অপারেশন চকবাজার সেনা ক্যাম্প
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে এসে চট্টগ্রাম শহরের প্রতিরােধ যুদ্ধ ভেঙে পড়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী শহরব্যাপী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং কোনাে বাধা ছাড়াই অত্যাচার নির্যাতন চালাতে থাকে জনগণের মনােবল ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। অনেকের মনে এমন ধারণাও বদ্ধমূল হয় যে স্বাধীনতার সংগ্রাম মুখ থুবড়ে পড়েছে ইতােমধ্যে উল্লেখযােগ্য সংখ্যক স্বাধীনতাকামী জনতা ভারতে পাড়ি জমায় এবং ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করেন কিন্তু একটি চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য এ সংখ্যা এবং প্রশিক্ষণ ছিল অপ্রতুল। তাই প্রয়ােজন ছিল যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করে পর্যাপ্ত সংখ্যায় প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানাে। কেননা কিছু সফল গেরিলা কর্মকাণ্ড যুবসমাজের মনে আস্থার সৃষ্টি করতে পারত। পাশাপাশি জনগণের মনে আস্থার সঞ্চার করে মনােবল দৃঢ় করা এবং স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য তাদের প্রস্তুত করা প্রয়ােজন। এর লক্ষ্য ছিল একটাই, পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে মাতৃভূমি উদ্ধার এবং তাদের চরম শিক্ষা।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হরিণায় মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য ট্রেনিং ক্যাম্প খােলা হয়। মেজর জিয়া, ক্যাপটেন শওকত, ক্যাপটেন অলি, লে, মাহফুজ প্রমুখ অফিসার সেখানে ট্রেনিং কার্যক্রম তদারক করতেন। চকবাজার অপারেশনের নায়ক মুক্তিযােদ্ধা জাহাঙ্গীর আলমের বর্ণনা মতে, মেজর জিয়া চট্টগ্রাম শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালানাের পরিকল্পনা করেন এবং লে, মাহফুজকে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব দেন সে অনুযায়ী, হরিণা ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রথমে ১০জনের গ্রুপকে ৭ দিনের প্রেশিক্ষণ প্রদান করা হয়। গ্রেনেড চার্জ, রিভলভার ও অন্যান্য গেরিলা কর্মকাণ্ডের উপযােগী অস্ত্র চালনা ও কৌশল শেখানাে হয়। ১০জনের দলকে ৫জন করে ২টি গ্রুপে বিভক্ত করে শহরে পাঠানাে হয়। ১টি গ্রুপের অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপটেন সাত্তার (পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন), তার অধীনস্থ ছিলেন তােফাজ্জল, জিন্টু, নুরুল হকসহ আরও ১জন। জাহাঙ্গীর আলমের দলে ছিলেন ইউসুফ, নুরুল আমিন, আবু সৈয়দ, আইয়ুব। দেশের অভ্যন্তরে পাঠানাের আগে পর্যাপ্ত ব্রিফিং প্রদান করা হয় এবং প্রত্যেককে ১ হাজার টাকা ও ১টি করে গ্রেনেড দেওয়া হয়। ২ দলের অধিনায়ককে ২টি রিভলভার দেওয়া হয়।
চৌদ্দগ্রাম দিয়ে ২টি দলই দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। পূর্বাহ্নেই যাত্রাবিরতির স্থান, রুট ঠিক করা ছিল। এতে বােঝা যায়, এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত ৩ রাত দুর্গম পাহাড়ি পথ হেঁটে জাহাঙ্গীর গ্রুপ এসে পৌছায় মিরসরাইয়ের মিঠাছড়া বাজারের কাছে নির্দিষ্ট গােপন শেল্টারে সেখানে তারা কয়েক দিন অবস্থান করে। চলার সময় তাঁদের পথপ্রদর্শক ছিল গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ। শত্রুর চোখকে ফাকি দেওয়ার জন্য রাতের অন্ধকারে তারা পথ চলত এবং দিনের বেলায় বিশ্রাম নিত।
তত দিনে শহরের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর গােয়েন্দা ও চেকপােস্ট স্থাপন হয়েছে। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রধান সমস্যা ছিল প্রয়ােজনীয় গােলাবারুদ ও অস্ত্র নিয়ে শহরে পৌছানাে অবশেষে স্থানীয় যুবকদের সহায়তায় তারা একটি অভিনব কৌশল অবলম্বন করেন। তারা ২৫টির মতাে বড়াে সাইজের মিষ্টিকুমড়া সংগ্রহ। করেন। এগুলােকে আকৃতির পরিবর্তন না ঘটিয়ে সতর্কতার সাথে সুড়ঙ্গ করে ভিতরে ২৫টি গ্রেনেড ও ২টি রিভলভার ঢােকানাে হলাে। এগুলােকে মিঠাছড়া বাজারে এনে সাধারণ যাত্রীবাহী বাসে তােলা হয়, যাতে কোনাে অস্বাভাবিকতা প্রকাশ না পায়। নুরুল আমিন নামে ৯ম শ্রেণির এক ছাত্র মুক্তিযােদ্ধাকে এর সাথে দেয়া হলাে প্রয়ােজনীয় ও সতর্কতামূলক ব্রিফিং সহকারে পথিমধ্যে পাকিস্তানি সেনারা রুটিন মতাে গাড়ি থামিয়ে চেক করলেও মিষ্টিকুমড়ড়ার মধ্যে তারা কোনাে বিশেষত্ব লক্ষ্য করল না। চট্টগ্রামের অলংকারে এসে গাড়িটি থামলে নুরুল আমিন এগুলাে একটি ঠেলাগাড়িতে তুলে দিয়ে ঠিকানা লিখে দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে থেকে হেঁটে চললেন। বস্তাগুলাে নেয়া হলাে বাদুরতলার ডা. মােজাফফরের বাসায় অন্য পথ ধরে ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা শহরে পৌছলেন অধিনায়ক ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। শহরে পৌছে মুক্তিযােদ্ধারা ডা. মােজফফরের ভাড়া বাসায় ৩-৪ দিন থাকেন। পরে গোপন স্থান হিসেবে বেছে নেন প্যারেড মাঠের পূর্ব পাশের চুনার গােডাউনের ওপরতলাকে তাদের অবস্থান ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ গােপন রাখা হয়। শহরে মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে কার্যক্রম না থাকায় অনেকে হতাশ হয়েছে। তাই ২১ দিনের মধ্যে অপারেশন শুরু করার পরিকল্পনা নেন তারা।
প্রতিদিন গ্রুপের সবাই আলাদাভাবে বের হতেন টার্গেটের সন্ধানে জাহাঙ্গীর আলমের বর্ণনা মতে ১৯৭১ সালের ১৮ মে, সকাল ১০টায় তিনি অবস্থান নেন। চকবাজার লেবারশেডের মধ্যে। পরনে লুঙ্গি ও গায়ে শার্ট। তিনি লেবারদের সাথে কথা বলতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর প্রতিদিনের মতাে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১টি জিপ সেখানে আসে এরা এসেছে কাঁচা বাজার করতে ১জনের কাছে শুধু অস্ত্র ছিল। জিপটি লালচান রােডের মাথায় পার্কিং করে অস্ত্রধারী সৈনিকসহ ১জন বাজারে প্রবেশ করে। জাহাঙ্গীর আলমের কাছেই ছিল ১টি রিভলভার ও গ্রেনেড ৪জন পাকিস্তানি সেনা গাড়ির ভিতর গল্পরত এমনি সময় তিনি সামনে এগিয়ে সন্তর্পণে গ্রেনেডটি জিপের মধ্যে রেখে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে চলে গেলেন দক্ষিণ বাকলিয়ার হাসান নওশাদ নামে এক বন্ধুর বাড়িতে। ইতােমধ্যে বিস্ফোরণে জিপটি পুরােপুরি ধ্বংস হয় এবং ৪জন পাকিস্তানি সেনা মারা যায় বলে তাঁর ভাষ্য। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ও বিবিসি থেকে অপারেশনের খবর প্রচার করা হয় বলে সাক্ষাৎকার দানকারী জানান।
সাক্ষাৎকার দানকারীসহ কোনাে কোনাে মুক্তিযােদ্ধার মতে অপারেশন চকবাজার চট্টগ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম গেরিলা অপারেশন (আজাদী, ১৯৯৫: ৫১; কালিধারা, ৮ম সংখ্যা, ১৯৯৭: ৭১)। যদিও এটাকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে মনে হতে পারে কিন্তু এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এর ফলে পাকিস্তানি সেনাদের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং স্পষ্ট বুঝতে পারে যে, প্রতিরােধ যুদ্ধে পিছুটান দিলেও মুক্তিযােদ্ধারা পুনরায় সংগঠিত হচ্ছেন। প্রাথমিক প্রতিরােধ ভেঙে পড়ার পর হতাশা গ্রস্ত জনগণের মনে এ অপারেশন আশার সঞ্চার করে এবং যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। জনগণ এটাও বুঝতে পারে যে, যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছে এবং অনতিবিলম্বে তা শুরু হবে। এ ঘটনার পর অনেক স্বাধীনতাকামী যুবক প্রশিক্ষণের জন্য ভারত পাড়ি জমায়।
এ অপারেশনটি মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে পরিচালিত। অপারেশনের ক্ষয়ক্ষতি তেমন উল্লেখযােগ্য না হলেও মুক্তিকামী জনগণের কাছে আশার আলাে সঞ্চারে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পরিচালিত এসব অপারেশন বিশেষ ভূমিকা রাখে। প্রতিরােধ যুদ্ধের শেষে স্বল্পসংখ্যক প্রশিক্ষিত বাঙালি নিয়মিত বাহিনীর যােদ্ধারা যখন ভারতে তাদের সংগঠনে ব্যস্ত ছিলেন, তখন মুক্তিযােদ্ধাদের গতি অনেকটা শ্লথ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় এ ধরনের অপারেশন গেরিলা যুদ্ধের সূচনা কালের বার্তা জনগণের কাছে পৌছে দেয়। এ অপারেশনের পূর্বে চট্টগ্রামে প্রবেশকালীন মুক্তিযােদ্ধারা যথেষ্ট সতর্কতামূলক কৌশল অবলম্বন করেন। প্রথমত, দিনের আলাে এড়িয়ে তাঁদের চলাচল ও শহরে প্রবেশ ছিল বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলের বহিঃপ্রকাশ। কুমড়াের ভিতর অস্ত্র নিয়ে অনুপ্রবেশও ছিল অভিনব কৌশলের নিদর্শন।
অপারেশন
পরিচালনায় গ্রেনেডের সুচারু ব্যবহারও ছিল গেরিলা অপারেশনের নীতির যথাযথ অনুসরণ। কেননা, গেরিলা যুদ্ধে সরাসরি সাহসিকতা প্রদর্শন না করে কৌশল ও অল্প শক্তি ব্যবহার করাতেই অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এতে প্রায় উদ্দিষ্ট ফলাফল অর্জন সম্ভব।
তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম। সম্পাদকের টীকা: ১. গ্রন্থের ত্রয়ােদশ অধ্যায়ের দলিল নম্বর ৫০৪ অনুযায়ী দেখা যায়, জি আর নম্বর ৬৪৮-৭১; কোতােয়ালী থানার মামলায় এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। সেখানে মামলার তারিখ হিসেবে উল্লেখ আছে ১১.৬.১৯৭১। তাই এ মামলার উল্লিখিত তারিখটিকেই প্রামাণ্য বলে গণ্য করা যায়। ঘটনার সময় ৯টা ৪০ মিনিট। গ্রন্থের দশম অধ্যায়ে সংকলিত দলিল নম্বর ২০৬-এর তথ্য মতে দেখা যায়, ১০ জুন মুক্তিবাহিনী হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ে রিয়াজউদ্দিন বাজারে দুজন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে। এ সূত্রে এটি চট্টগ্রামের প্রথম অপারেশন হিসেবে গণ্য। করায় সংশয় জাগে। তা ছাড়া বাংলাদেশ ফোর্সের ঐ ঘটন্ম প্রতিবেদনে ১১ জুন ইউনাইটেড ব্যাংকের সামনে নৌবাহিনীর সৈন্যের ওপর হাতবােমা নিক্ষেপের তথ্যও এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযােগ্য। এ অপারেশন বর্ণনায় মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে গেরিলা প্রশিক্ষণ, অনুপ্রবেশকালীন যাত্রা পথ এবং অস্ত্র আনা-নেওয়ার প্রক্রিয়া ও কৌশল সম্পর্কে সুস্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। (অপারেশন চকবাজার সেনা ক্যাম্পের নকশাটি ১১২৭ পাতায়)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড