You dont have javascript enabled! Please enable it! চন্দনাইশ থানার বলতফল ইউনিয়ন পরিষদ আক্রমণ - সংগ্রামের নোটবুক
চন্দনাইশ থানার বলতফল ইউনিয়ন পরিষদ আক্রমণ
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র যে-কোনাে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে পর্যাপ্ত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল না। ‘মািন্য যে কয়টি অস্ত্র তাদের কাছে ছিল, এর সাহায্যেই তাঁরা রাজাকার বাহিনীর প্রভূত ক্ষতিসাধনে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই তাদের দমন করতে মিলিশিয়া ও রাজাকার বাহিনী মুক্তিযােদ্ধার এলএমজি হস্তগত করার জন্য পরিকল্পনা করেছিল। শত্রুপক্ষের এ পরিকল্পনা নস্যাৎ করার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদেরও পালটা অপারেশন করতে হয়।
পরিকল্পনা
আনােয়ারা থানার তিশরী গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা ইনফর্মার মারফত খবর পান এক দল রাজাকার ও মিলিশিয়া সশস্ত্র অবস্থায় তাদের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের উদ্দেশ্য মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে থাকা এলএমজি দখল করে। যুদ্ধের সক্ষমতা হ্রাস করা। এ খবর পাওয়ার সাথে সাথে মুক্তিযােদ্ধা ইদ্রিস ও মঞ্জুর। পরিকল্পনা করেন যে, রাজাকার ও মিলিশিয়াদের দলটিকে অ্যামবুশে ফেলে তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করতে হবে।
অপারেশন
তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৬-১৭জন মুক্তিযােদ্ধার গ্রুপটি তিশরী গ্রাম থেকে প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে দুই দলে ভাগ হয়ে এক দল অধিনায়ক ইদ্রিসের নেতৃত্বে, অন্য দল মুক্তিযােদ্ধা মঞ্জুরের নেতৃত্বে বরকল বাংলাবাজারে অবস্থান গ্রহণ করে। রাজাকার ও মিলিশিয়াদের দলটি ঐ স্থানে এলে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ওপর গুলি বর্ষণ শুরু করেন। রাজাকারদের দলটি আকস্মিক এ আক্রমণের মুখে পালটা। গুলি বর্ষণ না করে দৌড়ে চন্দনাইশ থানার বলতলি ইউনিয়ন পরিষদে প্রতিষ্ঠিত রাজাকার ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। মুক্তিবাহিনী তাদের পিছু ধাওয়া করে এসে ঐ ইউনিয়ন পরিষদের পাশে দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অবস্থান নেয়। এক ভাগ ইউনিয়ন পরিষদের পার্শ্বস্থ পুকুর পাড়ে, অপর দল পরিষদের সামনে ধানক্ষেতে অবস্থান। নিয়ে কালবিলম্ব না করে ইউনিয়ন পরিষদের ওপর গুলি বর্ষণ শুরু করে। ইউনিয়ন পরিষদের ভিতর থেকে রাজাকাররাও পালটা আক্রমণ করে। রাজাকারদের গুলিতে মুক্তিযােদ্ধা এস এম সবুর গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে শহিদ হন। তারপরও মুক্তিযােদ্ধারা ইউনিয়ন পরিষদে গােলাগুলি অব্যাহত রাখেন। এভাবে অনেকক্ষণ গােলাগুলি চলার পর মুক্তিযােদ্ধাদের গুলি প্রায় নিঃশেষ হয়ে এলে, উপরন্তু রাজাকারদের ওপর এ আক্রমণে কোনাে উল্লেখযােগ্য প্রভাব বিস্তার করতে না পেরে তারা স্বীয় অবস্থান ত্যাগ করে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধারা ১টি এলএমজি, ২টি এসএমজি, ৩টি এসএলআর এবং ৫-৭টি রাইফেল ব্যবহার করেন।
ফলাফল
মুক্তিযােদ্ধা এস এম সবুর শহিদ হন। তবে রাজাকার ও মিলিশিয়া গ্রুপটি যে উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ করতে এগিয়ে এসেছিল, ১জন সহযােদ্ধা হারালেও মুক্তিযােদ্ধারা তাদের সে উদ্দেশ্য ব্যর্থ করতে সমর্থ হন এবং পাশাপাশি তাদের মনে ভীতির সঞ্চারও করতে পেরেছিলেন। পরাজয়ের কারণ মুক্তিযােদ্ধারা বিস্তারিত পরিকল্পনা ছাড়া শত্রুর শক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ফলে তুলনামূলক স্বল্প লােকবল ও অস্ত্রবলে শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত গােলবারুদের অভাবে তাদের অপারেশন ব্যর্থ হয়।
বিশ্লেষণ
এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধাদের মূল লক্ষ্য ছিল অ্যামবুশের মাধ্যমে রাজাকারদের যে দলটি তাদের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করা। মুক্তিযােদ্ধারা সেই কাজে সম্পূর্ণ সফল হলেও পরবর্তী সময়ে তাদের ধাওয়া করে পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া শত্রুর শক্ত অবস্থানে আঘাত হানার প্রচেষ্টা ছিল তাঁদের অদূরদর্শিতার পরিচায়ক। এ ক্ষেত্রে অপারেশনের শেষ ভাগে তাদের কর্মকাণ্ডে কৌশলের চেয়ে আবেগের প্রাধান্য অধিক ছিল। ফলে তাদেরকে ক্ষতির শিকার হতে হয়েছিল। যে-কোনাে যুদ্ধে লক্ষ্য নির্ধারণ ও তাতে অটল থাকা যুদ্ধের সাফল্যের বড়াে একটি দিক এ ক্ষেত্রে তাদের মূল লক্ষ্য পূরণের পর অপরিকল্পিতভাবে অপর্যাপ্ত জনবল ও অস্ত্রসহ অন্য লক্ষ্যে তাৎক্ষণিকভাবে ধাবিত হওয়ায় শেষ পর্যন্ত অপারেশনটি সফলতার বিপরীতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তথ্যসূত্র: সাক্ষাক্তার: মুক্তিযােদ্ধা প্রদ্যুৎ কুমার পাল (দুলাল)। (চন্দনাইশ থানার বলতলি ইউনিয়ন পরিষদ আক্রমণের নকশাটি ১১৪৫ পাতায়) 

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড