কমলদহ রানির দিঘির পাড়ে পাকিস্তানি সেনা কনভয় অপারেশন
অবস্থান
ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রােডের দারােগার হাটের উত্তর দিকে কমলদহ রানির দিঘি। অবস্থিত। এর পাশ দিয়েই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বরাবর উত্তর-দক্ষিণ দিকে চলে। গেছে। এ দিঘির দক্ষিণ পাশ দিয়ে একটি নালা পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ট্রাংক রােডের নিচ দিয়ে বয়ে গেছে।
উদ্দেশ্য
পাকিস্তানি সেনারা যাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রােডের উভয় পাশে যথেচ্ছভাবে যেতে না পারে এবং ভীত সন্ত্রস্ত হয়, সে জন্য তাদের কনভয়ের ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে গাড়ি ধ্বংস করা।
প্রস্তুতি ও পর্যবেক্ষণ
সেপটেম্বরের প্রথম সপ্তাহ (সঠিক তারিখ সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি)। মাঠে সবুজ বাড়ন্ত ধানগাছ। বর্ষার শেষ। বৃষ্টি হচ্ছে মাঝেমধ্যে। মুক্তিবাহিনী পর্যবেক্ষণ করে দেখে যে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রােড দিয়ে কখনাে কনভয়ের মাধ্যমে, আবার কখনাে ২-১টি গাড়ি দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করছে। সন্ধ্যা এবং রাতেও তাদের চলাচল অব্যাহত থাকে। পাকিস্তানি সেনাদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক খুরশিদের নেতৃত্বে কমলদহ রানির দিঘির দক্ষিণ পাশে নালা থেকে পাকিস্তানি সেনাদের কনভয়ের ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করার পরিকল্পনা করা হয়। অপারেশন পরিচালনার জন্য সন্ধ্যা ৬টায় তারা নালার। পাশে গিয়ে নিজ নিজ অবস্থান নির্দিষ্ট করে আসেন। নালায় তখন হাটুপানি। অপারেশন পর্যবেক্ষণ করার পরদিন। সন্ধ্যার অন্ধকার আসন্ন; আবছায়া নেমে এসেছে। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক খুরশিদ, রওশন উজ্জামান ভূইয়া, নাসির আহমদ ভূইয়া (ভােলা), সিরাজুল ইসলাম, আব্দুল জলিল ও নুরুল আলম (সাহায্যকারী স্থানীয় লােক) নালার পাড়ে যান। পরিকল্পনা মতাে মুক্তিযােদ্ধাদের ৩জন নালার উত্তর পাড়ে ও ৩জন দক্ষিণ পাড়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। ৩জনের মধ্যে ২জন একটু সামনে ও অন্যজন একটু পিছনে অবস্থান নেন। প্রত্যেকের হাতে ২টি করে গ্রেনেড এবং উভয় পাড়ে প্রত্যেক গ্রুপের কাছে ১টি করে ৩০৩ রাইফেল ছিল। অধিনায়কের নির্দেশ ছিল, তার আদেশে নালার উভয় পাড় থেকে শুধু সামনের ২জন ১টি করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করবেন। পাকিস্তানি সেনারা তাদের দিকে। আক্রমণের লক্ষ্যে ধাবিত হলেই সামনের ২জন নালায় লাফিয়ে পড়বেন এবং অন্যজন ধাবমান পাকিস্তানি সেনাদের প্রতি লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করবেন। অধিনায়ক খুরশিদের কাছে ছিল কেবল ১টি রিভলভার। তারা অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের কনভয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা দক্ষিণ দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়িকে আসতে দেখেন। কিন্তু সে সময় মাত্র ২টি গাড়ি থাকায় অধিনায়ক শত্রুকে আঘাত করার আদেশ প্রদান থেকে বিরত থাকেন। অধিনায়ক ভেবেছিলেন, এ ২টি গাড়ি দ্রুতবেগে অতিক্রম করে যেতে পারে।
ফলে গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে তা কার্যকর না হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তারা ধীরগতি সম্পন্ন কনভয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। ইতােমধ্যে উত্তর দিক থেকেও একইভাবে ২-১টি গাড়ি অ্যামবুশ স্থান অতিক্রম করে । কিন্তু একই কারণে সেগুলােতেও আক্রমণ করা হয় নি। এমনিভাবে তারা ধৈর্যের সাথে পাকিস্তানি সেনাদের কনভয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। রাত প্রায় ৯টা। মুক্তিযােদ্ধাদের অপেক্ষার ফলপ্রাপ্তির লক্ষণ দেখা গেল। তারা দেখলেন, দক্ষিণ দিক থেকে প্রায় পাঁচটি গাড়ি এবং একটি কনভয় আসছে। গাড়িগুলাের গতিও তেমন দ্রুত নয়। কনভয়টির প্রথম ২টি গাড়ি তাদের অ্যামবুশের স্থান অতিক্রম করার সময় অধিনায়কের আদেশে মুক্তিযোেদ্ধারা মুহূর্তের মধ্যে পর পর ৪টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। ৪টি গ্রেনেডের মধ্যে ১টি রাস্তায় পড়ে পূর্ব দিকে গড়িয়ে যায়। অন্য ৩টির মধ্যে কনভয়ের ৩ নম্বর গাড়িতে ১টি এবং ২টি একেবারে পিছনের গাড়িতে গিয়ে পড়ে। গাড়িগুলাের ওপরের অংশ ছিল খােলা। গ্রেনেড নিক্ষিপ্ত হওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তানি সেনাদের চিৎকার শােনা যায়। অধিনায়কের সংকেতে মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে নিরাপদ দূরত্বে চলে যান। সন্ত্রস্ত পাকিস্তানি সেনারাও প্রচুর ফায়ারিং করেছিল। পাকিস্তানি সেনাদের কেউ নিহত হয়েছে কি না তা জানা যায় নি। তবে ২ দিন পর রাস্তার ওপরে রক্তের দাগ দেখতে পাওয়া গিয়েছিল।
বিশ্লেষণ
ফাদ বা অ্যামবুশের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ এবং তাতে আঘাত হানার স্থান নির্বাচনে। মুক্তিযােদ্ধারা বিশেষ বিচক্ষণতার পরিচয় প্রদান করেছেন। তা ছাড়া দক্ষতা ও সাহসিকতা এ অপারেশনের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য দিক। উল্লেখ্য, অত্যন্ত কম জনবল ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একটি বড়াে লক্ষ্যবস্তুকে সহজে কাবু করা সম্ভব নয়। এ জন্য সামর্থ্যের বিবেচনায় বড়াে লক্ষ্যবস্তুর অংশবিশেষের ওপর আঘাত হানার পরিকল্পনা কিংবা অপ্রচলিত ফঁাদ বা অ্যামবুশ করা একটি বিশেষ কৌশলরূপে বিবেচ্য। এ বিবেচনায় এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের সীমিত সামর্থ্যকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজে লাগাতে সক্ষম হন। তা ছাড়া লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসের কাজে স্বয়ংক্রিয় বা অন্য কোনাে অস্ত্র নির্বাচন না করে গ্রেনেডকে বেছে নেয়াতেও তাদের পরিকল্পনায় দূরদর্শিতা এবং বাস্তবায়নে পারদর্শিতা স্পষ্টতই প্রতীয়মান। সর্বোপরি, পাকিস্তানি বাহিনীর কনভয়ের শ্লথগতি এবং ভূমির সঠিক ব্যবহার এ অপারেশনের সাফল্যকে ত্বরান্বিত করে। কনভয় হলাে অনেকগুলাে গাড়ির সমষ্টি। চলাচলকালে সেনা কনভয় সাধারণত ধীরগতি সম্পন্ন হয়। ১টি কনভয়ে গাড়ির সংখ্যার মতাে সৈন্য সংখ্যাও অধিক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মুক্তিযােদ্ধাদের পাকিস্তানি সেনাদের ২-১টি গাড়িকে লক্ষ্যবস্তু না করে কনভয়কে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার মূল বিবেচনা ছিল কনভয়ের শ্লথগতি। সেই বিচারে তাদের লক্ষ্যবস্তু নির্বাচন ছিল যথার্থ। তবে ১টি কনভয়ে সাধারণত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরালাে থাকে। তা ছাড়া অধিকসংখ্যক সৈন্যের উপস্থিতি মুক্তিযােদ্ধাদের বিপদেরও কারণ হতে পারত। তবে মুক্তিযােদ্ধারা আকস্মিক আঘাত করে দ্রুত পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে সে ধরনের ঘটনার উদ্ভব হয় নি। পুরাে অপারেশনটিতে গেরিলা যুদ্ধের নীতি যথাযথ অনুসরণ করা হয়েছিল। এত অল্পসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধার বৃহৎ একটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত ও ক্ষতিসাধন করার মতাে ঘটনা মুক্তিযােদ্ধাদের কৌশল, আকস্মিক আক্রমণের ক্ষমতা ও সাহসের পরিচয়বাহী। তথ্যসূত্র: সাক্ষাৎকার: মুক্তিযােদ্ধা এস এম খুরশিদ আলম।
(কমলদহ রানির দিঘির পাড়ে পাকিস্তানি সেনা কনভয় অপারেশনের নকশাটি
| দেখুন ১১১৮ পাতায়)
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – প্রথম খন্ড