বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৩ই মার্চ, বুধবার, ১৯৭৪, ২৯শে ফাল্গুন, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
সামরিক বিদ্যায়তন
ময়নামতি সেনানিবাসের মনোরম পাহাড়ের সবুজ চূড়ায় দেশের প্রথম সামরিক বিদ্যায়তন স্থাপিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত সোমবার সামরিক বিদ্যায়তনটি উদ্বোধন করলেন। এ উপলক্ষে জোয়ানদের এক সমাবেশে আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠার মনোভাব নিয়ে দেশ সেবার জন্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান।
সেনাবাহিনীর জোয়ানদের স্মরণ করিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, শান্তির সময়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকা হচ্ছে দেশ থেকে চোরাচালানী ও অন্যান্য ঘৃণ্য কার্যকলাপ নির্মূল করার কাজে সরকারকে সহায়তা করা। তিনি বলেন, সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করে দেবার অপচেষ্টায় যারা লিপ্ত তাদের সম্পর্কে জোয়ানদের সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধে জোয়ানদের বীরত্ব ও ত্যাগের ভুয়শী প্রশংসা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, আপনারা জনগণের সৈনিক, ভাড়াটে বাহিনী নন বরং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের সেনাবাহিনী।
উপমহাদেশে সম্প্রীতির নব অধ্যায় সম্পর্কে বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি উপমহাদেশে শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্যে বাস করতে চাই। কারো সঙ্গে শত্রুতা নয় বরং সকলের সাথে শান্তিতেই বাস করতে চাই। তিনি আরো বলেন, আমি কারো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাইনা, তেমনি কোনো মহলের হস্তক্ষেপও আমি সহ্য করবো না।
সেনানিবাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত টিলায় ঘেরা স্থানে দেশের প্রথম সামরিক বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠার দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ দিনটির কথা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
দীঘদিনের সাধনা, ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালী জাতি একটা রক্তাক্ত বিপ্লবের পর স্বাধীনতা সূর্যের আলোকে অবগাহন করার সুযোগ পেয়েছে। আটচল্লিশ, বায়ান্ন, চুয়ান্ন, বাষট্টি, ঊনসত্তর ও একাত্তরের রক্তঝরা দিনগুলোতে বাংলার মানুষ স্বপ্নের জাল বুনেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আটচল্লিশ সালের এগারোই মার্চ ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণের দায়ে গ্রেফতার হন। ভাষা আন্দোলনের দাবী ছিল স্বাধিকারের দাবী। আর এ দাবী পরবর্তী পর্যায়ে রূপান্তরিত হয় স্বাধীনতার দাবীতে।
পাকিস্তানী শাসনামলে এদেশের মাটিতে সামরিক বিদ্যায়তন স্থাপন করা দূরে থাকুক বাঙালীদের সেনাবাহিনীতে যোগদান করার মতো সুযোগ-সুবিধাও ছিল না। বাঙালী জাতি যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত নয় এ ঠুনকো অজুহাত দেখিয়ে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হতো না। কিন্তু বাঙালী জাতি যে বীরের মতো যুদ্ধ করতে জানে, শত্রুর সাথে পাঞ্জা লড়তে পারে তারই প্রমাণ হলো একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম। বাংলার মাটি যে দুর্জয় ঘাঁটি তা সেদিন দুর্বৃত্তরা বুঝে নিয়েছিল।
এগারোই মার্চ তারিখে দেশের প্রথম সামরিক বিদ্যায়তন উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে যেমন বাঙালী জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হলো তেমনি বাস্তবায়িত হলো জাতির পিতার স্বপ্ন।
আজ যাঁরা সেনাবাহিনীতে আছেন এবং ভবিষ্যতে যারা সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন সকলের জন্যেই সমান সুযোগের পথ প্রশস্ত করলো সামরিক বিদ্যায়তন। আজ আর কেউ এ অপবাদ দিতে সাহস পাবে না যে, বাঙালী জাতি যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত নয়।
সেনাবাহিনীর জোয়ানদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু যে মূল্যবান ও তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন তারই প্রতিধ্বনি করে আমরা বলবো, একটি স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক। শান্তি ও যুদ্ধকালীন-দু’টো অবস্থাতেই রয়েছে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব। শান্তিকালে সেনাবাহিনী দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে, চোরাচালানী আর মুনাফাখোরদের উচ্ছেদ করতে এগিয়ে আসতে পারেন। শুধু তাই নয়, অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে যারা নস্যাৎ করে দিতে চাইছে তাদেরও নির্মূল করার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর উপর। অপরদিকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার দায়িত্বও সেনাবাহিনীর উপর অর্পিত।
সেনাবাহিনীতে যারা রয়েছেন তারা এদেশেরই সন্তান। স্বাধীনতা সংগ্রামে এদের অনেকেরই অপরিসীম অবদান রয়েছে। রয়েছে সংগ্রামী ঐতিহ্য। এ ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের বীর জোয়ানরা সদা সতর্ক থাকবেন এ আশাই আমরা করছি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক