You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.08.03 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | কাগজ উৎপাদন ও বিতরণ পুনর্বিন্যাস | রেল দুর্ঘটনা | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ৩রা আগস্ট, শনিবার, ১৭ই শ্রাবণ, ১৩৮১

কাগজ উৎপাদন ও বিতরণ পুনর্বিন্যাস

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্য বাড়ানোর পরিকল্পনায় সরকারের নিউজপ্রিন্টের কোটা নিয়ন্ত্রন করেছেন। খোলাবাজারে নিউজপ্রিন্ট পাওয়া যায় না। অপরদিকে সাদা কাগজের সংকট রয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশে কাগজ ব্যবহারকারীরা নিদারুণ কষ্টের মধ্যে পড়েছে। এবং এমন অবস্থা কিছুদিন চলতে থাকলে সমগ্র প্রকাশনা শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে অভিজ্ঞ মহল আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
গতকাল স্থানীয় এক পত্রিকান্তরের প্রতিবেদনে কাগজের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের যে তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে তাকে সময় উপযোগী বলে আমরা মনে করছি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, শুধু দেশের কাগজ শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি নয় বিতরণের ব্যবস্থারও পুনর্বিন্যাস করা হবে। এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজির ফলে সৃষ্ট কৃত্রিম সংকটকে সুপরিকল্পীত পদ্ধতিতে রূপান্তর করার জন্য কাগজ শিল্প করপোরেশন চিন্তাভাবনা করছে। এ ব্যাপারে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই বিতরণ ব্যবস্থার নবতর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এই নতুন কর্মসূচির মূল মন্ত্র হবে- ডিলার পদ্ধতির ওপর থেকে ক্রমান্বয়ে বিতরণ ব্যবস্থাকে মুক্ত করা।
নতুন বিতরণ ব্যবস্থায় যেসব রূপান্তরের সম্ভাবনা আছে তার মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে (ক) মুদ্রাকর, প্রকাশক, টেক্সটবুক বোর্ড, সরকারি সংস্থা, বিভিন্ন সরকারি সংগঠন ছাড়াও সত্যিকার ব্যবহারকারীদের কাগজ সরাসরি যোগান দেওয়া হবে। (খ) পূর্ব পদ্ধতি অনুযায়ী ডিলার থাকলেও সে সব ডিলারদের কাজকর্মের উপজেলা ও মহাকুমা প্রশাসক এবং ভিজিল্যান্স টিম কড়া তদারকি রাখবেন। (গ) খুলনা ও রাজশাহীতে দুটি ন্যায্যমূল্যের কাগজ সরবরাহ কেন্দ্র চালু করা হবে। পরে প্রতিটি জেলায় এধরনের একটি করে দোকান চালু করার কথাও রয়েছে। (ঘ) দূরের ডিলারদের কাগজ পরিবহন খরচের আনুকূল্যে প্রয়োজনবোধে কমিশন বৃদ্ধি করা হবে। এবং (ঙ) পাকশী কাগজের কলে উৎপাদন বৃদ্ধি করে সেখান থেকে সমগ্র উত্তরাঞ্চলে কাগজ বিতরণের জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থা গৃহীত হবে। এ তথ্য ও একই প্রতিবেদন সূত্র প্রকাশিত হয়েছে।
কাগজ শিল্প সংকটজনিত কারণে উৎপাদন বৃদ্ধি ও বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটি মুক্ত করণ সংক্রান্ত পরিকল্পনার মধ্যে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি আছে বলে আমরা মনে করছি। কারণ একথা সত্য যে, কাগজের সংকট অনেকটাই কুচক্রী মহলের সৃষ্ট। একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ যখন প্রাণপণে নিজের চাহিদা পূরণ যোগ্য কাগজ উৎপাদনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে তখন একশ্রেণীর মুনাফাখোর তার মধ্য থেকে স্বার্থসিদ্ধির ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি কে ডেকে আনছে। এরা সব ব্যাপারে একই ভূমিকা পালন করছে। এবং এত ছোট কাগজ শিল্প কর্পোরেশনের জনৈক ও পদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, কাগজের মজুত যথেষ্ট আছে। তিনি আরো বলেন যে, দেশের সাদা কাগজের উৎপাদন মাসিক ১৮ হাজার টন এবং ১৯৭৩-৭৪ আর্থিক বছরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও প্রায় সমপরিমাণ কাগজ বিদেশে রপ্তানি করেছে। স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে তাহলে কাগজ সংকট কেন? দামও বাড়ছে কেন? কাগজ শিল্প কর্পোরেশন এর জনৈক কর্মকর্তা তারও ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন- প্রথমতঃ সংকটের মূলে আছে ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি। দ্বিতীয়তঃ অনুবাদের কাজ বেড়েছে, গ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকা এবং সংবাদপত্রের প্রকাশনা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তৃতীয়তঃ শিল্প ও বাণিজ্য কার্যক্রমের প্যাকিং এর কাজ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ স্বাধীনতার পর সব দিক থেকেই কাগজে চাহিদা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতি।
কাগজের মূল্যবৃদ্ধি সম্বন্ধে জনৈক কর্মকর্তা বলেছেন যে, কাগজ উৎপাদনের মূল্য বৃদ্ধিই এ জন্য দায়ী। তার প্রদত্ত হিসেবে বলা হয়েছে যে, আগে যেখানে টনপ্রতি কস্টিক সোডার ২ হাজার টাকা দাম ছিল এখন তার দাম ১০ হাজার হাজার টাকা। এছাড়া ফার্নেস অয়েলের দামও চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বাস্তব সমস্যার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই কাগজের দাম বেড়েছে।
কাগজের চাহিদা বৃদ্ধি এবং মূল্যবৃদ্ধির ব্যাখ্যাকে ভিত্তিহীন বলে আমরাও উড়িয়ে দিচ্ছি না। তাই এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য কাগজের উৎপাদন বৃদ্ধির বাস্তবমুখী পরিকল্পনাকে আমরা আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। কিন্তু কাগজ বিতরণের সমস্যা ও দুর্নীতির জন্য গৃহীত কর্মসূচির সৌজন্যে বিদূরিত হয়-এই আবেদন বলিষ্ঠভাবেই রাখছি। কারণ এ কথা অনস্বীকার্য যে কোনো পরিকল্পনা বা কর্মসূচিকে লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে তার পেছনে নিরবচ্ছিন্ন কর্মনিষ্ঠার স্বাক্ষর রাখতেই হবে। সেই আশ্বাসও আছে সাফল্যও সুনিশ্চিত। স্বাধীন দেশের পটভূমিতেই শুধু নয়-কাগজ শিল্প সংকট সভ্যতারও অগ্রগতি রোধক। বিশেষ করে কাগজ শিল্পে আমরা স্বয়ম্ভব ছিলাম এবং আছি। এবার তার আরো সম্প্রসারণ হোক এবং জাতীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ছটায় প্রভাসিত হোক। সংশ্লিষ্ট মহলের কাছ থেকে সেই নিশ্চয়তা আমরা দাবি করছি।

রেল দুর্ঘটনা

পরপর দুটো রেল দুর্ঘটনা ঘটে গেল গত দুই দিনে। হতাহত হয়নি—কারণ দুটোই ছিল মালগাড়ি। প্রথম কি ঘটেছে গত বুধবার মালিবাগের কাছে। মালগাড়িটি তেজগাঁও থেকে ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিল। দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে স্টেশন সুপারিনটেনডেন্ট বলেছেন, অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে ঘটনাস্থলের লাইন হয়তো বসে গেছে নতুবা মালিবাগ রেলগেট বন্ধ ছিল না যার জন্য হঠাৎ করে অকুস্থলে ট্রেনের ড্রাইভার সাথে সাথেই ব্রেক করেছে ফলে টাল সামলাতে না পেরে গাড়ি লাইনচ্যুত হয়েছে। দ্বিতীয় রেল দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বৃহস্পতিবার ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের কাছে। ১৭টি খালি ওয়াগনসহ ময়মনসিংহ গামী একটি মালগাড়ির ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন এর কাছে লাইনচ্যুত হয় এবং ঐদিন রেল কর্তৃপক্ষের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় দু’ঘণ্টার মধ্যে রেল যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী রেলকর্মীকে সঙ্গে সঙ্গেই সাসপেন্ড করা হয়েছে। মালিবাগের রেল দুর্ঘটনার কারণ স্পষ্টভাবে বোঝা না গেলেও স্টেশন সুপারেন্টেন্ড এর বক্তব্য অনুযায়ী যে দুটো কারণ আমাদের সামনে রয়েছে তাতে আমরা প্রশ্ন করতে পারি অবিরাম বৃষ্টি পাত তো গত সপ্তাহদুই ধরেই চলছে, তাহলে বৃষ্টির পানিতে লাইন বসে যাবে এতো জানা কথা। আর উপযুক্ত জরিপ না চালিয়ে কর্তৃপক্ষ ওই ভাবে ট্রেন চলাচলের অনুমতি দিলেন কেন? রেল ক্রসিংয়ের গেট বন্ধ করা সম্পর্কিত কারণের জবাবে আমাদের বক্তব্য হলো প্রতি রেল ক্রসিংয়ে গেটম্যান রাখা হয়, সে কি তাহলে কর্তব্যকর্মে অবহেলা করেছে? নাকি সেখানে আদৌ কোনো গেটম্যান নিয়োজিত ছিল না?
ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন এর কাছে রেল দুর্ঘটনার কোন কারণই কর্তৃপক্ষ দেখাননি, শুধু বলেছেন দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কর্মচারীকে সঙ্গে সঙ্গেই সাসপেন্ড করা হয়েছে। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কর্মচারীকে সাসপেন্ড করার মধ্যেই যদি দায়িত্ব সম্পাদন করা যায় তাহলে রেল দুর্ঘটনার খবর প্রতিদিনকার সংবাদপত্রের প্রতিবেদন হয়ে দাঁড়াতো না।
আমরা সর্বনাশা প্রলয়ংকারী প্লাবনের মুখে দাঁড়িয়ে আছি। দেশের অর্ধেক লোক বন্যার পানিতে ভাসছে। দুর্গত এলাকায় অন্ন, বস্ত্র আর খাবার পানির তীব্র সংকটের মুখে যদি আমাদেরকে এভাবে ট্রেন দুর্ঘটনার কথা শুনতে হয় তাহলে এর পরিণাম কী দাঁড়াবে? দেশের যোগাযোগের প্রধান ব্যবস্থা হল রেলপথ, আর এই সংকটজনক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে মালবাহী ট্রেন উল্টানোর খবর আমরা শুনতে চাই না। শুনতে চায়না লাইনচ্যুত গাড়ির ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে লাইন আটকে রাখার খবর। বন্যা দুর্গত এলাকার অসহায় মানুষের কাছে সময়মতো দু’মুঠো অন্ন যাতে পৌঁছে দেয়া যায় সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে, আমাদের তার প্রতি সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। রেল কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কর্মচারীকে সাসপেন্ড করার মাধ্যমে আপন দায়িত্ব হতে অব্যাহতি পাবেন না। আর রেল দুর্ঘটনা ঘটে দুর্গত মানুষের দুঃখ যাতে আরো না বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে কতৃপক্ষের কাছে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন