ধােপাছড়ি ফরেস্ট অফিসে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ
অবস্থান
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পূর্ব দিকে এবং বর্তমানে চন্দনাইশ থানার অন্তর্গত পাহাড়ি অঞ্চলে ধােপাছড়ি বাজারের অবস্থান। ধােপাছড়ি বাজারের আশেপাশের অঞ্চল ছিল বনজঙ্গল সমাকীর্ণ ও পাহাড় বেষ্টিত।
প্রেক্ষাপট
দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে অপারেশন পরিচালনার পর সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এমপিএ’র নেতৃত্বে এক দল মুক্তিযােদ্ধা ধােপাছড়ি বাজার ও সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নেন। উদ্দেশ্য ছিল, কিছুদিন এ স্থানে অবস্থান করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা। তখনকার প্রেক্ষাপটে মুক্তিযােদ্ধাদের বিশেষ প্রয়ােজন ছিল উন্নত প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, গােলাবারুদ ও অন্যান্য সহায়তা। অঞ্চলটি জঙ্গল ও পাহাড় বেষ্টিত হওয়ায় গােপন আস্তানা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল, যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে কিছুদিন অবস্থান করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম হতে নতুন মুক্তিযােদ্ধা সংগ্রহ করা যায় এবং পরবর্তীকালে তাদের নিয়ে ভারত গমন করা সম্ভব হয়। আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল, এ অঞ্চলে যুদ্ধে নিয়ােজিত যােদ্ধাদের সাথে সংযােগ স্থাপন করে তাদের প্রয়ােজন ও সমস্যাদি অনুধাবন করা। সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এমপিএ’র নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি ধােপাছড়ি বাজার ও সংলগ্ন এলাকায় ৩টি উপদলে বিভক্ত হয়ে কৌশলগতভাবে সুবিধাজনকভাবে অবস্থান করলেও শক্রর সম্ভাব্য আক্রমণকে বিবেচনা করে তাদের অবস্থান নির্ধারণ করা হয়। ৩টি উপদলের অবস্থান ছিল নিম্নরূপ: প্রথম দল: হাবিলদার আসহাব উদ্দিনের নেতৃত্বে ১০-১৫জন মুক্তিযােদ্ধার দলটি ধােপাছড়ি বাজারে অবস্থান নেয়। তাদের মূল দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানি বাহিনী ধােপাছড়ি বাজার দিয়ে আক্রমণ করলে প্রতিহত করা, যাতে অন্য ২টি দল নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে পারে। তারপর সুবিধামতাে নিজেদের সরে যাওয়া। দ্বিতীয় দল: সুজাইয়াত আলীর নেতৃত্বে এ দলে ৩০-৩৫জন মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। তাদের অবস্থান ছিল ধােপাছড়ি ফরেস্ট অফিসে। এ দলে সুলতান আহমদ কুসুমপুরী এমপিএ অবস্থান করছিলেন।
তৃতীয় দল: হাবিলদার আবু ইসলামের নেতৃত্বে এ দল গুনুমিয়ার পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান নেন। তাদের দায়িত্ব ছিল উত্তর দিক থেকে সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহতকরণ। ৮ নভেম্বর বিকাল আনুমানিক ৪টার সময় পাকিস্তানি বাহিনী গাছবাড়িয়া থেকে সড়ক পথে এসে ধােপাছড়ি বাজারে প্রথম দলের অবস্থানে হামলা করে। ধােপাছড়ি বাজারে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা তখন অসতর্কভাবে অবস্থান করছিলেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় হতচকিত হয়ে কোনাে বাধাদানের চেষ্টা না করে পিছু হটে যান। এ দলের মুক্তিযােদ্ধাদের কারাে পক্ষে অন্যান্য দলকে খবর দেওয়ারও সুযােগ ছিল না। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী ধােপাছড়ি বাজারে স্বীয় অবস্থান দৃঢ় করে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত ফরেস্ট হিলে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের ওপর ক্রমাগত গুলি বর্ষণ করতে থাকে।
উল্লেখ্য, ফরেস্ট হিলে যাতায়াতের একমাত্র পথ ছিল ধােপাছড়ি বাজারের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযােদ্ধারাও পালটা গুলি বর্ষণ করতে থাকেন। প্রচণ্ড গােলাগুলির শব্দ শুনে পার্শ্ববর্তী গুনুমিয়ার পাহাড়ে অবস্থানরত হাবিলদার আবু ইসলামের নেতৃত্বে তৃতীয় দল পাহাড়ি নালা বেয়ে দ্বিতীয় দলের সাহায্যের জন্য পৌছান। কিছুক্ষণ গােলাগুলির পর গােলাবারুদ নিঃশেষ হয়ে গেলে মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের প্রত্যাহার করে উত্তর দিকে পাহাড়ের মধ্যে অবস্থান নেন। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রত্যাহার সত্ত্বেও পাকিস্তানি বাহিনী ফরেস্ট হিলে উঠতে সাহস করে নি। তারপর মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি পাহাড়ি পথ দিয়ে রাঙ্গুনিয়া হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
বিশ্লেষণ
মুক্তিযােদ্ধারা তাদের আশ্রয় স্থল হিসেবে ধােপাছড়ি এলাকাটিতে অবস্থান নিয়ে এবং কৌশলগতভাবে সঠিক স্থানগুলােয় অবস্থান নিলেও স্বীয় গতিবিধি পাকিস্তানি। বাহিনীর কাছ থেকে গােপন রাখতে ব্যর্থ হন। ফলে তারা হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে হতচকিত মনােভাবে কোনাে প্রতিরােধ না গড়ে পিছু হটে যান। এটি গেরিলাসুলভ বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের তথ্যসংগ্রহের ক্ষেত্রেও মুক্তিযােদ্ধারা উদাসীনতার পরিচয় প্রদান করেন। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানি বাহিনী তাদের আক্রমণে অতটুকুও সফল হতাে না, যদি না ধােপাছড়ি বাজারে অবস্থানরত দলটি দায়িত্ব পালনে একনিষ্ঠতার পরিচয় দিত।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা হাবিলদার আবু ইসলাম। (ধােপাছড়ি ফরেস্ট অফিসে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের নকশাটি ১১৪১ পাতায়)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড