You dont have javascript enabled! Please enable it! যশাের যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক

যশাের যুদ্ধ

একাত্তরের মার্চেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নটি যশাের সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল রেজাউল জলিলের (বাঙগালি) নেতৃত্বে জগদীশপুরে প্রথম ইস্টবেঙ্গল বার্ষিক শীতকালীন এক্সারসাইজে ছিল। পাকিস্তানীদের নির্দেশে লেঃ কর্নেল রেজাউল জলিল ২৯শে মার্চ রাতে অধীনস্থ সমস্ত সৈনিকসহ যশাের সেনানিবাসে ফিরে আসেন। সমগ্র দেশে তখন বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। অসহিংস অহযােগ আন্দোলনে বাঙালি জাতি তখন স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত। বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ জাগ্রত জনতার সাথে সাধারণ সৈনিকদের এক করে দিয়েছিল। চারিদিকে আসন্ন স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিল। দেশের সর্বত্র দুঃসাহসী তরুণদের অস্ত্রচালনা শিক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছিল। যশােরের জনগণও স্বাধীনতার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিল। শহরের ঘরে ঘরে পত পত করে উড়ছিল স্বাধীন বাংলার পতাকা। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরাে বাংলাদেশ স্বাধীন করাে’-এই শ্লোগানের সমগ্র শহর মুখরিত। ঘরে ঘরে বেজে চলেছিল বঙ্গবন্ধু রেকর্ডকৃত ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সগ্রাম। পঁচিশে মার্চ আনুমানিক রাত সাড়ে এগারােটায় পাকবাহিনী যশাের সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে পড়ে। যশাের পােষ্ট অফিস, ব্যাংক, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, পাওয়ার হাউজ, রেলওয়ে স্টেশন ও ফায়ার সার্ভিস এলাকায় পাকসেনারা প্রতিক্ষা অবস্থান তৈরি করে এবং শহরে টহল দিতে থাকে। পঁচিশে মার্চ রাতে পাকবাহিনীর আক্রমণের আশংকায় যশাের ইপিআর সেক্টরের (বর্তমানে বিডিআর) বাঙালি সৈনিকেরা অস্ত্রাগার ভেঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ সংগ্রহ করে এবং সেক্টর সদর দপ্তরের চতুর্দিকে প্রতিরক্ষা অবস্থান সুদৃঢ় করে। শেষরাতের দিকে পাকসেনারা গুলিবর্ষণ করলে ইপিআর সৈন্যরা পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। ঐ রাতে যশােরের পাকসেনারা সংসদ সদস্য জনাব মসিউর রহমানকে গ্রেফতার করে যশাের সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং যশােরের ডিসি এবং এসপিকেও গ্রেফতার করে। ছাব্বিশে মার্চ সকালে সিগন্যাল কোম্পানী কমাণ্ডার (বাঙালি) ক্যাপ্টেন আওলাদ হােসেন সেক্টর সদর দপ্তরের সবাইকে অস্ত্র জমা দিতে বলেন। সেক্টর কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল আসলামও (পাকিস্তানী) অস্ত্র জমা দেবার আদেশ দেন। সেক্টর কমাণ্ডার জেসিও ও এনসিওদের সাথে বৈঠক করে অস্ত্র জমা দিতে বলেন। ইপিআর সৈন্যরা প্রয়ােজনীয় অস্ত্র লুকিয়ে রেখে বাকী অস্ত্র ছাব্বিশে মার্চ দুপুরে অস্ত্রাগারে রাখে।
ছাব্বিশে মার্চ সকালে চুয়াডাংগা উইং-এর বাঙালি ইপিআর সৈন্যরা মেজর এম ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্ব বিদ্রোহ করে। মেজর ওসমান চৌধুরী যশােহর সেক্টর সদর দপ্তরের বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন আওলাদ ও ক্যাপ্টেন হাসমত উল্লাহকে দেশ শত্রু মুক্ত করার জন্য তাঁর সাথে যােগ দিতে আহ্বান জানান। কিন্তু এই দু’জন বাঙালি ক্যাপ্টেন মেজর ওসমানের সাথে কথা বলতে অস্বীকার করেন। যশােহর সেক্টরের অয়ারলেস অপারেটরে মেজর ওসমানের আহ্বানে ক্যাপ্টেন আওলাদ ও হাসমত উল্লাহকে জানালেও তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। ব্রিগেডিয়ার আব্দুল রহীম দুররানী (পাকিস্তানী) ৩০শে মার্চ সকালে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অফিসে আসেন এবং কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল রেজাউল জলিলকে জানান যে, প্রথম ইস্ট বেঙ্গলকে নিরস্ত্র করা হল। রেজাউল জলিলের তত্ত্বাবধানে ব্যাটালিয়ন অস্ত্রাগারে অস্ত্রশস্ত্র জমা করে। ব্রিগেডিয়ার দুররানী অস্ত্রগারের চাবি হস্তগত করেন। সকাল ৯টার দিকে ১৪তম ডিভিসনের ১০৭ ব্রিগেডের ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এবং ২৫ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা অতর্কিতভাবে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের বাঙালি সৈন্যদের আক্রমণ করে। পাকসেনারা যশাের পুলিশ লাইন ও ইপিআর সদর দপ্তরের ওপর যুগপৎ গােলন্দাজ বাহিনী কামানের গােলা নিক্ষেপ করে। প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের সৈন্যরা এই ভয়াবহ অবস্থায় প্রতিরােধ গড়ে তােলার চেষ্টা করে। কিন্তু পাকবাহিনীর সুপরিকল্পিত গােলন্দাজ বাহিনীর গােলা নিক্ষেপের ফলে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন। শুধুমাত্র লেঃ হাফিজ (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর) সেনানিবাস থেকে কিছু সৈন্যসহ বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। এই আকস্মিক আক্রমণ ও পাকিস্তানীদের জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অধিকাংশ সৈনিক পাকিস্তানীদের হাতে মৃত্যু বরণ করেন। পাকবাহিনী-বাঙালি সৈনিকদের পরিবার পরিজনদেরও হত্যা করে। ৭ম ফিল্ড রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার (বাঙালি) লেঃ কর্নেল এস এ হাই এবং ক্যাপ্টেন আবুল কালাম শেখকেও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। মেজর হাফিজ বলেছেন যে, যশাের ক্যান্টনমেন্টে, ১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ আমি তখন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ানের একজন তরুণ অফিসার। আমাদের সৈনিকেরা সবাই বাঙালি, উপস্থিত অফিসারদের মধ্যে আমরা তিনজন বাঙালি, চারজন পাঞ্জাবী। ভাের সাড়ে সাতটার দিকে ব্রিগেডিয়ার দুররানী এসে আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার আদেশ দিয়ে চলে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সৈনিকেরা উত্তেজিত হয়ে বিদ্রোহ করে এবং অস্ত্রাগার ভেঙ্গে অস্ত্র হাতে নিয়ে পার্শ্ববতী বেলুচ রেজিমেন্ট ও ইঞ্জিনিয়ারস কোম্পানীর ব্যারাকের ওপর গুলি বর্ষণ করে। পাকিস্তানী সেনারাও এ ধরনের ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই তারা আমাদের তিনদিক থেকে আক্রমণ করে। বিকট শব্দ করে মর্টারের গােলা পড়তে লাগল আমাদের অফিসের চারদিকে। জীবনে প্রথমবারের মতাে শত্রুর উড়ন্ত গােলাগুলির সম্মুখীন হবার ললামহর্ষক অভিজ্ঞতা হল। আমার নেতৃত্বে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকেরা শত্রুকে প্রাণপণে প্রতিহত করে। যুদ্ধ পরিচালনার ফাঁকে উত্তেজিত মানসিক অবস্থায় ভাবছি কি করা যায়। আমি তেমন রাজনীতি সচেতন ছিলাম না, খেলাধুলা আর চাকরি নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। জানুয়ারি থেকে ১৫ই মার্চ পর্যন্ত সেনাবাহিনী দলের হয়ে পশ্চিমপাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে ফুটবল প্রতিযােগিতায় অংশ গ্রহণ করেছিলাম। ১৬ই মার্চ সুলতান থেকে ঢাকা হয়ে যশােরে ক্যান্টনমেন্ট কর্মস্থলে ফিরে এলাম। আমাদের ইউনিটও বিগত দু’মাস ধরে সেনাছাউনির বাইরে সীমান্ত এলাকায় শীতকালীন ট্রেনিংয়ে নিয়ােজিত ছিল। আমাকে ১৬ই মার্চে সরাসরি ট্রেনিং এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হল আমার কোম্পানীর ট্রেনিংয়ে অংশ
নেবার জন্য। তখন সারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল উত্তপ্ত। পশ্চিম পাকিস্তানের এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় ট্রেনিংয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে বাঙালি জনসাধারণের সংস্পর্শে আসতে পারিনি। হেড কোয়ার্টারের নির্দেশে ২৯শে মার্চ গভীর রাতে পায়ে হেঁটে আমরা যশােহর ছাউনিতে ফিরে যাই। কাজেই ২৫শে মার্চে পাকআমির হত্যাযজ্ঞ, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিরােধ সংগ্রাম, ২৭শে মার্চ মেজর জিয়ার বেতার ভাষণ ইত্যাদি সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না ৩০শে মার্চের সকাল পর্যন্ত। ব্যাপারটি হয়ত অবিশ্বাস্য মনে হবে অনেকের কাছে। আমাদের কাছে রেডিও রাখা এবং শােনা নিষিদ্ধ ছিল।
৩০শে মার্চ সকালে বিদ্রোহ করে আমি নিজেই চিন্তা করছিলাম, এ কি করলাম। আমার ধারণা হচ্ছিল যে দেশে বােধহয় আমিই একমাত্র অফিসার যে সেনাদল নিয়ে বিদ্রোহ করেছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে খুবই চিন্তাক্লিষ্ট মনে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
ইতিমধ্যে যুদ্ধ চলছে প্রায় ছ’ঘণ্টা। আমাদের গােলাগুলি প্রায় নিঃশেষ। ২য় লেঃ আনােয়ারকে ডেকে বললাম, “আমি বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দিচ্ছি, তুমি কি করবে ভাবছাে?’ কুমিল্লার এক আদর্শবান স্কুল শিক্ষকের পুত্র আনােয়ার তরুণ অফিসার। মাস ছয়েক আগে পল্টনে যােগ দিয়েছে। ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তুখােড় এ্যাথলেট ছিল সে। দৃপ্তকণ্ঠে আমাকে জানাল সেও সংগ্রাম, উই শ্যাল ফাইট ইট আউট। ২৫ বেলুচ যে এলাকা থেকে আমাদের ওপর আক্রমণ করেছে, সে প্রতিরক্ষা ব্যুহের দায়িত্ব দিলাম তাকে। ঘন্টাখানেক পর বেলা ৩টার দিকে সিদ্ধান্ত নিলাম ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে গ্রামাঞ্চলের দিকে বেরিয়ে পড়তে হবে। উপস্থিত জুনিয়র কমিশণ্ড অফিসারদেরকে ও আনােয়ারকে ডেকে ফায়ার এবং মুভ’ পদ্ধতিতে ছােট ছােট গ্রুপে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা জানালাম। একত্রিত হবার স্থান নির্ধারিত হল চৌগাছা বাজার।
প্রায় আট ঘণ্টা লড়াই চালিয়ে যাবার পর আমাদের সেনারা ছােট ছােট গ্রুপে বেরিয়ে যায়। শত্রুর বৃষ্টির ধারার মতাে গুলীবর্ষণের ফলে ক্ষেতের ধুলাে উড়ছে। অথচ এর মধ্য দিয়েই বেরুতে হবে। অন্যান্য সব পথই শক্ৰবেষ্টিত। | বেলা চারটার দিকে আমি ও আনােয়ার আলাদা আলাদা গ্রুপে সেনাছাউনি ছেড়ে পশ্চিমের গ্রাম অভিমুখে বেরিয়ে পড়লাম গুলিবৃষ্টির মাঝে। প্রায় এক হাজার গজ ব্যাপী খােলা মাঠ অতিক্রম করে গাছের ছায়াঢাকা গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করেই দেখি এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
সারা গ্রামের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ঘর ছেড়ে এসেছে, তাদের হাতে দা, কুড়াল, কাস্তে, লাঠি ইত্যাদি বিচিত্র সব হাতিয়ার। তাঁরা এসে আমাদেরকে জড়িয়ে ধরছে, খুশিতে কাঁদছে , কেউ কেউ শ্লোগান পর্যন্ত দিচ্ছে—‘জয় বাংলা, আল্লাহু আকবর। আমার সেনাদল নিয়ে গ্রামের কাঁচা সড়ক ধরে চৌগাছার দিকে যাওয়ার পথে দু’ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে অগণিত আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। কারাে হাতে ডাব, কারাে হাতে পানির কলসি কিংবা জগ, কেউ বা একথালা মুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটু কিছু আমাদের মুখে দেবার জন্য কি আকুল আবেদন তাঁদের। একটি কুঁড়েঘরের সামনে বসিয়ে পরম মমতায় একগ্লাস পানি খাওয়ালেন এক বৃদ্ধ, তার স্ত্রী আমাকে বাতাস করে বললেন, ইস, কোন মায়ের পুত না জানি বাবা তুমি।’ অদূরে দাড়িয়ে এক মাঝবয়েসী মহিলা। তার হাতে মাছ কোটার ধারালাে বটি, তার চোখের অগ্নিঝরা দৃষ্টি আমার আজীবন মানে থাকবে।
যশােরের আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, ‘আসুক ব্যাটা পাঞ্জাবী, দু’টুকরাে করে ফেলেবাে না। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এ-কোন জাতির সঙ্গে পরিচয় হল আজ! যুগযুগান্তরের ভেতাে বাঙালি, নিরীহ মুখচোরা শীর্ণদেহী মানুষেরা কিসের বলে বলীয়ান হল, সহসাই উপলদ্ধি করলাম আমরা বিছিন্ন নই, জনতার মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলাম, এতাে খুশি আর কখনও হইনি। গভীর প্রশান্তি নেমে এল মনে, যেন নবান্ন হল আমার । বুঝলাম ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, আলজেরিয়ার জনতার মতাে বাঙালিরাও জাতীয় জীবনে এক মহান অধ্যায়ের সূচনা করেছে। চৌগাছার পথে একজন কলেজ ছাত্র জানাল যে, ২৫শে মার্চ গণহত্যার পর সারাদেশে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়েছে, মেজর জিয়া চট্টগ্রামের বেতারে স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন, কুষ্টিয়ার মেজর ওসমানের নেতৃত্বে প্রতিরােধ যুদ্ধ চলছে। | মেজর হাফিজের যুদ্ধকালীন ডাইরী থেকে জানা যায় যে, ৩০শে মার্চ, ১৯৭১, আজ আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় কাহিনীর অবতারণা হয়। সকাল ৮টায় ব্রিগেডিয়ার আবদুর রহিম দুররানী আমাদের ব্যাটালিয়নের অফিসে এসে আমাদের পল্টনকে ডিজার্ম করে এবং সকল হাতিয়ার Kote-এ বন্ধ করে তার চাবিগুলাে দখল করে নেয়। আমাদের বীর সেনারা এহেন ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপের খবর পেয়ে ভীষণভাবে উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং বিদ্রোহ ঘােষণা করে। তারা Kote-এর দরজা ভেঙ্গে সব হাতিয়ার বের করে নেয় এবং আমাদের অফিস এবং লাইনের চারদিকে পরিখার মধ্যে defence নেয়। ইতিমধ্যে ২৫ বেলুচ ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স দু’কোম্পানী আরেক ২৭ বেলুচ আমাদেরকে ঘিরে ফেলে এবং মর্টার ও আর্টিলারীর সাহায্যে আমাদের ওপর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ করতে থাকে। দীর্ঘ ছ’ঘন্টা লড়াইয়ের পরে আমাদের নেতৃত্বে আমাদের পল্টনের সাড়ে তিনশ’ লােক তখন ছুটছিল। জওয়ানরা যারা যশােরে ছিল সবাই আমার পেছনে বেরিয়ে এসে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। শত্রুরা আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী সর্বপ্রথমেই মর্টারের গােলার সাহয্যে আমাদের ম্যাগাজিন ও মর্টারগুলাে উড়িয়ে দেয়। আমাদের গ্যারেজ একটু দূরে থাকায় ওরা ওখানে এসে প্রথমে পৌছে যায় এবং আমার কোনাে গাড়ি সঙ্গে আনতে পারিনি। আমি জেসিও এবং এনসিওদেরকে একত্রিত করে লড়াই চালিয়ে যেতে বললাম এবং ছােট-ছােট গ্রুপ বেরিয়ে গিয়ে চৌগাছার কাছে একত্রিত হতে বললাম। বাঙালি অফিসার ছিল তখন তিনজন, সিও, আমি এবং লেফটেন্যান্ট আনােয়ার । আনােয়ারকে আমি বেরিয়ে যাওয়ার প্লান জানানাের সাথে সাথে সে আসতে রাজি হল। আমার একটু পেছনে প্রচণ্ড মেশিনগানের গুলি এবং আর্টিলারি শেলিং-এর মধ্যে দিয়ে সে আমাকে অনুসরণ করছিল। কিন্তু আমাদের এবং সমস্ত বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য যে, হঠাৎ মেশিনগানের এক ব্রষ্ট তার কোমরে বিদ্ধ হয়, ফলে একটু পরেই ও শাহাদাৎ বরণ করে। মৃত্যুকালে আমার সাথে তার দেখা হল না। ওকে খিতিবদিয়া গ্রামবাসীরা ছােট হায়বতপুর গ্রামে নজরুল ইসলাম কলেজের সম্মুখে কবরস্থ করে। মৃত্যুর আগে সে আমার কাছে একটা চিঠি লিখে তাতে নিজের রক্ত মাখিয়ে রেখে যায় এক মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে। সে চিঠিটা কোনােদিন আমার হাতে পৌছল না।
ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে ১৮ মাইল পথ বিলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে পৌছলাম মাছলিয়া বিওপি’তে। সকালে গােলাগুলি করে দেখলাম আমাদের দু’শ লােক ওখানে পৌছেছে। অফিসার আমি একা, জেসিও নয় জন, বাকি ও আর। সবাই আমাকে দেখে

আনন্দে কাঁদতে লাগল। তাদেরকে একত্র করে ছােটখাটো বক্তৃতা দিয়ে বললাম যে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুর হল। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যখন অস্ত্র ধারণ করেছি তখন মাতৃভূমি মুক্ত না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হব না। সবাই প্রতিজ্ঞা করল যে দেহের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও বাংলাদেশকে স্বাধীন এবং শত্রুমুক্ত করতে হবে। তখনও জানি না বাংলাদেশের কোথায় কি হচ্ছে। কেবল জানলাম ইপিআররাও বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে। আমদের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্যান্য ব্যাটেলিয়ন যে কি করছে কিছুই জানতে পারলাম না। জেসি ওদের মধ্যে মাছলিয়াতে যারা আমার সাথে আসলেন তারা হলেন, সুবেদার আবুল খায়ের, সুবেদার আবদুল মজিদ, সুবেদার চাদ বকশ, সুবেদার রজব আলী, নায়েক সুবেদার আহমদ উল্লাহ, নায়েব সুবেদার সিদ্দিক, নায়েব সুবেদার আব্দুল সােবহান, নায়েব সুবেদার আখতার হােসেন, নায়েব সুবেদার নজরুল ইসলাম ও সুবেদার ফিরােজ খান প্রমুখ।
আমার কথা শুনে সিনিয়র টাইগাররা বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবনপণ করে মুক্ত করার জন্য দৃঢ় সংকল্প হল। মাছলিয়াতে আমরা ডিফেন্স নিলাম এবং যশাের ক্যান্টমেন্টের আশেপাশে বিভিন্ন খবরাদির জন্য পেট্রোলিং শুরু করলাম। এক বিরাট দায়িত্ব পালনের জন্য মনে মনে নিজেকে তৈরি করলাম। বিখ্যাত ইস্ট বেঙ্গল পল্টনে আজ আমি একমাত্র অফিসার। সমস্যার অন্ত নেই, খাবার, জামা-কাপড়, গােলাবারুদ equipment কোন কিছুই নেই বললে চলে। কিন্তু আমাদের সেনাদের অজেয় মনােবলই আমার প্রধান শক্তি। শত্রুর মােকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম।
৭ই এপ্রিল, ১৯৭১। খবর পেলাম যে চুয়াডাংগাতে ইপিআর-এর মেজর ওসমান ইপিআরদের নিয়ে সংগ্রাম শুরু করেছেন। কুষ্টিয়াতে ইপিআর-এর এক কোম্পানী এবং নাগরিকরা একত্র হয়ে ২৭ বেলুচ-এর দু’টো কোম্পানীকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের সকল অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ, গাড়িগুলাে দখল করে নিয়েছে। এটা একটা বিরাট সাকসেস। মেজর ওসমান আমাকে খবর দিলেন দেখা করার জন্য। চুয়াডাংগা পৌছলাম, দেখা হল তার সাথে। যশাের সেক্টরে কোথায় কি হচ্ছে খবরাখবর পেলাম। তার কাছ থেকে কয়েকটি জীপ আর এইচ এমজি এবং চাইনিজ, ammunition পেলাম। পুল ওড়ানাের জন্য এক্সপ্লোসিভও নিলাম। এখানেই দেখা হল আমার প্রিয় বাল্যবন্ধুদ্বয় তওফিক এলাহী চৌধুরী, পিএসপি ও মাহবুব উদ্দিন, পিএসপি-এর সাথে। ওরাও মেজর ওসমানের অধীনে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছে। ভাবতেও অবাক লাগে আমরা তিনবন্ধু একত্র হলাম এক মহান সংগ্রামের পটভূমিতে।
ইপিআর-এর ৫নং উইংটি খুলনায় অবস্থান করছিল। এই উইং-এর সকল অফিসারই ছিল পাকিস্তানী । উইং সদরদপ্তরের সব বাঙালি সৈনিকেরা পঁচিশে মার্চ রাতে বন্দি হয়ে যায়। উইং-এর অন্যান্য কোম্পানীগুলাের মধ্যে সাতক্ষিরার কলারোয়ায় অবস্থানরত ‘এ’ কোম্পানী সুবেদার আবদুল জলিল শিকদারের নেতৃত্বে, সুবেদার হাসান উদ্দিনের নেতৃত্বে ‘সি’ কোম্পানী-সুবেদার জব্বার আলীর নেতৃত্বে সাতক্ষিরা থেকে ‘ডি’ কোম্পানী এসে যশোরে বিদ্রোহী সৈনিকদের সাথে যােগদান করে। কালীগঞ্জ থেকে সুবেদার তবারক উল্লাহ তার কোম্পানীসহ মেজর ওসমানের সাথে মিলিত হন। এই সব সৈন্যরা যশােরের ঝিকরগাছায় একত্রিত হয়ে যশাের অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। যশােরের কারবালার কাছে, উপশহর এলাকায়, গরীব শাহ মাজারের কাছে এবং যশাের-খুলনা মহা সড়কের ওপরে এই সব সৈনিকেরা প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। চাচড়ার মােড়ে ৬ পাউন্ড

কামান বসান হয়। নিকটস্থ ট্রাফিক আইল্যান্ডের কাছে অপর একটি কামান বসান হল। এ ছাড়া সন্ন্যাসদীঘি এলাকাতেও সৈন্য মােতায়েন করা হয়। যশাের সেক্টর সদর দপ্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সৃদৃঢ় করা হয়। খুলনা থেকে পাকসেনারা ১টি জীপ, ১টি ডজ ও ১টি ৩টন গাড়িতে করে অস্ত্রশস্ত্র গােলাবারুদসহ যশাের আসছিল ৩০শে মার্চ সন্ধ্যায়। পাকসেনারা চাঁচড়ার কাছে আসা মাত্র মুক্তিবাহিনী এদের এ্যাম্বুশ করে। তিনদিক থেকে আক্রমণ করা হয় এবং ৬ পাউন্ডের কামানের গােলা নিক্ষেপ করা হয়। এই সংঘর্ষে আনুমানিক ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনা যশাের সেনানিবাসে পালিয়ে যায়। | ৩১শে মার্চ যশাের ইপিআর-এর অনুরােধে চুয়াডাংগা থেকে দুই কোম্পানী সৈন্য যশােরের সাহায্যে পাঠানাে হয়। এই দুই কোম্পানী ইপিআর সৈন্য যশােরের বারােবাজারে পাকবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ফলে কোম্পানী দু’টি যশাের সেনানিবাস আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়। ২রা এপ্রিল মুক্তিবাহিনী যশাের সেনানিবাসের প্রায় অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এই সময় সেনানিবাসে শ্বেত পতাকা উড়তে দেখে মুক্তিবাহিনী উল্লাসে ফেটে পড়ে। যশাের সেনানিবাসে শ্বেত পতাকা উড়িয়ে বস্তুত পাকিস্তানীরা সি-১৩০ পরিবহন বিমানে করে সাদা পােশাকে সৈন্য ও গােলাবারুদ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসছিল।
ছুটি ভােগরত বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম ১লা এপ্রিল যশােরে আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। এই সময় ক্যাপ্টেন আবদুল হালিমের নির্দেশে কয়েকজন বেনাপোেল হয়ে সাহায্যের প্রত্যাশায় ভারতে যান। ১৭তম ভারতীয় বিএসএফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক সাহয্যের আশ্বাস দিলেও আশানুরূপ সাহায্য পাওয়া যায়নি। ৩রা এপ্রিল থেকে যশাের মুক্তিবাহিনীর অবস্থানগুলাের ওপরে আকস্মিকভাবে পাকবাহিনী কামানের গােলা নিক্ষেপ করতে থাকে। পাকসেনাদের এই তীব্র আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। মুক্তিবাহিনীর দলগুলাে একে অপরের কাছ থেকে একটি দল সুবেদার হাসানুদ্দিনের নেতৃত্বে নড়াইলের দিকে এবং অপর দলটি ঝিকাগাছার দিকে চলে যায়। লেঃ (অবঃ) মতিউর রহমান নড়াইলে সুবেদার হাসানুদ্দিনের বাহিনীর সাথে মিলিত হন। নড়াইলের মহুকুমা প্রশাসক কামালউদ্দিন সিদ্দিকির সাহায্যে স্থানীয় জনতা, আনসার, পুলিশ, মুজাহিদ, ছাত্র-যুবকেরা ঝুমঝুমপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। ১৩ই এপ্রিল পাকসেনারা নড়াইল দখল করলে মুক্তিযােদ্ধারা মাগুরা চলে যান এবং সীমাখালি নামক স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন। পাকিস্তানীদের ব্যাপক আক্রমণের ফলে মুক্তিবাহিনী মাগুরা থেকে কামারখালী এসে নদীর তীরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। পরবর্তীকালে মুক্তিযােদ্ধারা কামারখালী এলাকা থেকে রাজাপুর সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নেয়। কুষ্টিয়ার পতনের পরে মেজর ওসমান চৌধুরী তাঁর সদর দপ্তর ইছাখালী থেকে ১৮ই এপ্রিল যশােরের বেনাপােলে স্থানান্তর করে। বেনাপােল-যশাের সড়ক ও বেনাপােলের পূর্বে কাগজ পুকুরে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করা হয়। এপ্রিলের ২০ তারিখে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল (পরে জেনারেল) এম এ জি ওসমানী বেনাপােলে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর পরিদর্শনে আসেন। এসময়ে মেজর ওসমান চৌধুরী, ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজ উপস্থিত ছিলেন। বেনাপােলে কাষ্টম কলােনীর দক্ষিণে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের এক কোম্পানী সৈন্যকে লেঃ হাফিজের নেতৃত্বে মােতায়েন করা হয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদও ২৩শে এপ্রিল ব্রিটিশ এম জি ডগলাসম্যানকে সঙ্গে করে বেনাপােল পরিদর্শনে আসেন। পাকসেনাদের আক্রমণের ফলে কাগজপুকুর প্রতিরক্ষা অবস্থানের পতন হলেও বেনাপােলের মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরের পতন হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা বেনাপােলে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে পত পত করে উড়ছিল। মেজর ওসমান চৌধুরীর নির্দেশে মুক্তিবাহিনী সাতটি কোম্পানীতে বিভক্ত হয়ে সীমান্ত এলাকায় সাতজন অধিনায়কের নেতৃত্বে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করল। শুরু হল মুক্তিযুদ্ধের আর এক অধ্যায়। সে এক অন্য ইতিহাস।
সূত্র – মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন