পূর্ববাংলার মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি
জনৈক মুক্তিযােদ্ধা
পূর্ববাংলার যুদ্ধরত বন্ধুরা, আপনাদের জানাই অসংখ্য শ্রদ্ধা, জানাই লাল সালাম! আপনারা যুদ্ধ করছেন, দেশের ভিতরের ও বাইরের শােষক শ্রেণী, তাদের দালাল শ্রেণী এবং তাদের রক্ষী বাহিনীকে খতম করে দেশকে শােষণ ও নিপীড়ন মুক্ত করার জন্য। কমরেড লিন পিয়াও বলেছেন, বিশ্বের যেখানেই যারা সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করেন প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে তারা আমাদের সঙ্গে আছেন, তাদের এ সংগ্রাম শ্রেণী সংগ্রামেরই এক ধাপ।’ অতএব আপনারা এ যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধে পরিণত করুন, কারণ আপনারা নিশ্চয়ই নিপীড়িত লাঞ্ছিত ও শােষিত বাংলার জনগণকে শােষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্ত করতে যাচ্ছেন। এ জনগণের প্রতি আস্থা রাখুন, তাদের উপর নির্ভর করে দৃঢ় পদে এগিয়ে যান, জয় আমাদের হবেই। এ প্রসঙ্গে যােদ্ধা হিসেবে আমরা সর্বদা মনে রাখবাে কমরেড মাও-এর বাণী, ‘জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম কোনাে মতেই প্রতিক্রিয়াশীল বা তাদের পদলেহী দালাল শ্রেণীর উপর ন্যস্ত করা উচিত হবে না, কেবলমাত্র জনগণকে সুসংগঠিত করেই এ সমস্যার সমাধান করা যায়।’
বন্ধুরা প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি শাসকদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না। পূর্ববাংলার এ মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে পিকিং রেডিও পাকিস্তানি প্রচারের তীব্র বিরােধিতা করে বলেন, পূর্ব বাংলার মুক্তিযােদ্ধাদের দমনের জন্য চীন পাকিস্তানকে বর্তমানে সাহায্য দিচ্ছে ইহা কুৎসা মাত্র।’ গণ-চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তার সঙ্গে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির একজন কমরেড পূর্ববাংলার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে সে ভদ্রমহােদয় বলেন, বস্তুত আওয়ামী লীগ হলাে পূর্ববাংলার বড় ধনিক সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যা সম্পূর্ণরূপে কমিউনিস্ট বিরােধী এবং চীন বিরােধী ভূমিকা পালন করে আসছে এবং যা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ও তার অনুগামী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত, ফলে শুধু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত চীন বিরােধী কোনাে সরকারকে নীতিগতভাবেই চীন সমর্থন করতে পারে না।’ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
‘It has been a natioanl oppression and suppression throughout the long 23 years. Now it has taken a naked shape. If you can form a united front against aggression-then and only then we can support this movement.’
সুতরাং চীন ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র গণযুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরােধিতা তাে করবেই , বরং তাকে সক্রিয় সমর্থন ও সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি একটি কথায় সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। সুতরাং প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া শােষকগােষ্ঠীর কোনাে দুরভিসন্ধিমূলক প্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গড়ে তুলি ও সশস্ত্র গণযুদ্ধের মাধ্যমে পিতৃভূমি থেকে শােষক ও অত্যাচারীদের সমূলে উৎখাত করি। আজ আমাদের ব্যক্তিস্বার্থ, শ্ৰেণীস্বার্থ, দলীয় স্বার্থকে ভুলে গিয়ে জাতীয় মুক্তির স্বার্থকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরি এবং পূর্ববাংলাকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করি।
সর্বশেষে আমি পূর্ববাংলার নিপীড়িত জনগণের একজন হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-এর প্রতিটি বিপ্লবী কর্মীর প্রতি আকুল আবেদন জানাই, দয়া করে আপনারা পাকিস্তানভিত্তিক বিপ্লবের পরিকল্পনা ত্যাগ করুন। যদিও মার্ক্সবাদীরা সমগ্র বিশ্বের জনগণের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে, তথাপি বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন পরিবেশে জনগণের চেতনার স্তর ও পরিচালনা করার মতাে গড়ে ওঠা একটি বিপ্লবী পার্টি ইত্যাদি বিপ্লবী পরিস্থিতির বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন স্থানের বিপ্লবী ক্রিয়াকাণ্ড বিভিন্ন হতে বাধ্য। আসুন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তি ও জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র লড়াই করে নিজেদের বিপ্লবী বলে কার্যত প্রমাণ করি, কারণ শশাষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে লড়াই করে না সে বিপ্লবী হতে পারে না। এ সগ্রামকে আমরা শ্রেণী সংগ্রামের রূপ দেই। পূর্ববাংলার ফ্যাসিস্ট অভ্যুত্থান দমন করা হচ্ছে’- এ বক্তব্য দিয়ে আপনারা নিষ্ক্রিয়তা অতিগােপনীয়তা এবং অপর যুদ্ধরত বিপ্লবীদের সঙ্গে সহযােগিতার নীতিতে সঙ্কীর্ণতাবাদকে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন।
আমি জানতে চাই পূর্ববাংলার প্রায় সাত লক্ষ জনতা কি ফ্যাসিস্ট ছিলেন? পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর অত্যাচার, নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোেগ শহরের পর শহর, গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস, পূর্ববাংলার মাবােনদের উপর পাশবিক অত্যাচার কি ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপ নয়? তবে আপনারা এ ফ্যাসিস্ট অত্যাচারীদের সম্পর্কে নীরব ও নিষ্ক্রিয় থেকে পরােক্ষভাবে সমর্থন দিচ্ছেন কোন বিপ্লব সফল করার উদ্দেশ্যে? আপনারা। যে ফ্যাসিস্টদের কথা বলছেন, বাস্তবে সে ফ্যাসিস্টরা সীমান্তের ওপারে নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান করছে। নির্বিচারে গণহত্যার প্রতিবাদে জনগণ আজ অস্ত্র ধারণ করেছেন, যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। এই সংগ্রামী জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে তাদের সঙ্গে, তাদের পথে নেমে আসুন! আপনাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে মহান নেতার সতর্ক বাণী নিষ্ক্রিয়তাবাদ সন্দেহবাদ ও সঙ্কীর্ণতাবাদ হচ্ছে সংশােধনবাদ। আপনারা এই সংশােধনবাদী ভূমিকা ত্যাগ করে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে (যারা বর্তমানে পূর্ববাংলার সমগ্র জনগণের শ্ৰেণীশ) খতম করে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা কায়েম করুন। মহান লেনিনের অমর বাণী ‘যে শােষিত ও নিপীড়িত শােষণ নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাবার জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করে না এবং অস্ত্রের পরিচালনা শিক্ষা করে না শােষণ ও নিপীড়নই সে জাতির একমাত্র প্রাপ্য’-কে নিজেদের ক্ষেত্রে গ্রহণ করুন। প্রমাণ করুন মহামনীষী মার্কসের কথা শশাষণ নিপীড়ন থেকে মুক্তির যে কোনাে আপােসহীন সংগ্রামই শ্রেণী সংগ্রাম।’
এ কথা সত্যি যে প্রতিক্রিয়াশীলরা কোনাে দিন মুক্তির সংগ্রাম চালাতে পারে না। কৃষক-শ্রমিক বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী ও দেশপ্রেমিক জাতীয় ধনিক শ্রেণীর এ স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব অবশ্যই বিপ্লবীদের দিতে হবে। সত্যিকারের বিপ্লবী হিসেবে এ সশস্ত্র সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিপ্লবী দায়িত্ব পালন করুন, কৃষক শ্রমিক বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী ও দেশপ্রেমিক জাতীয় ধনিক শ্রেণীর সমন্বয়ে গঠিত এ ঐক্যবদ্ধ পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের বিপ্লবী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করুন। পূর্ববাংলার বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে এর থেকে বিচ্যুত হলে আগামী দিনের ইতিহাস আপনাদের এ বাস্তব বর্জনতাকে কোনাে ক্রমেই ক্ষমা করবে না। পরিশেষে আমি পুনঃ ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তােলার জন্য সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলাের প্রতি আহ্বান জানাই, আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে পূর্ববাংলার এ গণযুদ্ধে জনগণের বিজয়কে সুপ্রতিষ্ঠিত করি, মুক্তির লাল সূর্যোদয় ঘটাই পূর্ববাংলার পুব আকাশে।
সূত্র: দর্পণ
০৪.০৬.১৯৭১