অপারেশন ফয়েজ লেক
প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন গেরিলা দল চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এ সকল মুক্তিযােদ্ধা স্থানীয় অনেক মুক্তিযােদ্ধাকে প্রশিক্ষণও প্রদান করেন। নতুন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন দলে যোেগ দেন। প্রধান গেরিলা দলগুলাে নিজেদের মধ্যে সমঝােতা করে অপারেশনসংক্রান্ত দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছিলেন। কার্যকরভাবে অপারেশন পরিচালনার জন্যই তা করা হয়েছিল। ডা, মাহফুজের নেতৃত্বাধীন কেসি-৩ দল প্রধানত বিস্ফোরক স্থাপন করে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করার কাজ করতেন। দালাল হত্যাসহ পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের। স্থাপনায় সশস্ত্র অভিযান পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ-আলহারুনের নেতৃত্বে কেসি-২। অবশ্য এটা কোনাে ধরাবাধা নিয়ম ছিল না। প্রয়ােজন। মতাে বিভিন্ন দলের মুক্তিযােদ্ধারা অন্য দলের সাথে গেরিলা কর্মকাণ্ডসহ সার্বিক যুদ্ধ তৎপরতায় নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতেন। অধিকাংশ সময় দল বিভক্তি শুধু নেতাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দলের সাধারণ সদস্যরা নিজেদের একজন মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে মনে করতেন এবং স্বাধীনতার মূল মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যে-কোনাে ত্যাগ স্বীকারে নিজেদের নিয়ােজিত করেছিলেন। চট্টগ্রাম শহরে নেতৃস্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা ভারতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বিভিন্ন মুক্তিযােদ্ধা দলের সমন্বয়ে পরীক্ষামূলকভাবে একটি যৌথ অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেন। এতে অনেক দলকে যুক্ত করা হয়েছিল। এ গেরিলা অপারেশনের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ফয়েজ লেকের ওপর দিয়ে। উত্তর-দক্ষিণ দিকে চলে যাওয়া বিদ্যুতের পাইলনকে নির্দিষ্ট করা হয়। উদ্দেশ্য, এর মাধ্যমে পতেঙ্গা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করা।
পরিকল্পনা ও তথ্যসংগ্রহ
কেসি-৩-এর দলনেতা ডা. মাহফুজ, কেসি-৩-এর ডা. জাহাঙ্গীর এবং কেসি-২এর দল নেতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ-আল-হারুন এ অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। সৈয়দ মফিজুল ইসলাম, মনসুরুর রহমান, ডা. আলাউদ্দিন আহমেদ, ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার খায়রুল ইসলাম সরওয়ার, মরহুম আজিজ, খােরশেদ, জাফর উল্লাহ, বােরহানসহ প্রমুখ মুক্তিযােদ্ধা এ অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ফয়েজ লেক এলাকার অপারেশন স্থলের। আশপাশের এলাকা ছিল অবাঙালি অধু্যষিত। তারমধ্যে পাহাড়তলি রেলওয়ে। কলােনি, পাহাড়তলি, পশ্চিম নাসিরাবাদ, দক্ষিণ কাট্টলি এলাকায় অনেক বিহারি কলােনি ছিল। পূর্ব পাশে ব্যাপকভাবে অবাঙালি বসবাস করত। ফয়েজ লেক এলাকা ছিল তাদের প্রভাবাধীন। তা ছাড়া ফয়েজ লেকে যাওয়ার মুখে দুই পাহাড়ের চূড়ায় ছিল পাঞ্জাবিদের অবস্থান। তথ্য বিশ্লেষণ করে নেতারা নিমলিখিতভাবে অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। পুরাে দলকে ৩টি উপদলে বিভক্ত করে প্রতিটি দলের কাজ ভালােভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
বিস্ফোরক স্থাপনকারী দল
অপারেশন স্থলে পৌঁছার পর বিস্ফোরক স্থাপন করে সেটিকে বিস্ফোরণের উপযােগী করে তুলবে সে জন্য এ দল আসার সময় প্রয়ােজনীয় বিস্ফোরক নিয়ে আসবে। তাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য থাকবে• কভারিং-১: এ দল বিস্ফোরক স্থাপনের জন্য নির্ধারিত পাইলনের পশ্চিম দিকে অবস্থান নিয়ে বিস্ফোরক স্থাপনকারী দলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। বিস্ফোরক স্থাপনকালীন অন্য দলগুলাে শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলেই কেবল মােকাবিলা করবে। বিস্ফোরক স্থাপন শেষে ফেরার সময় তারা পিছনের দল হিসেবে থাকবে। কভারিং-২: এ দলের কাজ ছিল টার্গেটে পৌছার ১০০ গজ আগে কাঁচা। রাস্তার পাশে অবস্থান নিয়ে ফেরত আসার পথকে নিরাপদ রাখা। প্রয়ােজনে অন্যান্য দলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
অপারেশন
সন্ধ্যার পর ছােটো ছােট দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত অপারেশন দল পাঞ্জাবি লেনস্থ (বর্তমানে শহিদ লেন) একজন মুক্তিযােদ্ধার বাড়িতে জড়াে হয়। দলের উপস্থিতির ব্যাপারে কঠোর গােপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। কারণ, পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলাে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অনুগত সশস্ত্র অবাঙালি অধ্যুষিত। অন্যদিকে, ছিল পাঞ্জাবিদের অবস্থান। অপারেশন সংক্রান্ত কিংবা মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান সংক্রান্ত যে-কোনাে সংবাদ অবাঙালিদের কর্ণগােচর হলে খুবই বিপদের আশঙ্কা ছিল। রাত ২টায় পাঞ্জাবি লেন থেকে পুরাে দল রওনা হয়। গভীর রাতে অনেক পাহাড় অতিক্রম করে পুরাে দল অপরেশন স্থলে হাজির হয়। যেহেতু অপারেশন স্থল ছিল শক্ৰবেষ্টিত তাই বিস্ফোরণ স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদে প্রত্যাবর্তন ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। শত্রুকে মােকাবিলা করেই নিরাপদ স্থানে পৌছাতে হতাে। কিন্তু সংগৃহীত জনবল ও অস্ত্র দ্বারা শত্রুকে কার্যকরভাবে মােকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। তখনকার যুদ্ধ-পরিস্থিতির সার্বিক অবস্থায় তা হতাে অপরিণামদর্শী কাজ। অপারেশন দলের নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের পর বিস্ফোরণ ঘটানাের মতাে কোনাে Time delay device মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে ছিল না। অবশেষে ইঞ্জিনিয়ার হারুন একটি অভিনব কৌশল বের করেন। মশার কয়েলের শেষ অংশের সাথে।
বিস্ফোরকের কর্ড সংযুক্ত করা হয়। পরে মশার কয়েলটি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। কয়েল পুড়ে পুড়ে কর্ডের কাছে এলেই কয়েল হতে আগুন কর্ডে লাগবে এবং বিস্ফোরণ ঘটবে। এ সময়ের মাঝে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের নিরাপদ স্থানে চলে যেতে পারবেন। সেটাই Time delay device-এর কাজ করবে। এটা পূর্বেই পরিকল্পনা। করা হয়েছিল এবং একটি মশার কয়েল কতক্ষণ জ্বলে, তা আগে থেকেই পরীক্ষা করে নেয়া হয়েছিল। রাত ৩টায় সবকিছু লাগানাে শেষে আবার অপারেশন দল পাঞ্জাবি লেনে প্রত্যাবর্তন করে। সকাল আটটার সময় বিস্ফোরণ ঘটে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। অবাঙালিরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়। কারণ, এমন দুঃসাহসী ঘটনাটি ঘটেছিল অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকার একেবারে কেন্দ্রস্থলে এ অপারেশনের সময়কার একটি ঘটনা স্মরণযােগ্য। বিস্ফোরক স্থাপনের সময় পরিকল্পনা মােতাবেক কভারিং দল তাদের অবস্থানে ওত পেতে আছে এদের একজন ডা. আলাউদ্দিনকে জঙ্গলের ভিতর একটি মশা কামড় দেয়। তিনি মশাটিকে থাপ্পড় মেরেই চেঁচিয়ে ওঠেন ‘আব কিধার যায়ে গা (কোথায় যাবে। এখন)। প্রথমে অনেক যােদ্ধা মনে করেছিলেন শক্র নাগালের মধ্যে। এদের কেউ কেউ প্রায় গুলি বর্ষণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পরক্ষণেই সবাই কৌতুকটির মর্মার্থটের পান।
বিশ্লেষণ
লক্ষ্যবস্তু নির্বাচনেই গেরিলা যুদ্ধের সাফল্য সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল তা ছাড়া অপারেশন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে অভিনবত্ব সাফল্যকে সব সময় নিশ্চিত করে। অন্যদিকে শত্রুকে বিভ্রান্ত করে তা ছাড়া অর্জন করা যায় সারপ্রাইজ। এ অপারেশনে লক্ষ্যবস্তু নির্বাচনে দক্ষতা ও Time delay device তৈরিতে। অভিনবত্বের পরিচয় পাওয়া যায় তা ছাড়া এটি ব্যবহারের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানাের। বিষয়টিতে দক্ষ পরিকল্পনার ছোঁয়া সুস্পষ্ট। এ ঘটনার মাধ্যমে এটাই সুস্পষ্ট হয় যে ক্রমেই মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন দল গেরিলা যুদ্ধে অত্যন্ত পারদর্শী হয়ে উঠছিল। তা ছাড়া দলের সদস্যদের বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, অভিনবত্ব ও স্থানীয় সরঞ্জাম। ব্যবহারের পারদর্শিতা গেরিলা যুদ্ধের সফলতায় বিশেষ ভূমিকা রাখে তা এ অপারেশনে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।
তথ্যসুত্র
১. সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ-আল-হারুন। ২. ডা. মাহফুজুর রহমান, বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম পৃষ্ঠা:
৩৬৩-৩৬৪।
(অপারেশন ফয়েজ লেকের নকশাটি দেখুন ১১২৫ পাতায়)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড