You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.04.09 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | খাদ্যাভাস বদলানোর প্রশ্নে— | কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৯ই এপ্রিল, মঙ্গলবার, ২৬শে চৈত্র, ১৩৮০

খাদ্যাভাস বদলানোর প্রশ্নে—

খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমেও পুষ্টি ও খাদ্য সমস্যার সমাধান করার কথা এর আগে অনেকেই বলেছেন। গত রোববার ঢাকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি জনাব মুহাম্মদউল্লাহও ওই কথাটা বলেন। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, চালের পরিমাণ কমিয়ে কম মূল্যের অতিরিক্ত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে দেশের খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে হবে এবং চালের সামগ্রিক প্রয়োজনের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। তিনি আলু, গম এবং ভুট্টা খাওয়ার পরিমাণ বাড়াতে বলেছেন। তিনি বলেন, সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করলে এ বিষয়টি অভ্রান্ত যে, পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হলে আমাদের কৃষি, শাকসবজি চাষ, পশু পালন এবং মৎস্য চাষ পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন সাধন করতে হবে। বাংলাদেশে অপুষ্টির সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনসমষ্টির উপরের প্রতিক্রিয়া আমাদের বিনা দ্বিধায় স্বীকার করে নিতে হবে এবং সরকারও এ ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন। সেজন্যই দেশের উন্নয়ন কর্মসূচিতে কৃষিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। দেশের খাদ্য ঘাটতি এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মধ্যবর্তী ফারাককে কমিয়ে আনতে হবে। রাষ্ট্রপতি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এবছরের কর্মসূচির মূল মন্ত্র হচ্ছে, ‘সুস্থতর জগতের জন্য উৎকৃষ্টতর খাদ্য’ একটি স্বাস্থবান জাতির জন্যই নয়, বরং অধিকতর সুস্থ ও সুখী বিশ্বের জন্য স্বাস্থ্যবান ব্যক্তির দরকার। এ প্রসঙ্গে তিনি ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের পর থেকে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ গুলোতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বস্তুতঃ খাদ্যাভাস বদলানো আজ কেবল বাংলাদেশের প্রশ্নেই নয়, বাংলাদেশ মত যেসব উন্নয়নশীল ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে জর্জরিত দেশে চালই প্রধান খাদ্য সেসব দেশের জন্য একটি মৌলিক ও বাস্তব প্রয়োজন কারণ একথা দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি চাল উৎপাদক দেশ একদিকে চালের উৎপাদন যেমন হ্রাস পেয়েছে, তেমনি জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ, তিনগুণ হারে। সে হারে আবাদি জমিতে বাড়েইনি, বরং কমেছে অনেকাংশেই। তাই একদা যে দেশে নাকি টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত বলে ইতিহাসের পাতায় বিধৃত রয়েছে, সে দেশের চালের সের চার টাকা হবার কথাও শোনা যাচ্ছে। অন্যদিকে স্মরণাতীত কাল থেকে খাদ্য ঘাটতির এদেশে আগে পার্শ্ববর্তী বর্মা বা থাইল্যান্ড থেকে চাল আমদানি করে ঘাটতি পূরণের যে ব্যবস্থা নেয়া হতো এখন আর তাও সম্ভব হচ্ছে না। কেননা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কালে যে বর্মা বিশ্বে ৩০ লাখ টন চাল রপ্তানি করতো, সে বর্মা গত বছর মাত্র সাড়ে ছয় লাখ টন চাল দিতে পেরেছে। থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রেও সেই একই ধরনের অবস্থা। আমাদের দেশে তো বটেই। এতেই বোঝা যায় বিশ্বের চালের উৎপাদনের হার কি পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে আর এজন্য চাল ভক্ষকদের এখন খাদ্যাভাস তথা চালের ব্যাপক ব্যবহার বদলানো উচিত।
চাল এর বিকল্প খাবারের কথা অবশ্য রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে বলেছেন। কিন্তু সেই বিকল্প সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত যে অনিশ্চয়তার উদ্ভব ঘটছে সরকারকে সেদিকেও অবশ্যই দৃষ্টি দিতে হবে। প্রয়োজনীয় প্রোটিন যুক্ত খাবার আজ এদেশের নেই বললেও চলে। কৃষিজাত প্রোটিনযুক্ত খাবার এর উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। আমদানিকৃত খাবারে ভেজাল এর ছড়াছড়ি। তার ওপর রয়েছে উচ্চমূল্য। এমতাবস্থায় খাদ্যাভাস বদলানোর জন্য এসব দিকে দৃষ্টি দেয়া অত্যাবশ্যক।

কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ

যেকোন দেশের প্রকৃত সুখ সমৃদ্ধি ও জাতীয় উন্নতি নির্ভর করে ওই দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদন, উৎপাদন এর মান এবং উৎপাদনের অবাধ পর্যাপ্ত উৎপাদনের নিশ্চয়তার ওপর।
যখন দেশের কোনো ক্ষেত্রে উৎপাদন নিয়মিত উৎকৃষ্ট ও আশানুরূপ হয় তখন ওই ক্ষেত্রে দেশের উন্নতি অগ্রগতি আশা করা যায়। অনুরূপভাবে উৎপাদন ব্যাহত হলে বা উৎপাদনে কোন রকমে অসুবিধা থাকলে জাতি উন্নতি বা সুখ-সমৃদ্ধি অনুসারে ব্যাহত হতে বাধ্য।
আবার যে কোন দেশের উৎপাদনের হার বা মান কখনোই শুধুমাত্র ঐ দেশের সরকার, কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসনের একক প্রচেষ্টায় বৃদ্ধি পেতে পারে না। এ জন্য জনগণের বা বেসরকারি পর্যায়ের উদ্যোগ যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা আছে।
কারণ, ব্যক্তি থেকে সমাজ আর সমাজ থেকে জাতি। সরকার জাতি বা রাষ্ট্রের একটি পরিচালনাকারী অংশ বা সংস্থা মাত্র।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে আমাদের সবচেয়ে বড় যে ব্যাধি আমাদের সবাইকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে, তা হচ্ছে আমাদের উৎপাদনে অনীহা। আমাদের অধিকাংশেরই এখন প্রবণতা হচ্ছে বিনা কষ্টে দুধ-মাখন খাওয়া। অর্থাৎ উৎপাদন না করেই জীবনের প্রয়োজনীয় শুধুমাত্র হুমকি, ইউনিয়ন আর ঘেরাও করে আদায় করে নেয়া। অথচ এটা কত যে অসম্ভব ও হাস্যস্পদ ব্যাপার তা বুদ্ধিমান মাত্রই জানেন।
একমাত্র আমাদের এই ব্যাধি ও অদূরদর্শিতার কারণে দেশে আজ দুর্গতির সীমা নেই। জীবন প্রাণান্ত। আমাদের এই মানসিকতা পরিহার করতেই হবে। তা না হলে কারোই রেহাই নেই।
সুখের বিষয়, উৎপাদন বৃদ্ধি ও সমাজ পরিচর্যায় হালে কিছু কিছু তরুণ ও উৎসাহী বেসরকারি উদ্যোগে বেশকিছু প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। আর এভাবে যদি দেশের প্রত্যেকটি আনাচে-কানাচে ও সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমন উৎসাহ ও উদ্দীপনা জাগে তাহলে কে বলে আমরা আমাদের সোনার দেশকে খাঁটি সোনার দেশে তৈরি করতে পারবো না?
তরুণদের উদ্যোগে ইতিমধ্যে বিভিন্ন নগর পরিচ্ছন্নতার অভিযান শুরু হয়ে গেছে তার ওপর হলে আবার একটি সুসংবাদ আমাদের কানে এসে পৌঁছেছে।
ঢাকা জেলার কাঁচপুর গ্রামে সম্প্রতি প্রায় চার হাজার বিঘা জমির ওপর বেসরকারি উদ্যোগে একটি কৃষি খামার স্থাপিত হয়েছে। এর নাম রাখা হয়েছে “মুজিব খামার।” এতে যে বিভিন্ন উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা লক্ষ্যমাত্রায় উপনীত হলে দেশের খাদ্য সংকট নিরসন হয়ে সবুজ বিপ্লবের একটা বিরাট অগ্রগতিও সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। দেশের অপরাপর ইউনিয়নে যদি এভাবে আরো কৃষি খামার গড়ে ওঠে, তবে আমাদের কৃষি উৎপাদনে আর কোনো ঘাটতি থাকতে পারেনা বলেই আমাদের মনে হয়। এদিক থেকে কাঁচপুর ইউনিয়নের জনসাধারণ নিঃসন্দেহে একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। অবশ্য, এসব খামারে বা অন্যান্য কৃষকের কাছে যাতে সময়মতো তাৎক্ষণিক ও পর্যাপ্তভাবে যাবতীয় কৃষি ঋণ, কৃষি যন্ত্রপাতি, সার, বীজ, কীটনাশক ওষুধ সেচ-সরঞ্জাম, পাওয়ার ট্রাক্টর, খুচরা যন্ত্রাংশ ইত্যাদি পৌঁছে সে জন্য কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট সজাগ ও সহযোগী মূলক দৃষ্টি রাখতে হবে।
পরিমিত কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যৌথ উদ্যোগের চেষ্টা নিতে হবে। কারণ, তাতে বেশি সুফল পাবার আশা থাকে। যথা সম্ভব জোতদারী, মহাজন প্রথা ও মধ্যস্বত্ব ভোগের ব্যবস্থা বিলোপ করতে হবে। কারণ এরাই এদেশের কৃষকদের সাধারণত শোষণ করে থাকে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ও অন্যান্য মড়কে যাতে শ্রম শস্য নষ্ট না হয় সে জন্য ব্যাপক পূর্ব ব্যবস্থা ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে কৃষিকাজ কোনরকমে বাধা না পেয়ে যাতে উৎপাদন অব্যাহত থাকে সেজন্য সর্বতোভাবে ইনসেনসিটিভ এর ব্যবস্থা করতে হবে। আর এভাবে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিলে একদিন নিশ্চয়ই এদেশের শ্যামল প্রাচুর্যে সারাবিশ্ব বিস্মিত হবে।
কাঁচপুর ইউনিয়ন আজ যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে চার হাজার বিঘার মত এত বিরাট কৃষি খামার স্থাপনে কৃতি সাহস দেখালেন, তা দেশের সব ইউনিয়নে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের সুখের দিন ফিরে আসবে বলেই আমরা আশা করছি। বিশেষ করে আওয়ামী যুবলীগের যেসব আর উৎসাহিত তরুণ কর্মীরা এমন উদ্যোগ নিয়ে ও কষ্ট স্বীকার করে কাঁচপুরের ঘাঁটি স্থাপনের মত বিরল দৃষ্টান্ত দেখালেন তারাও সবার অকুণ্ঠ প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। আর এভাবেই দেশের সব খানেই যদি যুবলীগের কর্মীরা তাদের নিজ নিজ দৃষ্টান্ত স্থাপনের সক্ষম হন তবে এদেশের সোনালী সমৃদ্ধি হাতের মুঠোয় চলে আসবে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, কাঁচপুরে আওয়ামী যুবলীগের কর্মীদের সহযোগিতার যে কৃষি খামারটি স্থাপিত হয়েছে তাতে মাত্র ৫টি পাওয়ার পাম্পের সাহায্যে জল সেচ কৃষি কাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেকের মতে যদি আরো পাম্প সংগ্রহ করা সম্ভব হতো তাহলে এর বর্তমান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আরও বৃদ্ধি করা যেত।
সুতরাং, আমরা মনে করি যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি এসব বেসরকারি উদ্যোগে যাবতীয় প্রয়োজনীয় সাহায্যাদি দেন, তাহলে এদেশে কৃষি বিপ্লব আরো নিশ্চিত হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন