বানীপুর শিবিরে শােচনীয় অবস্থা
সাগর বিশ্বাস
শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবেই বানীপুরের প্রসিদ্ধি। কিন্তু এতকালের সৃসজ্জিত টিপ্ টন্ বানীপুর বিগত এক বছরের মধ্যে একটি শ্রীহীন জঙ্গলাকীর্ণ, জীর্ন জনপদে পরিণত হয়েছে। গত বছরের শেষের দিক থেকেই হাবড়া অশােক- নগর অঞ্চলে যে সন্ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছিল তার অভিঘাত শিক্ষাকেন্দ্র বানীপুরে এসে লাগলেও সংবাদপত্রে হাবড়া অশােক নগরই স্থান পেয়েছে, দুই কিলােমিটার দূরে মাঠের প্রান্তে ছায়াঘেরা বানীপুরের প্রতি নজর দেবার অবকাশ সম্ভবত: কারুর ছিল না।
গত কয়েক মাস ধরে বহু শরণার্থী শিবির দর্শন করবার দুঃভাগ্য অর্জন করেছি। সাহারা থেকে বয়রা২৪ পরগণার বিরাট অঞ্চল পরিক্রমা করলাম। কিন্তু বাণীপুরের মতাে অবহেলিত শরণার্থী শিবির সম্ভবত ২৪ পরগণা জেলায় আর একটিও নেই।
গত ২৮ অক্টোবর আমি যখন বানীপুরে পৌছালাম তখন বেলা সাড়ে বারােটা। বছর পাঁচেক আগে যে যৌবন-প্রানােচ্ছল বানীপুরকে দেখেছিলাম, তার দেহের প্রতিটি ভঁজে আজ অকাল বার্ধক্যের চিহ্ন। যে হােস্টেলে সেদিন আমি রাত্রিবাস করে গিয়েছিলাম সেখানে অর্ধ উলঙ্গ মানুষের ক্লান্ত দেহের ‘জঞ্জাল। কলতাতা থেকে একদা যে তরুণ তরুণীর দল পিনি করতে ছুটে বাসত বানীপুরের আম্রকুঞ্জে, আগাছা আর জঙ্গলজীর্ণ সেখানে কারাে পায়ের ছাপ আজ আর পড়ে না। বন্যাবিধ্বস্ত শরণার্থী শিবিরের একটা বিরাট চালাঘর সেই বন্যার সময় ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সেটা আজো খাড়া করবার ব্যবস্থা করা হয়নি। প্রায় প্রতিটি শরণার্থী পরিবারই দেখতে পেলাম রিকেটি ডিসেন্ট্রি ব্রঙ্কাইটিস প্রভৃতি ব্যাধিগ্রস্ত মৃত্যু পথযাত্রী শিশুর মিছিল।
পায়খানা বা স্যানিটেশনের দিকে সরকারের কোন নজর আছে বলে মনে হলাে না। বন্যায় পায়খানা বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। সেগুলাে পুনর্গঠণের কোন চেষ্টা নেই। ঘণ্টা তিনেক এই মৃতপ্রায় মানুষের মিছিল দেখে দেখে যখন ক্যাম্প কমান্ড্যান্টের অফিস অনুসন্ধান করলাম তখন একটা প্রচণ্ড আঘাতে আমি হতবম্ভ হয়ে গেলাম। জানা গেল ও ধরণের কোন অফিস এখানে নেই। একজন ক্যাম্প ইনচার্জ আছেন বটে, তবে তিনি এখানে আসেন না। হাবড়াতে থাকেন। বাণীপুর ক্যাম্প আর ক্যাম্প-ইনচার্জ থাকেন দুই কিলােমিটার দূরে হাবড়া শহরে। এমন অদ্ভুত ব্যাপার অন্য কোথাও দেখা যায়না। শুধু তাই নয় শরণার্থীদের ড্রাই-ডােল বিতরণ করা হয় হাবড়া থেকেই অর্থাৎ রুটির জন্য চার কিলােমিটার পথ ওদের ছুটতে হয়।
ক্যাম্পবাসীদের ভাগ্যবিধাতা হলাে একদল ভলান্টিয়ার তাদের মধ্যে কয়েকজনের না আছে শিক্ষা না ভব্যতা, না সাধারণ মানবিকতা বহু মাস্তানকে এই কাজে নিয়ােগপত্র দেয়া হয়েছিল। ক্যাম্পে কাজ বিশেস ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেবার প্রতিবাদ করছিল একজন শরণার্থী, রমেশ বারােই। ফলে স্বেচ্ছাসেবকদের বেল্টের (নয়া শ্যামচঁাদ!) আঘাতে আহত হয়ে তাকে বিছানা নিতে হলাে। এধরণের ঘটনা এবং ক্যাম্প ‘পুড়িয়ে দেবার হুমকি প্রায় নিত্য নৈমত্তিক। সেবকদের সেবার দৌরাত্মে শরণার্থীরা সন্ত্রস্ত ও অসহায়।
মেডিক্যাল সার্ভিস দুটো ভাগে বিভক্ত। প্রিভেন্টিভ এবং কিউরেটিভ। প্রতিরােধ ও নিরাময় । কিউরেটিভ অংশটা একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান Oxfam এর পরিচালনা করবার উপযােগী করে তুলতে তাদের কোন শর্ট ট্রেনিং ও দেয়া হয়নি। ফলে তারা ক্যাম্পে মাস্তানিই করে। মােটা চামড়ার বেল্ট প্রায় প্রত্যেকের কাছেই দেখলাম। ক্যাম্পে এরা যে ভূমিকা পালন করেছে তা শাসকের ভূমিকা সেবকের নয়।
রেজিস্ট্রেশনের নতুন সরকারি নির্দেশে প্রতিদিনই বিরাট লাইন পড়ছে রেজিষ্ট্রেশনের জন্য। স্বেচ্ছাসেবকদের ঘুষ নিয়ে বিশেষ দিন। বেলা ৩-১৫য় এদের অফিস দেখলাম তালাবদ্ধ কেউ কোথাও নেই। আশ্চর্য হবার মতাে ঘটনা। প্রিভেনটিভ সেকশন ভারত সরকারের পরিচালনাধীন। দুজন কর্মিকে পেলাম। কোন রেকর্ড পেলাম না। ওগুলাে নাকি হাবড়ায় ইনসপেকটরের কাছে থাকে।
আমাশয়, ব্রঙ্কাইটিস, বিভিন্ন পেটের পীড়া মহামারীর মতাে হচ্ছে। প্রতিদিন ৪, ৫টি করে শিশু মারা যাচ্ছে। ভদ্রলােক আরাে জানালেন শতকরা ৭৫ শিশুর মধ্যে রিকেটের প্রাদুর্ভাব প্রবল।
সূত্র: সপ্তাহ, ১২ নভেম্বর ১৯৭১