শিবপুর গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রাভিযান প্রতিহতকরণ
অবস্থান
সীতাকুণ্ড থানা থেকে ১ কিলােমিটার উত্তরে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রােডের পশ্চিম পাশে অবস্থিত শেখপাড়া গ্রাম। এ গ্রামসংলগ্ন ট্রাংক রােডের পাশেই ছিল কিছু দোকানপাট এবং এখান থেকেই একটি কাঁচা রাস্তা (বর্তমানে পাকা) সােজা পশ্চিমে শিবপুর গ্রামে চলে গেছে। শিবপুর গ্রামের পাশেই হলাে গুইয়াখালী গ্রাম।
প্রেক্ষাপট
পাকিস্তানি সেনারা রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পায় যে শিবপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী গুইয়াখালী গ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প (আশ্রয় কেন্দ্র) রয়েছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে তারা ঠিক করে, প্রথমেই রাজাকারদের সহায়তায় শিবপুর গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করবে এবং গ্রামসহ আশপাশের এলাকা থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের তাড়িয়ে দিয়ে সমগ্র এলাকা মুক্তিযােদ্ধাদের কবল থেকে মুক্ত করবে। উল্লেখ্য, মুক্তিযােদ্ধারা সে সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের পূর্বের পাহাড়ি এলাকায় বহু যুবককে ১৫-২০ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সহযােগী হিসেবে গড়ে তুলতেন। মুক্তিযােদ্ধারা সাধারণত রাতের বেলায় ক্যাম্পে অবস্থান করতেন। কিন্তু দিনের বেলায় তারা পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের চলাচল সম্পর্কে জানার জন্য বিভিন্ন গ্রামে লুকিয়ে থাকতেন। তা ছাড়া ঐ এলাকার গ্রামের লােকজনের সাথে তাদের সবসময় যােগাযােগ থাকত। গ্রামবাসীর সুবিধা দেখাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। তারা ছিলেন গ্রামের লােকজনের সাথে আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ। ফলে রাজাকারদের ব্যাপারে যে-কোনাে ধরনের সংবাদ তারা নিমিষেই পেয়ে যেতেন। ১৯৭১ সালের ৪ অক্টোবর আনুমানিক ৫০জন পাকিস্তানি সেনা শেখপাড়ায় এসে জমায়েত হয় । মুক্তিযােদ্ধারা এ সংবাদ অল্প সময়ের মধ্যেই পেয়ে যান। তখন সকাল ১০টা। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের সাের্সের মাধ্যমে খবর পান যে, পাকিস্তানি সেনারা সেখান থেকে শিবপুর গ্রামে যাবে এবং ঐ এলাকার আশপাশের মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানগুলাে চিহ্নিত করে তাদের ওপর অপারেশন চালাবে। এ সংবাদের ভিত্তিতে শুধু ঐ এলাকার নয় বরং সীতাকুণ্ড থানার মুক্তিযােদ্ধাদের আরও কয়েকটি গ্রুপ একত্র হয় এবং শিবপুর গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রাভিযান প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
অপারেশন
পাকিস্তানি সেনাদের ওপর মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপগুলাের আক্রমণ পরিচালনার জন্য পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী কোনাে প্রস্তুতি ছিল না। গ্রুপগুলাে তখন যেভাবে যে অবস্থায় ছিল খবর পেয়ে সে অবস্থাতেই অস্ত্র নিয়ে চলে আসে। তাদের মনােবল ছিল খুবই সুদৃঢ়। তাৎক্ষণিক পরিকল্পনানুযায়ী মুক্তিযােদ্ধাদের গ্রুপগুলাে এমনভাবে পাকিস্তানি সেনাদের চতুর্দিকে অবস্থান গ্রহণ করে যে পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রসর হওয়া ছিল অত্যন্ত কঠিন। পরে মুক্তিযােদ্ধারা ফায়ার শুরু করলে পাকিস্তানি সেনারাও পালটা ফায়ার করে। এভাবে উভয় গ্রুপের মধ্যে ফায়ার ও পালটা ফায়ার চলতে থাকে। এ অবস্থায় পাকিস্তানি সেনারা শিবপুর গ্রামে তাদের অগ্রাভিযান বন্ধ করে বেলা আনুমানিক ২টার দিকে তাদের ক্যাম্পে ফেরত যায়।
ক্ষয়ক্ষতি
পাকিস্তানি সেনাদের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে কিছু জানা যায় নি। তবে একজন মুক্তিযােদ্ধার পায়ে গুলি লেগেছিল এবং তাকে চিকিৎসার জন্য নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
বিশ্লেষণ
মুক্তিযােদ্ধাদের তথ্য আদান-প্রদান ব্যবস্থা যে শক্তিশালী ও সক্রিয় ছিল এ। অপারেশনের মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়েছে। কারণ, পাকিস্তানি সেনারা যখন সবার। অগােচরে শেখপাড়ায় এসে জমায়েত হয়, তখন অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা যেভাবে ওখানে হাজির হয়েছিলেন, তা একটি উল্লেখযােগ্য ব্যাপার। মুক্তিযােদ্ধাদের গ্রুপগুলাে এলাকাভিত্তিক দায়িত্বে নিয়ােজিত থাকায় ১টি গ্রুপ অন্য গ্রুপের কাজের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করত না। তাই সীতাকুণ্ড থানার মুক্তিযােদ্ধাদের কয়েকটি গ্রুপ এক হলেও সুনির্দিষ্ট কমান্ড চ্যানেলের আওতায় তারা পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে অপারেশন করতে সমর্থ হন নি। তাৎক্ষণিকভাবে একত্র হওয়া। মুক্তিযােদ্ধাদের পারস্পরিক সমন্বয়ের ক্ষেত্রে এটি একটি দুর্বল দিক। তবু মুক্তিযােদ্ধারা যেভাবে ফায়ার অব্যাহত রেখে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করেছেন, সেটি দুঃসাহসিক এবং দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তস্বরূপ।
তথ্যসুত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক নুরুল হুদা, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড