You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.17 | পলাশী থেকে মুজিবনগর - সংগ্রামের নোটবুক
পলাশী থেকে মুজিবনগর
(১৭৫৭-১৯৭১) মুজিবনগর : আত্মপ্রকাশের প্রথম সােপান পলাশীর আম্রকানন থেকে মুজিবনগরের আম্রকাননের ভৌগােলিক দূরত্ব খুব বেশি নয়, বড়জোর মাইল ত্রিশেক হবে; কিন্তু ইতিহাসের দৃষ্টিতে সময়ের দূরত্ব মােটেই কম নয়, সেটা হচ্ছে দুই শতাধিক বছরের শােষণ-বঞ্চনানিপীড়ন এবং লড়াই-সংগ্রাম আন্দোলনের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমা, উত্তাল তরঙ্গমুখর অধ্যায়। বাঙালির স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এবং দেশের প্রথম সরকার গঠন ও ঘােষণার মাধ্যমে তার আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে এ-দেশেরই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত জেলা মেহেরপুরের মুজিবনগরে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। আত্মপ্রকাশ শুধু নয়, এই মুজিবনগর সরকারেরই সফল নেতৃত্বে ন’মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে বিজয় অর্জন ও আত্মপ্রতিষ্ঠা করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সেই অর্থে এই মুজিবনগরই হচ্ছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রবেশমুখ কিংবা আত্মপরিচয়ের সিংহদুয়ার বা আত্মপ্রকাশের প্রথম সােপান। মুজিবনগরেই সূচিত হয়েছে বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় টার্নিংপয়েন্ট। এ-জাতির কাছে মুজিবনগরই তাই ঘুরে দাঁড়ানাের সূর্ণোজ্জ্বল মাইলফলক। এখান থেকেই যাত্রা শুরু বাঁধন ছেড়ার, এখান থেকেই সুনির্দিষ্ট লড়াই শুরু আত্মপ্রতিষ্ঠার; একাত্তরের মুজিবনগর থেকে ঐতিহাসিক একাত্তর তাে হঠাৎ একদিনে অগ্নিক্ষরা রক্তঝরা চারিত্র্য লাভ করে নি। ঐ একাত্তরের পিছনে আছে উদ্দাম সত্তর, শেকল ছেড়া উনসত্তর, তরঙ্গমুখর বাষট্টি, ছেষট্টি, তারও পিছনে আছে বায়ান্নর রক্তভেজা পথ; এমনই। আরাে কত লড়াই-সংগ্রামে উদ্দীপ্ত দিন পেরিয়ে তবেই আসে একাত্তর। মুজিবনগরও তেমনই সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনাে জনপদ নয়, খানিক ব্যতিক্রম বটে।

ব্যতিক্রম হচ্ছে এই যে, দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী  তখনােও পর্যন্ত মুজিবনগরের মাটিতে ভয়াল ছােবল দিতে পারে নি; মুজিবনগর ছিল শত্রুমুক্ত স্বদেশভূমির মূর্ত প্রতীক। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা কিংবা চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন অথবা ময়মনসিংহের টংক বিদ্রোহ কিংবা নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তবেই বাঙালি এসে মুজিবনগরের মুক্ত মাটিতে দাঁড়িয়েছে, বজ্রকঠোর শপথ নিয়েছে, ন’মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী লড়াই করেছে, অবশেষে ফুটিয়েছে স্বাধীনতার রক্তকুসুম। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলতে গেলে তাই পিছনে ফিরে তাকানােটাও খুব জরুরি হয়ে ওঠে। উত্তরে সৌম্যশান্ত হিমালয় আর দক্ষিণে উত্তাল তরঙ্গমুখর বঙ্গোপসাগরের মাঝে নদীনালা বিধৌত পাখিডাকা, ছায়াঢাকা সবুজ শ্যামলিমাময় বাংলা নামের এই ছােট্ট দেশটি যুগে-যুগে কালে-কালে বিদেশী শাসকদের দ্বারা হয়েছে শাসিত-শােষিত, বঞ্চিত-নির্যাতিত এতদ্ঞ্চলের সাহসী জনগােষ্ঠী কিন্তু কখনােই বাইরের শক্তির অধীনতা নির্বিবাদে মেনে নেয় নি। আপন জাতিসত্তার পরিচয়কে সমুন্নত রাখতে খণ্ড ক্ষুদ্র বিদ্রোহ-বিপ্লব, আন্দোলন সংগ্রাম তারা করে আসছে সেই সুদূর অতীত থেকেই। সেই অর্থে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সূত্রপাত ঘটেছে বহু পিছনে, দূর অতীতে।

 
পলাশীর ট্র্যাজেডি
বলা হয়ে থাকে ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধ নামের প্রহসনের খেলায় পরাজিত হন ঘরে-বাইরে অসংখ্য ষড়যন্ত্রের জালে জড়িয়ে পড়া বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। সাজানাে যুদ্ধের ফলাফল ও নীলনকশা অনুযায়ী ছিল পূর্ব প্রস্তুত। তবু নবাব সিরাজউদ্দৌলা অমিত তেজ আর অসীম সাহসিকতা আর প্রবল দেশপ্রেম নিয়ে যুদ্ধকে যুদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং মােকাবিলা করতে চেয়েছেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, সফল হয়েছে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্ত; নবাব সিরাজের পতনের মাধ্যমেই পলাশীর আম্রকাননে অস্তমিত হয়েছে বাংলায় স্বাধীনতা সূর্য। পলাশীর এই পতনের মধ্য দিয়ে শুধু বাংলা নয়, গােটা ভারতবর্ষই পরাধীনতার শৃঙ্খল পরে পায়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্রিটিশ বেনিয়ার দল বণিকের বেশে এই দেশে একদা প্রবেশ করলেও ছলে-বলেকৌশলে অচিরেই ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতার মােহে হয়ে ওঠে উন্মত্ত এবং অত্যন্ত কূটকৌশলে দখল করে নেয় ক্ষমতার রাজদণ্ড। ভারতবর্ষ তথা বাংলার মানুষের বুকে চেপে বসে দু’ শ’ বছরের ইংরেজ শাসনের নিষ্ঠুরতম জগদ্দল পাথর।
 
দূরের পথে বীরের যাত্রা
 
বীরের জাতি বাঙালি নির্বিবাদে মুখ বুঝে মেনে নিতে পারে নি পরাধীনতার গ্লানি। দীর্ঘ বিলম্বে হলেও বাংলা থেকেই শুরু হয়েছে বিদ্রোহ, যা পরবর্তীতে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করে। গৌরবােজ্জ্বল সে-সব বিদ্রোহ-বিপ্লবে, আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালি সবসময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। বহু শত বছরে মুক্তির বাসনা ও সংগ্রামী চেতনাকে ধারণ করে এ-অঞ্চলের মানুষ গভীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বীরত্বের সঙ্গে অংশ নিয়েছে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০), ওহাবি আন্দোলন (১৮৩১), ফারায়েজি আন্দোলন (১৮৩৮-১৮৪৭), সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭), নীল বিদ্রোহ প্রভৃতি বিদ্রোহ-লড়াইয়ে। এই রক্ত ঝরানাে লড়াইসংগ্রামের দুর্গম পথ দুঃসাহসে বুক বেঁধে পাড়ি দিয়েছে এ-অঞ্চলের মানুষ, অবশেষে অবসান ঘটিয়েছে দু’ শ’ বছরের ইংরেজ শাসনের, এক রাষ্ট্র ভেঙে প্রতিষ্ঠা করেছে পাকিস্তান নামের নতুন রাষ্ট্র।
বড়ই কিম্ভূতকিমাকার এই রাষ্ট্রের গঠনপ্রকৃতি। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে হাজার মাইলের ভৌগােলিক ব্যবধান তখন এ-রাষ্ট্রের অধিবাসীদের চোখে বড় হয়ে ধরা পড়ে না, ধর্মবিশ্বাসের ঐক্যই তখন মুখ্য; কোনাে ব্যবধানই বুঝি-বা তাদের বিশ্বাসের দেয়ালে বিভেদের ফাটল ধরাতে পারবে না। এ-অঞ্চলের মানুষ অদম্য লড়াইসংগ্রামের মধ্য দিয়ে দু শ বছরের ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছে বুকের মধ্যে একরাশ স্বপ্ন আর প্রত্যাশা নিয়ে। তারা প্রত্যাশা করেছে, এবার অর্থনৈতিক শােষণ, রাজনৈতিক আধিপত্য এবং সামাজিক অসাম্যের অবসান ঘটবে। কিন্তু বাঙালির এই স্বপ্নসাধ মােটেই পূরণ হয় নি, বক্ষলালিত প্রত্যাশাও হয় নি ফলবতী। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের আধিপত্যবাদী চেহারার নগ্নপ্রকাশ ঘটেছে শুরুতেই। যে অঞ্চলের মানুষ সব চেয়ে বেশি সংখ্যক ভােট দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনকে নিঃশর্ত সমর্থন করেছে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নতুন রাষ্ট্রের শাসকগােষ্ঠী একেবারে শুরু থেকে নব্য সাম্রাজ্যবাদী কায়দায় তাদের উপরেই চালিয়েছে শাসন-শােষণ-নির্যাতনের স্টিমরােলার। বাঙালি মুসলমানের মােহভঙ্গ ঘটে অচিরেই। পাকিস্তানি শাসকদের বিভেদনীতির বাস্তবায়ন দেখে তারা বিস্মিত হয়, কিন্তু হতাশায় ভেঙে পড়ে না। আবার নতুন করে তারা হয়ে ওঠে অধিকার সচেতন, হয়ে ওঠে আন্দোলনমুখী। পাকিস্তানি শাসনের ২৩ বছর ধরে বাঙালি তার জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নেই রাজপথজুড়ে গড়ে তােলে আন্দোলন-সংগ্রাম, যার অনিবার্য পরিণতি হয়ে ওঠে একাত্তরের ১৭ এপ্রিলে মুজিবনগরে এসে বাঁক বদলের অভিযাত্রা।
 
শােষণ আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতি
 
১৯৪০ সালে উত্থাপিত ‘লাহাের প্রস্তাব”-এর মধ্যেই নিহিত ছিল পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রের স্বপ্নবীজ। ঐ প্রস্তাবে অবশ্য বলা হয়, ভারতবর্ষের যে-সব অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা বেশি সেই এলাকাগুলাে নিয়ে অন্তত দু’টি রাষ্ট্র এবং অবশিষ্ট অংশ নিয়ে আরেকটি রাষ্ট্র গঠন করা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলাে নিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পরিবর্তে পাকিস্তান নামে একটি বিচিত্র দেশের জন্ম হল, যে-দেশের পূর্ব এবং পশ্চিম অংশের মধ্যে ভৌগােলিক দূরত্ব হাজার মাইলেরও অধিক। একই দেশের দুই অংশের মাঝখানে রয়েছে ভারত নামের ভিন্ন একটি দেশের অস্তিত্ব। ভারতীয় ভূখণ্ড বা আকাশসীমা ব্যবহার করে তবেই পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যােগাযােগ রক্ষা করা সম্ভব হয়। শুধু এই ভৌগােলিক দূরত্বই নয়, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ এবং ভূ-প্রকৃতির মধ্যেও রয়েছে বিরাট পার্থক্য ও দূরত্ব। পাকিস্তানের দুই অংশের মাটি-জলবায়ু-ফল ফসলে পর্যন্ত রয়েছে পার্থক্য, আর দুই অংশের অধিবাসীদের মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনাচার তাে একেবারেই ভিন্ন। দুই অংশের মানুষের দৈহিক গড়ন, চেহারা, গায়ের রং, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পােশাক-পরিচ্ছদ, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সবকিছুই ছিল আলাদা। তাদের মধ্যে সাদৃশ্য এবং ঐক্যের ক্ষেত্র শুধু একটিই, সে হচ্ছে অভিন্ন ধর্মবিশ্বাস। দেশের উভয় অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম। কেবল ধর্মীয় ঐক্যই কি পারে জাগতিক শশাষণ-বঞ্চনা নির্যাতন-নিপীড়নের মর্মজ্বালা দীর্ঘকাল ভুলিয়ে রাখতে? ক্ষুধা পেলে কিংবা দীর্ঘসময় ধরে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হলে মানুষ তাে এক সময় ফুসে উঠবেই। কেবল ধর্মের দোহাই দিয়ে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর কি চিরকাল স্তব্ধ করা যায়? বিচিত্র দেশ পাকিস্তানের শাসকেরা তা-ই করতে চেয়েছিল নির্লজ্জভাবে। যে অঞ্চলের মানুষ সর্বাধিক ভােট দিয়ে বিভাগ-পূর্ব সময়ে পাকিস্তান আনন্দোলনের প্রতি জানিয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শাসকগােষ্ঠী সে-অঞ্চলের মানুষের প্রতি সামান্যতম কৃতজ্ঞতাও জানায় নি।
 

বরং শুরু থেকেই তারা গ্রহণ করে বিভেদ আর বৈষম্যের অর্থনীতি এবং শশাষণ আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। দেশভাগের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল দুই কোটি, পূর্ব পাকিস্তানের ছিল চার কোটি। কাজেই সহজ হিসেবে বলা যায় শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পুলিশ-মিলিটারি, সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা সব কিছুতেই যদি একজন পশ্চিম পাকিস্তানের লােক থাকে, তা হলে সেখানে দু’জন পূর্ব পাকিস্তানের লােক থাকা উচিত। বাস্তবে হল ঠিক তার উল্টো। সবকিছুতেই পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগ ছিল শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ। বাজেটের ৭৫% ব্যয় হত পশ্চিম পাকিস্তানে, ২৫% ব্যয় হত পূর্ব পাকিস্তানে, যদিও পূর্ব পাকিস্তান থেকে রাজস্ব আয় ছিল বেশি, শতকরা ৬২ ভাগ। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল সেনাবাহিনীর সংখ্যা, পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যের সংখ্যা ছিল ২৫ গুণ বেশি পাকিস্তানি শাসনের দীর্ঘ ২৩ বছর ধরেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপরে চলেছে শােষণ আর বৈষম্যের শাসনব্যবস্থা। এই বিভেদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বঞ্চিত ও বিক্ষুব্ধ বাঙালি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের পথে অগ্রসর হলেই তাদের উপরে নেমে এসেছে নিষ্ঠুর নিপীড়ন, নির্মম নির্যাতন। বাঙালির আন্দোলন প্রতিবাদ থেকে শাসকরা কখনােই নিজেদের কোনাে ভুল শুধরানাের চেষ্টা করে নি, হয়েছে মারমুখী, গ্রহণ করেছে দমননীতি। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তান সরকারের এই শােষণ ও বৈষম্যের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে সত্তরের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ একটি গুরুত্বপূর্ণ পােস্টার প্রকাশ করে। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে ঐতিহাসিক সেই পােস্টারটির (শিরােনাম : সােনার বাংলা শ্মশান কেন?) প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে।

ভাষার লড়াই
 
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যে শুধু অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে তা-ই নয়, পাকিস্তানি শাসকেরা প্রথমেই আঘাত হেনেছে দেশের পূর্বাঞ্চলের বাঙালি জনগােষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপরে। বাঙালি জাতিসত্তার হাজার বছরের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং অস্তিত্বকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যেই তারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাঙালি ও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে শুরু থেকেই মেতে ওঠে ভয়ঙ্কর চক্রান্তে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তাে অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা বাংলা ভাষারই। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় এসে ২১ মার্চ রেসকোর্স মাঠে এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙালি ছাত্র-জনতার সামনে দাঁড়িয়ে দর্পভরে ঘােষণা করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। উর্দুর পাশে ইংরেজিও থাকবে, কিন্তু সেখানে বাংলা ভাষার স্থান হবে না কিছুতেই। বাঙালি কি তাই মানতে পারে? পাকিস্তানের জন্মের পর বছর না ঘুরতেই এই রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে এসে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মােহভঙ্গ ঘটতে শুরু করে। জিন্নাহর একরােখা এবং একপেশে ঘােষণার প্রতিবাদে বাঙালি ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। গড়ে ওঠে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। সরকার বাঙালির দাবির যৌক্তিকতা বুঝতে বা খুঁজতে চায় নি, শক্ত হাতে গ্রহণ করেছে দমন-পীড়নের নীতি। তাতে অবশ্য ভাষার আন্দোলন আরাে বেগবান হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সরকারের পুলিশবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়, হত্যা করে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং আরাে অনেককে। তাতে আন্দোলন থেমে যায় নি। বরং সারা দেশের গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে সে আন্দোলন। স্কুল-কলেজের বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজের সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন স্তরের সাধারণ মানুষও। অবশেষে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাদের ভিতরের বদমায়েশি চক্রান্তের শেষ হয় না।
 
এরই মাঝে প্রস্তাব তােলে বাংলা ভাষা লিখতে হবে আরবি হরফ দিয়ে। কিছুদিনের মধ্যে ফরমান জারি করা হয়—“হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সঙ্গীত পাকিস্তানের সংহতির জন্য ক্ষতিকর, কাজেই ও-সবের চর্চা এ-দেশে চলবে। এমনি ধারা নানান টালবাহানা চলতে থাকে। সে-সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কী ধরনের বিভেদ ও বৈষম্যের নীতি প্রকৃতপক্ষে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনই সারা দেশের বাঙালি সমাজকে নতুন বাস্তবতার মুখােমুখি দাঁড় করায়, বাঙালি চিনতে শুরু করে নিজেকে, খুঁজতে শুরু করে আপন ঠিকানা। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদেরা যেখানে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ে, সেখানে গড়ে ওঠা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কালক্রমে হয়ে ওঠে বাঙালির প্রাণের মিনার, ওই শহীদ মিনারই হয়ে ওঠে বাঙালি জাতির ইতিহাসে বাঁক বদলের মাইলফলক।
 
যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন : ঝলসে ওঠা আলাের বাতি
 
ভাষার লড়াইয়ে বাঙালি ছাত্র-যুবকের যে রক্তক্ষয়, তা মােটেই ব্যর্থ হয় নি। বরং শহীদের রক্ত বাঙালিকে করেছে অধিকার সচেতন, প্রতিবাদমুখর, ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতাপ্রত্যাশী। তারই প্রতিফলন দেখা যায় ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে। শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, সােহরাওয়ার্দী, মাওলানা আতাহার আলী এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা যুক্তফ্রন্ট পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটিয়ে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠন করে। এ কে ফজলুল হক হন মুখ্যমন্ত্রী। | প্রাদেশিক এই নির্বাচনের রায় পাকিস্তানি শাসকদের কাছে অশনিসংকেত হয়ে দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানিদের মনে মুসলিম লীগবিরােধী মনােভাব কতটা তীব্র হয়েছিল তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই ফলাফলে। প্রাদেশিক আইন পরিষদের মােট ৩০৯টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ পায় ৯টি আসন। কারাে কাছেই এ-কথা আর অস্পষ্ট থাকে না যে, পূর্ব পাকিস্তানে যথার্থই মুসলিম লীগের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে। পাকিস্তানে ক্ষমতার আড়ালে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি সর্বদাই থেকেছে সক্রিয়। এবারও তার পুনরাবৃত্তি ঘটে। মাত্র ৫৪ দিনের মাথায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার নানা অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বে গঠিত প্রাদেশিক সরকার বাতিল করে সংসদীয় গণতন্ত্রকে সূচনাতেই স্তব্ধ করে দেয়। বন্দি করা হয় হাজার হাজার যুক্তফ্রন্টকর্মীকে।
 
গণবিরােধী সামরিক আইন
 
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশটির শাসনক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত থেকেছেন, বলতে গেলে তারা কেউই গণমানুষের নেতা নন, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতাও নন। বলা যায়, জন্ম থেকেই পাকিস্তান অগণতান্ত্রিক শাসনের দিকে ঝুঁকে থেকেছে। দেশশাসনের নামে সেখানে চলেছে ষড়যন্ত্রের খেলা। আর এই খেলার নেপথ্যে নিয়ন্ত্রণের সুতােটি প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে থেকেছে সেনাবাহিনীর হাতে। দেশের বাজেটের ৬০% ব্যয় করা হত সেনাবাহিনীর পিছনে, তাই তারা তাদের অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা ও সুযােগ-সুবিধার লােভনীয় জীবন বেসামরিক লােকজনের হাতে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিল না। নানা রকম টালবাহানা করে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযােগে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনাপতি আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে নেন। সামরিক উর্দি এবং সামরিক আইনের জোরেই তিনি একটানা এগারাে বছর টিকে থাকেন ক্ষমতার মসনদে এরই মাঝে দেশের পূর্বাংশে তাে বটেই, পশ্চিমাংশেও ক্ষোভের আগুন ধূমায়িত হয়ে ওঠে, তীব্র গণঅসন্তোষের মুখে কেঁপে ওঠে স্বৈরশাসকের ক্ষমতার ভিত।
 
ঐতিহাসিক ছয়-দফা
তখন দেশে চলছে সামরিক শাসন। সেই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের উপরে চলছে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামরিকবেসামরিক সবক্ষেত্রে সীমাহীন শােষণ-বঞ্চনা আর নিপীড়ন। প্রতিবাদ করার সুযােগ নেই বটে, তবু বাঙালি আর কতকাল নীরবেনির্বিচারে সইবে এ দুঃসহ অনাচার? তাদের বুকে জ্বলছে বঞ্চনার বারুদ, প্রতিবাদের আগুন। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে বাঙালির, প্রশ্ন এখন মরা-বাঁচার। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক বৈষম্য সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে বিক্ষুব্ধ বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ দিচ্ছেন শেখ মুজিব 
 
 
 
মুজিব ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি লাহােরে অনুষ্ঠিত বিরােধীদলগুলাের এক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি সংবলিত এক কর্মসূচি ঘােষণা করেন। এই কর্মসূচি ঐতিহাসিক ছয়-দফা নামে পরিচিতি লাভ করে। এই ছয়-দফাই হয়েছে বাঙালির মুক্তির সনদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ নিহিত ছিল সে-দিনের ছয়-দফাতেই। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষও ঘটে এখান থেকেই। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিব এবং তার দল আওয়ামী লীগ জেল-জুলুম নির্যাতনের হুমকি উপেক্ষা করে পূর্ব পাকিস্তানের মাঠে ময়দানে এমনকি ঘরে ঘরে ছয়-দফার সঠিক ব্যাখ্যা পৌছে দেন। বিরুদ্ধবাদীদের বিদ্বেষপ্রসূত অপব্যাখ্যা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ছয়দফাকে মুক্তির সনদ হিসেবেই গ্রহণ করে।
পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণের কাছে ছয়-দফার জনপ্রিয়তা দেখে পাকিস্তানের শাসকেরা ভীতসন্ত্রস্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে শেখ মুজিবসহ বহু নেতাকর্মী ও বিশিষ্টজনকে গ্রেপ্তার করে, নিপীড়ন চালায়।
 
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করেও স্বস্তি পায় না পাকিস্তানের শাসকচক্র। তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগ এনে মিথ্যা মামলা সাজায়। দেশবাসীর কাছে হেয় করতে চায় নেতাদের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি, দিতে চায় কঠোর শাস্তি। ছয়দফা কর্মসূচিকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবসহ ৩৪ জনকে আসামি করে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামের এক রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করে এবং প্রহসনমূলক বিচারের আয়ােজন করে। অভিযােগ করা হয়, আসামিরা ভারতের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যে আগরতলায় বসে ষড়যন্ত্র করেছে। কাজেই রাষ্ট্র ভাঙার দায়ে সাজা তাদের পেতেই হবে।
 
এগার-দফা ও ছাত্রসমাজ
 
বৈষম্য আর বঞ্চনায় ভরা রাষ্ট্রনীতি দ্বারা চালিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের ভাঙন অনিবার্য জেনেও পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা আগরতলা মামলার অভিযোেগ মােটেই মানতে পারে নি, এ-মামলাকে ষড়যন্ত্র মামলা নামেই অভিহিত করেছে। আগরতলা মামলাকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছে। এ-আন্দোলন 
যেন অচিরেই ব্যাপক, সর্বাত্মক ও অপ্রতিরােধ্য সংগ্রামে পরিণত হয় সেই উদ্দেশ্যে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯ সালের ৬ জানুয়ারি এগার-দফা কর্মসূচি ঘােষণা করে। মূলত এই এগার-দফা কর্মসূচি ছিল আওয়ামী লীগের পূর্বঘােষিত ছয়-দফা কর্মসূচিরই সম্প্রসারিত রূপ।
 
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
 
আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচির সঙ্গে উনসত্তরের শুরুতে ছাত্রসমাজের এগার-দফা কর্মসূচি যুক্ত হওয়ার ফলে পূর্ব পাকিস্তান তাে বটেই, সারা পাকিস্তানেরই রাজনৈতিক অবস্থা উত্তাল তরঙ্গসঙ্কুল হয়ে ওঠে। শাসকচক্রও মরিয়া হয়ে গ্রহণ করে দমননীতি। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ছাত্রনেতা আসাদ, ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক হাজতে নিহত হন সার্জেন্ট জহুরুল হক, ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক অফিসারের গুলিতে নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা। এ-সব হত্যাকাণ্ড আন্দোলনের বারুদে আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং অতি দ্রুত সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। গণআন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে।
 
রাজবন্দী-মুক্তি ও আইয়ুব শাহীর পতন
 
আওয়ামী লীগের ছয়-দফা এবং ছাত্রসমাজের এগার-দফা কর্মসূচির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা গণআন্দোলন শেষপর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে এবং শেখ মুজিবসহ নিরাপত্তা আইনে আটক অন্য রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে। ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি লাভের পর বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে রেসকোর্স মাঠে গণসংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সেদিনের এই সংবর্ধনাসভাতেই উপস্থিত ছাত্রজনতার পক্ষ থেকে ডাকসু’র সহসভাপতি তােফায়েল আহমদ সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আরেক বড় অর্জন হচ্ছে, লৌহমানব’ বলে খ্যাত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট স্বঘােষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন। দেশজোড়া প্রবল গণঅভ্যুত্থানের ধাক্কায় পরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নিজে চলে যান পর্দার আড়ালে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে অবসান ঘটে আইয়ুব আমলের। দ্বিতীয় সামরিক শাসন : ইয়াহিয়া খান। আইয়ুব খানের পর পাকিস্তানের ক্ষমতার মঞ্চে আসেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। চালু হয় দ্বিতীয়বারের মতাে সামরিক শাসন। ইয়াহিয়া প্রথমে প্রধান। সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশ শাসন করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতায় এসে ১৯৬২ সালের সংবিধান বাতিল করেন। এবং একই সঙ্গে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদও বাতিল করেন। তবে ১৯৬৯ সালের অক্টোবরে এসে তিনি দেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন এবং একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচনেরও ঘােষণা দেন। এই ঘােষণা রাজনীতিবিদদের কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করে সত্তরের সাধারণ নির্বাচন অতঃপর বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ ও ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্বঘােষিত ছয়-দফা এবং ছাত্রদের এগার-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে ঘােষণা করে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার পাকিস্তানি। 
 
শাসকদের শােষণ ও বৈষম্যের হাত থেকে মুক্তিলাভের আশায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের প্রতি সমর্থন জানায় এবং বিপুল পরিমাণে ভােট দেয়। এ-নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে বরাদ্দকৃত জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়। মনােনীত মহিলা আসনসহ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মােট আসন ৩১৩টি। তার মধ্যে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি, জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পিপলস পার্টি পায় ৮৮টি এবং অন্য সব দল মিলিয়ে পায় ৫৮টি আসন। নির্বাচনের এই ফলাফল দেখে পাকিস্তানের শাসকদের মাথায় যেনবা আকাশ ভেঙে পড়ে। পূর্বঘােষিত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আহ্বান জানাবেন পাকিস্তানের নতুন সরকার গঠন ও সংবিধান প্রণয়নের জন্য। সেটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধুও সােজা কথা জানিয়ে দেন—ছয়-দফার কথা বলে তিনি জনগণের ভােট পেয়েছেন, কাজেই দেশের সংবিধান বা শাসনতন্ত্রও রচনা করবেন ছয়-দফার আলােকে এবং দেশ পরিচালিত হবে ছয়-দফার ভিত্তিতেই।
 
ষড়যন্ত্রের নীলনকশা
 

পাকিস্তান সৃষ্টির পর সত্তরের নির্বাচনের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতাে বাঙালির সামনে সুযােগ আসে-পাকিস্তানের শাসনভার পরিচালনার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অচিরেই পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, এটা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বাঙালির এই নেতৃত্ব মেনে নিতে পারে না। মেতে ওঠে গভীর ষড়যন্ত্রে । পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো সাহেবের পরামর্শে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নিজের প্রতিশ্রুতি থেকে নিজেই সরে আসেন এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে চক্রান্তের নীলনকশা প্রস্তুত করেন—ক্ষমতা তারা ছাড়বেন না। ভিতরে-ভিতরে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। কিন্তু বাইরে থেকে সেটি বােঝার উপায় নেই। সব ষড়যন্ত্র নিপুণ হাতে ঢেকে রেখে অতিশয় সজ্জন প্রেসিডেন্টের মতাে তিনি ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে ঘােষণা দিলেন—জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে ঢাকায়, মার্চের ৩ তারিখে। এ-ঘঘাষণা শােনার পর আর কোনাে সংশয় নয়, সারা দেশ গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে প্রথম অধিবেশনের ওই দিনটির জন্য। কিন্তু দিন যতই

এগিয়ে আসে জুলফিকার আলী ভুট্টোর অগণতান্ত্রিক, একগুঁয়ে এবং ৩ তারিখের অধিবেশনবিরােধী কথাবার্তা ততই বেপরােয়া হয়ে ওঠে। অবশেষে জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের মাত্র দু’দিন আগে, ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের ৩ তারিখের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করেন।
 
উত্তাল মার্চ : অসহযােগ আন্দোলন
 
দীর্ঘ ২৩ বছরের এত আন্দোলন-সংগ্রাম, এত স্বপ্ন এত আয়ােজন ষড়যন্ত্রকারী প্রেসিডেন্টের এক ঘােষণায় সব পণ্ড হয়ে গেল। স্থগিত হয়ে গেল নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদের পূর্বঘােষিত অধিবেশন। বাঙালি এ-ঘােষণা মানবে কী করে? বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে হােটেল পূর্বাণীতে বৈঠকে বসেছেন—ছয়দফার ভিত্তিতে কীভাবে সংবিধান রচনা করবেন, কীভাবে দেশ চালাবেন, মাত্র দুদিন পরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে কীভাবে এ-সব উপস্থাপন করবেন—এ-সব নিয়ে জোর আলােচনা চলছে। এরই মাঝে প্রেসিডেন্টের ঘঘাষণা সবাইকে স্তম্ভিত করে। সহসাই বন্ধ হয়ে যায় স্কুল-কলেজ, অফিসআদালত, দোকানপাট, ঢাকা স্টেডিয়ামের ক্রিকেট ম্যাচ। লাখ-লাখ বিক্ষুব্ধ মানুষ নেমে আসে রাস্তায়, ফেটে পড়ে বিক্ষোভে প্রতিবাদে। শ্লোগানে-শ্লোগানে মুখরিত সারা ঢাকা ‘জয় বাংলা’, ‘তােমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্রধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’—স্বাধীনতার অবিস্মরণীয় শ্লোগানে কেঁপে ওঠে আকাশ-বাতাস। মিছিলের-পর-মিছিল ছুটে চলে হােটেল পূর্বাণী অভিমুখে। জনগণ বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী নির্দেশ জানতে চায়। জাতীয় পরিষদের পূর্বঘােষিত অধিবেশন আকস্মিকভাবে স্থগিত করাকে ২৩ বছর দাবিয়ে রাখা বাঙালিদের বঞ্চিত করার আরাে একটি ষড়যন্ত্র বলে। উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু এ-দিন আবারও ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ওপর জোর দেন এবং ওই ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা পূর্ববাংলায় হরতাল আহ্বান করেন। সরকার অস্ত্রের জোরে দমন করতে চায় আন্দোলন। ২ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেন, নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালানাে গণহত্যার শামিল এবং তা মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ। পাকিস্তানি শাসকচক্রকে তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে যদি আগুন জ্বলে—ঐ আগুনের শিখা থেকে তারাও রেহাই পাবে না। এ-দিন ডাকসুর ভিপি আ স ম আব্দুর রব শ্লোগানমুখর পরিবেশে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এদিকে স্বৈরশাসক সন্ধ্যা ৭টা থেকে  সকাল ৭টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি করে। বঙ্গবন্ধু ঘােষণা দেন অসহযােগ আন্দোলনের। তার মতে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক নয়, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই কেবল বৈধ কর্তৃত্বের অধিকারী। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত গণবিচ্ছিন্ন পাকিস্তান সরকারকে কোনাে প্রকার সহযােগিতা না-করার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। ৩ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন অর্ধ দিবস হরতাল এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স মাঠে জনসভার কর্মসূচি ঘােষণা করা হয়।
 
বস্তুতপক্ষে, পাকিস্তান সরকারের তখন কর্তৃত্ব ছিল শুধু সেনাবাহিনীর ওপরেই, আর বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল জনগণের ওপরে, উত্তাল সেই মার্চে সারা পূর্ববাংলা চলেছে তারই আদেশে-নির্দেশে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়েছে। আবার হরতালের পর ব্যাংক খুলে সরকারি কর্মকর্তাকর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ারও ব্যবস্থা হয়েছে। এমন অহিংস অথচ সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলন নজিরবিহীন। মুজিবের নির্দেশে অচল সারা দেশ। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাধ্য হয়ে ২৫ মার্চ আবারও জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের ঘােষণা দেন। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এল ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ঢাকার রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) কানায়-কানায় ভর্তি মানুষে। রাজপথে উপচেপড়া মানুষের ভিড়। কারফিউ, গুলি, সামরিক আইন উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা অনুযায়ী সব কর্মসূচি পালন করেছে মুক্তিকামী বাঙালি। এবার জানতে চায় পরবর্তী নির্দেশ।
নির্দেশ নয়, নেতার কণ্ঠে সে-দিন সােজাসুজি ঘােষণা—এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই সংগ্রাম যাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে তাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর স্পষ্ট কিছু নির্দেশ আছে ৭ মার্চের ভাষণে। অন্ততপক্ষে ৪টি নির্দেশ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। সেগুলাে হল
১. অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে।
২. অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে।
৩, সামরিক বাহিনী যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।
৪.জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগেই জনগণের ভােটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
 
 
 
এই নির্দেশ তথা দাবিগুলাে যদি অমান্য করা হয়, তা হলেই সংগ্রাম চলবে বাঙালির মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য। এই সংগ্রাম যারা চালাবে, সব ক্ষমতার উত্স যে আপামর জনগণ, সব শ্রেণী পেশার সেই সংগ্রামী জনসাধারণের করণীয় উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বেশকিছু নির্দেশ প্রদান করেন। বস্তুতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর ঘােষিত কর্মসূচি এবং আহ্বানের প্রতি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে প্রশাসনের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী তথা সর্বস্তরের জনসাধারণ নিঃশর্ত সমর্থন জানায়, স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সব অফিস আদালত, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, যানবাহন, কলকারখানা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ৯ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানীও পরিষ্কার ঘােষণা দিয়ে জানিয়ে দেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা যেন আলাদা করে তাদের শাসনতন্ত্র তৈরি করে, কারণ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়ে নিজেদের শাসনতন্ত্র নিজেরাই তৈরি করে নেবে।
 
আবার ষড়যন্ত্র : মিথ্যা সময়ক্ষেপণ
 

পূর্ব পাকিস্তানের ঘরে-ঘরে কালাে পতাকার সাথে উড়ছে বাংলাদেশের নতুন পতাকা। ছাত্র-জনতা মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে শুরু করেছে। পথে-পথে ব্যারিকেড দিয়ে মিলিটারির চলাফেলা বিঘ্নিত করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে অবস্থা বেসামাল দেখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানকে শায়েস্তা করার জন্য গণহত্যার সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এই উদ্দেশ্যেই বেলুচিস্তানের কসাই নামে খ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে পাঠান। কিন্তু তাকে শপথগ্রহণ করাতে এ-দেশের কোনাে বিচারপতি রাজি হলেন না। অসহযােগিতা বলে কাকে! অবস্থা বেগতিক দেখে ইয়াহিয়া খান মার্চের ১৫ তারিখে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলােচনার নামে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। এদিকে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিদিন বিমানে করে সৈন্য আনা হয় ঢাকায়, আবার ঢাকা থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সারা পূর্ব পাকিস্তানে। যুদ্ধজাহাজ বােঝাই করে অস্ত্র গােলা-বারুদ এনে নােঙর করে চট্টগ্রাম বন্দরে। এদিকে আলােচনার অভিনয় চলছে প্রতিদিন। খুব গভীর এই ষড়যন্ত্রে ভুট্টো এসে যােগ দিলেন ২১ মার্চ। কিন্তু আলােচনার ভান আর কতদিন করা যায়! এ-দিকে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে। বাঙালি সৈনিকেরা বিদ্রোহ করে বসেছে। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে সেনানিবাস আর গভর্নর হাউজ ছাড়া কোথাও পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে না, উড়ছে বাংলাদেশের নতুন পতাকা। পরদিন ২৪ মার্চ। রাজনৈতিক উদ্বেগ আর অস্থিরতায় উত্তাল দিন। এদিন বঙ্গবন্ধু এবং ইয়াহিয়ার মধ্যে বৈঠক নেই। বৈঠক হয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ আর ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে। এ-সব বৈঠকের ভান করে আরাে একটা দিন কাটিয়ে দেওয়া এবং পরদিন যে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুষ্ঠিত হবে তারই সর্বশেষ প্রস্তুতি চূড়ান্ত খবরাখবর জেনে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দেওয়াই হচ্ছে মুখ্য উদ্দেশ্য। ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাপরিকল্পনা অপারেশন সার্চ লাইট’-এর সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পর কোনাে প্রকার ঘােষণা না-দিয়েই ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। এই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের সব দরজা-জানালা।

 
অপারেশন সার্চলাইট : নজিরবিহীন গণহত্যা
 
পৃথিবীর ইতিহাসে যতগুলাে গণহত্যার খবর পাওয়া যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা, নিষ্ঠুরতা ও ক্ষীপ্রতার মাপকাঠিতে অন্যতম প্রধান। কোনাে কোনাে যুদ্ধবিশেষজ্ঞ অন্যতম না-বলে ‘প্রধান’ বলে চিহ্নিত করতে চান। এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন বিপুলসংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা আগে কখনাে ঘটে নি। মার্চ মাসের গােড়ার দিকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসনের জনসংযােগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক অবাধ্য নাগরিকদের দমন করতে 
 
 
 
 
পাকবাহিনীর সম্ভাব্য ভূমিকা সম্পর্কে বিদেশী সাংবাদিকদের যে ব্রিফ দেন তার প্রেক্ষাপটে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গ ২৮ মার্চ নয়াদিল্লি থেকে লেখেন : দীর্ঘদেহী এই পাকিস্তানি অফিসার বলেছিলেন, যখন ডাকা হবে সেনাবাহিনীকে, সেটা হবে একেবারে চূড়ান্ত পদক্ষেপ। সেনাবাহিনী হত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই গুলি ছুঁড়বে।” শুধু হত্যা নয়, পঁচিশে মার্চের সেই ভয়াল রাতে ঢাকায় সংঘটিত হয় পরিকল্পিত এবং বর্বরতম গণহত্যা। এ-দিন ষড়যন্ত্রকারী ভুট্টোর সঙ্গে চূড়ান্ত আলােচনা করে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঙালি জাতির স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের আকাক্ষা চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে গণহত্যার নিখুঁত পরিকল্পনা অনেক আগে থেকে করা আছে, সেই নীলনকশার নাম অপারেশন সার্চলাইট।” এ অপারেশন শুরুর আগেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী সব বাঙালি অফিসারকে হয় হত্যা, না হয় গ্রেপ্তার করে, সাধারণ সৈন্যদের এবং পিলখানায় ইপিআরদেরও নিরস্ত্র করে। তারপর রাত সাড়ে ১১টায় ভুট্টোর কুপ্ররােচনায় ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া হায়েনা বাহিনী নিরীহ ঘুমন্ত মানুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে রক্ত লােলুপতায়। ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, আরমানিটোলা, পিলখানা, পুরনাে ঢাকায় প্রত্যেক হিন্দুবাড়িতে গুলি চালায় নির্বিবাদে, আগুন জ্বালায় নির্বিচারে। ঢাকা থেকে বিদেশী সাংবাদিকদের আগেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবু সাইমন ড্রিং নামে এক দুঃসাহসী সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গােপনে এই হত্যাকাণ্ড এবং ধ্বংসলীলার সংবাদ ও চিত্র সংগ্রহ করে ওয়াশিংটন পােস্ট পত্রিকার মাধ্যমে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেন। | আরও একজন মানুষ, পেশায় সাংবাদিক না-হয়েও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল এবং জগন্নাথ হলে পঁচিশের ভয়াল রাতে যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটে, তার ছবি ধারণ করেন মুভি ক্যামেরায়। বুয়েটের অধ্যাপক ড. নূরুল উলার ধারণকৃত সেই ছবি এখনাে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার দলিল হয়ে আছে। শুধু হলের ছাত্র নয়, আশেপাশের বস্তিগুলােতে তারা আগুন জ্বালিয়ে দেয়, মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করে প্রাণভয়ে ভীত মানুষজনকে। এককথায়, সেই ভয়াল রাতে ঢাকা নগরীতে বিরাজ করে নারকীয় পরিবেশ। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরে দেশের প্রধান শহরগুলােতে একযােগে ঝাপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। প্রকৃতপক্ষে পঁচিশে মার্চের বিভীষিকার তুলনা হয় না।
 
শুধু ঢাকাতেই সে রাতে লক্ষাধিক নারী-পুরুষকে হত্যা করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়। | বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং স্বাধিকারের দাবি সম্পূর্ণভাবে স্তব্ধ করে দেওয়াই ছিল অপারেশন সার্চলাইটের মূল লক্ষ্য। একইসঙ্গে এই অভিযানের অন্যতম আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা। হয়তাে বঙ্গবন্ধু নিজেও সেটা জানতেন। তার আশঙ্কা ছিল জেনারেল ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া হায়েনা বাহিনী তাকে না পেলে সারা ঢাকায় আগুন জ্বালিয়ে দেবে। তাই তিনি স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘােষণা প্রচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করলেন, দলের সব নেতাকর্মীকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন, তারপর এপিকধর্মী ট্র্যাজেডির নায়কের মতাে নিয়তি নির্দিষ্ট পরিণাম ভােগ করার জন্য প্রতীক্ষায় রইলেন।  অতঃপর সেদিনের সেই মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক কমান্ডাে দল এসে ইতিহাসের মহানায়ককে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। বাংলার মানুষের মুক্তির প্রত্যাশায় তিনি নিজে বন্দিত্ব বরণ করে নেন। এর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি ঘােষণা করেন, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।  কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই, বাংলাদেশের মাটিতে তখন দাবড়ে বেড়াচ্ছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর দানবেরা। বঙ্গবন্ধু তাই আহ্বান জানিয়ে গেলেন—এই হিংস্র দানবদের থাবা থেকে মুক্ত করতে হবে মাতৃভূমিকে।
 
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা
 
‘স্বাধীনতা’ নামের মহাকাব্যের বীরােচিত নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি অত্যন্ত শৈল্পিক কৌশলে পাকিস্তানের মােহবন্ধন থেকে ধীরে-ধীরে বাঙালি জাতিকে বের করে এনেছেন মুক্তির পথে, যুক্তির আলােয়। বাঙালি আত্মানুসন্ধানী হয়ে পথে নামতেই বাধা পেয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির, সেই বাধা সরাতে গিয়েই তারা গড়ে তুলেছে আন্দোলন-সংগ্রাম। ‘৫২, ‘৬৬, ‘৬৯, ‘৭০ পেরিয়ে জনতার সেই আন্দোলন-সংগ্রাম এমন এক পর্যায়ে পৌছে যে, সেই শীর্ষবিন্দুতে দাড়িয়ে স্বাধীনতার ঘােষণা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। গণমানুষের নেতা শেখ মুজিব দিনে-দিনে একটু-একটু করে স্বাধীনতার এই স্বপ্নসাধই জাগিয়ে তােলেন গণমানসে। ফলে ১৯৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্সরা লাখাে জনতার দিকে তাকিয়ে তিনি সরাসরি ঘােষণা দিয়েই দেন—’এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ | এই ঘােষণা থেকেই গােটা জাতি ‘গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে যায়। বেসামরিক জনগণ তাে বটেই সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যরাও ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে, দেশকে শত্রুমুক্ত করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে। ৭ মার্চের পর থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অসহযােগ আন্দোলন পরিচালনা করে। আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের সব পথ বন্ধ করে দিয়ে পঁচিশে মার্চের কালাে রাতে বর্বর ইয়াহিয়ার নির্দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যা চালায় ঢাকা নগরীতে। এরই প্রেক্ষাপটে বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম’ তথা ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ অনিবার্যভাবেই মােড় পরিবর্তন করে সশস্ত্র যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করে।
 

স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তান কমান্ডাে বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অনিবার্য সেই সশস্ত্র যুদ্ধেরও ঘােষণা দিয়ে যান। বাংলার মানুষের উদ্দেশে তার শেষ বার্তাটি ছিল এ রকম : This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have. To resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achicved.” (এটাই হয়তাে তােমাদের জন্য আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। যে যেখানেই থাক, যে অবস্থায় থাক, হাতে যার যা আছে তাই দিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিরােধ গড়ে তােল। যতদিন পর্যন্ত-না দখলদার পাকিস্তানিদের শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে।) এ ঘােষণাটি বঙ্গবন্ধু বিশেষ ব্যবস্থায় আগেই রেকর্ড করিয়ে রেখেছিলেন এবং ইপিআর-এর অয়্যারলেসযােগে যথাসময়ে প্রচারেরও দায়িত্ব দিয়ে ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনামতাে এটা প্রচারও হয়। কিন্তু সেই রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে যখন বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিলখানায় ইপিআর এবং রাজারবাগে পুলিশের দুর্গে বর্বরােচিত হামলা চালিয়েছে, তখন অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকার টিএন্ডটি (টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন) এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে তিনি আরাে একটি বার্তা প্রেরণ করেন, সেখানে বলা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পিলখানায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের সদর দপ্তর আর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ওপর আক্রমণ করেছে সমস্ত শক্তি জড়াে করে প্রতিরােধ করুন আর স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিন।

 
স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুনমাত্রা
 
২৬ মার্চ বাঙালির জাতীয় জীবনে সবচেয়ে উজ্জ্বল ডেটলাইন। আর পূর্ব পাকিস্তান নয়, পূর্ববাংলাও নয়; পঁচিশের কালাে রাতে পৈশাচিক গণহত্যা চালানাের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সব সম্পর্কের সুতাে অনায়াসে কেটে দিয়েছে; বাঙালির আর পিছনে তাকানাের অবকাশ নেই, যত ঝুঁকিপূর্ণই হােক তাকে সামনেই যেতে হবে—চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে। স্বাধীনতা সংগ্রাম ২৬ মার্চের পর অনিবার্যভাবেই মুখ ফিরিয়েছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকে। কিন্তু তার আগে আছে প্রতিরােধ যুদ্ধ। কেবল ঢাকা শহরে নয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে একযােগে দেশের বড় শহরগুলােতে ঝাপিয়ে পড়ে, কারফিউ জারি করে, ঘরে-ঘরে আগুন জ্বালায়, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে। আক্রমণের আকস্মিকতায় ঢাকা শহরের প্রতিরােধ ব্যবস্থা বেশিক্ষণ টিকে থাকে নি বটে, চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ সহজে নিতে পারে নি তারা। চট্টগ্রামের প্রতিরােধযােদ্ধারা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আগলে রাখে বীরের মাটি চট্টলাকে। এদিকে কুষ্টিয়া এবং পাবনা শহর প্রথম আঘাতেই পাকিস্তানি সৈনিকরা দখল করে নিলেও চুয়াডাঙ্গার ইপিআরপ্রধান মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে কুষ্টিয়া এবং  
 
 
 
 

পাবনার জেলা প্রশাসক এম নূরুল কাদেরের নেতৃত্বে পাবনা পুনরায় দখল করে নেয় প্রতিরােধযােদ্ধারা। বগুড়া-দিনাজপুরেও একই ঘটনা ঘটে। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত মুক্ত থাকে এ-সব শহর। কুমিল্লা, খুলনা ও সিলেট পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেদের দখলে রাখলেও প্রতিরােধযােদ্ধারা বারংবার আক্রমণ করে তাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। যশাের সেনানিবাসে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলে তারা বিদ্রোহ করে, প্রায় অর্ধেক সৈন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারালেও বাকি সৈন্যরা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে আসতে পারে বিভিন্ন এলাকা থেকে পালিয়ে আসা বা ছুটিতে বাড়ি আসা বাঙালি সৈনিকরাই নিজ-নিজ এলাকায় দেশপ্রেমিক ছাত্রযুবক ও আনসারমুজাহিদদের সংগঠিত করে গড়ে তােলে দুঃসাহসী প্রতিরােধযােদ্ধা। দেশমাতৃকাকে দখলদারমুক্ত রাখতে তাদের যে সাহসী প্রচেষ্টা, সত্যিই তার তুলনা হয় না। কিন্তু তাদের সাধ্যের সীমাবদ্ধতার কথা ভুললে চলবে না। এরই মাঝে পাকিস্তান থেকে দুই ডিভিশন সৈন্য, অস্ত্র, গােলাবারুদ এনে বাংলাদেশের ভিতরে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তি ও তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। আক্রমণের ভয়াবহতাও অনেকাংশে বেড়ে যায়। ফলে কৌশলগত কারণে প্রতিরােধযােদ্ধাদের পিছু হটতে হয়। সীমান্ত পেরিয়ে

তারা চলে আসে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। এদিকে পাকসেনাদের অত্যাচারে নিরীহ জনগণ ও ছাত্র-যুবকরাও প্রাণভয়ে আশ্রয় নেয় ভারতে শরণার্থী শিবিরে। সাত কোটি বাঙালির মধ্যে এক কোটি গিয়ে আশ্রয় নেয় ভারতে। মানবেতর জীবন শরণার্থীদের। অবর্ণনীয় কষ্ট খাদ্য নেই চিকিৎসা নেই, শিশু ও বৃদ্ধদের কষ্ট সবচেয়ে বেশি। এরই মাঝে দেশপ্রেমিক ছাত্র-যুবকদের ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিযােদ্ধা করে তােলা, সমগ্র সীমান্ত এলাকাজুড়ে যে-সব যুদ্ধতৎপরতা অব্যাহত আছে, অবিলম্বে তার মধ্যে সমন্বয়সাধন করে একক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণে যুদ্ধ পরিচালনা, আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযােগিতা আদায় করে আনা—এসব জরুরি কাজের জন্য সবকিছুর আগে সারা দুনিয়ার সামনে পরিচয় দেওয়ার জন্য দরকার বাংলাদেশের জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত সরকার কিন্তু কোথায় সেই সরকার? স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ অন্য নেতৃবৃন্দ বিচ্ছিন্নভাবে কে কোথায় ছড়িয়ে আছেন ঠিক-ঠিকানা নেই। 
 
চরম এই দুঃসময়ে শক্তহাতে হাল ধরলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, অমিত সাহসী স্বাধীনতা সংগ্রামী তাজউদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথমে খুঁজে বের করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, খােন্দকার মােশতাক, কর্নেল ওসমানীসহ বেশ কিছু নির্বাচিত প্রতিনিধিকে। এপ্রিলের ১০ তারিখে আগরতলায় বসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি (তার অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম) করে এক মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তিনি নিজে দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রীর। | গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এই নবগঠিত সরকার ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর (তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলা) জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে ছায়াসুনিবিড় আম্রকাননে দেশী-বিদেশী কয়েক শত সাংবাদিকের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে, শপথগ্রহণ করে, মুক্তিযােদ্ধাদের গার্ড অব অনার ও সালাম গ্রহণ করে এবং সরকারের পক্ষ থেকে স্পিকার অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ করেন। এ ঘােষণাপত্রটির মাধ্যমেই বাংলাদেশ নৈতিকভাবে এবং আইনগতভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের অধিকার লাভ করে। এ সরকারের প্রধান দায়িত্ব বাংলাদেশের মাটি থেকে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাজিত করার লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, সমগ্র যুদ্ধপ্রক্রিয়া একক নিয়ন্ত্রণে আনা, যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন এবং সর্বোপরি দেশ পরিচালনার সার্বিক 
 
 
 

দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা। বৈদ্যনাথতলার এ শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হিসেবে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্য সাবেক সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে যুক্ত হয়ে যায় মেহেরপুর জেলার নিভৃত এক পাড়াগ্রাম-বৈদ্যনাথতলা। শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা বিন্দু হয়ে আছেন যে নেতা, যার নামে গঠিত হল বাংলাদেশের প্রথম সরকার, শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে ইতিহাস আশ্রিত বৈদ্যনাথতলার নতুন। নামকরণ হল সেই অবিসংবাদিত নেতার নামে—মুজিবনগর। এই মুজিবনগরকেই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানীর মর্যাদায় করা হলাে। অভিষিক্ত। এরপর ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত। বাংলাদেশ সরকারের সকল কার্যক্রমই পরিচালিত হয়েছে এই মুজিবনগরের নামে। সেই ১৯৭১ সালে গােটা বাংলাদেশেরই অন্যনাম হয়ে ওঠে মুজিবনগর। মুজিবনগর থেকেই বাঙালি জাতির সত্যিকারের অভিযাত্রা শুরু বাংলাদেশ অভিমুখে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বর্ণাঢ্য ইতিহাসে তাই মুজিবনগর হয়ে আছে উজ্জ্বলতম এক বাতিঘর ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে শতসহস্র ষড়যন্ত্রের নিপ্রদীপ মহড়ায় যে বাতি নিভে গিয়েছিল, দু’ শ’ বছরের তিমির অন্ধকার পেরিয়ে সেই বাতি আবারও জ্বলে ওঠে আলাে ছড়ানাের প্রত্যয়ে মুজিবনগর আম্রকাননে, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল।

 
 

সূত্রঃ  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর – রফিকুর রশীদ