You dont have javascript enabled! Please enable it! তৈলারদ্বীপে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের আক্রমণ প্রতিহতকরণ - সংগ্রামের নোটবুক
তৈলারদ্বীপে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের আক্রমণ প্রতিহতকরণ
অবস্থান
আনােয়ারা থানার অন্তর্গত শঙ্খ নদীর তীরে অবস্থিত তৈলারদ্বীপ গ্রাম। এখানে মুক্তিযােদ্ধারা তাঁদের বেস ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন। ঐ সময় তৈলারদ্বীপ একটি কাঁচা রাস্তা (বর্তমানে পাকা) দিয়ে চট্টগ্রাম শহরের সাথে সংযুক্ত ছিল।
প্রেক্ষাপট
মুক্তিযােদ্ধাদের ৩৬ নম্বর গ্রুপ অধিনায়ক কাজী মাে. ইদ্রিস জুন মাসে (সঠিক তারিখ সগ্রহ করা সম্ভব হয় নি) ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৯জন সহযােদ্ধাকে নিয়ে তৈলারদ্বীপে আসেন। এখানে আসার পর তার সাথে ইপিআর-এর নায়েব সুবেদার আবদুল লতিফ ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার মদন আলীর পরিচয় হয়। উল্লেখ্য, নায়েব সুবেদার লতিফ ও হাবিলদার মদন আলী প্রশিক্ষণ। প্রাপ্ত সৈনিক হওয়ায় পূর্ব থেকেই তৈলারদ্বীপের আশপাশের গ্রামের যুবকদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ দেন। তারা ২৪জন যুবককে আনুমানিক ২০ দিনের প্রশিক্ষণ দেন। ৩৬ নম্বর গ্রুপ অধিনায়ক কাজী মাে. ইদ্রিসের গ্রুপ হাবিলদার মদন আলীর গ্রুপের সাথে একত্র হয়। পরে হাবিলদার মদন আলী আরও ১৬জন যুবককে প্রশিক্ষণ দেন। এভাবে আনুমানিক ৫৯জন মুক্তিযােদ্ধাকে তৈলারদ্বীপে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সংগঠিত করা হয়। কার্তিক মাসের মাঝামাঝি (সঠিক তারিখ সংগ্রহ করা সম্ভবপর হয় নি) রাজাকারদের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনারা জানতে পারে যে, তৈলারদ্বীপে মুক্তিযােদ্ধাদের বেস ক্যাম্প। রয়েছে। এ সংবাদের ভিত্তিতে আনুমানিক ৫০জন পাকিস্তানি সেনা তাদের মেরিন। একাডেমি ক্যাম্প থেকে ১২৫জনের মতাে রাজাকার সমভিব্যাহারে তৈলারদ্বীপে মুক্তিযােদ্ধাদের বেস ক্যাম্প আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হয়।
মুক্তিযােদ্ধারাও সাের্সের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাদের আগমনের সংবাদ পেয়ে যান এবং তাদেরকে প্রতিরােধ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তখন বেলা আনুমানিক ১টা। উল্লেখ্য, তৈলারদ্বীপ যে রাস্তা দিয়ে চট্টগ্রাম শহরের সাথে সংযুক্ত, সেই রাস্তা ধরেই পাকিস্তানি সেনারা সহযােগী রাজাকারসহ আসে। তৈলারদ্বীপের কাছে আসা মাত্রই পাকিস্তানি সেনারা মেশিনগান দিয়ে ফায়ার শুরু করে এবং রাজাকারদের সহায়তায় গ্রামটি ঘেরাও করে ফেলে। এ সময় মুক্তিযােদ্ধারা খবর। পান যে, পাকিস্তানি সেনারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছে। তাই তাদের পক্ষে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া তারা আরও জানতে পারেন যে, পাকিস্তানি সেনারা তৈলারদ্বীপ থেকে শঙ্খ নদী পাড়ি দিয়ে নদীর ওপারে বাঁশখালীতে যাবে। তাই মুক্তিযােদ্ধারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, যেহেতু তাদের পক্ষে এখানে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করা সম্ভব নয়, তাই তারা নদীর ওপারে পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদেরকে গেরিলা কায়দায় অপারেশন চালিয়ে হতাহত করার সুযােগ পাবেন। তারা শঙ্খ নদী পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, নদীতে মুক্তিযােদ্ধাদের ২টি নৌকা সব সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকত, যেগুলাে দিয়ে তারা নির্দিষ্ট স্থানগুলােয় যাতায়াত করতেন। পরবর্তী পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে না থাকায় উপায়ান্তর না দেখে তারা সেই নৌকাগুলাে দিয়ে নদী পার হয়ে ওপারে চলে যান এবং পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এদিকে পাকিস্তানি সেনারা তৈলারদ্বীপের নায়েব সুবেদার আবদুল লতিফের বাড়িতে এসে মুক্তিযােদ্ধাদের না পেয়ে তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। তারা আশপাশের গ্রামের আরও কতকগুলাে বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তারপর তারা শঙ্খ নদী অতিক্রম না করে পূর্ব দিকে হাইলদর বশিরুজ্জামান উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে তা দিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং এক দিন অবস্থান করে। পরদিন সেখান থেকে মেরিন একাডেমির ক্যাম্পে চলে যায়।
ক্ষয়ক্ষতি
পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। মুক্তিযােদ্ধাদেরও কেউ হতাহত হয় নি। তবে পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলি বর্ষণে ৮-১০জন গ্রামবাসী শহিদ।
বিশ্লেষণ
অধিকতর শক্তিসম্পন্ন এবং স্থানীয় রাজাকার দ্বারা সমর্থিত পাকিস্তানি সেনার হঠাৎ আক্রমণের মুখে মুক্তিযােদ্ধারা উপলব্ধি করেন যে, এদের বিরুদ্ধে এভাবে মুখােমুখি লড়াই করতে যাওয়া স্বীয় সীমিত শক্তি ক্ষয় করারই নামান্তর। এজন্যই তারা পশ্চাদপসরণ করে অন্যত্র অবস্থান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। সার্বিক পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে ছিল না। তাই গেরিলা তাত্ত্বিক বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত যথােপযুক্ত। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা আবদুল মােতালেব, আনােয়ারা।

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড