বাংলার বাণী
ঢাকা: ৪ঠা সেপ্টেম্বর, বুধবার, ১৮ই ভাদ্র, ১৩৮১
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ
বুখারেস্টে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জনসংখ্যা সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। দীর্ঘ ১২ দিনব্যাপী এই সম্মেলনে বিশ্বের ১৩৬টি দেশ অংশগ্রহণ করে। সম্মেলনের শেষ দিকের আলোচনা মোটামুটি দুটো ভাগে বিভক্ত হয়। একদিকে জন্ম নিয়ন্ত্রণের সমর্থক অন্যদিকে উন্নয়নের সমর্থক। যার ফলে জাতিসংঘের জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির উপর প্রায় ৪ শত সংশোধনী বিল পেশ করা হয় এবং পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বিনা ভোটে তা গৃহীত হয়। এই সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলো তথা তৃতীয় বিশ্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান সন্তোষ বলে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রীও জনসংখ্যা প্রতিরোধের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে দীর্ঘমেয়াদি সমর্থন ও বর্ধিত অর্থনৈতিক ও কারিগরি সাহায্যের উপর জোর দেন।
একথা সত্য যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির আশংকাজনক হার একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এবং পৃথিবীর সীমিত সম্পদের প্রেক্ষিতে জনসংখ্যার বর্তমান হার বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সার্বিক প্রতিকূলতা সৃষ্টি করবে। তবে জনসংখ্যার সমস্যায় পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহ বিড়ম্বিত নয়। দেশের অন্যান্য সম্পদের মতো জনসম্পদকেও তারা উন্নয়নশীল কর্মে বিনিয়োগ করতে পেরেছেন। জনসম্পদকে যেখানে কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি, জনসংখ্যার ভার সেখানেই জগদ্বল পাথরের মত চেপে বসে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে সমস্যা সৃষ্টি করছে। বলাবাহুল্য সে সমস্যায় ওরা আক্রান্ত নন। বিশ্বের অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি স্থান আমাদের এই বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তথ্যনুযায়ী প্রতিদিন প্রায় সোয়া কোটি দম্পতি এদেশকে লক্ষ লক্ষ মানব সন্তান উপহার দিচ্ছে। দুটো শক্ত সবল হাতের সম্ভাবনা নিয়ে এই শিশুরা ভূমিষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তাদের শ্রমকে বিনিয়োগ করতে গেলে যে পরিমাণ পুষ্টি ও পর্যাপ্ত খাদ্য প্রয়োজন তার জোগান আমাদের নেই। ১৯৭২ সালে ঢাকায় জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা বাংলাদেশের পুষ্টিহীনতা সম্পর্কে একটি জরীপ চালিয়ে বলেন যে, এদেশের শতকরা ৪৫ জন শিশু পশ্চিম দেশের শতকরা ৯৮ জন শিশুর চেয়ে রুগ্স ও কৃশ। এদেশের মেহনতি মানুষের জন্য যেখানে গড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার ক্যালোরি খাদ্যের প্রয়োজন সেখানে তার এক চতুর্থাংশও তারা পায় না। আমাদের অসুবিধা এখানেই। জনসম্পদকে আমরা কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করতে পারছি না।
এর কারণ হল আমাদের জন্মহার এবং মাথাপিছু গড় উৎপাদনের বৈষম্য। বিশ্বব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী ১৯৬০-৭১ সালে বাংলাদেশে জন্মহার ছিল শতকরা ২.৭ ভাগ, ১৯৬৫-৭১ এ ছিল ২.৬ ভাগ। ১৯৬০-৭১ সালের মাথা পিছু গড় উৎপাদন ছিল ০.৭ ভাগ, এখন দেশে জন্মহার বেড়ে প্রায় ৩.০৯ এর মত হয়েছে। অপরদিকে মাথাপিছু গড় উৎপাদন আরও হ্রাস পেয়েছে। ফলে জনসংখ্যার সমস্যাটা আমাদের দেশে জগদ্বল পাথরের মত চেপে বসেছে।
দুঃখের সাথে স্বীকার করতে হয় যে, আমাদের দেশে শিক্ষার হার শতকরা ২১ ভাগের মত। ফলে স্বাভাবিকভাবে অশিক্ষাজনিত কুসংস্কার ও অদূরদর্শিতা, বাল্যবিবাহ ও একাধিক বিবাহ ইত্যাদির কারণে এদেশের জনসংখ্যা এস্তার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সুন্দর জীবনবোধের অভাব, অবসর বিনোদনের অ-ব্যবস্থা এবং সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি সম্বন্ধে অজ্ঞতা। বিশ্বের সকল অনুন্নত দেশের জনসংখ্যা সমস্যার কারণগুলো মোটামুটিভাবে এইরকমই।
এই বাস্তব কারণগুলি প্রতি লক্ষ্য রেখে বুখারেস্ট সম্মেলনে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানে চাবিকাঠি বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তন বিশ্ব সম্পদের সুষম বন্টন এর উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হলেও তারা উল্লেখ করেন। আমরা বিশ্বাস করি কৃত্রিম উপায়ে নয়-অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে জনসংখ্যাবহুল দেশ গুলো একদিন জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হবে, উন্নত জীবন বোধের উদ্দীপ্ত হবে এবং সক্ষম হবে মাথাপিছু গড় উৎপাদন বাড়াত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যা সেদিন আপনিই লঘু হয়ে আসবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক