উৎপত্তি ক্রমবিকাশমান বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এক অংশের দ্রুত বিকশিত হতে না পারার ক্ষোভ এবং আরেক অংশের জীবনযাত্রায় টানাপােড়েনের জ্বালা—এই দুই প্রবণতার সম্মিলিত শক্তি তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। তাদের অংশগ্রহণের মাত্রা বুঝতে হলে এই শ্রেণীর উৎপত্তি এবং উদ্ভবের ধারাবাহিকতা চিহ্নিত করার প্রয়ােজন রয়েছে। বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বাভাবিক ক্রমবিকাশ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। এক পর্যায়ে এই শ্রেণীর নিজস্ব উন্নতির পথ হতে তাকে বিচ্যুত হতে বাধ্য করা হয়। কার্যত ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে নবাব সিরাজউদৌলার পরাজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উন্নয়নের (ইউরােপীয়দের মত) সকল উপসর্গ বিকশিত হচ্ছিল। একদিকে জমিদারদের একটি শক্তিশালী দল বিকশিত হচ্ছিল, অন্যদিকে নিয়ােজিত চাষীদের দল, প্রস্তুতকারক এবং ব্যবসায়ীদের দলও নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করে তােলে এই সময় ক্ষুদ্র আকারের কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা গিয়েছিল (আজাদ, ১৯৮৯ : ৬৭-৮২)। কিন্তু ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের কারণে এই প্রক্রিয়াটি বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। অথচ প্রায় ইউরােপের মতােই সনাতনী কায়দায় মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিকশিত হতে শুরু করেছিল। অবশ্য সিরাজের পতনের আগে থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এক ধরনের দালালদের নিজেদের দলে ভিড়িয়েছিল। এরা স্থানীয় পণ্য কিনতে এবং ব্রিটিশ পণ্য বিক্রি করতাে এদের বলা হতাে গােমস্তা (রহমান ও আজাদ, ১৯৯০ : ৯)।
পলাশীর যুদ্ধের পর এদের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায় এই স্থানীয় দালালরা ছিল কোম্পানির প্রতিনিধি। যে প্রক্রিয়ায় সনাতনী মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিকশিত হচ্ছিল এরা তার বাইরেই ছিল। যথেষ্ট সম্পদ উপার্জনের পর এই প্রতিনিধিরা নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। তাদের কেউ কেউ সামাজিক এবং ধর্মীয় কাজের জন্য প্রচুর অর্থ দান করেন (ঘােষ, ১৩৮৬ : ১৪৬০)। কোম্পানি তাদের উত্তরণে নাখােশ ছিল এবং তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। এ সময় এমন কিছু নতুন নিয়ম-কানুন চালু করা হয় যা ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের পক্ষে যায় এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় অথবা শিল্পে পুঁজি খাটাতে নিরুৎসাহিত করে। কার্যত স্থানীয় পুঁজি ব্যবসায় অথবা শিল্পে না খেটে জমিদারি কেনার কাজে ব্যবহৃত হতে শুরু করে (উমর, ১৯৮৭ : ১৬-১৭)। মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে তাদের ঐতিহ্যগত ভিত্তি থেকে পৃথক করার জন্য ১৮৩৭ সালে ফার্সি ভাষার জায়গায় ইংরেজিকে প্রশাসনিক ভাষায় অধিষ্ঠিত করা হয়। উনিশ শতকের মধ্যভাগে সামাজিক সুবিধা ভােগ করার জন্য স্থানীয় জনসাধারণকে প্রশাসনিক যােগাযােগের উদ্দেশ্যে ইংরেজি ভাষা শিখতে হয়, যা নতুন শিক্ষানীতির জন্ম দেয়। এই নীতির ফলে হাই স্কুল এবং কলেজগুলােতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি পায় ইংরেজি এবং তা সরকারি যােগাযােগের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। আমলা, আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক প্রভৃতি বিশাল শিক্ষিত জনগােষ্ঠী প্রশাসন এবং সমাজের জন্য যথেষ্ট অবদান রাখলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদেরস্পষ্ট কোন অবদান ছিল না। কিন্তু যখন থেকে কৃষকদের একাংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে রূপান্তরিত হতে শুরু করে তখন থেকেই এই চিত্র বদলে যেতে শুরু করে। এই সময় থেকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
অবশ্যি ১৮৫৯ সালে জমিদারি প্রথার বিপক্ষে আদালত রায় দেয়ার পর কৃষকরা আংশিকভাবে লাভবান হয়েছিলেন। ১৮৮৫ সালে প্রজাস্বত্ব আইন কৃষকদের জমির মালিকানা লাভে সাহায্য করেছিল (রহমান ও আজাদ, ১৯৯০ : ২৮-২৯)। তাছাড়া ১৯০২ সালের আরেকটি আইন কৃষকদের জমির অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল। এইভাবে কৃষকরা তাদের সম্পত্তির অধিকার রক্ষায় বেশি নিরাপদবােধ করতে লাগলেন এবং এই পদ্ধতিতে কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে একটি স্বাধীন মধ্যবিত্ত শ্রেণী বের হয়ে আসে। পরবর্তীকালে তাদের উৎপাদিত বাণিজ্যিক পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায় এবং তারা কিছু বাড়তি আয় করতে শুরু করেন। বাড়তি এই আয় সন্তানদের শিক্ষাখাতে ব্যয় হতে থাকলাে। এই প্রক্রিয়ায় ধনিক কৃষকদের উদ্বৃত্ত শিক্ষাখাতে ব্যবহৃত হয়ে তাদের মধ্য থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ হতে থাকে।
উপরােক্ত আলােচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশে তিনটি আন্তঃসম্পর্কীয় পদ্ধতি অবদান রেখেছিল:
১. কোম্পানির স্থানীয় দালালদের মধ্যস্থতার কারণে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত;
২. ইংরেজি শেখা জনসাধারণের মধ্য থেকে প্রশাসনিক এবং সামাজিক
অভিজাত শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং
৩. ১৮৫৯ এবং ১৮৮৫ সালের আইনের মাধ্যমে কৃষকদের জমির ওপর
মালিকানার অধিকার। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ওপরের পদ্ধতিগুলােকে আরাে বেগবান করেছে।
আংশিকভাবে হলেও পূর্ব বাংলার অভিজাতরা কিছু আঞ্চলিক রাজনৈতিক ক্ষমতার সুবাতাস পেয়েছিলেন। ব্যবসায় ও শিক্ষার সুযোেগ হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাণিজ্যিক পণ্যের দাম বিশেষ করে পাটের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল। ছেলেমেয়েরা প্রথমে স্থানীয় শহরগুলােতে এবং পরে কলকাতা ও ঢাকায় উচ্ছ শিক্ষার সুযােগ পাওয়া শুরু করলাে। এই নতুন শিক্ষিত যুবকদের কেউ কেউ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং অন্যরা প্রশাসনিক কাজসহ বিভিন্ন পেশাদারি কাজে জড়িয়ে পড়েন। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে তারা অগ্রাধিকারও পান।
তা সত্ত্বেও তাদের একটি বড় অংশ উপনিবেশ-বিরােধী আন্দোলনে সাধারণভাবে জড়িয়ে পড়েন এক সময় ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করা হয়। পূর্ব বাংলার এই শিক্ষিত অভিজনদের বেশির ভাগই পাকিস্তান চেয়েছিলেন তারা আশা করেছিলেন, তারা কিছুটা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক উন্নতি করতে পারবেন। কিন্তু তারা শিগগিরই বুঝতে পারলেন, তাদের এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার নয়। তাই এ অঞ্চলে একটি নতুন জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলন শুরু হতে থাকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে পাকিস্তানের প্রশাসন কৃষক শ্রেণীতে জন্ম নেয়া পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিতে চায় নি। এই প্রদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন প্রথমে গণতন্ত্রের জন্য এবং পরবর্তীকালে আঞ্চলিক রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির মানসিকতা নিয়ে বিস্তৃত হয়। আর এভাবেই পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারে এমন শক্তিশালী একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভিত সুদৃঢ় হতে থাকে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিভিন্ন উপাদান মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিভিন্ন বর্গকে বােঝার জন্যে আমরা ছক ৩.১ দেখতে পারি। এই ছকে ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের পেশাগত অবস্থানের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অর্থনৈতিক ও পরিবহন ক্ষেত্রে এবং প্রশাসনিক এলিট ছাড়া দুই কোটি ষাট লক্ষ শ্রমশক্তির বেশির ভাগকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কোনাে একটি বর্গে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। প্রশাসনিক এলিটরা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত নন। এদের বেশির ভাগই রাষ্ট্র অথবা পুঁজির পক্ষে কাজ করতেন। শোষণের মাধ্যম হিসেবে তাদের চিহ্নিত করা যায়। সুতরাং তারা ধনিক শ্রেণীর অন্তর্গত পরিবহন এবং অন্য শ্রমিকরা মজুর শ্রেণীর অন্তর্গত। আবার বর্গাচাষীর বড় অংশ প্রলেতারিয়েতের অন্তর্গত তাছাড়া ছাত্ররা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সকল আশাআকাক্ষাও ধারণ করে। গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে হিসেবে না ধরলে মাত্র ৩৭ লক্ষ শ্রমশক্তি মধ্যবিত্ত হিসেবে শ্রেণীভুক্ত হবে। এরা মােট শ্রমশক্তির ১৪.৩ শতাংশের মতাে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত কৃষকদের পরিচয় জানার জন্যে আমরা Pakistan Census of Agriculture, 1960 এবং Master Survey of Agriculture in Bangladesh 1967-68 (সপ্তম মুদ্রণের সপ্তম সংস্করণ, ১৯৭২-এ বিবিএস কর্তৃক প্রকাশিত)-এর ওপর নজর দিতে পারি। এই দুই নিরীক্ষা মতে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত কৃষকের সংখ্যা ২৩ লাখ ১৩ হাজার ৯৭০ এবং ২৪ লাখ ২৪ হাজার। ২২৪। অন্যভাবে বলা যায়, এই আট বছরে এই শ্রেণীর কৃষকদের বৃদ্ধির হার ছিল। ৫.৪৬ শতাংশ।
না। ছাত্ররা ছিল দ্বিতীয় বৃহৎ মধ্যবিত্ত উপশ্রেণী এরা পুঁজিপতি অথবা পেশাজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখতাে উৎপাদনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকা সত্ত্বেও তারা পিতা-মাতা ছাড়া অন্যের ওপর নির্ভরশীলও ছিল না। এর পরের গুরুত্বপূর্ণ শ্ৰেণীটিতে লেখক, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, দোকান-মালিক ও কর্মচারীরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তারা বিভিন্ন ধরনের কাজ করলেও তাদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। তারা সবাই কমবেশি স্বাধীন শ্রেণীর অন্তর্গত ছিলেন। দোকান কর্মচারীদেরকে এই শ্রেণীতে বিশেষ করে দোকান মালিকদের (অনিবন্ধিত) শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাদের আয়ের স্তর প্রায় সমান বলেই তা করেছি। মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে যখন আঘাত করা হয় তখন সেই সঙ্কটের মুহূর্তে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে সাড়া দেন। কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের বিভিন্নতার কারণে এই সংঘবদ্ধ প্রতিরােধের সুযােগগুলাে সংখ্যায় বেশি ছিল না। এরাই ছিল ১৯৬৯ সালে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রায় এক-দশমাংশ।
কেরানি এবং অন্য কর্মচারীরা ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রায় ৪ শতাংশ। সংখ্যায় কম হলেও তারা শহরাঞ্চলের অফিস ও কারখানাগুলােতে কাজ করতেন বলে যে-কোনাে আন্দোলনে তাদের সহজেই সংগঠিত করা যেত। পক্ষান্তরে, নিবন্ধিত দোকান এবং ব্যবসায় কেন্দ্রগুলাের কর্মচারীরা বরাবরই ঝুঁকির মধ্যে থাকতেন। মালিকদের মানসিকতা সম্বন্ধে তাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হতাে। তাদের যে বিপুলভাবে শােষণ করা হচ্ছে তা এ সময়টাতেই তারা অনুভব করলেন। তাদের চাকরিদাতাদের নেতিবাচক মানসিকতার বিরুদ্ধে তারা অনেকেই রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়নে। তারাই নয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অংশ হিসেবে আবির্ভূত হতে শুরু করলেন এই রাজনৈতিক আন্দোলনে প্রকাশ্যে যােগদানে সরকারি কর্মচারীদের সুযোেগ অত্যন্ত সীমিত ছিল। তাদের চাকরির এই শর্তে তারা খুশি ছিলেন না। বেতন কাঠামাে এবং আবাসন ও অন্যান্য সুবিধার দিক থেকে অসমতা তাদেরকে প্রায়ই আন্দোলনে উৎসাহিত করতাে যদিও তা সীমিত ছিল, তবুও কিছু রাজনৈতিক দল এই অসন্তোষকে দক্ষতার সাথে ঐ সময় কাজে লাগিয়েছিল। অন্যান্য বিশেষজ্ঞ ও পেশাজীবীরা আকারে ক্ষুদ্র হলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে তারাই সবচেয়ে বেশি সচেতন ছিলেন। তারা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বৈষম্যের ধারা বুঝতে পারার মতাে যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিলেন। বিকাশমান বাঙালি জাতির বিবেক হিসেবে তারা বিবেচিত হতেন এবং বৈষম্যের ভিত্তির গভীরতর অন্বেষণে তারা অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। তারা শহরে বাস করতেন এবং বুদ্ধিজীবীদের বড়াে অংশ ছিলেন। আর্থ-সামাজিক বৈষম্য এবং অবিচারের বিরুদ্ধে তারাই ছিলেন সবচেয়ে বেশি সােচ্চার আইনজীবী এবং চিকিৎসকগণ সংখ্যায় মাত্র ১৪ হাজার হলেও মধ্যবিত্ত বিভিন্ন অংশ এবং জনসাধারণের ওপর তাদের প্রচণ্ড প্রভাব ছিল।
তাদের কারাে কারাে ওপর মানুষের অগাধ বিশ্বাস ছিল। ভালাে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সকল আইনজীবী এবং চিকিৎসকরা ছােটখাটো সমাজসচেতন গােষ্ঠী গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এরা আলােকিত মধ্যবিত্তের ধ্যান-ধারণাকে মূলধারার রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। অবশ্যি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছাত্ররা ছিল সামাজিক ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র এবং সর্বোপরি জাতীয় মুক্তির স্বপ্নের ব্যাপারে আবেগপ্রবণ তারা গ্রাম এবং শহর উভয় অঞ্চল থেকেই এসেছিল তারা সবসময়ই তাদের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবীদের সংস্পর্শে থাকতাে। সুতরাং, চলমান রাজনীতি সম্পর্কে তাদের পরিষ্কার ধারণা ছিল চাষী এবং শ্রমিক উভয়ের কাছে প্রয়ােজনীয় রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে এই ধারণা তাদের সাহায্য করেছিল। একইভাবে রাজনৈতিক দলের কর্মীদেরও তারাই আরাে সচেতন করার ক্ষেত্রে বড়াে ভূমিকা পালন করেছে। কার্যত তারাই আলােকিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশে পাট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কাঁচা পাটের ৯২ শতাংশ পূর্ব বাংলায় উৎপাদিত হতাে বিশ শতকের গােড়ার দিকে বিশ্ববাজারে পাট এবং পাটজাদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পায় এ সময় কলকাতায় পাটকলের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। এই কলগুলােতে কাঁচা পাট যােগান দিতে গিয়ে একটি নতুন সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এদের ফড়িয়া বলে ডাকা হতাে উৎপত্তিগত দিক থেকে তারা বাংলার উদ্বৃত্ত কৃষক সম্প্রদায়ের অংশ। মধ্যস্বত্বভােগী এবং পূর্ব বাংলার বেশির ভাগ কৃষকই ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের তাই ফড়িয়াদেরও বেশির ভাগ ছিল ঐ সম্প্রদায়ের (রহমান ও আজাদ, ঐ; পৃ. ৪৩)। অন্যভাবে বলা যায়, পাটের এই ব্যাপক চাহিদা শুধুমাত্র সনাতন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্বৃত্ত কৃষক বৃদ্ধিতেই সহায়তা করে নি বরং পাট ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ব্যবসায়িক শ্রেণীর বৃদ্ধিতেও সহায়তা করেছে। পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এরাও ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
কলকাতাভিত্তিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী পাট এবং পাট সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড থেকে শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন। কিছু মধ্যস্বত্বভােগী পাট ব্যবসায়ের সাথে জড়িত হয়ে কলকাতার পৌর অভিজনদের দলে যােগ দেন। এক সময় কলকাতাভিত্তিক শক্তিশালী এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী ঔপনিবেশিক শাসকদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ঔপনিবেশিক শাসকেরা এর জবাবে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতির সূচনা করে। এ কারণেই ১৯০৫ সালে বাংলার বিভক্তি ঘটে। নতুন প্রদেশের মূল রাজধানী হয়। ঢাকা এবং চট্টগ্রামকে বিকল্প রাজধানী হিসেবে ঘােষণা দেয়া হয়। পূর্ব বাংলার আইন প্রণয়ন কেন্দ্র ঢাকায় স্থানান্তরিত করা হয় এবং এ অঞ্চলে এলিটরা এই সুবিধা ভােগ করতে থাকে। এরপরে এ অঞ্চলে অনেক নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। অনেক স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক আদালতকে ঘিরে একদল আইনজীবীর উদ্ভব হয়। এভাবেই তারা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের স্বাদ পেতে শুরু করেন। কিন্তু ঐ সময় কলকাতাভিত্তিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী ব্রিটিশ রাজকে অবিরাম চাপ দিয়ে আসছিলেন বাংলাকে পুনরায় একত্র করার জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন এই চাপের কাছে নতি স্বীকার করে। ১৯১১ সালে বাংলা আবার এক হয়। এই অল্প সময়ের জন্য পাওয়া আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, তা যত সীমিতই হােক না কেন, পূর্ব বাংলার সাধারণ এবং অভিজন উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই আশীর্বাদ বলে বিবেচিত হয়েছিল তাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলমান এ কারণে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে আখ্যা দেয়ার নতুন সুযােগ তারা পেয়ে গেলেন। পূর্ব বাংলার ঢাকা ও চট্টগ্রামকে ঘিরে অভিজনেরা, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলমান, তারা বুঝতে পারলেন, হিন্দু-প্রভাবিত কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাদের প্রতি আন্তরিক নন পরিসংখ্যানও তাদের এই অসন্তুষ্টির পক্ষে যায় পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে ১৯০৭ এবং ১৯১২ সালের মধ্যে শিক্ষিত জনসংখ্যার পরিমাণ ৮৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। সারা বাংলায় ঐ সময় শিক্ষিত জনসংখ্যা বেড়েছিল ৩৭ শতাংশ এভাবে পূর্ব বাংলার অনেক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের সন্তানেরা শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন।
১৯০৫ সালের পর কর্মসংস্থান এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, বাংলা এক হওয়ার পর সেখানে একটি ভাটার টান লাগে সাধারণ চাকরিক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের প্রশ্ন শিক্ষিত মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ব্যবসা করার জন্যে যে পুঁজির প্রয়ােজন তা যােগান দেয়ার মতাে অতিরিক্ত অর্থ এই অঞ্চলে মধ্যবিত্তের কারাে ছিল না। সরকারি চাকরির জন্য মুসলমান রাজনৈতিক নেতারা তৎপরতা। চালান, যাতে এই সম্প্রদায়ের শিক্ষিত যুবকরা প্রয়ােজনে যােগ্যতা শিথিল করে। হলেও তা লাভ করতে পারে (রহমান ও আজাদ, ঐ, পৃ. ৬৮)। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এই দাবির পক্ষে বিখ্যাত বাংলা চুক্তির মাধ্যমে তাঁর ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ১৯২৩ সালে নির্বাচনে মুসলমানদের অভূতপূর্ব সমর্থন নিয়ে তাঁর স্বরাজ পার্টি জয়যুক্ত হয়। তিনি বাংলা চুক্তিতে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করেন এবং মুসলমানরা তাকে সেজন্যই বিশ্বাস করতেন। সুতরাং তারা তাকে নির্বাচনে প্রয়ােজনীয় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৯২৫ সালে তিনি। মারা গেলেন এবং স্বরাজ পার্টির ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র দ্রুতই হারিয়ে গেল আর এভাবেই মধ্যবিত্ত মুসলমানরা তাদের হিন্দু বন্ধুদের কাছ থেকে দূরে সরে গেলেন তখন পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ বহিরাগত দল ছিল অবাঙালি জমিদারদের প্রভাবে এটি চলতাে।
কিন্তু জমিদারি প্রথা উচ্ছেদে রাজি হওয়ার সাথে সাথেই মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলার বিপুল সমর্থন পেল কৃষক-প্রজা পার্টির নেতা এ, কে, ফজলুল হক মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতায় পরিণত হলেন এবং পাকিস্তান আন্দোলনে তার লাহাের প্রস্তাব এক নতুন মাত্রা যােগ করলাে। পূর্ব বাংলার কৃষকরা জমিদারদের (বেশির ভাগ হিন্দু) শশাষণে প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তাই এ অঞ্চলে মধ্যবিত্ত মুসলমানেরা সর্বান্তকরণে চেয়েছিলেন যাতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন একটি সৎ এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের যাতে তারা অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে আগের চেয়ে ভালাে থাকতে পারবেন কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাদের সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় নি। জমিদারি প্রথা সত্যিকার অর্থে তখনও লােপ পায় নি। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রশাসন ঔপনিবেশিক শাসনের চেয়ে কম নির্মম কিছু ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সদস্যরা তাদের উন্নয়নের ধারা নিয়ে তাই দারুণ অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাদের আর্থ-সামাজিক বিকাশের পথ সঙ্কুচিত হতে শুরু করেছিল। খাজা নাজিমউদ্দীন বরাবরই জমিদারদের পক্ষে ছিলেন।
আর তিনিই হলেন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। তিনি কখনােই পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ইচ্ছের মর্যাদা দেন নি। বরং অবাঙালি আমলা, প্রকৌশলী এবং শিল্পপতিদের আশা-আকাক্ষার প্রতীক হয়ে রইলেন পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধনী হিন্দুরা দলে দলে ভারতে চলে গেলেন। ফলে ব্যবসায় ও প্রশাসনে শূন্যতা দেখা দিল (করিম, ১৯৮৪:২৪১)। যে সব মুসলমানের হাতে উদ্বৃত্ত পুঁজি ছিল তারা দেশান্তরী হিন্দুদের সম্পত্তি কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তারা ব্যবসায় ও শিল্পেও তাদের পুঁজি খাটালেন না। শিগগিরই এই শূন্যস্থান অবাঙালিদের দ্বারা পূরণ হতে লাগলাে তারা পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সতিকারের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন (রহমান ও আজাদ, ঐ; আলী, ১৯৮৫, পৃ. ৪৫)। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় এই পূর্ববঙ্গীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সদস্যরা শিগগিরই বুঝতে পারলেন যে, তারা অবাঙালি আমলা, ব্যবসায়ী। এবং শিল্পপতিদের দ্বারা অবরুদ্ধ। তাদের আশা পূরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সমর্থন সম্পর্কে তারা বিশ্বাস হারালেন। পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হতাশার কারণ না। খুঁজে শাসক সম্প্রদায় বরং বাঙালিদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে অগ্রাহ্য করতে শুরু করলাে। ফলে বাঙালি অভিজনদের হতাশা আরাে তীব্র হতে লাগলাে। সাথে সাথে পাকিস্তান রাষ্ট্র বাঙালি সংস্কৃতিকে অগ্রাহ্য করে তাদের ইচ্ছামতাে তথাকথিত ধর্মীয় সংস্কৃতিকে অগ্রাধিকার দিতে শুরু করলাে।
সুতরাং তারা শুরুতেই বাংলা ভাষার পবিত্রতায় আঘাত হানলাে। তৎকালীন পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষের মাতৃভাষা বাংলার জায়গায় জোর করে তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। এই অসৎ উদ্দেশ্য দ্রুতই বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ভাষা আন্দোলন সেই অর্থে বাঙালি মধ্যবিত্তের ঐ চ্যালেঞ্জেরই ফসল আগেই বলেছি, পূর্ববাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বেশির ভাগ মানুষ কৃষক সম্প্রদায় থেকে এসেছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলনে তারা সক্রিয় ভূমিকাও রেখেছিলেন যেহেতু পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন তাই তারা মনে করেছিলেন, রাষ্ট্র তাদের আবেগ অনুভূতির মূল্য দিয়ে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবে কিন্তু বাস্তবে তারা বরং উর্দুকে সেই মর্যাদা দিলাে বাংলাকে করলাে। অপমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অংশ ছাত্ররা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলনের সূত্রপাত করলাে। এমনকি বাংলা ভাষার মর্যাদার লড়াইয়ে তাদের রক্ত ঝরলাে তারা সরাসরি সরকারের রাষ্ট্রভাষা নীতির বিপক্ষে চলে গেল।
তাদের এই আন্দোলনে অংশ নেয়ার পেছনে যেসব কারণ কাজ করেছে সেগুলাের প্রধান দুটো কারণ হলাে : এক, বাংলা অপমানিত হওয়ার কারণে তারা মনে করলাে, পাকিস্তান রাষ্ট্র বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য এবং গর্বের বিরুদ্ধে যারা মােট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ তাদের ভাষার প্রতি এই অবিচার বুদ্ধিজীবী মহলে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। সেই প্রতিক্রিয়া এক সময় সাধারণ মানুষের মনেও সঞ্চারিত হয়েছিল। তারা এটা উপলব্ধি করতে পারলাে যে, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে তাদের সরকারি ও আধাসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রবেশের সুযােগ সংকুচিত হবে তাদের অর্থনৈতিক সুবিধেগুলাে হারিয়ে যাবে। তাদের সন্তানদের শিক্ষার সুযােগ সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। তাদের সংস্কৃতি বিকশিত হবে না। ভাষা আন্দোলনে শহরাঞ্চলের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যাপক অংশগ্রহণ ঐ শ্রেণীর শিক্ষিত অংশের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করে। মাতৃভাষার পবিত্রতা রক্ষার জন্য সর্বসাধারণের দাবির মাধ্যমে বাঙালি জাতির পৃথক আশাআকাক্ষার বার্তা সবার কাছে পৌছে দেয়ার কাজটি দক্ষতার সাথেই করতে পেরেছিলেন নেতৃত্বের অপেক্ষাকৃত বেশি আলােকিত অংশটি পাকিস্তান রাষ্ট্র যে সংখ্যাগুরু বাঙালিদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে মােটেই আন্তরিক নয় ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে এই কথাটি স্পষ্ট হয়ে যায়। সেই চেতনারই প্রতিফলন ঘটে পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে। ঐ নির্বাচনে বাঙালি জাতিসত্তায় বিশ্বাসী যুক্তফ্রন্ট বিপুলভাবে জয়ী হয়।
গভীরভাবে পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখিত ২১-দফা আসলে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আশা-আকাক্ষারই প্রতিচ্ছবি। এই ছবিটি আরাে পরিষ্কার হয় যখন এই দাবিটি শ্রমশক্তির বিভিন্ন উপদলে বণ্টন করে দেখা হয়। আমাদের কাছে ১৯৫৪ সালের শ্রমশক্তির তথ্য না থাকার কারণে আমরা ১৯৬১ সালের উপাত্ত ব্যবহার করেছি। ১৯৬১ সালে মাত্র ৭ শতাংশ শ্রমশক্তি অকৃষিজীবী মধ্যবিত্ত কৃষক শ্রেণীর অন্তর্গত ছিল । শ্রমশক্তির প্রায় ২৯ শতাংশ ছিল মধ্যবিত্ত কৃষক। তাদের প্রায় সব আকাক্ষাই এই ইশতেহারে উল্লিখিত বা প্রতিফলিত হয়েছিল। ২১-দফায় অন্তর্ভুক্ত আর্থ-সামাজিক দাবিসমূহের ২৪ শতাংশ ছিল এদের আশা-আকাক্ষার আলােকে তৈরি মােট শ্রমশক্তির প্রায় ৩৬ শতাংশ ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত কিন্তু ২১-দফায় প্রায় ৬৮ শতাংশ আর্থ-সামাজিক দাবি-দাওয়াই ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আশা-আকাক্ষা ঘিরে এটা অভাবিত নয়। কার্যত যুক্তফ্রন্ট ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনৈতিক জোট। সুতরাং নির্বাচনী ইশতেহারে তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে এটাই স্বাভাবিক।
সত্যিকার অর্থে পঞ্চাশের দশকের গােড়ার দিকে শহুরে এবং গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সংযােগ ছিল খুবই গভীর রাজনৈতিক নেতারা ছিলেন মূলত শহুরে মধ্যবিত্ত অভিজাত শ্রেণীর প্রথমদিককার প্রজন্ম। সুতরাং কৃষকদের আর্থ-সামাজিক দাবি শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতাদেরও প্রাণের দাবি ছিল। ছক ৩.৩ থেকে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি যে বর্গাচাষী, কৃষিমজুর এবং শিল্পশ্রমিক (যাদের মােট পরিমাণ প্রায় ৬০ শতাংশ) ছিলেন মােট শ্রমশক্তির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কিন্তু তাদের দাবি-দাওয়ার মাত্র ১৯ শতাংশ ২১ দফায় প্রতিফলিত হয়। তখন দেশে প্রায় ২৭,৬০,০০০ কৃষি শ্রমিক ছিলেন তাদের একটি মাত্র দাবি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। অন্যদিকে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী যারা সংখ্যায় কৃষিশ্রমিকদের অর্ধেকেরও কম, তাদের জন্য প্রায় ১৮টি দাবি উত্থাপিত হয়েছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়ার দরুনই যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিপুল ভােটে জয়যুক্ত হয়। যুক্তফ্রন্ট ২৯১টি আসন দখল করে এবং শাসকদল মুসলিম লীগকে ১০টি আসন নিয়েই খুশি থাকতে হয়।
হয়েছিল। ছক ৩.৩-এ ধর্মঘট আহ্বানকারীদের অবস্থান দেখানাে হয়েছে এই ছক অনুযায়ী ১৯৬৪ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ২৫। শতাংশ ধর্মঘটই ছিল ছাত্রদের নেতৃত্বে তার মানে আন্দোলনকারীদের মধ্যে তারাই ছিল প্রভাবশালী। অফিস এবং অন্য কর্মজীবীরা ডেকেছিলেন ২৭ শতাংশ এবং সনাতন মধ্যবিত্ত শ্রেণী ডেকেছে মাত্র ১৪ শতাংশ ধর্মঘট। অন্যভাবে বললে, সনাতন এবং নয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণী সেই সময় একত্রে প্রায় ৬৬ শতাংশ ধর্মঘট ডেকেছিল এতে কোননা সন্দেহ নেই যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রশাসনের বিরুদ্ধে আহূত ধর্মঘট বাস্তবায়নে মধ্যবিত্ত শ্রেণীই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ধর্মঘট ছাড়াও প্রতিরােধের অন্যান্য ক্ষেত্রে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এই প্রতিরােধে যােগ দেন। দৈনিক আজাদের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এই সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে (ছক ৩.৪ দেখুন)। সরকার-বিরােধী বিক্ষোভের ৩০৫টি খবর এই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭ শতাংশ বিক্ষোভ ছাত্ররা সংগঠিত করেছিল। সাংবাদিক এবং শিক্ষকদের প্রতিরােধের হার ছিল ১৫ শতাংশ। কৃষকেরাও নিশ্ৰুপ ছিলেন না (১৪ শতাংশ)। চাকরিজীবীরাও (৫.৫ শতাংশ) তাদের কণ্ঠস্বর উঁচু করেছিলেন। এই দৈনিকে প্রতিরােধ সম্পর্কিত ৫৭ শতাংশ সংবাদের সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংযােগ ছিল। বাঙালি শিল্পপতিরাও নিচুপ ছিলেন না (৪ শতাংশ)। অবশ্যি মনে রাখতে হবে, পত্রিকাটি আইয়ুব খানের একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিভিন্ন উপদলের সকল প্রতিরােধের সকল খবর প্রকাশ করতে
পারে নি। একটি সাধারণ সমীক্ষায় (১৬২ জন উত্তরদাতা) দেখা গেছে, বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের ৪০ শতাংশ ছিলেন শহুরে এবং বাকি ৬০ শতাংশ ছিলেন গ্রামের অধিবাসী (আজাদ, ঐ)। এই সমীক্ষায় আরাে দেখা গিয়েছে, তারা ভৌগােলিকভাবে ১৭টি জেলার মধ্যে ১৫টি জেলা হতে এসেছিলেন সমীক্ষাটি চারটি বিভাগীয় এবং কিছু জেলা সদরের প্রধান কার্যালয়ে চালানাে হয়েছিল। উত্তরদাতাদের ১৭ শতাংশ ছিলেন ভূমিহীন, ৪০ শতাংশ ছিল উদ্বৃত্ত কৃষক, যাদের জমির পরিমাণ ৮ একরের বেশি (গড়ে জমির পরিমাণ ছিল ৩১ একর) ধনী ভূমিমালিক হওয়া সত্ত্বেও তারা সরাসরি কৃষিকাজের সাথে যুক্ত ছিলেন না। পেশাগত দিক থেকে তারা ছিলেন ছাত্র, অফিস কর্মজীবী, দোকান মালিক ইত্যাদি বাকি ৪৩ শতাংশ ছিলেন মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের। ৮৩ শতাংশের পারিবারিক আয়ের উৎস ছিল আংশিক অথবা পুরােপুরি কৃষিনির্ভর তাদের বাৎসরিক গড় আয় ছিল ১৬ হাজার ৩১৬ টাকা। মাত্র ১৩ শতাংশ তাদের বাৎসরিক পারিবারিক আয় বলেছিলেন ২০ হাজার টাকা এবং অন্যান্য ২৪ শতাংশের এই পরিমাণ ছিল ১০ হাজার টাকারও কম আয়ের এই চিত্র থেকে বােঝা যায়, আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলনের সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশগ্রহণকারীই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত ছিলেন।
উত্তরদাতাদের ৯১ শতাংশ মনে করেন, বিভিন্ন পেশার লােকের মধ্যে ছাত্ররাই প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। ঊনসত্তরের বিক্ষোভ ও আন্দোলনে ছাত্ররাই সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী অংশ ছিল সে ব্যাপারে কোনাে সংশয় নেই। কিন্তু তাদের পর আর কোন্ কোন্ গােষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সে প্রশ্নে কিছুটা মতভেদ রয়েছে ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, শ্রমিকরা এবং ৩৬ শতাংশের মতে বুদ্ধিজীবীরা বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ গােষ্ঠী এবং ৩ শতাংশ। বুদ্ধিজীবী ছিলেন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাশাপাশি বিভিন্ন। পেশাজীবী, দোকানদার এবং বস্তিবাসীদেরও আন্দোলনে উজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। একথা ঠিক, ১৯৬০-এর আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিশাল অবদান ছিল এবং তাদের এই অংশগ্রহণ বাঙালিদের মনে জাতীয়তাবাদী ভাবনা স্পষ্টভাবে জাগিয়ে তােলে।
১৬২ জন উত্তরদাতার মধ্যে ৭৫ শতাংশ বলেন, তারা আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলনে যােগ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে প্রায় সমান সংখ্যক। মনে করেন, পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ববাংলার অর্থনীতিকে ধ্বংস বা অবদমন করছিল। এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাও বিপন্ন হচ্ছিল বলেই তারা এই আন্দোলনে যােগ দিয়েছিলেন (৬৪ শতাংশ)। উত্তরদাতাদের অনেকেই (৬০ শতাংশ) বলতে চেয়েছেন যে, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল মুক্তিযুদ্ধের পূর্বলক্ষণ কার্যত ৯৬ শতাংশ উত্তরদাতাই বলেছেন, তারা ১৯৬৯-এর আন্দোলনের সময় স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। যারা এই সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন তারা সবাই আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, যদিও তাদের অনেকেই রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন সুতরাং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সমগ্র জাতির প্রতিনিধিত্ব করে না। তা সত্ত্বেও তাদের এই মতামত কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্কও ছিল গভীর। তাদের অনেকেরই পিতামাতাও ছিলেন গ্রামে এটা নির্বিবাদে বলা চলে, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে সাধারণ মানুষও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। কাজেই পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান যে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল সে কথাটি অনুমান করা যায়। ইতিহাসের ধারাও ঠিক সেই পথেই ধাবিত হয়।
উনসত্তরের গণআন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণীর ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং পরবর্তীকালে ছাত্রদের নেতৃত্বে উত্থাপিত ১১-দফায় পরিষ্কারভাবেই জাতীয় দাবির পাশাপাশি গণমানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তির আকাক্ষার প্রতিফলন লক্ষ করা যায় বাম রাজনীতিকরা গণমানুষের এই আকাঙ্ক্ষাকে পুরােপরি বুঝতে না পারলেও আওয়ামী লীগ সঠিক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসে দলের নেতারা সফলভাবেই নির্বাচনের প্রাক্কালে দেয়া বক্তৃতা-বিবৃতিতে গণমানুষের এই আকাঙক্ষাকে তুলে আনেন মধ্যবিত্ত, শ্রমিকশ্রেণী, প্রান্তিক চাষী, ছাত্র তথা পুরাে বাঙালি জাতিই তাই ভােট দিয়ে আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করে। কিন্তু নির্বাচনে জিতেও তারা তাদের ন্যায্য ক্ষমতা লাভে বঞ্চিত হওয়ার কারণে অসহযােগ আন্দোলন (দেখুন রহমান, ১৯৯৮) এবং অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় খুবই দক্ষতার সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সকল জনগণের সমন্বিত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে রাজনৈতিক রূপ দিতে সক্ষম হয়। যুদ্ধকালে বিভিন্ন পেশার মানুষদের সক্রিয় অংশগ্রহণ সে কথাই প্রমাণ করে। আর সে কারণেই তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম বেতার ভাষণে মুক্তিযুদ্ধে খেটে-খাওয়া মানুষের অবদান অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছিলেন। তার আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছিলেন : “যারা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলাদেশের মাটি, যেখানে উকর্ষিত হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা” (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র তৃতীয় খণ্ড, ১৯৮২, পৃ. ১৫)। সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচারের সেই প্রত্যয়ই ছিল একাত্তরে সকল বাঙালির এক হওয়ার মূল অনুপ্রেরণা।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত – আতিউর রহমান