You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.03.30 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | দ্রব্যমূল্য রোধে সরকার সত্বর ব্যবস্থা নিন | ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দিন | পুরনো ব্যাধিকে ‍নির্মূল করতে হবে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৩০শে মার্চ, শনিবার, ১৯৭৪, ১৬ই চৈত্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

দ্রব্যমূল্য রোধে সরকার সত্বর ব্যবস্থা নিন

দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরকার মওজুতদার, কালোবাজারী, মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর ফলে কোথাও দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি অনুকূলে এসেছে কোথাও প্রতিকূলে গেছে। তবু সর্বোপরি এ অভিযান সর্বমহলের অভিনন্দন লাভ করেছে। যদিও এ অভিযানে কিছু কিছু পরিকল্পনার অভাব হেতু অশুভ ফলোদয় লক্ষ্য করা গেছে। যারা দুর্নীতির মূলে তাদের অনেকেই নাকি এ অভিযান থেকে ফসকে যাচ্ছে। রুই-কাতলাদের ধরতে না পারলে যে এ অভিযান ব্যর্থ হযে যাবে তা নিশ্চিত করে বলা চলে।
খাদ্য-শস্যের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে গত পরশুদিন উচ্চ পর্যায়ের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঊর্ধ্বমূল্য কেমন করে রোধ করা যায় তার উপায় উদ্ভাবনের জন্য এ সভা গুরুত্বপূর্ণ। জানা গেছে, কর্তৃপক্ষ দ্রব্য-মূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে জরুরী ভিত্তিতে মোকাবেলা করবেন। একটি সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধির কাছে আমাদের খাদ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন যে, খাদ্য-শস্যের বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি নাকি সম্পূর্ণ সাময়িক ব্যাপার। তাই এই অবস্থাকে সর্বতোভাবে জরুরী ভিত্তিতে মোকাবেলা করা হবে। খাদ্য মওজুত প্রসঙ্গে বলতে গিয়েও মন্ত্রী দেশে সন্তোষজনক খাদ্য মওজুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন। উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে দেশে খাদ্য-শস্যের মূল্যের অব্যাহত ঊর্ধ্বগতি রোধ ও দ্রব্যমূল্য হ্রাসের ব্যাপারে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া দেশের সার্বিক খাদ্য পরিস্থিতি ও দেশের অভ্যন্তরে বহির্বিশ্ব থেকে খাদ্য সংগ্রহ সম্পর্কিত বিষয়াদি নিয়েও পর্যালোচনা করা হয়েছে। সুষ্ঠু সরবরাহ ও সুষ্ঠু বন্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার স্বপক্ষে বৈঠক অভিমত পোষণ করেছে। দেশের খাদ্য পরিস্থিতি এবং দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত ঊর্ধ্বগতি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক ব্যাপার। গোটা জাতি আজ দ্রব্যমূল্যের কারণে জর্জরিত। যে সকল জিনিসের ঘাটতি রয়েছে তা পূরণে সরকার তৎপর এ কথা সত্য। দেশের ভুক্তভোগী মানুষের কাছে বিভিন্ন জিনিসের সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত করার জন্যেও কর্তৃপক্ষ প্রাণান্ত। একশ্রেণীর সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা সেই বন্টন ও সরবরাহে ঘাপলা সৃষ্টি করে চলেছে এবং জনজীবন দরকার কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু ও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ। সঙ্গে সঙ্গে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলসমূহের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। সমাজবিরোধী এই সকল মুনাফাখোর, কালোবাজারী ও মওজুতদারদের বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক সংঘবদ্ধ আন্দোলন আজ আবশ্যক। জনগণের জীবনে আজ যে দুর্দশা নেমে এসেছে তা থেকে মুক্তি দেবার সত্যিকার উপায় কি তা আজ উদ্ভাবন করতে হবে। শুধু কর্তৃপক্ষীয় আশ্বাস বাণীই এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবার পথ দেখাতে পারে বলে আমরা মনে করি না। সরকার মওজুতদার, মুনাফাখোর সহ বিভিন্ন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আজ যে অভিযান শুরু করতে চাইছেন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে করেছেন তার বাস্তবায়ন আমরা চাই। এবং দেশের প্রগতিশীল মানুষকে অনুরোধ করবো সরকারের এ অভিযানে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করতে। দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলসমূহকেও আমরা অনুরোধ করবো সরকারী অভিযানকে সাফল্যমন্ডিত করে তোলার জন্যে সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য। খাদ্যমন্ত্রী ‘সাময়িক সংকট’ অথবা ‘খাদ্য মওজুত রয়েছে’ বলে যতই আশ্বাসের বাণী বর্ষণ করুন না কেন দেশের বাস্তবতা আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশের সাধারণ মানুষ আজ সাড়ে তিন থেকে চার টাকা সের চাউল খাচ্ছে। প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্যের কাছে তাদের আজ আত্মাহুতি দেবার উপক্রম হয়েছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে—খাদ্যমন্ত্রী যতই বলুন আমরা তার থেকে ব্যতিক্রম হতে পারিনা। উৎপাদন বিভিন্ন কারণে ব্যাহত হচ্ছে এটাও আজ সত্য। দেশের ধান উৎপন্ন একটি সঠিক নিয়মের মাধ্যমে হলে এ অবস্থার হের-ফের হতে পারতো। কিন্তু কারিগরি সাহায্যের অভাব ও বাস্তব পরিকল্পনাহীনতার জন্যে উৎপাদন সর্বক্ষেত্রেই ব্যাহত হয়েছে এবং হচ্ছে। সরকার সময় থাকতে অনিবার্য দুর্ভিক্ষ উৎরানোর মানসে একটি কার্যকরী ব্যবস্থা নেবেন দ্রব্যমূল্য রোধের জন্য—এটাই আমাদের কামনা।

ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দিন

ব্লাড ব্যাংকে রক্ত নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে অচলাবস্থার উদ্ভব হয়েছে। রক্তের অভাবে গুরুতর রোগীর জীবনাশংকাও মারাত্মকভাবে সঙ্গীন হয়ে উঠেছে। যে সব রোগীর দেহে রক্ত দেয়া প্রয়োজন, সেই সব রোগীরা রক্তের অভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক আকস্মিকভাবে রক্তশূন্য হয়ে পড়াতে রোগী, রোগীর আত্মীয়-পরিজন যেমন, তেমনি দেশের সচেতন নাগরিকরাও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। দেশের বৃহত্তর চিকিৎসা কেন্দ্রের ব্লাড ব্যাংকের রক্তশূন্যতা একটি জাতীয় সমস্যা। কারণ সবল হওয়ার জন্য এমনকি মৃত্যুর হিমশীতল হাতছানি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই রোগীরা হাসপাতালে আশ্রয় নেয় কিন্তু হাসপাতালে যদি রক্তশূন্যতা দেখা দেয় তাহলে চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। প্রকৃত বাস্তবে হয়েছেও তাই। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখন সব রকম অস্ত্রোপচার বন্ধ। এদিকে উপযুক্ত অস্ত্রোপচারের জন্য রোগীদের জীবনও অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দান করা একটি মানবিক দায়িত্ব। রক্ত ছাড়া মারাত্মক রোগীদের জীবন বাঁচানো অনেক সময়ই সম্ভব হয়ে ওঠেনা। তাই সবলদেহী তরুণ সমাজকে ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দানের জন্য এই মুহূর্তেই এগিয়ে আসা উচিত। রক্তের অভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের জীবনলীলা সাঙ্গ হয়ে যাওয়াও কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। ব্লাড ব্যাংকে রক্ত জমা না থাকলে চিকিৎসকরাও রোগীদের যথাযথভাবে চিকিৎসা করতে অপারগ। অস্ত্রোপচারের জন্য তো রক্ত সঞ্চয় করা অতি জরুরী। কিন্তু যেহেতু ব্লাড ব্যাংকে রক্ত নেই সেই হেতু প্রতিটি সচেতন এবং সবলদেহী নাগরিককে মানবিক দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্লাড ব্যাংকের রক্ত সংকট দূরীভূতকল্পে অগ্রণী ভূমিকা নেয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। তরুণ ছাত্র সমাজ এ ব্যাপারে বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন। ছাত্ররা ইতিমধ্যেই এই দায়িত্বের প্রতি সজাগ হয়েছেন। এবং অনেকেই ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দিতে শুরু করেছেন। এটা খুবই শুভ লক্ষণ। ছাত্র সমাজের এই সচেতনতা আমাদের জাতীয় জীবনের পরম সম্পদ। যখনই জাতীয় জীবনে দুর্যোগের অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে ওঠে, এদেশের ছাত্রসমাজ তখনই এগিয়ে আসে, এর কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। তবে ব্লাড ব্যাংকের রক্ত সংকটের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকটের মোকাবেলা করার জন্য দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যেই একটা দায়িত্ব জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

পুরনো ব্যাধিকে ‍নির্মূল করতে হবে

ব্যাধিটা পুরনো। সেই পুরনো ব্যাধিটাই আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। পুলিশ অবশ্য আপাততঃ ব্যাধি নিরাময়ের ব্যবস্থাও করেছেন।
গত শুক্রবার স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকার সংবাদে প্রকাশ, পুলিশ পাসপোর্ট ও ভিসা জালকারী একটি সংঘবদ্ধ দলের উদ্ঘাটন করেছেন। কয়েকটি জাল পাসপোর্ট, সিলমোহর, কালি, রাসায়নিক দ্রব্য সহ তিন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, দলটি বহু পুরনো। পাকিস্তান আমল থেকে এরা পাসপোর্ট জালিয়াতি করে আসছে। দলটির রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ কেবল ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এদের অফিস রয়েছে। জাল পাসপোর্ট তৈরীর সাজসরঞ্জামের সাথে ভারতীয় জাল ভিসা ইস্যুর সিলমোহর পাওয়া গেছে।
পুলিশ অবশ্য যথাসময়ে সংঘবদ্ধ দলটিকে হাতেনাতে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে। পুলিশকে এ জন্যে আমরা ধন্যবাদ জানাবো। তবে এ প্রসঙ্গে এ কথাও বলবো যে, ব্যাপারটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে ততটা সহজ নয়। পাসপোর্ট ও ভিসা জালকারী দল একটি বিচ্ছিন্ন দল নয়। এদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংঘবদ্ধ দলেরও যোগসাজশ থাকাটাই স্বাভাবিক। সুতরাং দু’জন বা তিনজনকে গ্রেফতার করে মামলা দায়ের করলেই যে পুরনো ব্যাধির নিরাময় হয়ে যাবে এমন নয়। একটানা সতর্ক দৃষ্টি রাখাও প্রয়োজন এক্ষেত্রে। আর সে দায়িত্ব পালন করতে পারেন পুলিশ বিভাগ।
পাসপোর্ট ও ভিসা জাল করার পরিণতি প্রসঙ্গে বিস্তারিত বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। পাসপোর্ট বা ভিসা জালের ফলে একদিকে যেমন দেশের অবাঞ্ছিত, দুষ্কৃতিকারী ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র দেশের বাইরে যাবার সুযোগ পায় তেমনি আবার নিরীহ নাগরিকরা এদের কবলে পড়ে নাজেহাল হয়। ইতিপূর্বে এমন কান্ড যে ঘটেনি তা নয়।
পরিশেষে আমরা বলবো, পুলিশ প্রশংসনীয় কাজই করেছেন। তবে এ পুরনো ব্যাধি যাতে মাথা চাড়া দিয়ে কোনো অবস্থাতেই উঠতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন