You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে কৃষকের অংশগ্রহণ - সংগ্রামের নোটবুক
মুক্তিযুদ্ধে কৃষকের অংশগ্রহণ
পটভূমি পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর ভূমি সংস্কার এবং কৃষি উন্নয়ন ক্ষেত্রে গৃহীত বৈষম্যমূলক নীতি পূর্ববাংলার কৃষক সম্প্রদায়ের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংগ্রহণের উর্বর ভিত্তি তৈরি করেছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির সময় জমিদারি প্রথা বিলােপের কথা বলা হলেও ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের সংসদে যে ভূমি সংস্কার বিল পাশ করা হয় তাতে সেই প্রতিশ্রুতির বিপরীতে জোতদার বা ধনী কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়। সাধারণ কৃষকরা তখনও একটি অসম ভূমি ব্যবস্থার চাপ অনুভব করতে থাকেন। এ চাপ পৃষ্ঠপােষকতা পায় এমন একটি নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার যার একমাত্র আগ্রহ ছিল এর অসাধু ভূমি রাজস্ব আদায়ে নিয়ােজিত কর্মচারীদের (তহসিলদার)। মাধ্যমে কৃষক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বেশি করে রাজস্ব আদায় করা (আবদুল্লাহ ১৯৭৬, সিদ্দিকী ১৯৮১)।
এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি অবকাঠামাে উন্নয়নে খুব একটা সরকারি বিনিয়ােগ করা হয় নি, যা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিশ্চিত করতে পারতাে বরং এখানকার উদ্বৃত্ত খাদ্য থেকে অর্জিত অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নেই ব্যবহৃত হচ্ছিল। আর পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলে একটি সীমিত ক্ষমতার ভিত্তি তৈরির সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পাকিস্তান সরকার পৃষ্ঠপােষকতা দিয়ে যাচ্ছিল জোতদার ও উদ্বৃত্ত কৃষকশাসিত একটি স্থবির ক্ষমতাকাঠামােকে লােক দেখানাে কিছু কর্মসূচি যেমন ভি-এইড, গ্রামীণ গৃহায়ণ কর্মসূচি, কুমিল্লা মডেলের মতাে সমবায়, থানা সেচ কর্মসূচি ইত্যাদি গ্রামের ধনী আর শক্তিশালী এলিটদের আরাে শক্তিশালী করে চলছিল (সােবহান, ১৯৯২)। পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক এসব কাঠামােগত ও রাষ্ট্র-আরােপিত বাধা পেরােতে পারে নি। ফলে খাদ্যাভাব গ্রামীণ সমাজে অস্থিরতার মাত্রা বাড়াতে থাকে আমলা ও স্থানীয় ক্ষমতাশালীদের দুর্নীতি আরও বিক্ষুব্ধ করতে থাকে সাধারণ জনগণকে  যাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিল কৃষক। এই অসন্তোষ আর স্থবিরতায় কৃষক পরিবারের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িত মধ্যবিত্ত শ্রেণীও আক্রান্ত হতে থাকে।
 
কেননা তখনও শহরে বসবাসকারী মধ্যবিত্তের আয়ের একটা অংশ আসতাে কৃষিখাত থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের বিরাট অংশ নির্ভরশীল। ছিল তাদের পরিবারের কৃষিখাতের আয়ের ওপর যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল বেশি এবং কৃষি ছিল শক্তিশালী, তাই। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিলেন কৃষির ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল তাই মুক্তিযুদ্ধে এই। শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণই ছিল সর্বোচ্চ। যুদ্ধের আগে বৈষম্য আর বঞ্চনার আলােচনাতেও বারবার এই সম্প্রদায়ের কথাই উঠে আসতাে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মূলে অন্যতম ছিল কৃষকদের অসন্তোষ পরবর্তীকালে এক জরিপ থেকেও আমরা মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অথবা। পরােক্ষভাবে কৃষকগােষ্ঠীর অংশগ্রহণের প্রমাণ পাই। প্রায় চার-পঞ্চমাংশ। মুক্তিযােদ্ধাই ছিলেন কৃষক পরিবারের সন্তান। অন্যরাও নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহযােগিতা করেছেন। তারা মুক্তিযােদ্ধাদের অর্থ, আশ্রয়, খাদ্য, বস্ত্র ইত্যাদি। দিয়েই শুধু নয় বরং শত্রুপক্ষের সংবাদ দিয়ে, অস্ত্র লুকিয়ে রেখে, প্রয়ােজনে তাদের। পাহারা দিয়ে শক্রপক্ষের আড়ালে রেখে—নানাভাবেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ এই সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল সকল অর্থেই উজ্জ্বল। আর সে কারণেই এই সাদামাটা, নিষ্ঠাবান ও দেশপ্রেমিক জনগণ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযােগীদের নিষ্ঠুর এবং বর্বর অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে তাদের এই বীরত্ব আর আত্মত্যাগ ছিল অতুলনীয়।
এই বীরত্বের আর আত্মত্যাগের জন্য তারা মানসিকভাবে তৈরিই ছিলেন। আগেই বলা হয়েছে, কৃষি উন্নয়ন আর ভূমি সংস্কারে পাকিস্তান সরকারের গৃহীত নীতিমালা কখনােই। তাদের প্রকৃত স্বার্থ সংরক্ষণের দিকে লক্ষ রেখে নেয়া হয় নি। এমনকি এ দেশের মধ্যবিত্ত আর শ্রমিক শ্রেণী যাদের জীবন কৃষকদের ভাগ্যের সাথেই জড়িত ছিল, তাদের ভূমিকাতেও তারা ছিলেন অসন্তুষ্ট। এই কৃষক সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা পেতে আমরা ১৯৬৯-৭০ সালের সংবাদপত্রের কিছু নির্বাচিত অংশের দিকে চোখ বুলিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের আগে দু’বছরের এই সংবাদগুলােতে যেসব খবর ছাপা হয়েছে, সে সব থেকে আমরা বুঝতে পারবাে পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্র কী অবজ্ঞার সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক সম্প্রদায়কে বঞ্চিত করেছে। সুতরাং স্বাধীনতা যুদ্ধে তারা যে সর্বব্যাপী অংশগ্রহণ করবেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।
 
এই সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক সম্প্রদায় ছিল পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনার প্রত্যক্ষ শিকার। তাইতাে ১৯৫৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন : “My question is whose money we are spending now? This money belongs to the poor farmers of this country- jute and cotton cultivators, this money belongs to common people … And with this money we are going to give the Governors 6 thousand Rupees every single month. We are showing off that we are Islamic country. But in this country a peon gets 50 Rupees a month, orderly gets 90 Rupees and a clerk gets 100 to 150 Rupees a month.” (রহমান, ১৯৯০)। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্ববাংলার ভূমি সংস্কার প্রকৃত অর্থে কখনই পাকিস্তানি প্রশাসনে গুরুত্ব পায় নি। অসম ভূমি ব্যবস্থাপনা ব্রিটিশ শাসন থেকে পাকিস্তানি শাসন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ভূমি সংস্কার দীর্ঘদিন ধরেই চাষীদের প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ দাবি ছিল। তেভাগা আন্দোলনের মূল সুর ছিল এটাই এখানে উল্লেখ্য, ভূমি সংস্কারের মূল বিবেচ্য বিষয় ছিল দু’টো : ১. জমির মালিকানা এমন সুষম হওয়া উচিত যাতে যতটা জমি চাষ করা যায় আর যতটার মালিক একজন হতে পারে তার মধ্যে কোনাে পার্থক্য না থাকে; এবং ২. জমিমালিক আর বর্গাচাষীর মধ্যে ফসলের সুষম বণ্টন হওয়া উচিত।
পাকিস্তানি আমলে ভূমিপ্রশাসনে জড়িতরা এ দুটি দিকই অবজ্ঞা করেছে। এই দুই বিষয়ে ন্যায়বিচারের দাবি করতে গেলেই কৃষক সম্প্রদায় নিগ্রহ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সুতরাং স্বভাবতই তারা ছিলেন হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। তাই সুযােগ পাওয়া মাত্রই জনগণ তার যােগ্য প্রত্যুত্তরও দিয়েছিলেন। এভাবে ১৯৫৪-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পাটি ও অন্যান্য দল নিয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্টের কাছে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে কৃষকমুক্তির নানা দাবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট সরকারকে কাজ করতে দেয়া হয় নি। এই সরকার সংসদে ভূমি সংস্কার আইন উত্থাপন করতে চেয়েছিল (২১-দফায় যা প্রতিশ্রুত ছিল)। কিছু দিনের মধ্যেই চক্রান্ত করে এই সরকারের পতন ঘটানাে হয়। কৃষক সম্প্রদায় তখন আরও হতাশ হয়ে পড়েন। উপরন্তু ১৯৫৮-তে সামরিক আইন জারি করা হয়। ১৯৬২-তে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হলেও পূর্ব বাংলা স্বৈরাচারী কায়দায় শাসিত হতে থাকে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত এই ধারার শাসন ও শােষণ চলতে থাকে। এর পরে আসে ১৯৭০-এর নির্বাচন এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত সরকারকে দেশ শাসনের অধিকার দেয়া হলাে না। ফলে জনগণ সহিংস প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে বাধ্য হন। এভাবেই ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে কৃষক সম্প্রদায় অংশ নেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। অবশ্যি মুক্তিযুদ্ধে কৃষকদের ব্যাপক অংশগ্রহণের পেছনে জোরালাে আর্থ-সামাজিক কার্যকারণ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের আগে দু’বছরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও মতামতে সারসংক্ষেপ আমরা সেই সব কার্যকারণ তুলে ধরবাে। কীভাবে দিনে দিনে অবিচার। 
 
কৃষকদের নানা সঙ্কট নিরসনের জন্যে রাষ্ট্রের তেমন কোনাে আগ্রহ চোখে পড়ে নি। অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যর্থতা সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ করে তােলে কৃষকদের অন্যদিকে প্রতিশ্রুত ভূমি সংস্কার বাস্তবায়িত না হওয়াতে এই কৃষক-অসন্তোষ আরাে বাড়তে থাকে কৃষিঋণ প্রদান ও আদায়ের অনিয়মেও অসন্তুষ্ট ছিলেন তারা প্রথমত, কৃষিঋণ যথাসময়ে সঠিক ও যথাযথ পরিমাণে বিতরণ করা হয় নি। অন্যদিকে, কৃষকদের অবস্থার কথা না ভেবেই সরকার ঋণ আদায়ের উদ্যোগ নেয়। শরীর তল্লাশি, ওরারেন্ট জারিসহ নানা পন্থায় ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়াকে কৃষক সমাজ সাদরে গ্রহণ করেন নি রাষ্ট্রযন্ত্র নিপীড়নের মধ্য দিয়ে খাজনা আদায়ের যে উদ্যোগ নিয়েছিল তাতে কৃষক সমাজ ক্রমশ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। রাজনৈতিক নেতারা বিশেষ করে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের কৃষক ও ছাত্রকর্মীদের নিয়ে নানাভাবে এই কৃষক হয়রানির রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়াকে নিন্দা জানাতে থাকেন এবং এই ক্ষোভকে রাজনৈতিক রূপ দিতে থাকেন বিক্ষুব্ধ কৃষকরা আরাে বেশি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন।
সরকারি অফিস ভাঙচুর শুরু করেন। পুলিশি গুলিবর্ষণ চলে পূর্বপাকিস্তান জুড়ে কৃষক-অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে পাট-আখসহ কৃষিজাত পণ্যের দামের ক্রমাবনতি, ভােগপণ্যের দাম বৃদ্ধিসহ নানাবিধ বৈষম্যমূলক কৃষিনীতির বিরুদ্ধেও সােচ্চার হতে থাকেন কৃষকসমাজ এক পর্যায়ে খাদ্যাভাবে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে থাকে বিশেষত ১৯৭০ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর অবস্থা আরাে সঙ্কটাপন্ন হতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের এই দুর্যোগপূর্ণ অবস্থাতেও কেন্দ্রীয় সরকার নিচুপ নিশ্চল ছিল খাদ্যাভাবে গ্রামীণ জনপদের মানুষ অপুষ্টির শিকার হতে থাকে ডায়রিয়া, বসন্ত রােগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে তবুও সরকারের তরফ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া মেলে নি। রাজনৈতিক ঘনঘটা ওঠানামা করতে থাকে রাজনৈতিক শক্তিসমূহ জনগণের বিক্ষোভকে পুঁজি করে তাদের সক্রিয় ও সমবেত করতে থাকে ৬-দফা ও ১১-দফায় কৃষকদের বিক্ষোভ ও বঞ্চনার আভাস সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় ন্যাপ ও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণায় বিষয়টি প্রধান্য পেতে থাকে বিশেষ করে ঐ সময় গ্রাম-বাংলায় যে নির্বাচনী উত্তাপ সৃষ্টি হয় তার পেছনে ছিল কৃষকদের ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সুতরাং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে কৃষকদের অংশগ্রহণ কোনাে অত্যাশ্চার্য ঘটনা নয় কৃষকসমাজ যখন সুযােগ পেয়েছে পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রের বৈরী আচরণের জবাব তাদের মতাে করে দিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে কৃষকসমাজ সরাসরি এবং তাদের সন্তান ও আত্মিক পরিমণ্ডলের দ্বারা সৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণী মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।

সূত্রঃ  মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত – আতিউর রহমান