দ্যা ইভিনিং স্টার, ওয়াশিংটন, ডিসেম্বর ১৯৭১
উচ্ছসিত বাঙ্গালীদের স্বাধীনতা উৎযাপন
যশোর, পূর্ব পাকিস্তান: যখন পূর্ব বাংলার উচ্ছসিত জনতা তাদের উপর এতদিন অত্যাচারকারী প্রতিপক্ষ দলের মৃতদেহগুলোকে ঘিরে আনন্দ করছিল, তখন পশ্চিম পাকিস্তানের ১০০০ সৈনিকের একটি দল শোচনীয় পরাজয়ের পর তাদের পরিবারসহ, ইন্ডিয়ান মিত্রবাহিনীর হাতে মারা পরা অথবা আটক হওয়ার ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল সমুদ্রের দিকে।
যশোর থেকে বেড়িয়ে আসার প্রধান সড়কটি ইন্ডিয়ানরা কোন প্রকার যুদ্ধ ছাড়াই তিনদিন আগেই দখল করে নেয়, গতকাল (৮, ডিসেম্বর) পাকিস্তানী সৈন্যদের মৃতদেহ, পুড়ে যাওয়া জীপ, ট্রাক, ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র রাস্তার উপর পরে থাকতে দেখা যায়।
আত্মসমর্পন অথবা মৃত্যু
পালিয়ে যাওয়া পাকিস্তানিরা তাদের স্ত্রী সন্তান নিয়ে যদি সাগর পর্যন্ত যেতেও পারে তাও তাদের বাকি পথটুকু অতিক্রম করার জন্য সমুদ্রে সাঁতার কাটতে হবে কারন সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে ভারতীয় নৌবাহিনী, পালিয়ে যেতে পারা পাকিস্তানী জাহাজগুলো পরিণত হবে ভারতীয় বিমানবাহিনীর নির্ভুল লক্ষ্যে, যারা ইতোমধ্যেই আকাশে তাদের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে।
জল স্থল আর আকাশ সব দিক থেকে আক্রমণের শিকার হয়ে আটকে পরা ৬০,০০০ পাকিস্তানী সৈন্যকে পূর্ববাংলার জনগণের প্রতিহিংসার মুখে আত্মসমর্পন অথবা মৃত্যু এ দুটির একটিকে এখন বেছে নিতে হবে।
পূর্বে যশোর আর পশ্চিমে কুমিল্লার মত দুটি প্রধান ও শক্ত ঘাটিতে পরাজয়ের পর ঢাকায় পাকিস্তানিরা আদৌ কোনও যুদ্ধ করতে পারবে কিনা তা নিয়েই সন্দেহ দেখা দেয়। যদিও ঢাকা তাদের রাজধানী এবং ত্রিভূজ প্রতিরক্ষা বূহ্যের শীর্ষ বিন্দু।
ভয়ংকর বলে বিবেচিত পাকিস্তানি যোদ্ধাদের সহজেই পরাস্ত করতে পারায় ভারতীয় সেনাক্রর্মকর্তাদের একটু বিব্রতই দেখাচ্ছিল। তারা জানায় তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই শত্রুদের পিছনে ধীরে ধাওয়া করছিল।
“আমরা তাদের আত্মসমর্পন করতে অনুরোধ করছি” আর্টিলারি অফিসার মেজর সাবু সিং বলেন, “তাদের সামনে এখন আর কোনও রাস্তা খোলা নেই, আর আমরা আকাশপথ ব্যবহার থেকে বিরত আছি শুধুমাত্র নারী এবং শিশুদের কথা ভেবে।“
কাল চামড়ার বাঙ্গালীরা রাস্তার পাশে দাড়িয়ে অগ্রবর্তী ইন্ডিয়ান বাহিনীকে স্বাগত জানায় “জয় বাংলা” চিৎকারে, তাদের আত্মস্বীকৃত নতুন দেশকে ইতোমধ্যেই নয়াদিল্লী সমর্থন করেছে।
যশোর এবং খুলনার মধ্যবর্তী রাস্তার একটি অংশে, বিদেশি টেলিভিশন ক্যামেরার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য একদল বাঙালি ডজনখানেক মৃত পাকিস্তানি সৈনিকদের ঘিরে নাচতে থাকে আর “জয়বাংলা” চিৎকার করতে থাকে।তাদের কেউই কখনো টিভি, দেখেনি এমনকি তাদের কোনও বিদ্যুৎ সংযোগও নেই।
ইন্ডিয়ান মুক্তিবাহিনীর প্রতি খানিকটা রক্ষণশীল মনোভাব পোষন করলেও বাঙ্গালীরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছথেকে মুক্ত হতে পেরে যে এখন উৎফুল্ল এ বিষয়টি পরিষ্কার। কারণ গত আটটি মাস অহংকারে অন্ধ পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতিসত্বাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য হাজারে হাজারে বাঙ্গালী জবাই করে হত্যা করেছে।
গণহত্যার অভিযোগ
পিছু হটে যাওয়া পাকিস্তানিরা তাদের চলার পথের ব্রীজগুলোকে ধ্বংস করে দেয়ার পাশাপাশি আর কিছু গণহত্যার কাহিনী রেখে যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়াররা প্রশংসনীয় দক্ষতার সাথে পন্টুন ব্রীজগুলোকে জুড়ে দিয়ে বড় নদীগুলো পার হতে সক্ষম হয়।
পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যার কাহিনী গ্রামে গ্রামে উত্তেজিত বাঙ্গালীদের মুখে মুখে ফিরছে। একজন বাঙ্গালী বলছিল- কিভাবে পাকিস্তানিরা বিল্লাল (যা এই অঞ্চলের একটি অতি প্রচলিত নাম) নামের মুক্তিবাহিনীর একজন নেতা কে খুঁজতে তাদের গ্রামে আসে। যখন তারা তাকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলো তখন এই নামে ঐ গ্রামে যে ১০ জন লোক ছিল তাদের সবাইকে তারা গুলি করে মারে।