বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রােজনামচায় ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ১
আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। ঠিক পনের বছর আগে সেদিন ছিল বাংলা ১৩৫৮ সালের ৮ই ফাল্গুন, বৃহস্পতিবার, ইংরেজি ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য শহীদ হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন বীর সন্তান : ১। আবদুস সালাম, ২। আবদুল জব্বার, ৩। আবুল বরকত, ৪। রফিকউদ্দিন। আহত হয়েছিলেন অনেকেই। ঠিক পনের বৎসর পূর্বে এইদিনে আমিও রাজবন্দি ছিলাম ফরিদপুর জেলে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট করি। জানুয়ারি মাসে আমাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। সেখানেই ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি অনশন করব আর ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা দিবস পালন করা হবে বলে স্থির হয়। আমাকে আবার জেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হলাে চিকিৎসা না করে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি আমাকে ও মহিউদ্দিনকে ফরিদপুর জেলে চালান দেওয়া হলাে। মহিউদ্দিনও আমার সাথে অনশন করবে স্থির করে দরখাস্ত দিয়েছিল।
আজ পনের বৎসর পরের এই দিনটিতে আমি কারাগারে বন্দি। প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদুন মজলিসের নেতৃত্বে। ওইদিন ১০টায় আমি, জনাব শামসুল হক সাহেবসহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হই এবং আব্দুল ওয়াদুদ-সহ অনেকেই ভীসনভাবে আহত হয়ে গ্রেপ্তার হয়। ১৫ই মার্চ জনাব নাজিমুদ্দীন (তখন পূর্ব পাকিস্তানের চিফ মিনিস্টার ছিলেন) সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলাপ করে ঘােষণা করলেন, “পূর্ব পাকিস্তান আইন সভা হতে প্রস্তাব পাশ
——————
১ শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রােজনামচা, পঞ্চম মুদ্রণ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা : অক্টোবর ২০১৭ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত
————–
করাইবেন বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে।’ সকল বন্দিকে মুক্তি দিবেন এবং নিজেই পুলিশের অত্যাচারের তদন্ত করবেন। ওই দিন সন্ধ্যায় আমরা মুক্তি পাই।
১৫ই মার্চ আবার বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় সভা হয়, আমি সেই সভায় সভাপতিত্ব করি। আবার বিকালে আইন সভার সামনে লাঠি চার্জ হয় ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হয়। প্রতিবাদের বিষয় ছিল, ‘নাজিমুদ্দীন সাহেবের তদন্ত চাই না, জুডিশিয়াল তদন্ত করতে হবে।’ ২১শে মার্চ বা দুই একদিন পরে কায়েদে আজম প্রথম ঢাকায় আসলেন। সেই জন্য আন্দোলন বন্ধ করা হলাে। আমরা অভ্যর্থনা দেওয়ার বন্দোবস্ত করলাম। তিনি এসে ঘােষণা করলেন, “উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। ছাত্ররা তাঁর সামনেই কনভােকেশনে প্রতিবাদ করল। রেসকোর্স ময়দানেও প্রতিবাদ উঠল। তিনি হঠাৎ চুপ করে গেলেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন এরপরে কোনােদিন ভাষার ব্যাপারে কোনাে কথা বলেন নাই। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ প্রত্যেক বৎসর ১১ই মার্চকে ‘ভাষা দিবস পালন করেছে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ (এখন আওয়ামী লীগ) এই একই দিনে ‘ভাষা দিবস পালন করেছে। ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দান সবচেয়ে বেশি। পরে ইয়ুথ লীগও আন্দোলনে শরীক হয়েছে। (পৃ. ২০৬)
১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ তারিখে খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যে ওয়াদা আইনসভায় করেছিলেন,, ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি১ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তা ভেঙ্গে পল্টনের জনসভায় ঘােষণা করলেন, “উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হবে। তখন প্রতিবাদের ঝড় উঠলাে। আমি তখন বন্দি অবস্থায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। রাত্রের অন্ধকারে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের সহায়তায় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ করে ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদের দিন স্থির করা হয়। কারণ ২১শে [ফেব্রুয়ারি) থেকে বাজেট সেশন শুরু হবে। আমি ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন শুরু করব মুক্তির জন্য। কাজী গােলাম মাহবুব, অলি আহাদ, মােল্লা জালালুদ্দিন, মােহাম্মদ তােয়াহা, নঈমুদ্দীন, খালেক নেওয়াজ, আজিজ আহম্মদ, আবদুল ওয়াদুদ ও আরাে অনেকে গােপনে গভীর রাতে আমার সঙ্গে দেখা করত।
—————
১ খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টনের জনসভায় ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঘােষণা দেন, “উর্দুই। হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ -লেখক।
—————–
তখন জনাব নূরুল আমীন মুখ্যমন্ত্রী। ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলি হলাে। আমার ভাইরা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত করল। . এইদিন আমাদের কাছে পবিত্র দিন। ১৯৫৫ সালে নূতন কেন্দ্রীয় আইন সভায় আওয়ামী লীগ ১২ জন সদস্য নিয়ে ঢুকল এবং তাদের সংগ্রামের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাধ্য হলাে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে। বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে। আওয়ামী লীগ যখন ১৯৫৬ সালে ক্ষমতায় বসল তখন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ সরকারি ছুটির দিন ঘােষণা করল। ১৯৫৭-৫৮ সালে এই দিবসটা সরকারিভাবেও পালন করা হয়েছে। শহীদ মিনার করার জন্য পরিকল্পনা করে বাজেটে টাকা ধরে কাজ শুরু হয়েছিল কিন্তু ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হওয়ার পরে এই দিনটি সরকারি ছুটির তালিকা থেকে বাদ পড়ল, আর মিনারটি চুনকাম করেই শেষ করে দেওয়া হলাে। (পৃ. ২০৭)
সূত্র: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম