You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.15 | বাঙলাদেশের পূর্ব রণাঙ্গনে | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

বাঙলাদেশের পূর্ব রণাঙ্গনে

ইয়াহিয়ার হানাদার ফৌজ চেয়েছিল ময়মনসিংহ ও শ্রীহট্ট জেলার চারটি মহকুমাকে মুক্ত করতে। এই তথাকথিত বিমুক্তি অভিযানের মহৎ প্রেরণায় পাকসেনারা ক্ষ্যাপা নেকরের মতাে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আবালবৃদ্ধ-বনিতার ওপর অল্প সময়ের মধ্যেই পাঁচ-হাজার নরনারীকে তারা শেয়াল-কুকুরের মতাে গুলি করে মেরেছিল। কিছু কিছু অঞ্চলে তারা জঙ্গলে রাজত্ব কায়েম করেছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু সে সব অঞ্চল পরিণত হয়েছিল জনমানবহীন ও মৃতের স্মৃতিমুখর সমাধিক্ষেত্রে।
সুনির্দিষ্ট তথ্য থেকে জানা গেছে, পাকফৌজ শ্রীহট্ট এবং ময়মনসিংহের সব কটি সীমান্ত ঘাঁটি দখল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল এবং সৈন্যদের পাশাপাশি অ-বাঙালী ‘রক্ষী বাহিনীকে সেসব জায়গায় মােতায়েন করার মতলব এঁটেছিল। সেই পরিকল্পনা আজঅবধি তারা কার্যকর করতে পারে নি। এক কথায় বলা চলে, তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
নৃশংস গণহত্যায় লিপ্ত পাক ফৌজ যতই মরিয়া হয়ে উঠছে, বাঙলাদেশের মুক্তিসেনারা তাদের ওপর জবর আঘাত হানছে। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে শ্রীহট্ট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত হাদাবিল্লা অঞ্চলে হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিফৌজের এক প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। এই লড়াইয়ে ৬০ জন পাকসৈন্য মারা যায় ও অন্ততঃ ২০ জন আহত হয়। মুক্তিফৌজের কেউই হতাহত হয় নি। কোথাও কোথাও রাজাকাররা রাইফেল সমেত ধরা পড়েছে।
১৯ সেপ্টেম্বর দিরায় থানার অন্তর্গত মহতাবপুর অঞ্চলে মুক্তিফৌজ ও হানাদারবাহিনীর মধ্যে সরাসরি সংগ্রাম বাধে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সংগৃহীত কিছু ভাড়াটে বাঙালীর সহায়তায় পাক ফৌজ মুক্তিসেনা অধিকৃত একটি অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এই সংঘর্ষ ৬ জন পাকসেনা খতম হয়। আহতের সংখ্যা হিসেব করা যায় নি।
মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দুর্ধর্ষ কিশাের কমী ২২ সেপ্টেম্বর ছাতক থানার কাছে বেতুরা গ্রামে ৩ জন পাকসেনাকে হত্যা করে।
ঐ একই থানার অন্তর্গত সুলতানাপুরে গেরিলাদের গ্রেনেড দুজন পারক্ষীর ইহলীলা সাঙ্গ হয়। লীলাপুরের রাস্তা দিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় একটি জীপ বােঝাই হয়ে হানাদার সেনারা যাচ্ছিল। মুক্তিযযাদ্ধাদের পেতে রাখা মাইনে জীপটি উড়ে যায় ও সব কজন আরােহী তৎক্ষণাৎ মারা যায়।
সেপ্টেম্বরের শেষার্ধে শ্রীহট্টের সুনামগঞ্জ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার সামান্য কিছু নিদর্শন ওপরে তুলে ধরা হয়। এরকম আরও বহু ঘটনা ধারাবাহিকভাবে সেখানে ঘটেছে, যার সমস্ত তথ্য আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি।
মুক্তিফৌজের অকুতােভয় গেরিলাদের ঘন ঘন ঝটিকা আক্রমণ পাক জঙ্গী শাহীর আগ্রাসী পরিকল্পনার ছকটিকে তছনছ করে দিয়েছে। বহু চেষ্টা করেও অধ্যাবধি তারা বাঙলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী শ্রীহট্ট ও ময়মনসিংহের চৌকী গুলি দখল করা দূরে থাক, সেখানে আক্রমণের দাঁত পর্যন্ত বসাতে পারে নি।
অপরদিকে কুমিল্লা চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার জন্য হানাদার সৈন্যরা মরিয়া হয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচেছ। কিন্তু সেখানেও তারা ঠিক একইভাবে একটার পর একটা মার খেয়ে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
শ্রীহট্ট ময়মনসিংহের সীমান্তস্থ মেঘালয়ের উপান্তে খাসি ও গারাে পাহাড়ের দুর্ভেদ্য এলাকা বর্ষার পর আরও ভয়ঙ্করভাবে অরণ্যসংকুল ও পথ-চিহ্নহীন হয়ে উঠবে। এই অরণ্য মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের মায়ের মতাে আশ্রয় দিচ্ছে। পাকফৌজ এখানে এগােনাের কোনাে সাহসই পাবে না। রাস্তা বলতে যা বােঝায়, তেমন কিছু এখানে নেই, নেই রেলপথের সংযােগ। এ সব এলাকা নৌকায় চলাচল করা ছাড়া কোনাে গত্যন্তরই নেই। কিন্তু বর্ষার অব্যবহিত পর দেশীয় মাঝিরা পর্যন্ত খরস্রোতা নদীতে নৌকা বাইতে সাহস পায় না। হানাদাররা খুব চেষ্টা করেছিল বৃষ্টি নামার আগেই ভারী অস্ত্রশস্ত্র সমেত বিপুল সংখ্যক সৈন্য ঐ সীমান্তে মােতায়েন করতে। তাদের পরিকল্পনা ছিল এলাকাটি যখন অগম্য হয়ে পড়বে, বর্ষার পরবর্তী সময়ে তখন আকাশ থেকে র্যাশন এবং অন্যান্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করে ঐ বাহিনীটিকে কর্মক্ষম রাখা হবে। পরিকল্পনাটি একেবারে মূলেই মার খেয়েছে।
ইতিমধ্যে জানা গেছে যে, ফ্যাসিস্ট চরিত্রের সংস্থা জামাত-এ ইসলামীর লুটেরাও গুণ্ডারা ‘মুজাহিদ’ বা বদর বাহিনী নামে অর্ধ সামরিক ধাচের সংগঠন তৈরি করতে প্রচেষ্টা হয়েছে। ইসলামীবাদের মতে তারাই পূর্ববাঙলার ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘দেশপ্রেমিক সংস্থা। এরা হচ্ছে হানাদারদের রিজার্ভ ফোর্স বা অতিরিক্ত বাহিনী। নানা জায়গা থেকে খবরাখবর সংগ্রহ করা ও মাঝে মাঝে অতর্কিতভাবে নিরীহ নরনারীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে খুন, জখম, ধর্ষণ ও লুটপাট করাই এদের দেশ প্রেমিকতা’র লক্ষণ।
মুক্তিসেনারা ভালাে করেই জানে যে, এই বিভীষণদের যদি ঝাড়েবংশে উচ্ছেদ করা না যায় তা হলে সংগ্রামের পথ জটিলতর হয়ে পড়বে। যখনই তারা পাক-অধিকৃত অঞ্চলে আক্রমণ চালায়, তখনই সর্বাগ্রে তাদের পরিকল্পনা থাকে ঐ ‘মুজাহেদ’দের খতম করার ব্যাপারে। মুক্তিবাহিনী তাদের পাত্তা পেলে কোনাে দ্বিধা না করেই এই বেইমানদের বিনা বাক্যব্যয়ে চরম দম্ভ দান করে। বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি মৃত্যু বাঙলাদেশের মানুষর কাছে এটা নিছক একটা শ্লোগান নয়, বারবার প্রমাণিত বাস্তব ঘটনা।
মেঘালয়ে শরণার্থী শিবিরে একমাসের মধ্যে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা কয়েক হাজার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দেড় লাখ পৌঁছেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের সংগ্রামী তরুণরা মরণপণ যুদ্ধে প্রবৃত্ত থেকেই তাঁদের এইসব আত্মীয় পরিজনদের বিস্মৃত হতে পারেন নি। সাম্প্রতিক পাকসেনাদের একটি রসদ ভাণ্ডার আক্রমণ করে তারা সম্প্রতি ৫০০ টন গম উদ্ধার করেছিল। এর সবটাই তারা ঐ ক্যাম্পের শরণার্থীদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন।
ইয়াহিয়া খানের বহুঘােষিত ‘ক্ষমাকরণ নীতি যে কত বড় একটা ধাপ্পা তা পাক অধিকৃত অঞ্চল ছেড়ে আসা মানুষ-জন হাড়ে হাড়ে বুঝে ফেলেছেন। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের কাগজগুলিতেও নিয়ে শাসকচক্রের ওপর কঠোর স্ক্রিপ বর্ষিত হচ্ছে।
জান গেছে, পাকহানাদাররা কিছু দালাল শ্রেণির লােকজনকে সীমান্ত অতিক্রম করিয়ে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে পাঠিয়ে দিয়েছে। তারা আশ্রয় প্রার্থীর ভেক ধরে ঐ নিপীড়িত শরণার্থীদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে পাক-অধিকৃত এলাকায় ফুসলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা তলে তলে চালিয়ে যাচ্ছে ইয়াহিয়ার তথাকথিত ‘শরণার্থী-প্রত্যাগমন শিবির গুলিতে বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে কিছু লােকজন সংগ্রহ করে দেখানােই এর একমাত্র উদ্দেশ্য। জানা গেছে যে ঐ দালালরা দেশে ফেরার শর্ত স্বরূপ অভাবগ্রস্ত শরণার্থীদের সামনে মােটা টাকার টোপ ফেলছে। দালালদের লােক নির্বাচন পদ্ধতি চলে একান্ত সতর্কতার সঙ্গে। তারা সে সব নরনারীকেই নির্বাচন করে, যাদের ওপর দিয়ে পাক-নৃশংসতার ঝড় তীব্রভাবে বয়ে যায় নি, যারা সাধারণভাবে অ-রাজনৈতিক এবং যাদের ব্যক্তি স্বার্থ চিন্তাই হচ্ছে সবচয়ে বড়াে কথা। তাছাড়া, দেশভাগের পর সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে একশ্রেণির নতুন ধরণের মানুষের উদ্ভব হয়েছে। এদের কাছে স্বদেশ বা দেশপ্রেমের কোন সংজ্ঞা নেই এবং এরা হচ্ছে আন্তর্জাতিক চোরা চালানদারদের ভাই-বেরাদার। এদের মােটা টাকা ঘুষ দিয়ে যে কোনাে খারাপ কাজ করানাে খুব সহজ।
এই রকম কিছু কিছু গােনাগুণতি লােকজনকে প্রলােভন দেখিয়ে যে পাক অধিকৃত এলাকায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয় নি তা নয়। কিন্তু ফিরে গিয়ে তারা যে খুব রাজার সম্মান পেয়েছে, এ কথা হলফ কর বলা কঠিন। বিদেশী সাংবাদিকরা তাদের দেখে চলে যাওয়ার পর পরই এদের অধিকাংশের ভাগ্যে জুটছে গ্রেপ্তারে অথবা মৃত্যু। না হয় পাক হানাদারদের দালাল বাহিনীতে এদের নিরুপায়ভাবে যােগ দিতে হচ্ছে।
মেঘালয়ের শরণার্থী শিবির থেকে অতি অল্প সংখ্যক লােককে পাক দালালরা অধিকৃত অঞ্চলে ভাঙিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিল। কিন্তু সে সংখ্যা আগত শরণার্থীদের তুলনায় এত হাস্যকরভাবে কম যে তাতে ইয়াহিয়া খানের আর যাই হােক আনন্দিত হওয়ার কোনাে কারণ নেই। [‘নিউএজ’-এর তথ্যানুসরণে]

সূত্র: কালান্তর, ১৫.১০.১৯৭১