একটি মুক্ত গ্রামে গেরিলাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ
[বাঙলাদেশের কোন এক স্থান থেকে]
শ্রীহাট এবং এর আশেপাশের গ্রামগুলি বাইরে থেকে পূর্ব-বাঙলার আর পাঁচটা গ্রামের মত দেখতে। কিন্তু সম্প্রতি এই গ্রামগুলির মর্যাদা ও গৌরব বেড়েছে। কারণ, খুলনা জেলায় এই গ্রামগুলিই সবার আগে মুক্ত হয়েছে।
মে মাসে পাক দস্যুরা এই গ্রামগুলির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং সন্ত্রাসের রাজত্ব স্থাপন করেছিল। দগ্ধ বাড়ীগুলির কারাে দেওয়ালগুলাে এখনও সেই দস্যুতার সাক্ষ্য বহন করছে।
পাকবাহিনী এখানে দুটি বড় বড় শিবির স্থাপন করেছিল। বিবর ঘাঁটি তৈরি করেছিল। কিন্তু ঐ বিবর ঘাঁটি কিংবা তাকে রক্ষার জন্য মাইনের বেড়া গেরিলাদের সংকল্পচ্যুত করতে পারে নি।
আগস্ট মাসে রাতের পর রাত গ্রেনেড হাতে নিয়ে গেরিলারা পাক বাহিনীকে বিব্রত করেছে। শেষকালে এক রাত্রে তারা আশেপাশের ঝোপ ঝাড়ের আড়াল থেকে একদিন পাকসৈন্যদের শিবির দুটো উড়িয়ে দিল।
হেড মাস্টার আজ গেরিলা কমাণ্ডার
ক্যাপ্টেন শাহজাহান, পূর্ব বাঙলা যেদিন স্বাভাবিক ছিল সেদিন তিনি ছিলেন হেডমাস্টার। আজ তিনি পুরােপুরি গেরিলা কমাণ্ডার। ইউএনআইকে তিনি বললেন, ঐ দিনের আক্রমণে একটি ক্যাম্পেই চারজন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। তাদেরকে কাছাকাছি কবর দেওয়া হয়েছে।
দুটি শিবিরের এখন আর দেওয়াল ছাড়া কিছু অবশিষ্ট নেই। দেওয়ালগুলাের মধ্যে বিরাট বিরাট গর্ত। ঐ অঞ্চল থেকে প্রায় ২০০ মাইন সরানাে হয়েছে।
স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসছে
গ্রামের স্বাভাবিক জীবন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফিরছে। যারা পালিয়ে গেছিল তাদের কিছু ফিরেছে। তবু লােক খুব কম। কিছু দোকানপাট খুলেছে। চাষীরা মাঠে হাড় বের করা বলদগুলাে নিয়ে এখানে ওখানে চাষেও নেমে পড়েছে। একটা নতুন প্রশাসনও ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে।
তবে তলায় তলায় একটা অস্বস্তির ভাব সব সময়ে সবার মনে চেপে আছে। কারণ মাত্র তিন কিলােমিটার দূরেই পাকসৈন্যের একটা শিবির আছে।
তরুণ গেরিলারা যাদের বেশির ভাগে বয়সই কুড়ির নীচে তারা গ্রামের পাশের কাঁচা রাস্তাটা পাহাড়া দিচ্ছে। তাদের কাঁধে ৩০৩ রাইফেল। এরা পাহারা দিচ্ছে সাইকেলে চড়ে না হয় ২৩ জন একসঙ্গে পায়ে হেঁটে।
ক্যাপ্টেন শাহজাহান বললেন, ঐ খানদের পক্ষে “এই গ্রাম পুন-দখল করা খুবই কঠিন। এর প্রতিটি বাড়ি এখন গেরিলার। যারা দিনযাপনের জন্য স্বাভাবিক কাজ কর্ম করে। কিন্তু এরা প্রত্যেকেই কিভাবে রাইফেল স্টেনগান বা হালকা মেশিনগান চালাতে হয় তা জানে। এরা এক মিনিটের নােটিশেই সমবেত হতে পারে। তাছাড়া এরা স্থানীয় জনসাধারণের পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছে।”
শাহজাহান জানালেন, এদের দু-তিন মাস ধরে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এদের কোন বেতনের বন্দোবস্ত নেই এবং তা চায়ও না। এরা ওদের বন্ধুক নিয়েই খুশী এবং যে কোন সুযােগে মাতৃভূমির জন্য সংগ্রামে অংশ নিতে পারলেই ওরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করে।
প্রতি সন্ধ্যায় বহু যুবক তাদের যার যা পােষাক আছে তাই নিয়ে গ্রামের মাঝখানে খেলার মাঠে ট্রেনিং এর জন্য জমায়েত হন। একজন প্রাক্তন ই,পি,আর এই ট্রেনিং-এর দায়িত্বে আছেন।
সেদিন শুক্রবারের ট্রেনিং কিন্তু মাঝপথে থেমে গেল। যখন সবে গুলি ছোড়ার অনুশীলন চলছে সে সময়ে ১৮ বছরের ছাত্র আবদুল গণি সাইকেলে চড়ে এসে হাজির। সে সংবাদ দিল যে তিন কিলােমিটার দূরে কালিগঞ্জ-সাতক্ষীরা রাস্তার ওপর শিকারপুরে পাক সৈন্যরা বেপরােয়া গােলা বর্ষণ করছে।
শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ডিসপার্স করতে বললেন। কিছুক্ষণ পরেই আর একজন এসে খবর দিলেন পাকসৈন্য চলে গেছে।
সাংবাদিককে শিক্ষক বললেন “আমরা গেরিলা শত্রু যখন এসেছি আমরা তখন পিছু হঠকে না। প্রকাশ্য লড়াই আমাদের লক্ষ্য নয়— অন্তত এই মুহূর্তে নয়ই।
সূত্র: কালান্তর, ১৫.১১.১৯৭১