You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.11 | বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রথম সরকারি নির্দেশ - সংগ্রামের নোটবুক
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রথম সরকারি নির্দেশ
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘােষণা দেন। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১০ এপ্রিল আগরতলায় গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার, যা ১৭ এপ্রিল আত্মপ্রকাশ করে মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আনুষ্ঠানিক অনুমােদন পেলেন তাজউদ্দিন আহমদ। যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের সামরিক সরকার জোর করে দেশের শাসনভার দখল করে রাখলেও মূলত সব ক্ষমতার উৎস হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ সরকার। জনগণের জন্য ঘােষিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সরকারি নির্দেশটি তাই বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি অমূল্য ঐতিহাসিক দলিল। এ-নির্দেশটি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র এবং সাপ্তাহিক জয়বাংলা পত্রিকায় ১১ মে ‘৭১ সংখ্যায় প্রচারিত হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এ-নির্দেশটিতে স্বাক্ষর করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ-নির্দেশটি অনুপ্রাণিত করেছে এবং দিকনির্দেশনা দিয়েছে। নির্দেশটি নিম্নরূপ : স্বাধীন বাংলাদেশ আর তার সাড়ে সাত কোটি সন্তান আজ চূড়ান্ত সংগ্রামে নিয়ােজিত। এ-সংগ্রামের সফলতার ওপর নির্ভর করছে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির, আপনার, আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ।
আমাদের সংগ্রামে জয়লাভ করতেই হবে এবং আমরা যে জয়লাভ করব তা। অবধারিত। মনে রাখবেন, আমরা এ-যুদ্ধ চাই নি। বাঙালির মহান নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন গণতান্ত্রিক উপায়ে বিরােধের মীমাংসা করতে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতি, শােষকশ্রেণী ও রক্তপিপাসু পশু শক্তির মুখপাত্র ইয়াহিয়া-হামিদ-টিক্কা সে-পথে পা না বাড়িয়ে বাঙালির পাট বেচা টাকায় গড়ে তােলা সেনাবাহিনী নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে আমাদের ওপর, সর্বশক্তি নিয়ে। তারা নির্বিচারে খুন করছে আমাদের সন্তানদের, মা-বাপদের, ইজ্জত নষ্ট করছে মা- বােনদের, আর  জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে শহরের-পর-শহর, গ্রামের-পর-গ্রাম। তাই আমরা আজ পাল্টা হামলায় নিয়ােজিত হয়েছি। গঠন করা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। এ-সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য হল। বাংলাদেশকে শকবল হতে মুক্ত করা বাংলাদেশের এই মুক্তিসংগ্রামে ধর্ম, মত, শ্রেণী বা দল নেই। বাংলার মাটি, পানি ও আলাে-বাতাসে লালিত-পালিত প্রতিটি মানুষের পরিচয় আমরা বাঙালি।
আমাদের শত্রুপক্ষ আমাদের সেভাবেই গ্রহণ করেছে। তাই তারা যখন কোথাও গুলি চালায়, শহর পোড়ায় বা গ্রাম ধ্বংস করে, তখন তারা আমাদের ধর্ম দেখে না, মতাদর্শ দেখে না বাঙালি হিসেবেই আমাদেরকে মারে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সব রকমের অত্যাচার, অবিচার, অন্যায় ও শশাষণের অবসান ঘটিয়ে এক সুখী-সমৃদ্ধ, সুন্দর সমাজতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজ কায়েমে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাই জাতির এই মহা সংকট মুহূর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনাদের প্রতি আমার আবেদন : ১। কোনাে বাঙালি কর্মচারী শত্রুপক্ষের সাথে সহযােগিতা করবেন ।
ছােট-বড় প্রতিটি কর্মচারী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ মােতাবেক কাজ করবেন। শত্রুকবলিত এলাকায় তারা জনপ্রতিনিধিদের এবং অবস্থা বিশেষে নিজেদের বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করবেন। সরকারি, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের যে-সব কর্মচারী অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁরা স্ব-স্ব পদে বহাল থাকবেন এবং নিজ-নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করবেন। সব সামরিক, আধা-সামরিক লােক কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত অবিলম্বে নিকটতম মুক্তিসেনা শিবিরে যােগ দেবেন। কোনাে অবস্থাতেই শত্রুর হাতে পড়বেন না বা শত্রুর সাথে সহযােগিতা করবেন না। ৪। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ছাড়া অন্য কারাে বাংলাদেশ থেকে খাজনা, ট্যাক্স, শুষ্ক আদায়ের অধিকার নেই। মনে রাখবেন, আপনার কাছ থেকে শত্রুপক্ষের এভাবে সংগৃহীত প্রতিটি পয়সা আপনাকে ও আপনার সন্তানদের হত্যা করার কাজে ব্যবহার করা হবে। তাই যে-কেউ শত্রুপক্ষকে খাজনা, ট্যাক্স দেবে না, অথবা এ-ব্যাপারে সাহায্য করবে, বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী তাদেরকে জাতীয় দুশমন বলে চিহ্নিত করবে এবং তাদের দেশদ্রোহের দায়ে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবে।
৫। যােগাযােগ ব্যবস্থা, বিশেষ করে নৌ-চলাচল সংস্থার কর্মচারীরা কোনাে অবস্থাতেই শক্রর সাথে সহযােগিতা করবেন না। সুযােগ। পাওয়া মাত্রই তাঁরা যানবাহনাদি নিয়ে শত্রু-এলাকার বাইরে চলে। যাবেন।  ৬। নিজ-নিজ এলাকার খাদ্য ও নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির চাহিদার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। আর এ-চাহিদা মিটানাের জন্য খাদ্যশস্য। উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। মনে রাখবেন, বর্তমান অবস্থায় বিদেশী খাদ্যদ্রব্য ও জিনিসপত্রের ওপর নির্ভর করলে তা আমাদের জন্য আত্মহত্যার শামিল হবে। নিজেদের ক্ষমতানুযায়ী কৃষি উৎপাদনের চেষ্টা করতে হবে। স্থানীয় কুটিরশিল্প বিশেষ করে তাঁতশিল্পের ওপর গুরুত্বারােপ করতে হবে। ৭। কালােবাজারী, মুনাফাখখারী, মজুদদারী, চুরি, ডাকাতি বন্ধ করতে হবে। এদের প্রতি কঠোর নজর রাখতে হবে। জাতির। এই সঙ্কট সময়ে এরা আমাদের এক নম্বর দুশমন। প্রয়ােজনবােধে এদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ৮। আর একশ্রেণীর সমাজবিরােধী ও দুষ্কৃতকারী সম্পর্কেও সদা। সচেতন থাকতে হবে। এদের কার্যকলাপ দেশদ্রোহমূলক। একবার এদের খপ্পরে পড়লে আর নিস্তার নেই। ৯। গ্রামে-গ্রামে রক্ষীবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। মুক্তিবাহিনীর নিকটতম শিক্ষাশিবিরে রক্ষীবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবকদের পাঠাতে হবে। গ্রামে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও এরা প্রয়ােজনবােধে মুক্তিবাহিনীর সাথে প্রতিরােধসংগ্রামে অংশগ্রহণ করবে। আমাদের কোনাে স্বেচ্ছাসেবক বা কর্মী যাতে কোনাে অবস্থাতেই শক্রর হাতে না পড়ে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। ১০। শত্রুপক্ষের গতিবিধির সব খবরাখবর অবিলম্বে মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রে জানাতে হবে। ১১। স্বাধীন বাংলায় মুক্তিবাহিনীর যাতায়াত ও যুদ্ধের জন্য চাওয়া মাত্র সব যানবাহন (সরকারি, বেসরকারি) মুক্তিবাহিনীর হাতে ন্যস্ত করতে হবে।
১২। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী অথবা বাংলাদেশ সরকার ছাড়া অন্য কারাে কাছে পেট্রোল, ডিজেল, মবিল ইত্যাদি বিক্রি করা চলবে না। ১৩। কোনাে ব্যক্তি পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর অথবা তাদের এজেন্টদের কোনাে প্রকারের সুযােগ-সুবিধার সংবাদ সরবরাহ অথবা পথনির্দেশ করবেন না, যে করবে তাকে আমাদের দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে এবং প্রয়ােজনবােধে উপযুক্ত শাস্তির
ব্যবস্থা করতে হবে। ১৪। কোনাে প্রকার মিথ্যা গুজবে কান দেবেন না বা চূড়ান্ত সাফল্য। সম্পর্কে নিরাশ হবেন না। মনে রাখবেন, যুদ্ধে অগ্রাভিযান ও পশ্চাদৃসরণ দু’টিই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কোনাে স্থান থেকে মুক্তিবাহিনী সরে গেছে দেখলেই মনে করবেন না যে, আমরা সংগ্রামে বিরতি দিয়েছি। ১৫। বাংলাদেশের সব সুস্থ ও সবল ব্যক্তিকে নিজ-নিজ আগ্নেয়াস্ত্রসহ নিকটস্থ মুক্তিবাহিনী শিবিরে রিপাের্ট করতে হবে। এ-নির্দেশ সব আনসার, মুজাহিদ ও প্রাক্তন সৈনিকের ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য। ১৬। শত্রুবাহিনীর ধরাপড়া সব সৈন্যকে মুক্তবাহিনীর কাছে সােপর্দ করতে হবে। কেননা, জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের কাছ থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য সংগৃহীত হতে পারে। ১৭। বর্বর ও খুনি পশ্চিমা সেনাবাহিনীর সব প্রকার যােগাযােগ ও সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হতে পারে তৎপ্রতি লক্ষ রাখতে হবে। 

সূত্রঃ  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর – রফিকুর রশীদ