারা। শুরু হয় দুই পক্ষের গুলি বিনিময়। মুক্তিযােদ্ধারা পাহাড়ের ওপরে থাকায় কৌশলগত দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী সংখ্যা ও অটোম্যাটিক অস্ত্রের শক্তিতে এর সুফল প্রাপ্তিকে ব্যাহত করে। সকাল ৭-১০টা পর্যন্ত প্রায় ৩ ঘন্টা চলে এ গুলি বিনিময়। ক্রমাগত গুলি বর্ষণে মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামুনিশন প্রায় শেষ হয়ে আসে। সৌভাগ্যক্রমে পাকিস্তানি বাহিনী চতুর্মুখী আক্রমণ করে নি। সে জন্য ৫০০ গজ দূরে উত্তর-পূর্ব দিকের। পাহাড়টিতে তখন পর্যন্ত প্রয়ােজনীয় আড়াল বিদ্যমান। সেটাই এখন মুক্তিযােদ্ধাদের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। সে, বিবেচনায় সেখানেই পশ্চাদপসরণ। করার আদেশ দেন হাবিলদার সােবহান। শুধু থেকে যায় ছােটো একটি দল। মুক্তিযােদ্ধাদের ফায়ার স্তিমিত হয়ে আসতেই বিশৃঙ্খলভাবে পাহাড়ে ওঠার। প্রতিযােগিতা শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে। এ সুযােগে ওদের হতবাক করে দিয়ে গর্জে ওঠে অপেক্ষমাণ মুক্তিযােদ্ধাদের ছােটো দলটির হাতিয়ার। শত্রুপক্ষের। ১৪জন গুলিবিদ্ধ হয়। এ পর্যায়ে দ্রুত মূল দলের সাথে যােগ দেয় দলটি। তারপর আবার মর্টার ও হেভি মেশিনগানের গােলা বর্ষণের সহায়তায় ক্যাম্প এলাকায় উঠে আসে পাকিস্তানি বাহিনী। কিন্তু কোনাে মুক্তিযােদ্ধাকে তারা পায় নি। ক্রোধে আর হতাশায় সমগ্র ক্যাম্প আর মুরংদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। মুরংপাড়ার অনেক অধিবাসীকে সামনে পেয়ে হত্যা করে।
বিশ্লেষণ
মুরংপাড়া ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের একটি গুপ্ত আশ্রয় এবং এটি থেকে মুক্তিযােদ্ধারা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করে আসছিলেন। গুপ্ত আশ্রয়টি দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। কৌশলগত দিকগুলাে লক্ষ্য রেখেই এ গুপ্ত আশ্রয়টি নির্বাচন করা হয়েছিল এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল বলেই শত্রুপক্ষ আকস্মিকতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। তা ছাড়া সংখ্যায় প্রায় চতুগুণ এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়েও শক্র বাহিনী তেমন কোনাে পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম হয় নি। মুক্তিযােদ্ধারাও গুপ্তাশ্রয় তাদের আয়ত্তে রাখতে ব্যর্থ হয়; যা ছিল রণকৌশল সিদ্ধ। কেননা, সেখান থেকে কখনাে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যুদ্ধ পরিচালনা করা হয় না। বরং রণকৌশলের নিয়মে বর্তমান অবস্থান ছেড়ে দিয়ে নতুন অবস্থান প্রতিষ্ঠাই স্বাভাবিক। তবে পালিয়ে যাওয়ার পথ এমনভাবে হওয়া উচিত, যাতে শত্ৰু কোনাে বাধা ও কতির সৃষ্টি করতে না পারে। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযােদ্ধারা নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করতে সক্ষম হন। এ ঘটনা থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের উন্নত রণকৌশল প্রয়ােগের বিষয়টি পরিছন্নভাবে ফুটে উঠেছে। পর্যবেক্ষণ চৌকি ও তাতে প্রহরার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে মুক্তিযােদ্ধারা পারদর্শিতার ছাপ রেখেছেন। তা ছাড়া শত্রুর আক্রমণে কভারিং দলের গুলি বর্ষণের আবরণে মূল দলের গুপ্ত আশ্রয় ত্যাগের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক পরিকল্পনায় মুক্তিযােদ্ধাদের দক্ষতা প্রতীয়মান। দৃঢ় মনােবলের সাথে তারা ফায়ার শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রেখে শত্রুর বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযােগ গ্রহণ। করেন। ফলে শক্র যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং কভারিং দল নিরাপদে মূল। দলে যােগ দিতে সক্ষম হয়। গুপ্তাশ্রয় ত্যাগে কৌশলগত যে-সব নিয়মনীতি রয়েছে, তা সফলভাবে প্রয়ােগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এটি একটি দৃষ্টান্তমূলক অপারেশন হিসেবে গেরিলা যুদ্ধের বিশেষ স্থান দখল করেছে।
তথ্যসূত্র: ১. সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা অনারারি ক্যাপটেন সােবহান। ২. দৈনিক পূর্বকোণ, ১৩ মে, ১৯৯৩। ৩. দৈনিক কক্সবাজার, ৩ মার্চ, ২০০২। ৪. দৈনিক পূর্বতারা, ৯ জানুয়ারি, ১৯৯৩। (নতুন মুরংপাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহতকরণের নকশাটি ১১৬৪ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড