বাংলাদেশের মিটমাট আসন্ন?
কিসিঞ্জার কেন এসেছিলেন?
রমাপ্রসাদ মল্লিক
হেনরি কিসিঞ্জারের ভারত এবং পাকিস্তান পর্যটন আকস্মিক বা অহেতুক নয়। বাংলাদেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের শাসকবর্গ বহুদিন থেকেই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পূর্বপ্রস্তুতি চালিয়ে আসছিল। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ওয়াশিংটন দৌত্য এরই পথ সুগম করার অন্যতম উপকরণ।
মন্ত্রী মহাশয় স্বর্ণ সিংয়ের দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানের সামরিকচক্রী সরকারকে আমেরিকার কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমােদিত অস্ত্র সাহায্যের গােপন তথ্য ফাঁস হয়ে গেল। বিশাল আমেরিকা জনগণের মাঝে আজও এমন অনেক সত্যার্থী প্রকাশক, সম্পাদক বা জননেতা প্রগতির পথে অবিচল রয়েছেন, যারা বাংলাদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ ধনিকবর্গের চাপানাে ঔপনিবেশিক শােষণ এবং সামরিক বলাৎকার সম্বন্ধে প্রকৃত চিত্র বিশ্বের চোখে উদঘাটিত করতে দ্বিধা বা দেরি করেনি। এবারও তাই পাকিস্তান সরকারকে দেয়া সামরিক সাহায্যের পরিমাণ (কেবল পঁয়তিরিশ মিলিয়ন ডলার মূল্যেরই নয়, এই অঙ্কের আড়ালে অনেকগুণ বেশি সামরিক অস্ত্র সাহায্যের স্রোত অব্যাহত) জানাল ইয়র্ক টাইমস এবং সেনেটর চার্চ, এডওয়ার্ড কেনেডি আদি সত্যব্রতী লােকসেবকরা। স্বর্ণ সিং এই অকাল উদঘাটনের দ্রুততায় এতই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিলেন যে, তাঁকে স্বদেশে পার্লামেন্টের সামনে নিক্সন প্রশাসনের বিরুদ্ধে ছদ্ম উদগারের পরিশ্রমে গলদঘর্ম হতে হয়।
এ প্রসঙ্গে সামরিক সাহায্যের পরিমাণ টাকার অঙ্কে- কোনােই গুরুত্ব রাখে না। আধুনিক যুগের যুদ্ধ প্রকৃতি, আণবিক অস্ত্র ব্যবহৃত না হলেও, এত জটিল এবং দ্রুত সম্প্রসারণশীল প্রয়ােজনের পটভূমিকায় রচিত যে, উক্ত সাহায্যের কার্যকারিত একাধিক কার্যকারণের সমাবেশের ওপর নির্ভর করে। সুতরাং ১৯৫৪ এর পর পাকিস্তানকে দুই হাজার মিলিয়ন ডলার মূল্যের সাহায্য দেয়া হয়েছে, কিংবা তারও পরেকার অধ্যায়ে অর্থাৎ ১৯৬৭ এবং তিরিশে এপ্রিল ১৯৭০ এর মাঝে ৪৭,৯৪৪,৭৬১.৭৬ ডলার মূল্যের সমরােপকরণ দেয়া হয়েছে, সে বিবেচনা অবান্তর। মধ্যপ্রাচ্যে যেমন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতপাকিস্তান উপমহাদেশের ভূ-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের কয়েকটি বাধা নীতির কেন্দ্রবিন্দু রয়েছে-
(এক) সুদূর প্রাচ্য থেকে এগিয়ে আসা কমিউনিজমের প্লাবন রােধ করার কাজে বর্তমান পাকিস্তান সরকার ভারত অপেক্ষা বেশি নির্ভরযােগ্য; পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তথাকথিত সামরিক জাতির লােক দিয়ে গঠিত, যারা নাকি ভারতীয় সেনাবাহিনীর জবানদের তুলনায় বেশি দক্ষ, সাহসী ও দৃঢ়; ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে লাহােরের লড়ায়ে তা নাকি প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং চীনের সঙ্গে পাকিস্তানি সরকারের মিতালীর’ জনরবে যুক্তরাষ্ট্র মােটেই বিচলিত নয়। তারা জানে, পাকিস্তানের বর্তমান শাসকশ্রেণী তাদের বিত্তস্বার্থের খাতিরে যেমন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলকে উপনিবেশ করে রাখতে বাধ্য ঐশ্রমিক সমধর্মের বােলচাল এবং ভনিতা সত্ত্বেও তেমনি তারা চীনের সঙ্গেও বন্ধুত্বের ভান বজায় রেখে বিশ্বাসঘাতকতা করতে প্রস্তুত (অধিকৃত কাশ্মীরে গিলিগিটের উত্তরাঞ্চলে যে এক ফালি জমি চীনকে নাকি খয়রাত করা হয়েছে তা পাকিস্তানি সরকারের বৃহৎ ব্যবসায়ীবর্গের স্বার্থে-সিংকিয়াং থেকে আনুমানিক একশ পঞ্চাশ মিলিয়ন চৈনিক মুদ্ৰামূল্যের পণ্য সাহায্যের স্বপ্ন কম লােভনীয় নয়। পাকিস্তানের পূর্বাঙ্গ হাত ছাড়া যাতে না হয়, সে উদ্দেশে ভারত এবং সােভিয়েত রাশিয়ার জুজু দেখিয়ে চীনের পরােপক্ষ কূটনৈতিক সমর্থন এবং প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক সাহায্য আদায় করে নেয়া উক্ত শাসকবর্গের অনুসৃত চীনকে ব্ল্যাকমেইল করা নীতির অন্তর্গত।)।
(দুই) ১৯৬৬ সালে তাশখন্দে সােভিয়েত রাশিয়ার কূটনৈতিক মুরুব্বিয়ানা মেনে নিয়ে পাকিস্তানের শাসক গােষ্ঠী পস্তেছিল; পরে তারা পেশােয়ারের অনতিদূরে বাদবেরা উড়ােজাহাজ ঘাঁটি আমেরিকার মৌরসিপাট্টাচ্যুত করিয়ে আশা করেছিল যে, সােভিয়েত রাশিয়াকে তােয়াজ করে কাশ্মীর পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে। কালক্রমে যখন দেখা গেল তা দুরাশা মাত্র, কারণ সােভিয়েত রাশিয়া কেবল যে সকল জাতিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রয়ােগ হতে দেয়ার লেনিনপন্থী নীতি থেকেই সরে এসেছে তা নয়, এই বৃহৎ রাষ্ট্র এখন মধ্যদক্ষিণ এশিয়ায় শক্তি-ভারসাম্যের হানি ঘটতে দিতে নারাজ এবং সে জন্য কাশ্মীরের জনগণ প্রকৃতপক্ষে কী চায়, ভারতে চিরন্তন অবস্থিতি, পাকিস্তানে বিলিয়ন না স্বাধীন রাজসত্তা, তা নিয়ে কোনাে প্রশ্নের পুনরুত্থাপন হতে দেবে না। সে সময় থেকেই পাকিস্তান সরকারের সােভিয়েত রুশ নীতি ঘুরতে আরম্ভ করেছে। বর্তমানে পাকিস্তানি শাসক মহল রাশিয়ার কোনাে রকম মধ্যস্থতার ভূমিকা সহ্য করবে না; গত এপ্রিল মাসে রুশী প্রেসিডেন্ট পদগাের্নির চিঠির প্রায় অপমানকার অবজ্ঞা এই মনােভাবের সূচক। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও রাশিয়ার সরকারি স্তরে মনােমালিন্যের সুযােগ চূড়ান্তভাবে নিতে উদ্যত।
(তিন) অথচ পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে সেখানকার জনগণের সুব্যক্ত অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে কোনাে নগ্ন ঔপনিবেশিক শাসন চলতে দেয়া ডাহা অবিবেচনা; অভিজ্ঞতাই যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়েছে যে নােগাে-দিয়েম সরকারের (দক্ষিণ ভিয়েতনামে), মত, অস্বাভাবিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী কায়েমী সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে টিকতে সাহায্য তাে করেই না, উপরন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত ত্বরান্বিত করে। সুতরাং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সম্ভব না হােক, একটা এমন মন্দের-ভালাে বােঝাপড়া হওয়া এখন যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য, যাতে বাংলাদেশে সম্ভাব্য গণঅভ্যুত্থান যুক্তরাষ্ট্রের সকল রাজনৈতিক হিসাব বানচাল করে দেয়। কারণ গেরিলা মুক্তি বাহিনীর লড়াই জনগণভিত্তিক সশস্ত্র সংগ্রামের পরিণতির দিকে যতই যাবে, ততই ভিয়েতনাম অপেক্ষা অনেক গুণ বলশালী, সম্পদপূর্ণ এবং ভৌগােলিক-সামারিক-রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ এক সাম্যবাদী রাষ্ট্রের উদ্ভব অনিবার্য হয়ে উঠবে।
কিসিঞ্জারের দৈত্য ঠিক তাই এমন সঙ্কট-কুটিল ক্ষণে ঘটেছে, যার পূর্বাঙ্ক রচনা করে গেছেন, ইউ এন ওর ছদ্ম-প্রতিনিধিরূপে সদরুদ্দিন সাহেব যিনি যুক্তরাষ্ট্রর একচেটে বিত্তশিল্পপতি শ্রেণী এবং পাকিস্তানের বৃহৎ ব্যবসায়ী তথা সামরিক অফিসার শাহীর মধ্যে সেতুবন্ধ বিশেষ।
(চার) যে অভিসন্ধি প্রণােদিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রয়ােগ স্তম্ভিত ও রুদ্ধ করে দিতে চায়, ঠিক সেই কারণে ভারতের সরকারি মহলও চায় না, বাংলাদেশে স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয়।
(পাঁচ) উপরােক্ত কারণ সমাবেশের ফলে ভারতীয় শাসকমহলে তাই এখন এক নতুন সুর— ‘রাজনৈতিক সমাধান পার্লামেন্টে, ইন্ডিকেট কংগ্রেসের বৈঠকে, কংগ্রেস পার্লামেন্টারি দলের গােপন ও অনুমােদন সাপেক্ষ প্রকাশ্য আলােচনায় এ সময় ধ্বনিত হচ্ছে ভারতের অর্থনৈতিক দুর্বিপাক (উদ্বাস্তুদের প্রচণ্ড সংখ্যায় আগমনজনিত) ভারতের পূর্বাঞ্চলে সম্ভাব্য বিশৃঙ্খলতা’র বিপদ এবং জনগণের মুক্তি সংগ্রামের ভয়াবহ পরিণাম থেকে অব্যাহতি ও তদুদ্দেশ্যে এক মীমাংসা।
কিসিঞ্জারের দৈত্য সফল?
বলা বাহুল্য, কিসিঞ্জার সানন্দে দিল্লী ত্যাগ করেছেন। ভারতের বাক্যবাগীশ মন্ত্রীদের দৌড় তাঁর মতাে ঘঘাড়েল মতলবাজের পক্ষে আঁচ করা মােটেই কঠিন হয়নি। সর্বাপেক্ষা হাস্যকর হয়েছে, তাঁর আগমনের সঙ্গে সময়-সাহায্য বজায় রেখে উড়ােজাহাজ আক্রমণের প্রতিবিধানার্থে নিপ্রদীপ ব্যবস্থা ও বেসামরিক প্রতিরক্ষার মহড়া অনুষ্ঠান। বস্তুত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সম্ভাবনার জুজু দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ মারণব্যবসায়ীদেরকে প্রভাবিত করা দূরের কথা, সামান্য বিচলিতও করা যায় না, এ সত্য বুঝতে ভারত সরকারের মহামহীরূহসম বিভাগীয় মাথা এবং নীতি-নিয়ন্ত্রদের এখনও অনেক বাকি। একাত্তর যে পঁয়ষট্টি নয় তা আমেরিকার সমর অভিজ্ঞ সেয়ানারা জানে; তারা এও জানে, ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদনমন্ত্রী যতই সমর-সম্ভার সম্পর্কে ভারতের স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবি করুন না কেন, যুদ্ধ বেঁধে গেলে ভারতের পক্ষে সােভিয়েত রাশিয়ার নিকট থেকে অব্যাহত সরবরাহ না পেলে অন্য কোনাে উপায় থাকবে না।
সােভিয়েত রাশিয়া স্বাভাবিক কারণেই এমন এক চরম পরিণতির ঝুঁকি নিতে অপ্রস্তুত।
সুতরাং নিক্সনের ব্যক্তিগত বিশ্বাসভাজন দূত এবং আমেরিকার সংবিধান-ঊর্ধ্ব প্রধানমন্ত্রী মমাটামুটিভাবে হিসাব করে নয়া দিল্লী থেকে ইসলামাবাদে গেছেন ভারতের শাসকমহল কতদূর পর্যন্ত ছাড়তে রাজি আছে, কোন রাজনৈতিক শর্তে তারা ‘অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে নতুন বন্দোবস্তে খাপিয়ে নিতে ও পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে মীমাংসায় প্রস্তুত এবং কীভাবে তাদের সরকারি আত্মমর্যাদার মানরক্ষা সম্ভব। অসংশয়ে বলা চলে, কিসিঞ্জারি ফর্মুলা চৌকাঠের ওপারেই ঠিক দেখা দিল বলে। ( মুশকিলের প্রশ্ন বাকি বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ, ক্রমঘনায়মান অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং আরব্ধ মুক্তিযুদ্ধের বৈপ্লবিক ভবিতব্য!
দুই বাংলার মানুষই সাগ্রহে এই প্রশ্নের প্রতীক্ষা শুধু করছে না, অন্তিম নিষ্পত্তির উদ্দেশে অংশগ্রহণে প্রস্তুতও হচ্ছে।
সূত্র: দর্পণ
১৬.০৭.১৯৭১