You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.08.01 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | আন্তর্জাতিক সাহায্য | সিহানুক সরকারকে স্বীকৃতি | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১লা আগস্ট, বৃহস্পতিবার, ১৫ই শ্রাবণ, ১৩৮১

আন্তর্জাতিক সাহায্য

রেডক্রস লীগ বাংলাদেশের বন্যা দুর্গত জনসাধারণকে সম্ভাব্য সব রকম সাহায্য ও ত্রাণ সামগ্রী প্রদান করবে বলে রেডক্রস লীগের প্রতিনিধি মিঃ পল এডামস আশ্বাস দিয়েছেন। বাংলাদেশ রেডক্রস সমিতিও বন্যা দুর্গতদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনে ৬টি জাতীয় রেডক্রস সমিতির তরফ থেকে সাহায্যের সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি এবং অন্যান্য কয়েকটি উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। অপর দিকে ঢাকাস্থ কূটনৈতিক মিশনের সদস্যরা বন্যা কবলিত অঞ্চল গুলি পরিদর্শন করবে বলে শোনা গেছে। আমরা আশা করছি অন্ততঃপক্ষে স্বচক্ষে বন্যা পীড়িত মানুষের অবর্ণনীয় দুরবস্থা দেখলে তাদের পক্ষ থেকেও ত্রাণ সামগ্রী কিছু আসবে।
একথা অনস্বীকার্য যে, বন্যার এ করাল প্রকোপের ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচতে হলে শুধু রাষ্ট্রীয় বা সরকারি ও বেসরকারি প্রচেষ্টায় তা সম্ভব নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা নিষ্ঠুরতার মুখে আজ তার উপর চাল-ডালসহ নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির অগ্নিমূল্য স্বাভাবিকভাবেই ঊর্ধ্বমুখী। এরপরে আসবে মহামারী ও কালব্যাধি। এই থৈথৈ পানির রাজ্যে পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ এর মত সামর্থ্য আমাদের নেই বলেই আর্ত-মানবতার সেবায় এগিয়ে আসার জন্য বঙ্গবন্ধু বিশ্ব সংস্থা গুলি প্রতি গভীর আবেদন রেখেছেন।
এদেশে বন্যার তান্ডব নতুন নয় এবং আমরা দেখেছি বারবারই বন্যা প্লাবিত অঞ্চলের ছিন্নমূল প্রাণীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা ও পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশের প্রতি বিশ্ব সংস্থার সেবার হাত প্রসারিত হয়েছে। এবারও সেই রকম প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাচ্ছে বলে আমরা আশান্বিত হচ্ছি। এবং অকথিত দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত কারী লক্ষ লক্ষ বন্যা দুর্গত মানুষের আশার সংবাদে আবার বাঁচার স্বপ্ন দেখছে।
বঙ্গবন্ধু স্বয়ং বন্যা উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শন করে ব্যথিত ও পীড়িত হয়েছেন। তারই ফলশ্রুতিতে ক্ষমতাসীন সরকার ইতিমধ্যেই বন্যা ক্লিষ্ট জনসাধারণের জন্য বিশেষ তৎপরতার মাধ্যমে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকল দেশ প্রেমিক রাজনৈতিক দল, সেবা প্রতিষ্ঠান ও প্রতিটি মানুষের কাছে বন্যার্তদের বিবিধ ত্রাণের কাজে এগিয়ে আসার দরদী আহ্বান জানান। এবং বন্যাদুর্গতদের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে প্রয়োজনমতো পদস্থ কর্মচারী নিয়োগের জন্য ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনকে বন্যাকবলিত হতভাগ্যদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্যও তিনি আহ্বান জানান।
বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলের কোন কোন এলাকা পরিদর্শন করে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রী এক বাক্যে বন্যার ভয়াবহতা স্বীকার করেছেন। অভিজ্ঞ মহলের মতান্তরে বিগত দুই দশকের মধ্যে এমন বলা হয়নি। শহর-গ্রাম বন্দর সব চলে গেছে পানির তলায়। কলাগাছের ভেলায় ভেসে বা মাচা বেঁধে লতা পাতা সেদ্ধ খেয়ে লাখ লাখ লোক কোনমতে শুধু প্রাণ ধারণ করার প্রাণান্ত কষ্ট করে যাচ্ছেন। বস্ত্র নেই, খাদ্য নেই, পোষ্য গৃহপালিত জীব জন্তু সহ ঘর-গৃহস্থালির সব ভেসে গেছে। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। উপকূলীয় বাঁধগুলো স্থায়ী ক্ষতির রন্ধ্র করে দিচ্ছে। তারই মাঝে অসহায় মানুষগুলির বাঁচার ঐকান্তিক আশায় আকুলি-বিকুলি করে মানবতার দুয়ারে সাহায্যের প্রত্যাশা করছে।
বন্যা বেড়েই চলেছে। ইতিমধ্যেই সর্বগ্রাসী বন্যা এযাবত দেশের ১৯ টি জেলার মধ্যে ১৪ টি জেলার চল্লিশটি মহাকুমার দেড়শটি থানার প্রায় ১২ হাজার বর্গমাইল এলাকা ২২৫ জন লোক ও প্রায় ১০ হাজার গবাদি পশু মারা গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দেড় কোটি লোক সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৫ লক্ষ ঘরবাড়ি, ৭০ একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে এবং প্রায় আড়াই হাজারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ‘বাংলার বাণী’র বিশেষ প্রতিবেদনে উক্ত পরিসংখ্যান প্রদত্ত হয়েছে।
একথা সত্য যে, প্রতিবারের মতো এবারের বন্যায় মানবতার উৎস গুলি অতিদ্রুত উৎসারিত হয় নাই। এর পেছনে কারণ যা-ই থাক তা বিশ্লেষণের সময় এখন নয়। যার যেটুকু সামর্থ্য সেই অনুপাতে আজ ত্রাণ তহবিলে সাহায্য দান এবং সামগ্রী বিতরণের কাজে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। দল-মত-নির্বিশেষে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় আজ সবাইকে মানবতার সেবায় সঙ্ঘবদ্ধ কর্মপ্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তাহলে আর্ত মানুষের দুঃখ কষ্ট কিছুটা অন্ততঃ লাঘব হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো আন্তর্জাতিক সাহায্য ছাড়াই দুর্দিন কাটিয়ে ওঠার সাধ্য আমাদের নেই। কৃষি ও সমবায় মন্ত্রী জনাব আব্দুস সামাদ আজাদ তাই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ও মানবিক সংস্থাগুলোর প্রতি গভীর প্রত্যাশা নিয়ে তাদের সাহায্যের হাত প্রসারিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। এবং মানবতার আবেদন বৃথা যাবেনা বলেই আমরা বিশ্বাস করি।

সিহানুক সরকারকে স্বীকৃতি

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কম্বোডিয়ার রাজকীয় সরকারকে স্বীকৃতি দান করেছে। আবার কম্বোডিয়ার রাজকীয় সরকারও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। দু’দেশের পারস্পরিক স্বীকৃতির কথা দু’দেশের পক্ষ থেকে প্রচারিত এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষণায় বলা হয়েছে যে, উভয় দেশের সরকার সমতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং পরস্পরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অবলম্বন করে চলবে। কম্বোডিয়ার রাজকীয় সরকারকে স্বীকৃতি দান ও কম্বোডিয়ার এই সরকার কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ঘটনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার বলে আমরা মনে করি। সরকারের স্বীকৃতিদানের এই প্রগতিশীল নীতিকে আমরা অভিনন্দন জানাই। মুক্তিযুদ্ধেরত কম্বোডিয়ার জনগণের বিজয় আজ অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মার্কিন সরকারের তাবেদার প্রেসিডেন্ট লননলের পতনোন্মুখ অবস্থা আজ আর কারো অজানা নেই। ঠিক এক মুহূর্তে বাংলাদেশে কম্বোডিয়ার বিপ্লবী প্রিন্স নরোদম সিহানুক সরকারকে স্বীকৃতি দান করেছে। প্রিন্স সিহানুকের এই বিজয় হবে মার্কিন সামরিক আগ্রাসনের আরেকটি নির্মম পতন। কম্বোডিয়ার জনগণের অত্যাসন্ন বিজয়ের শুভ লগ্নে আমরা বাংলাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। আমরা বিশ্বাস করি যারা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে তাদের সেই স্বপ্ন কোনদিন বৃথা যায় না।
মার্কিন তাঁবেদার লননল সরকারের বিরুদ্ধে আজ চার বছরের অধিক হল কম্বোডিয়ার জাতীয় মুক্তি বাহিনীর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭০ সালের মার্চ মাসে কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান প্রিন্স নরোদম সিহানুক বিদেশ সফর কালের এক পর্যায়ে যখন মস্কো অবস্থান করছিলেন তখন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী মহলের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় লননল চক্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। কম্বোডিয়ার জনগণ লননলকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। ১৯৭০ সালের ২৩ মার্চ তাই গঠিত হয় প্রিন্স সিহানুকের নেতৃত্বে ন্যাশনাল ইউনাইটেড ফ্রন্ট। কম্বোডিয়ার স্বাধীনতাকামী সকল শ্রেণীর মানুষকে ফ্রন্টের যোগদান করেন। সকল শ্রেণীর মানুষের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় মুক্তি বাহিনি। গত চার বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম করেছে এই মুক্তিবাহিনী। বহু রক্তক্ষরণের পর আজ সমস্ত পরিস্থিতি তাদের করায়ত্তে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রীড়ানক লননল আজ প্রমাদ গুনছে। তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অধিকাংশ এলাকা মুক্তি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে প্রিন্স সিহানুকের প্রশাসনের পরিচালিত হচ্ছে। আমেরিকার কোটি কোটি ডলার সাহায্য ও প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম প্রেরণ সত্বেও লননল বর্তমানে পর্যায়ে এসে পতনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতাকামীদের কাছে তাকে পতন অনিবার্য মেনে নিতেই হবে। আর সেই অনিবার্য পরিস্থিতির কথা চিন্তা করেই সে শর্তহীন আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় মুক্তি বাহিনীর নেতাদের কাছে। রাজধানীর নমপেন আজ যেহেতু জাতীয় মুক্তি বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে সেহেতু লননলের আর কোন উপায়ন্তর নেই। কম্বোডিয়ায় ৭০ লাখ অধিবাসী। গোটা আয়তনের আশিভাগ বাহিনীর ও তার প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে। আমরা বাংলাদেশের জনগণ কম্বোডিয়ার জনগণের সার্বিক বিজয় কামনা করি। অনতিবিলম্বে তাদের সেই বিজয় সম্ভব হবে বলেও আমরা বিশ্বাস করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন