You dont have javascript enabled! Please enable it! হাজি মােহাম্মদ আলীর বাড়ি ইদগা আক্রমণ - সংগ্রামের নোটবুক
হাজি মােহাম্মদ আলীর বাড়ি (ইদগা) আক্রমণ
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
পাকিস্তানি বাহিনীর একান্ত সহযােগী মােহাম্মদ আলী তার বাড়িটিকে একটি নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত করে। তার বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনী নিয়মিত আসাযাওয়া করত। লােকাল বেইজ অধিনায়কদের মাধ্যমে খবর আসে যে, সেটি রাজাকার ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং স্থানীয় জনসাধারণ তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ এর ফলে আশপাশের এলাকায় থাকা মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, মৌলবি সৈয়দের নেতৃত্বে মনসুরাবাদ ও আগ্রাবাদ সংলগ্ন এলাকায় মুক্তিযােদ্ধারা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযােগীদের তৎপরতা সেখানে সীমিত হয়ে আসে। এমতাবস্থায় ইদগা এলাকায় মােহাম্মদ আলীর তৎপরতা মুক্তিযােদ্ধাদের কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন ঘটায়। তা ছাড়া এতে জনগণের মনােবলও দুর্বল করে দেয়। এ প্রেক্ষাপটেই মােহাম্মদ আলীর বাসভবন আক্রমণ করে তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এজন্য ২টি অপারেশন করতে হয়েছিল।
অবস্থান
দেওয়ানহাট থেকে পশ্চিমে পাহাড়তলি সিডিএ মার্কেটের পূর্ব দিকে ইদগাও মােহাম্মদ আলীর পেট্রোল পাম্প (বর্তমানে গাজী পেট্রোল পাম্প) অবস্থিত ছিল এর সাথেই ছিল তার বাসা।
প্রথম অপারেশন
উপরি-উক্ত প্রেক্ষাপটে কেসি-৪ সিদ্ধান্ত নেয়, মােহাম্মদ আলীকে সরিয়ে দিতে হবে। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করে মুক্তিযােদ্ধা এনামুল হক দানু, শফিউল বশর, আহসানুল হক মণি তাকে সরাসরি আক্রমণ করে হত্যার অপারেশনে যান মণি কভারিংয়ে থাকেন এবং দানু ও শফি থাকে আক্রমণ করেন। দানু তার স্টেনগান দিয়ে মােহাম্মদ আলীকে লক্ষ্য করে গুলি চালান কিন্তু স্টেনগান থেকে কোনাে বুলেট বের হয় নি। এ সুযােগে সে ডাকাত-ডাকাত বলে চিঙ্কার শুরু করে। পাশের ট্রাক স্ট্যান্ড থেকে ডাকাত মনে করে ট্রাক ড্রাইভাররা ছুটে আসে। মণি কভারিংয়ের জন্য পজিশন নিয়েছিলেন এ অবস্থায় তিনি দৌড়ে এসে গুলি বর্ষণ করেন। ১জন ট্রাক ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। তা ছাড়া অনেকেই আহত হয় অবশেষে কার্যসিদ্ধি ছাড়াই অপারেশন থেকে গেরিলা দলকে ফেরত আসতে হয়।
দ্বিতীয় অপারেশন
মােহাম্মদ আলীকে হত্যার প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর মুক্তিযােদ্ধারা পুনরায় এ বিষয়ে ভাবতে থাকেন। অবশেষে ৩টি গ্রুপ মিলে যৌথ অপারেশন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এজন্য আবদুল্লাহ-আল-হারুন, আবু সৈয়দ, হারেস, ডা. জাফর বিস্তারিত রেকি করে নিম্নলিখিত তথ্যসংগ্রহ করেনঃ ক. বাড়ির অভ্যন্তরে আনুমানিক ২০জন সশস্ত্র রাজাকার অবস্থান করে তারা। সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকে। বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে হলে এদের। সশস্ত্র বাধা অতিক্রম করতে হবে। খ, বাড়িটি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে তিন দিক থেকে আক্রমণ করতে হবে। গ. আক্রমণের জন্য ন্যূনতম ৩০জন মুক্তিযােদ্ধার প্রয়ােজন হবে, সম্ভব হলে। অধিক। ঘ, ভারী অস্ত্রও ব্যবহার করতে হবে। পর্যবেক্ষণ শেষে এবার একটি সফল অপারেশনের জন্য নিমলিখিত পরিকল্পনা প্রণীত হয়: ক, অপারেশনের প্রথম কাজ হবে কৌশলে রাজাকারদের বের করে নিয়ে আসা। এজন্য গােপনীয়তা ও অপারেশনের সময় নীরবতা পালনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বাড়ির দুই দিকে ২টি গ্রুপ (১০জন করে) পজিশন নেবে। ১০জনের ১টি দল বাড়ির পিছনের অংশে বিস্ফোরক সংযােগ করে উড়িয়ে দেবে। মনসুরাবাদ দরগার পাশ দিয়ে অপারেশনে যাতায়াতের পথ নির্দিষ্ট করা। হয়। পরিকল্পনা করার সময় অধিনায়করা সার্বিক সাফল্যের ব্যাপারে আশাবাদী। ছিলেন না। রাজাকারদের প্রতিরােধ ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করা হয়ত সম্ভব না-ও হতে পারে। তা সত্ত্বেও নিজেদের ও জনগণের মনােবল চাঙ্গা। করার জন্য এ
অপারেশন
পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। অপারেশন। পরদিন ছিল প্রথম রমজান। পরিকল্পনা মতাে রাত ১১টার দিকে ৫০জনের একটি গেরিলা দল অত্যন্ত গােপনীয়তার সাথে নির্দিষ্ট স্থানে পৌছে অবস্থান নেয়। কিছুক্ষণ পর পাহাড়তলীর দিক থেকে পুলিশের ১টি ভ্যান গাড়ি দেওয়ানহাটের দিক যাচ্ছিল। রাস্তার পাশে অবস্থানরত ১টি গ্রুপ তাদের পথ রােধ ও নিরস্ত্র করে। এর ফলে আক্রমণের পূর্বে গােলাগুলি ও কোনাে শব্দ না করে এবং শত্রুকে বিস্মিত করে আক্রমণ করার পরিকল্পনা ব্যাহত হয়। পেট্রোল পাম্পের সামনে রাস্তার বিপরীতে ছিল একটি সরকারি গুদাম ঘর। সেখানে নিরাপত্তা রক্ষার জন্য কিছু মিলিশিয়া অবস্থান করত। তারা টের পেয়ে পূর্বোক্ত ঘটনার অবস্থান লক্ষ্য করে।  গুলি বর্ষণ শুরু করে। এ ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। ফলে বিভিন্ন স্থানে পজিশন নেয়া মুক্তিযােদ্ধারা ব্যাপকভাবে গুলি বর্ষণ শুরু করেন।  প্রচণ্ড গােলাগুলিতে সারা শহর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে গােলাগুলি চলে। ইতােমধ্যে খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর ১টি দল এসে পজিশন নেয় কদমতলিতে। তারপর তারা দেওয়ানহাট মােড়ে অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য অপারেশন স্থলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। একই সাথে অলংকারের দিক হতেও বিপুল সংখ্যক সৈন্য এদিকে অগ্রসর হয়। এদিকে গােলাগুলি চলার সময় রাজাকাররা সাধারণ পােশাকে বের হয়ে যায়। এলাকার সাধারণ জনতা মনে করে মুক্তিযােদ্ধাদের কেউ তাদের চ্যালেঞ্জ করে নি। উদ্ভূত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযােদ্ধাদেরকে এক পর্যায়ে পশ্চাদপসরণের সিগনাল দেওয়া হয়। পশ্চাদপসরণ করলেও মুক্তিযােদ্ধা হারুন ও ফজলু শেষ মুহূর্তেও পেট্রোল পাম্পে আগুন ধরানাের চেষ্টা করেন কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্য নিকটবর্তী এসে যাওয়ায় উপায়ান্তর না দেখে ২জন ধানক্ষেতে লাফ দিয়ে কোনােরকমে আত্মরক্ষা করেন।
বিশ্লেষণ
এ অপারেশনে প্রথম বারের মতাে তুলনামূলক ভারী অস্ত্র ব্যবহৃত হয়। দীর্ঘ সময় ধরে শহরে শত শত রাউন্ড গােলাগুলি পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ শিথিলতার ইঙ্গিত বহন করে। পাশাপাশি শহরে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর সহযােগী অবাঙালি সম্প্রদায় প্রচণ্ড ভীত হয়ে পড়ে। মােহাম্মদ আলীও ঐ এলাকা থেকে পালিয়ে যায়। আগ্রাবাদ-মনসুরাবাদ এলাকা মুক্তিযােদ্ধাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধা ও অধিনায়কদের অনেক দুর্বলতা প্রকাশিত হয়। বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করলেও অপারেশন স্থলের সন্নিকটে মিলিশিয়াদের অবস্থান তাদের অজ্ঞাত থেকে যায়। অপারেশন স্থল ছিল একটি প্রধান সড়কের ওপর। অথচ এ সত্ত্বেও সম্ভাব্য যানবাহন চলাচল ও বিপদ সম্পর্কে পরিকল্পনাকারীরা চিন্তা করেন নি। সে কারণে অপারেশনের মূল সময়ে আকস্মিকভাবে ১টি পুলিশ ভ্যান এসে উপস্থিত হলে বাধ্য হয়ে চ্যালেঞ্জ করতে হয়। এতে গােপনীয়তা বিনষ্ট হয় এবং পুরাে অপারেশনই ভণ্ডুল হয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে ফায়ার ডিসিপ্লিন’এর অভাব পরিলক্ষিত হয়। তবু গেরিলা যুদ্ধ তত্ত্বমতে এটিকে সফল অপারেশন বলে গণ্য করা যায়। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ-আল-হারুন, ফজলুল হক, এনামুল হক দানু।
(হাজি মােহাম্মদ আলীর বাড়ি (ইদগা) আক্রমণের নকশাটি ১১৩০ পাতায়)

সূত্রঃ   মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড