নয়ারহাট, কালীগঙ্গা, আরিচা ও বাঘাবাড়ির নদী অতিক্রমে বিপদসঙ্কুল পথ পার হয়ে পৌছলাম পৈতৃক নিবাস বগুড়ায়। সপ্তাহ দুয়েক বগুড়ায় অবস্থানের পর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি নাগাদ একটা জীপে সড়ক পথে মহাস্থান, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট হয়ে হিলি সীমান্ত অতিক্রম করলাম। সঙ্গে প্রাক্তন সিএসপি ও বর্তমানে টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি খােন্দকার আসাদুজ্জামানের পরিবার স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় জনাব জামান মুজিবনগর সরকারের অর্থ সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বাংলাদেশের হিলিতেই আমরা জীপ ও অস্ত্রপাতি জমা রেখে ভারতে প্রবেশ করলাম মনের অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অপরিচিত দেশ আর অজানা ভবিষ্যৎ। বালুরঘাটে পৌছে ইউপিআই-এর টোকিও অফিসে এসওএস জানিয়ে ছােট্ট তারবার্তা পাঠালাম। বালুরঘাট থেকে সড়কপথে মালদহ এবং সেখান থেকে ট্রেনযােগে হাওড়া। আমরা দুটি পরিবার ছাড়াও বগুড়া থেকে একই সঙ্গে ছিলেন জনা পনেরাে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ মুজাফফরের নেতা ও কমী। পথ প্রদর্শক হিসাবে বালুরঘাট ফরােয়ার্ড ব্লকের জনৈক যুবনেতা আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি আমাদের দুটি পরিবার ছাড়াও সেই পনেরাে রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা সবাইকে হাওড়া থেকে মির্জাপুরের এক হােটেলে ওঠালেন বিদায় নেয়ার আগে ভদ্রলােক শুধু বললেন, এখন থেকে সমস্ত খরচপত্র নিজেদের বহন করতে হবে।সকালের নাস্তা ও দু’বেলা খাওয়া আর রুম ভাড়া দৈনিক ৪৫ রুপী। আমার কাছে তখন সবসুদ্ধ এক হাজার পাকিস্তানী টাকা। সকালে নাস্তা খেয়ে হেঁটেই গেলাম শিয়ালদহে। টাকা ভাঙ্গানাের জন্য তখনও রেট খুব ভাল এক হাজার টাকা ভাঙ্গিয়ে পেলাম আট শ’ আশি টাকা। হােটেলে ফিরে বার বার শুধু অজানা ভবিষ্যতের কথাই চিন্তা করলাম কিছুই কিনারা করতে পারলাম না। দুপুর দেড়টা নাগাদ খেতে বসেছি। এমন সময় একটা ফোন এলাে। হ্যা, আমাকেই চাচ্ছে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বার দুয়েক আমার নাম জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিন্ত হলেন। বললেন, এর আগেও একবার ফোন করেছিলাম। এরপর নিজের পরিচয় দিলেন। বললেন, “আমার নাম অজিত দাশ। কলকাতায় ইউপিআই-এর ব্যুরাে চীফ। কিছুক্ষণ আগে টোকিও অফিস থেকে আপনার সম্পর্কে ম্যাসেজ পেয়েছি। পার্ক সার্কাসে জাস্টিস মাসুদের কাছে খুঁজতে গিয়েছিলাম। শেষে অধ্যাপক ইউসুফ আলীর অফিসে আপনাদের খবর পেলাম। এরপর বহু খুঁজে এই ফোন নম্বর সংগ্রহ করেছি তা মশায়, হােটেল থেকে লড়বেন না। একেবারে তৈরি হয়ে থাকবেন। চমৎকার একটা ফ্ল্যাটে আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করেছি। সেখানে কোন ফার্নিচার নেই। মেঝেতেই শুতে হবে। তবে কোন ভাড়া লাগবে না।” সেদিনই বিকাল তিনটা নাগাদ আমরা দু’টা ফ্যামেলি এসে উঠলাম বালীগঞ্জ সার্কুলার রােডে ট্রিভলী কোর্টের একটা আধুনিক ফ্ল্যাটে তবে একটা কঠিন শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। এই ফ্ল্যাটে কোন রান্না করা যাবে না। তাই তিন বেলা খাবার পার্ক সার্কাসের ফুটপাতের দোকান থেকে আনার ব্যবস্থা হলাে। দায়িত্বে আমার চৌদ্ধ বছরের কিশাের সন্তান এদিকে নতুন আস্তানায় মালপত্র ওঠাবার সঙ্গে সঙ্গে অজিত দা বললেন, “আখতার সাহেব, চলুন এখন গ্র্যান্ড হােটেলে ইউপিআই-এর সিঙ্গাপুরের ব্যুরাে চীফ প্যাট কিলেন আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”
অজিতদা’র ফিয়াট গাড়িতেই গ্র্যান্ড-এ গেলাম। এই মার্কিনী সাংবাদিক প্যাটু আমার পূর্ব পরিচিত। পূর্ব বাংলায় সত্তরের সাইক্লোনের সময় দু’জনে নােয়াখালীর চর জব্বার, চর বাট্টা এলাকায় রিপাের্ট সংগ্রহ করেছি। আবার দেখা হলাে কলকাতার গ্র্যান্ড হােটেলে। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে উষ্ণ করমর্দন করলেন। বিপদের দিনে এই মার্কিনী সাংবাদিকের ব্যবহার আমাকে বিমুগ্ধ করলাে। বললেন, “আখতার, তুমি যখন ফ্যামিলি নিয়ে এসেছ, তখন তােমার কোন চিন্তাই নেই। ইউপিআইতে তুমি চাকরি ‘কটিনিউ’ করবে। তােমার কাজ হচ্ছে মুজিবনগর সরকার, মুক্তিবাহিনী আর বাংলাদেশের শরণার্থী সম্পর্কে খবর পাঠানাে । আর ক্যালকাটা ব্যুরাে থেকে তুমি বেতন নিবে। আমি লিখিতভাবে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি।” বিকালের নাস্তা খাওয়ার পর প্যাটু আমার চার চারটা ইন্টারভিউ’ টেপ রেকর্ডারে টেপ করলাে। সবই পাকিস্তানী আর্মি ক্র্যাক ডাউনের’ ঘটনাবলী সম্পর্কিত আমিই হচ্ছি ঢাকার প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক যে সপরিবারে প্রায় পৌনে দু ‘শ’ মাইল অতিক্রম করে ভারতে পৌছেছি রাত আটটায় প্যাট-এর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় আমার হাতে এক হাজার ভারতীয় টাকা দিয়ে বললেন, “তােমার স্পেশাল ইন্টারভিউ-এর জন্য কিছু পারিশ্রমিক দিলাম।” আমি হতবাক হয়ে রইলাম। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে দু’টো ঘটনায় দেশ-বিদেশে দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলাে। প্রথমত ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের মাটিতে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথপুর গ্রামের এক আম্রকাননে বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। আর দ্বিতীয়ত দিল্লীস্থ পাকিস্তানী হাই কমিশনের বাঙালী কূটনীতিবিদ কে এম শিহাবুদ্দীন আহম্মদ এবং আমজাদুল হকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কলকাতায় ডেপুটি হাই কমিশনার হােসেন আলীসহ ৭২ জন বাঙালী কূটনীতিবিদ ও অন্য পদের কর্মচারীদের একযােগে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ। সাংবাদিক হিসাবে অজিত দা’ ও আমার ব্যস্ততা খুবই বেড়ে গেলাে ।
দু’জনে দিনভর নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম সংবাদ সংগ্রহের আশায়। এসব জায়গার মধ্যে পার্ক সার্কাসে হাইকমিশন ও বালু হক্কাক লেনে ‘জয় বাংলা’ অফিস এবং আকাশ বাণী সল্ট লেকের শরণার্থী শিবির’, আর আনন্দ বাজার পত্রিকা অফিস ছিল অন্যতম। এরপর সন্ধ্যা নাগাদ ১নং চৌরঙ্গী টেরাসের তিন তলায় ইউপিআই অফিসে বসে প্রেস টেলিগ্রাম তৈরি করে পাঠানাে ছিল আমাদের রােজকার রুটিন। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ ‘জয় বাংলা’ অফিসে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদের এ মর্মে নির্দেশ এলাে যে, মুজিবনগর সরকারের নিজস্ব বেতার কেন্দ্র চালু করতে হবে। ইতােমধ্যেই একট ৫০ কিলােওয়াট ট্রান্সমিটার সংগ্রহ করে তা মুর্শিদাবাদ রাজশাহী সীমান্তে বসানাে হয়েছে। এখন শুধু অনুষ্ঠান তৈরি এবং সেসব রেকর্ডিং করা। পরিচিত মহলের সর্বত্র দারুণ উত্তেজনা। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত এমএনএ অ্যাডভােকেট আব্দুল মান্নানের ওপর সবচেয়ে লক্ষণীয় এই যে, এ সময় কলকাতায় অবস্থানকারী প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাদের বেতারের অনুষ্ঠান প্রণয়ন এবং পরিচালনা সম্পর্কে কিছুটা পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল, তাঁরা এই শক্তিশালী গণমাধ্যমকে করায়ত্ত করার লক্ষ্যে বেশ ক’টা শর্ত জুড়ে দিল। অন্যথায় সহযােগিতা করা সম্ভব নয় এ সময় শিল্পী কামরুল হাসান, চলচ্চিত্র পরিচালক আব্দুল জব্বার খান, রাজনীতিবিদ্ জিল্লুর রহমান ও আবুল খায়ের (ফরিদপুর), সাংবাদিক মােহাম্মদুল্লাহ আর আমি একযােগে মান্নান ভাইকে সাহস দিলাম। সবাই মিলে একই কথা বললাম, যুদ্ধের সময় বেতারের মতাে শক্তিশালী গণমাধ্যমের নীতি নির্ধারণ ও অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব কিছুতেই অন্য কোন গােষ্ঠীর হাতে ছেড়ে দেয়া বাঞ্ছনীয় হবে না। এতেই কাজ হলাে। বাংলা ১৩৭৮ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ, ইংরেজী ১৯৭১ সালের ২৪ মে রােজ মঙ্গলবার ঠিক সকাল ৭টায় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলার আকাশে ইথার তরঙ্গে ভেসে এলাে এক নতুন বেতার কেন্দ্রের সঙ্কেত ধ্বনি । যন্ত্রসঙ্গীতে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়।’ এর পরেই গুরুগম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারিত হলাে- ‘আস্সালামু আলাইকুম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।’
সূত্রঃ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা – এম আর আখতার মুকুল