মুজিবনগর সরকারের কাঠামাে ও রূপরেখা
মুজিবনগর সরকারের নামকরণ কীভাবে হয়?
এই সরকারের মন্ত্রীসংখ্যা কম কেন?
মন্ত্রীসভা বানাতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা আছে কি?
মুজিবনগর সরকারের বেতনকাঠামো কীভাবে ঠিক হয়?
বেতন দেবার পদ্ধতি কী ছিল?
গুরুত্বপূর্ণ পদ ও জোনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা কারা?
সরকারের উপদেষ্টা কমিটিতে কোন দল ও কে কে ছিলেন?
বাংলাদেশের প্রথম সরকারের সাংবিধানিক নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। দেশের গণমানুষের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই জাতীয় জীবনের ভয়াবহ এক দুঃসময়ে প্রতিবেশী দেশে বসে গঠন করে এই সরকার। কিন্তু ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে স্বদেশেই, মুজিবনগরের আম্রকাননে। তাই ‘অস্থায়ী সরকার প্রবাসী সরকার প্রথম সরকার’ ইত্যাদি নানা রকম নাম ছাপিয়ে দেশে বিদেশে ‘মুজিবনগর সরকার’ নামটিই সর্বাধিক প্রচার ও ব্যাপ্তি লাভ করে। আত্মপ্রকাশের পরদিনই, অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই মন্ত্রীদের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের বণ্টনের কাজ শেষ করে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয় দেশ পরিচালনার জন্য, চলমান মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে পরিচালনার মাধ্যমে দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য। এর এ-সব করতে গিয়ে এ-সরকার শুরু থেকেই লাভ করে বিশেষ ব্যতিক্রমী চারিত্র। এ-প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ ড. সৈয়দ আনােয়ার হােসেন বলেন : নিজের বাসভূমি শত্রুপক্ষের দখলে চলে গেলে কোনাে একটি জাতির স্বাধীনতাকামী নেতৃবৃন্দ দূরের বা কাছের সহমর্মী ও বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রে পাড়ি জমায়। সেখানে গড়ে তােলে প্রবাসী সরকার, এবং এই সরকারের নেতৃত্বে ও দিক-নির্দেশনায় চলে স্বাধীনতা-সংগ্রাম। এমন। দৃষ্টান্ত অনেক আছে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূচনায় ফ্রান্স জার্মানির অধীন হলে দ্য গলের নেতৃত্বে লন্ডনে গঠন করা হয়েছিল প্রবাসী ফরাসি সরকার। একই সময়ে জার্মান আগ্রাসনের শিকার বেশকিছু পূর্ব ইউরােপীয় দেশের প্রবাসী সরকারও লন্ডনে গঠিত হয়েছিল। আপাত দৃষ্টিতে বাংলাদেশের এই প্রথম সরকার ও ছিল প্রবাসী; কিন্তু বাস্তবে এবং প্রতীকী অর্থে নয়। কারণ, অন্যসব প্রবাসী সরকার প্রবাসে গঠিত। ও পরিচালিত হয়েছিল। অপরদিকে, বাংলাদেশের এই সরকার শক্রকবলিত স্বদেশের মুক্ত মাটিতে গঠিত হয় এবং শপথ গ্রহণ করে। প্রবাসী সরকারের ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি নেই। অবশ্য পরবর্তী সময়ে এবং ন’মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই সরকারের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের ভূখণ্ড থেকে এ-সরকারের আরাে একটি নাম ছিল— ‘মুজিব সরকার’ বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তাকেই প্রধান করে গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকার। সে-কারণে কেউ-কেউ মুজিব সরকারও বলে।
তবে মুজিবনগর সরকারই অধিক প্রচারিত এবং পরিচিত নিরাপত্তার কারণেই মুজিবনগরে আত্মপ্রকাশের পর আবার আত্মগােপনে যেতে হয় এই সরকারকে, আশ্রয় নিতে হয় বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আত্মগােপনই বা বলি কী করে। ১৭ এপ্রিলের পর এই মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, আন্তর্জাতিক সাহায্যসহযােগিতা অর্জন করা সম্ভব হযেছে, শুধু দেশ চালানােই নয়, দেশের বাইরে বাংলাদেশের দূতাবাস পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছে এই সরকারের সুযােগ্য নেতৃত্বেই ১৮ এপ্রিল মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকের সিদ্ধান্ত পর্যালােচনা করলে দেখা যাবে, দেশ পরিচালনার জন্য স্বাভাবিক অবস্থায় যতগুলাে মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর না-হলেই নয় তার সবগুলােই আছে এ-সরকারের মন্ত্রীর সংখ্যা কম বলেই প্রত্যেক মন্ত্রীকেই কাঁধে নিতে হয়েছে একাধিক মন্ত্রণালয়, এর ফলে সবারই কাজের চাপ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ বেশি। কারাে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যসংখ্যা বাড়ানাে যায় নি কেন? কেন ঐ ৫ জনেই সীমিত রাখতে হয়েছে? আমাদের মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সম্পূর্ণ বৈরী পরিবেশে ও পরিস্থিতিতে এবং নানাবিধ জটিল অন্তদ্বন্দ্ব সত্ত্বেও মােটামুটি সবার কাছে গ্রহণযােগ্য সীমিত আকারের একটি মন্ত্রিসভার কথাই প্রথমে ভাবতে হয়েছে। এই সরকারের নেপথ্য রূপকারদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের স্মৃতিচারণের প্রাসঙ্গিক অংশে আমরা দৃষ্টি দিতে পারি। তিনি লিখেছেন : তাজউদ্দিন ভাই (৪ এপ্রিল ১৯৭১) আমাকে জিজ্ঞাস করেন, কাকে নিয়ে সরকার গঠন করা হবে? আমি স্বাভাবিক উত্তর দিলাম- বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করে রেখে গেছেন। আমি বললাম, যে ৫ জনকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু হাইকমান্ড গঠন করেছিলেন, এই ৫ জন নিয়েই সরকার গঠন করা হবে। কারা এই হাইকমান্ডের ৫ জন নেতা? ৩ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় প্রবাসী নেতা তাজউদ্দিন আহমদও উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি সরকার গঠন করা হয়েছে বলে জানান এবং দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করেন আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের সবাই এই মন্ত্রিসভায় আছে। বাংলাদেশ সরকারের সত্যিকারের মন্ত্রিসভা তখনাে গঠিত হয় নি বটে, তবু তাজউদ্দিনের এই তাৎক্ষণিক উক্তির মধ্যেও আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কারা ছিলেন এই হাইকমান্ডের সদস্য? ইতিহাস-গবেষক ড. মােহাম্মদ হাননান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থে জানাচ্ছেন : ১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ বঙ্গবন্ধু এবং দুই সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও খন্দকার মােশতাক এবং দুই সাধারণ সম্পাদক (পাকিস্তান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কামরুজ্জামান ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক শাখার তাজউদ্দিনসহ) এই ৫ জনকে নিয়ে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড গঠ করা হয়েছিল।
১ মার্চ জাতীয় পরিষদের পূর্বঘােষিত অধিবেশন আকস্মিকভাবে স্থগিত করে দিলে এ-দেশের রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা তৈরি হয়, তারই প্রেক্ষিতে যে-কোনাে সময় অদ্রুিত সিদ্ধান্তগ্রহণের সুবিধার কথা বিবেচনা করে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড গঠন করা হয়েছিল, গােটা জাতিকে যথাযােগ্য নেতৃত্ব প্রদানের দক্ষতা ও যােগ্যতাও এই ৫ জন নেতার অবশ্যই ছিল; তাই বলে বাঙালি জাতির মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় অর্জন পর্যন্ত দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে তথা প্রথম সরকার যে এভাবে গঠিত হবে, সে-কথা কে ভাবতে পেরেছিল? বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা প্রতিফলিত হয়েছে মুজিবনগর সরকারের গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তিনি তাঁর অনুসারীদের এমনভাবেই গড়ে তুলেছিলেন বা নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে, তাঁর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তারা তাৎক্ষণিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন; এবং যথার্থই সেটা তারা পেরেছেন। ভিতরের সামান্য অন্তর্কোন্দলকে অতিক্রম করে অবিচল দৃঢ়তার সঙ্গে তারা অত্যন্ত বৈরী পরিবেশ ও পরস্থিতিতে দীর্ঘ নয় মাস সফল সরকার পরিচালনা করেছেন। যেকোনাে সরকারের কিছু থাকে সাফল্যের খতিয়ান, আবার কিছু থাকে ব্যর্থতার তালিকাও। সাফল্যের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে মুজিবনগর সরকারের যে অভিজ্ঞতা লাভ ঘটেছে, এ-সুযােগ আর কখনাে কোনাে সরকারই পাবে না, পাওয়া সম্ভব নয়। তথাপি স্বীকার করতেই হয় বাঙালি জাতি সবচেয়ে বড় সংকটময় সময়ে গড়ে ওঠা এই মুজিবনগর সরকারের পুরােটাই সাফল্যের ইতিহাস, এখানে ব্যর্থতার কোনাে অধ্যায় নেই। যদি কোনাে ব্যর্থতা থাকেও, সফল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে জাতীয় বিজয় অর্জনের উজ্জ্বল আলােয় ঢাকা পড়ে যায় আপাত ব্যর্থতার সেই বিবর্ণ রং মুজিবনগর সরকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ১৭ এপ্রিল ১৯৭১, মুজিবনগর থেকে। এ-সরকার যে দুর্গম দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে প্রস্তুত এবং সক্ষম, সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮ এপ্রিল তারখে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলাের দিকে সচেতন দৃষ্টি বুলালেই। কৌতূহলী পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকের কার্যবিবরণী এখানে তুলে ধরা হল।
বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভা প্রথম বৈঠকের কার্যবিবরণী। প্রবাসী এমএনএ ও এমপিএগণ ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘােষণা করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মােশতাক আহমেদ ও এ.এইচ.এম, কামরুজ্জামানকে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য নিয়ােগ করা হয়। ১১ এপ্রিল এম.এ. জি. ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ঘােষণা দেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিপরিষদ ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে শপথগ্রহণ করেন।
শপথ নেওয়ার পরের দিন ১৮ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সভায় নিমােক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় :
১. মন্ত্রণালয় বন্টন : তাজউদ্দিন আহমদ—প্রধানমন্ত্রী
ক, প্রতিরক্ষা খ, তথ্য ও বেতার এবং টেলিযােগাযোেগ গ. অর্থনৈতিক বিষয়, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ঘ, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম, সামাজিক উন্নয়ন উ, সংস্থাপন এবং প্রশাসন চ, অন্য সব বিষয় যা কোনাে মন্ত্রীকে বণ্টন করা হয় নি।
থ, আইন ও সংসদ বিষয়াবলি
ক. অর্থ ও রাজস্ব খ, বাণিজ্য ও শিল্প গ. যােগাযােগ
ক. স্বরাষ্ট্র খ, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন
২. বেসামরিক কর্মচারীদের বাংলাদেশ সরকারের কোষাগারের অবস্থায়ী
অনুযায়ী নিচের হারে বেতন দেওয়া হবে : ক. চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণী : পূর্ণ বেতন। খ. দ্বিতীয় শ্রেণী শতকরা ২০ (% হার কম কিন্তু সর্বোচ্চ ৪০০/প্রতিমাসে।) গ, প্রথম শ্রেণী শতকরা ২৫ (% হার কম কিন্তু সর্বোচ্চ ৫০০/প্রতিমাসে।)। ৩. এম, আর, সিদ্দিকীকে পূর্বাঞ্চলের কর্মচারীদের বেতন বিতরণের ক্ষমতা দেওয়া হল। তিনি ঐ অঞ্চলে রক্ষিত বাংলাদেশের অর্থ থেকে বেতন দেবেন। আরাে সিদ্ধান্ত গৃহীত হল যে, জনাব এম, আর, সিদ্দিকী বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারূপে সাহায্য করবেন। ৪. ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বৈঠক অতিসত্বর আয়ােজন করতে স্থানীয় সংযােগকারীকে অনুরােধ করা হবে। সিদ্ধান্ত হল যে, প্রধান সেনাপতি সাহায্যকারী কর্তৃপক্ষের সহায়তায় বিভিন্ন কার্যকর ভূমিকা নিয়ােগের জন্য বাংলাদেশের ছাত্র ও যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। শেখ ফজলুল হক (মণি), সিরাজুল আলম। খান, তােফায়েল আহমেদ এবং আবদুর রাজ্জাককে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নিতে ক্ষমতা দেওয়া হল। মিজানুর রহমান চৌধুরীকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তিকে সচল করে রাজনৈতিক প্রতিরােধের দায়িত্ব দেওয়া হল।
৭. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্যাংক এবং ট্রেজারিতে গচ্ছিত অর্থ যাতে শক্রর হাতে না পড়ে সেজন্য প্রধান সেনাপতির পরিকল্পনা অনুমােদন করা হল। দু’জন অফিসারের সমন্বয়ে একটি বাের্ড গঠন করা হল যারা এই অর্থ সংগ্রহ করে যথােপযুক্ত রশিদ রেখে নিরাপদ এলাকায় বন্ধুদের নিকট গচ্ছিত রাখবেন। ৮, সমন্বয়কারীর সাথে বন্দোবস্ত অনুযায়ী অর্থমন্ত্রী মহােদয়ের ব্যক্তিগত নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ১৮ এপ্রিল মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে বণ্টনকৃত ও বিন্যস্ত মন্ত্রণালয়গুলাের বাইরেও বেশ কিছু সংস্থা, অধিদপ্তর, বিভাগ চালু করা হয়, যেগুলাে মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্বাধীনে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ১৯৭১ সালের ২০ অক্টোবর তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংগঠন এবং কার্যাবলির ওপরে একটি প্রতিবেদন পেশ করেছিলেন। এতে বাংলাদেশের সরকারের মন্ত্রণালয়গুলাের বাইরে যে বিভাগগুলাে সংগঠিত হয়েছিল, এবং যারা সরাসরি মন্ত্রিপরিষদের নিয়ন্ত্রণে থেকে কাজ করত, সেই সংস্থাগুলাে ছিল নিম্নরূপ : ১. পরিকল্পনা কমিশন ২. শিল্প ও বাণিজ্য বাের্ড ৩. নিয়ন্ত্রণ বাের্ড, যুব ও অভ্যর্থনা শিবির ৪, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি ৫. শরণার্থীকল্যাণ বাের্ড। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক সংগঠন হিসেবে নিমলিখিত বেসরকারি সংস্থা, দল, গােষ্ঠী, সমিতি, বাহিনী ইত্যাদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নিমবর্ণিত সংগঠনগুলাের নাম থেকেই ধারণা পাওয়া যাবে তাদের ভূমিকা কীরকম ছিল। বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন ১. যুব নিয়ন্ত্রণ পরিষদ ও প্রশিক্ষণ বাের্ড ২. বাংলাদেশ হাসপাতাল। ৩. স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ৪. জয়বাংলা পত্রিকা। ৫. বাংলাদেশ বুলেটিন ৬, বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সহযােগী সংগঠন ৭. বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ৮. স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ৯, বঙ্গবন্ধু শিল্পীগােষ্ঠী ১০. বাংলাদেশ তরুণ শিল্পীগােষ্ঠী ১১. বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি ১২. বাংলাদেশ সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ ১৩. নিউইয়র্ক বাংলাদেশ লীগ। ১৪. বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকাশন কমিটি, লন্ডন ১৫. লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া। ১৬. বাংলাদেশ ভলেন্টিয়ার্স কোর ১৭. বাংলাদেশ নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
গুরুত্বপূর্ণ নিয়ােগ প্রধান সেনাপতি : জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী চিফ অব স্টাফ আব্দুর রব বিমানবাহিনী প্রধান : এ. কে. খন্দকার। বিশেষ দায়িত্বে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ তথ্য, বেতার ও প্রচার : আব্দুল মান্নান এমএনএ সাহায্য ও পুনর্বাসন : অধ্যপক ইউসুফ আলী এমএনএ ভলিন্টিয়ার কোর : ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম এমএনএ বাণিজ্য বিষয়ক : মতিউর রহমান এমএনএ বহির্বিশ্বে বিশেষ দূত : বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পরিকল্পনা কমিশন প্রধান : ড. মােজাফফর আহমদ শিক্ষক সমিতি প্রধান : ড. এ, আর, মল্লিক মুজিবনগর সরকারের সচিবালয় মন্ত্রণালয় থাকলেই সেই সঙ্গে থাকবে সংশ্লিষ্ট সচিবালয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ক্ষেত্রে তা-ই ছিল একেবারে গােড়া থেকেই যুদ্ধকালীন সময়ের কথা বিবেচনা করে স্বল্পসংখ্যক মন্ত্রীকে যেমন সমগ্র মন্ত্রণালয় চালাতে হয়েছে, সচিবালয়ের ক্ষেত্রেও অনেকটা সেই রকমই ঘটেছে মুজিবনগর সরকারের সচিবালয়ে যুক্ত হওয়ার মতাে অনেকেই অবরুদ্ধ বাংলাদেশে কিংবা দূর পাকিস্তানে আটকা পড়েছিলেন। আবার অনেকে যুদ্ধ করতে-করতেই মুজিবনগর সরকারের অধীনে কাজে যােগ দিয়েছিলেন। সচিবালয়ের সব পদ পূরণ করার মতাে জনবল কাঠামাে হয়তাে যুদ্ধচলাকালে হাতে ছিল না, তবু মুজিবনগর প্রশাসন পরিচালিত হয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ সেক্রেটারিয়েট বা সচিবালয়ের মাধ্যমেই মুজিবনগর সরকারের সচিবালয় এবং সংশ্লিষ্ট সচিবগণের বিবরণ নিম্নরূপ : প্রধান সচিব : রুহুল কুদ্স সংস্থাপন সচিব : এম, নূরুল কাদের অর্থ সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান মন্ত্রিপরিষদ সচিব : এইচ. টি. ইমাম প্রতিরক্ষা সচিব : আব্দুস সামাদ পররাষ্ট্র সচিব : মাহবুবুল আলম চাষী তথ্য সচিব : আনােয়ারুল হক খান স্বরাষ্ট্র সচিব ও ডিজি পুলিশ আব্দুল খালেক স্বাস্থ্য সচিব : ডা. টি, হােসেন কৃষি সচিব : নূরউদ্দীন আহমেদ আইন সচিব : আব্দুল হান্নান চৌধুরী।
সাহায্য ও পুনর্বাসন, যুব শিবির, বিদেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত প্রকাশনা প্রভৃতি বিভাগ একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এমএনএ প্রমুখ এ-সব বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাদের শুশ্রুষার জন্য স্থাপিত বাংলাদেশ নাসিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের আবাসিক পরিচালিকা ছিলেন বেগম সাজেদা চৌধুরী এমএনএ। পাঁচজন সদস্য নিয়ে এই কেন্দ্রের পরিচালনা বোর্ড গঠিত হয়েছিল। তাঁরা হলেন বেগম সাজেদা চৌধুরী, বেগম বদরুনেসা আহমেদ, মমতাজ বেগম এবং রাফিয়া আখতার ডলি। বেগম আইভি রহমান, বেগম জাহানারা হক, বেগম হাসিনা আহমদ প্রমুখ মুক্তিবাহিনী ও শরণার্থী শিবিরে সাহায্য সামগ্রী বিতরণে বিভিন্নভাবে সহযােগিতা করেছেন।
মুজিবনগর প্রশাসনের কয়েকটি জোন ও তার চেয়ারম্যান মুজিবনগর সরকারের সমগ্র কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার ও সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে মুজিবগর প্রশাসনকে কয়েকটি জোনে ভাগ করা হয় এবং একজন চেয়ারম্যানের দায়িত্বে দেওয়া হয়। ১। সাউথ ইস্ট জোন (১): অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী এম এন এ, ২। ঐ (২) : জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এন এ, ৩। নর্থ ইস্ট জোন (১) : জনাব দেওয়ান ফরিদ গাজী এম এন এ, ৪। ঐ (২) : ঐ জনাব শামসুর রহমান খান ৫। ইস্ট জোন : লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম.এ. রব, এম এন এ, ৬। নর্থ জোন : জনাব মতিউর রহমান ৭। ওয়েস্ট জোন (১) জনাব আজিজুর রহমান ৮। ঐ (২) : জনাব আশরাফুল ইসলাম এম এন এ, ৯। সাউথ ওয়েস্ট জোন (১) : জনাব এম এ রৌফ চৌধুরী, এমপিএ ১০। ঐ (২) : শ্রী ফণিভূষণ মজুমদার, এমপিএ মুক্তিযুদ্ধে উপদেষ্টা পরিষদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুজিবনগর সরকারের পাশাপাশি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলের প্রধানের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়।
কেউ-কেউ একে সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ বলেও অভিহিত করেন। এই পরিষদ গঠনের ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অধিকতর সর্বজনীন চারিত্র্য লাভ করে এবং মুজিবনগর সরকারের ভাবমূর্তি অনেকাংশে উজ্জ্বল হয়। সে-দিনের এই উপদেষ্টা পরিষদ ছিল এরকম : তাজউদ্দিন আহমদ : প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী : ন্যাপ (ভাসানী) প্রতিনিধি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ : ন্যাপ (মােজাফফর) প্রতিনিধি মনি সিংহ : বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিনিধি। মনােরঞ্জন ধর : বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস প্রতিনিধি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা অপরিসীম। যুদ্ধপ্রক্রিয়াকে একটি রাজনৈতিক সরকারের অধীনে এবং সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার পুরাে কৃতিত্বই মুজিবনগর সরকারের। এর ফলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পেয়েছে গণভিত্তি এবং গণমানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণে এযুদ্ধ হয়ে উঠেছে গণযুদ্ধ। এ-সরকার শুধু যুদ্ধ পরিচালনাই করে নি, দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করে মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসে, এসরকারেরই যথাযথ কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে অল্পদিনেই নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ বিশ্বের বহু দেশের স্বীকৃতি লাভ করে। এ-সরকারের খুব বড় একটি অর্জন হচ্ছে— যুদ্ধের সময়েই তাদের রচিত বাংলাদেশ পুনর্গঠন পরিকল্পনা। এ-পরিকল্পনায় স্থান পায় যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ কীভাবে চলবে। তার প্রশাসনিক পুনর্গঠন রূপকল্পনাসহ অন্যান্য বিনির্মাণ পরিকল্পনা। বিশ্বের যে-কোনাে দেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিকল্পনায় এ-রকম সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ সত্যিই বিরল।
সূত্রঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর – রফিকুর রশীদ