কদুরখিল নাপিতপাড়া অপারেশন
উদ্দেশ্য
সেপটেম্বরের শেষের দিকে বােয়ালখালী থানার মুক্তিবাহিনীর ৩টি গ্রুপ কদুরখিল নাপিতপাড়া এলাকায় রাজাকারদের অত্যাচার ও প্রভাব বন্ধ করার উদ্দেশ্যে কদুরখিল ডিসি রােডের ওপর রাজাকারদের যাতায়াত পথে অ্যামবুশ করার পরিকল্পনা করেন।
পরিকল্পনা
এই অ্যামবুশের পরিকল্পনায় মুক্তিবাহিনীর ক্যাপটেন করিম গ্রুপ, গােপাল দাশ গ্রুপ ও সােলায়মান গ্রুপ জড়িত ছিল। অ্যামবুশ সফল করার লক্ষ্যে প্রায় ৪০জন মুক্তিযােদ্ধা ২টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে উল্লিখিত রােডে অবস্থান নেন। তাঁদের সাথে ছিল ৩টি এলএমজি, ১৫-১৬টি এসএলআর ও ২০টির মতাে .৩০৩ রাইফেল।
অপারেশন
পরিকল্পনা অনুযায়ী, গােপাল দাশ গ্রুপ ক্যাপটেন করিমের নেতৃত্বে ১টি গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাট অফ পাটি’ বা বাধা প্রদানকারী দল হিসেবে কদুরখিল ডিসি রােডে রাতের অন্ধকারে অবস্থান নেন। সােলায়মান গ্রুপ ‘ফায়ারিং পাটি’ হিসেবে। তাদের পিছনে অবস্থান নেয়। রুটিন অনুযায়ী ভােররাতে রাজাকারদের ১টি গ্রুপ এ রাস্তা ধরে নাপিতপাড়ার দিকে যায়। বাধা প্রদানকারী দল বা কাট অফ পার্টি এদেরকে সামনে যেতে দেয়। রাজাকার বাহিনী এগােতে এগােতে সােলায়মানের নেতৃত্বে থাকা মূল দলের ফায়ারিং রেঞ্জের মধ্যে এলে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ওপর গুলি চালান। হতচকিত রাজাকার বাহিনী কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিনা প্রতিরােধে ভয়ে অস্ত্র ফেলে দৌড়ে পালানাের চেষ্টা করে। সােলায়মান গ্রুপ পিছন থেকে ধাওয়া করে এদের ৪১জনকে হত্যা এবং ৫জনকে গ্রেপ্তার করে।
ফলাফল
অ্যামবুশ স্থান থেকে ৪১টি ৩০৩ রাইফেল উদ্ধার করা হয়। পরে মুক্তিযােদ্ধারা এ স্থান ত্যাগ করে চান্দারহাটে পুনরায় একত্রিত হন। এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। পক্ষান্তরে, মুক্তিবাহিনী ৪১জন রাজাকার হত্যা ও ৫জনকে গ্রেপ্তারসহ ৪১টি রাইফেল উদ্ধার করে। এ অপারেশনে করিম গ্রুপ ফায়ার ওপেন করে নি। রাজাকার হতাহত হওয়ার পরদিন পাকিস্তানি বাহিনী রাজাকারদের সাথে মিলে নাপিতপাড়ায় গণহত্যা চালায় এবং বাড়িঘরে অগ্নি সংযােগ করে। তবু এ অপারেশনের পর ঐ এলাকায় রাজাকারদের নিয়মিত যাতায়াত বন্ধ হয় এবং তারা মুক্তিবাহিনীর ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর এ সফল অপারেশন জনমনে আশা ও আস্থার সঞ্চার করে। অনেক যুবক উৎসাহী হয়ে মুক্তিবাহিনীতে যােগ দেন।
বিশ্লেষণ
কদুরখিল নাপিতপাড়ায় রাজাকারদের ওপর অ্যামবুশ মুক্তিযােদ্ধাদের একটি অত্যন্ত সফল অপারেশন। লক্ষ্যবস্তু নির্বাচনে এবং নির্বাচিত লক্ষ্যবস্তুকে যথাস্থানে ধ্বংস করার ব্যাপারে তারা দক্ষতার পরিচয় দেন। এ অপারেশন ছিল একটি পরিকল্পিত অপারেশন, যাতে সমন্বিতভাবে ৩টি গ্রুপ নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে অ্যামবুশ পরিকল্পনা করে। অ্যামবুশে যাওয়ার পূর্বে ক্যাপটেন করিম নিজে অ্যামবুশ স্থান পর্যবেক্ষণ করে অবস্থান গ্রহণের স্থান নির্ধারণ করেন। রাতের অন্ধকার ব্যবহার করে ২টি গ্রুপ। নিজ অবস্থানে পৌঁছে এবং অতর্কিত আক্রমণের মাধ্যমে আকস্মিকতা অর্জনে সমর্থ হয়। এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রাপ্তি ছিল অনেক। প্রথমত, এ অপারেশনের মাধ্যমে অনেক অস্ত্র তাদের হস্তগত হয়, যা পরবর্তী সময় তারা ব্যবহার করেন। দ্বিতীয়ত, এতে রাজাকার বাহিনী সমুচিত শিক্ষা লাভ করে এবং বিপথগামী জনগণ। হক বাহিনীতে যােগদান থেকে বিরত থাকে। তৃতীয়ত, এ অপারেশন। ক্তিক জনগণের মাকে আর প্রদীপকে উজ্জ্বলতর করতে সহায়তা করে।
তথ্যসুত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা বনগােপাল দাশ, তারিখঃ ৩১ মে, ২০০২। সম্পাদকের টীকা: ডা. মাহফুজুর রহমান রচিত, বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম গ্রন্থের ৪৫৯ পৃষ্ঠায় এ অপারেশন-সম্পর্কিত নিমলিখিত তথ্য আছে।
ক, যুদ্ধটি হয়েছিল কদুরখিলের মিলন মন্দিরের কাছে। খ, অপারেশনে অংশগ্রহণ করে ক্যাপটেন করিম গ্রুপ, সার্জেন্ট আলম গ্রুপ, আবুল
হােসেন গ্রুপ ও শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপ।
(কদুরখিল নাপিতপাড়া অপারেশনের নকশাটি ১১৪৮ পাতায়)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড