বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ মেহেরপুরের মানুষ শুনতে পায় পরদিন বেতারে প্রচার হওয়ার ফলে। প্রচণ্ড আবেগ এবং উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী এই বক্তৃতা শােনার পর বলতে গেলে সারা দিনই শহরব্যাপী। মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার মিছিল চলতে থাকে। জয় বাংলা’ ছাড়াও তাদের প্রধান শ্লোগান ছিল বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, পূর্ববাংলা স্বাধীন কর।’ এরই মাঝে বেলা তিনটায় মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি মােঃ সহিউদ্দীনের সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হয়ে ৭ মার্চের ভাষণের পর্যালােচনা এবং নিজেদের করণীয় স্থির করে। এদিনের বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী অবিলম্বে প্রত্যেক ইউনিয়নে, এমনকি প্রত্যেক গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য মােঃ সহিউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট মেহেরপুর মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন মােঃ নূরুল হক (প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য), ২. মােঃ ইসমাঈল হােসেন, ৩. মান্নান মাস্টার, ৪. আ ক ম ইদ্রিস, ৫. হিসাবউদ্দীন, ৬. জালালউদ্দীন, ৭. শাহাবাজউদ্দীন নির্জু, ৮. ডা. আবু আব্দুল্লাহ, ৯, ডা. আব্দুর রশিদ, ১০. খাদেমুল ইসলাম, ১১. ডা. মহিউদ্দীন, ১২. আব্দুর রহমান, ১৩. মােঃ এনামুল হক, ১৪. নঈমউদ্দীন। শুধু মহকুমা সংগ্রাম কমিটিই নয়, এই কমিটির নেতৃত্বে মেহেরপুরের প্রতিটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। বর্তমানে মুজিবনগর উপজেলার অধীনে যে ৪টি ইউনিয়ন অবস্থিত, তার প্রত্যেকটিতেই মার্চ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠনের কাজ সম্পন্ন হয়। বাগোয়ান ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি ১. আব্দুল মােমিন চৌধুরী, ২. কেরামত আলী (আনন্দবাস), ৩. হজরত আলী (জপুর), ৪. রফিকউদ্দীন (আনন্দবাস), ৫. রফিজউদ্দীন মাস্টার (রতনপুর), ৬. সুশীল মল্লিক (ভবেরপাড়া), ৭. ইউনুস মাস্টার (আনন্দবাস), ৮. খােকনমণ্ডল (ভবেরপাড়া), ৯, আনারুল ইসলাম (বাগােয়ান), ১০, থিওফিল মল্লিক (বল্লভপুর), ১১. সুশীল মাস্টার (রতনপুর), ১২. রুস্তম আলী (সােনাপুর), ১৩. দোয়াজ আলী মাস্টার (মানিকনগর)। মহাজনপুর ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি ১. আব্দুল মান্নান মাস্টার (গােপালপুর), ২. আব্দুল হান্নান (গােপালপুর), ৩, আহাদো মাস্টার (গােপালপুর), ৪. মাদার বিশ্বাস (জতারপুর), ৫. লুত্যর রহমান বিশ্বাস (বেগমপুর), ৬. গােলাম কিবরিয়া (মহাজনপুর), ৭. আদম আলী সর্দার (কোমরপুর), ৮. নূর মহম্মদ (মহাজনপুর), ৯. শামসুদ্দীন সর্দার (জতারপুর), ১০, ফসিউল্লাহ সর্দার খয়ের (জতারপুর), ১১. হিফাজউদ্দীন সর্দার (বাবুপুর), ১২. হেমন্ত অধিকারী (মহাজনপুর), ১৩. কায়েমউদ্দীন (পরানপুর)। দারিয়াপুর ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি ১. আ কা ম ইদ্রিস, ২. ওয়াজেদ আলী (বিদ্যাধরপুর), ৩. দাউদ হােসেন (পুরন্দরপুর), ৪. ডা. শামসুল ইসলাম, ৫. আলীজান মণ্ডল (দারিয়াপুর), ৬. ইউনুস মাস্টার (দারিয়াপুর), ৭. আব্দুস সাত্তার (পুরন্দরপুর), ৮. ফিরাতুল মিয়া (গৌরীনগর), ৯. আবুল হায়াত (গৌরীনগর), ১০, হাফিজা আক্তার মণি (গৌরীনগর), ১১. আকালী বিশ্বাস (গৌরীনগর), ১২. আব্দুল বারি (দারিয়াপুর), ১৩. আতা পাল (দারিয়াপুর)। মােনাখালী ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি। ১. ডা, কমরউদ্দীন (ভবানীপুর), ২. হজরত আলী (মােনাখালি), ৩. হিফাজউদ্দীন সর্দার (মােনাখালী), ৪. নূর মােহাম্মদ (গােপালনগর), ৫. শামসুদ্দীন-শ্যামবাবু (শিবপুর) বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটি মুজিবনগর উপজেলার প্রত্যেকটি ইউনিয়নে সংগ্রাম কমিটি গড়ে ওঠে মেহেরপুরের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এভাবে কোনাে কোনাে গ্রামেও সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ-সব কমিটির সদস্য স্বাধীনতা সংগ্রামে নানাভাবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং গৌরবময় ভূমিকা পালন করেন বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটির সদস্যবৃন্দ।
তিনি এবং তার কোম্পানির অধিকাংশ সৈনিক বাঙালি হওয়ায় বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটির সব কার্যক্রমের সঙ্গে সহজেই একাত্ম হতে পারেন। এমনকি মার্চের ১২ তারিখে সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ ক্যাম্পে এসে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের নতুন পতাকা উঠিয়ে দিতে চাইলে সুবেদার মুকিদ। নিজে এগিয়ে এসে সহযােগিতা করেন। দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কুষ্টিয়ার প্রতিরােধযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে বৈদ্যনাথতলা ইপিআর ক্যাম্পের সব সৈনিক কুষ্টিয়া অভিমুখে রওনা হয়ে গেলে ২৭ মার্চ থেকে এ-ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করে স্থানীয় কয়েকজন আনসার এবং বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটির সদস্যবৃন্দ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযােগিতার অংশ হিসেবে এরই মাঝে হৃদয়পুর বিওপি পেরিয়ে ভারতীয় ওষুধপত্র, বিস্কুট, কিছু খাদ্যসামগ্রী, এমনকি সামান্য কিছু অর্থসাহায্য বৈদ্যনাথতলায় পৌছলে ইপিআর ক্যাম্পের অস্থায়ী কার্যালয়ে বসে বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ তা গ্রহণ করতেন, রেকর্ডবুকে লিখে জমা করে নিতেন, তারপর কুষ্টিয়ার প্রতিরােধযুদ্ধের জন্য পাঠিয়ে দিতেন। এভাবেই বৈদ্যনাথতলার ইপিআর ক্যাম্পটি মুজিবনগর এলাকার স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত সব কার্যক্রমের অস্থায়ী কার্যালয় হয়ে ওঠে এবং এ কার্যালয় সক্রিয়ভাবে চালু থাকে ১৭ এপ্রিলের নতুন সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা পর্যন্ত। অতঃপর এই বৈদ্যনাথতলাই এ-দিন হয়ে যায়। মুজিবনগর, বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী। সেই বিবেচনায় বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ এখনাে অহঙ্কার করে বলেন—এই ইপিআর ক্যাম্পটিই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানীর প্রথম কার্যালয়, কারণ এখানেই ভাড়া চেয়ার-বেঞ্চে এসে সর্বপ্রথম বসেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদসহ পুরাে মন্ত্রিপরিষদ।
সূত্রঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর – রফিকুর রশীদ