২৪ জানুয়ারি, ১৯৭১
- শোষণমুক্তির সংগ্রামের নবতর বলিষ্ঠ শপথ গ্রহণের মাধ্যমে প্রদেশের সর্বত্র ১১-দফার মহান ‘গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ পালিত হয়। এই দিবসে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলা ছাত্রলীগ, নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা গঠিত মতিউর স্মৃতি কমিটি- প্রভাতফেরী, মিছিল, পথসভা ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিক ও অন্যান্য সংগঠনও এই দিবস পালন করে। ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের কর্মসূচি বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ করে। সব অনুষ্ঠানেই ১১-দফার পূর্ণ বাস্তবায়ন, ১১-দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন, রাজবন্দীদের মুক্তি, দ্রব্যমূল্য হ্রাস, বকেয়া খাজনা মওকুফ ও সর্বোপরি জাতীয় পরিষদের সার্বভৌমত্বের দাবি সোচ্চার হয়ে ওঠে।
- গণ-অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ আহূত জনসভায় সভাপতির ভাষণে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি নূর-এ-আলম সিদ্দিকী বলেন যে, দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে যদি ৬-দফা ও ১১- দফার একটি দাড়ি-কমাও বাদ দেওয়া হয় তাহলে তুমুল প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে যাতে খাজনা-ট্যাক্স প্রদান বন্ধ হবে, অফিস আদালত, কল-কারখানায় তালা ঝুলানো হবে। জনসভায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আ. স. ম আব্দুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখন, ছাত্রলীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ও নব-নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য খালেদ মোহম্মদ আলী প্রমুখ বক্তৃতা করেন। সভাশেষে একটি গণসঙ্গীতের আসর অনুষ্ঠিত হয়।
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সঙ্গীত শিল্পীসমাজ কর্তৃক তাঁর সন্মানে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন। ভাষণদানকালে তিনি বলেন যে, বাংলার মহান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও অন্যান্যদের প্রতি উপযুক্ত সন্মান প্রদর্শন করা হয়নি। তিনি শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীদের আশ্বাস প্রদান করেন যে, দেশের এই অংশে পৃথক ও সাধারণ একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা হবে। বঙ্গবন্ধু অভিযোগ করে বলেন, বিগত বছরগুলিতে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে শাসকগোষ্ঠী ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্র নিজেদের স্বার্থে বিকৃত করেছে। রেডিও পাকিস্তান নজরুল সঙ্গীতের শব্দ পরিবর্তন করে প্রচার করেছে। আমাদের মেয়েরা কপালে টিপ পরলে তাদের হিন্দু আখ্যায়িত করার জন্য তথাকথিত পূজারীরা উঠে পড়ে লাগতো। তিনি বলেন, অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুধু জনগণ এবং রাজনীতিকদের একার দায়িত্ব নয়। জাতীয় কল্যাণে শিল্পীরাও বিরাট দায়িত্ব পালন করতে পারে। বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, দেশাত্ববোধক সঙ্গীত রচনা করার জন্যই বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। অনুষ্ঠানে সভানেত্রীত্ব করেন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী লায়লা আর্জুমান্দ বানু। বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তৃতা করেন সঙ্গীতশিল্পীদের পক্ষ থেকে সুরশিল্পী সমর দাস, কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌসী রহমান, সৈয়দ আবদুল হাদী, আঞ্জুমান আরা বেগম, মুস্তফা জামান আব্বাসী প্রমুখ।
- ১১- দফা গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম বীর শহীদ কিশোর মতিউর রহমানের আজ দ্বিতীয় স্মৃতিবার্ষিকী। এ উপলক্ষে ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটে এক ছাত্র জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই ছাত্র জনসভায় শহীদ মতিউর রহমানের পিতা আজহারুল হক মল্লিক, ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আ. স. ম আব্দুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন প্রমূখ বক্তৃতা করেন। এছাড়া শহীদ মতিউর স্মৃতি স্মরণে নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ, প্রভাতফেরী, কোরআনখানি প্রভৃতি কর্মসূচি পালন করে।
- পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কে. জি মোস্তফা পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের তিনদিন ব্যাপী বার্ষিক সাধারণ সভার উদ্বোধনী ভাষণে সাংবাদিকদের দ্বিতীয় বেতন বোর্ড অবিলম্বে সক্রিয় করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান। তিনি প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স বাতিল, জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরো ও পাকিস্তান কাউন্সিল বিলুপ্তির দাবি করেন। উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহীদুল্লাহ কায়সার। তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অব্যাহত রাখার জন্য আহবান জানান এবং অবিলম্বে সৈয়দ নজিউল্লাহ ও শামসুদ্দোহাসহ দেশের সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করেন। উদ্বোধনী অধিবেশনে কূটনৈতিক মিশনের সদস্য ছাড়াও বেশকিছু গণ্যমান্য অতিথি যোগদান করেন।
- Source: Bangladesh Liberation War Museum