আসলে অখণ্ড পাকিস্তানের (১৯৪৭-১৯৭১) মূল সমস্যাই ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সংখ্যাধিক্য জনগােষ্ঠী। এ সময় পাকিস্তানের মােট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগের বসবাস ছিল পূর্ববঙ্গে এবং ৪৪ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলােতে। ফলে করাচীইসলামাবাদের অবাঙালী শাসকগােষ্ঠীর পক্ষে একটা গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করা এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হয়নি। বরং ২৩ বছর ধরে কিভাবে সংখ্যাধিক্য পূর্ববঙ্গকে দাবিয়ে রাখা যায়, একটার পর একটা তারই ষড়যন্ত্র হয়েছে। প্রথমে পূর্ববঙ্গকে দ্বিধাবিভক্ত করার লক্ষ্যে ইংরেজ আমলের পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্র হয়েছিল এখানেই শেষ নয়। সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে “সংখ্যাসাম্য” নামে এক অদ্ভুত নীতি গ্রহণের ষড়যন্ত্র ও হয়েছিল এতে কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হলাে যে, “মুসলমান-মুসলমান ভাই ভাই। অতএব পূর্ববঙ্গকে ৫৬ ভাগের ৬ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম ভাইদের জন্য ত্যাগ করতে হবে তাতে সংসদে পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিত্ব হ্রাস পেয়ে দাঁড়াবে শতকরা ৫০ ভাগ। অন্যদিকে সেই ৬ ভাগ গিয়ে যােগ হবে পশ্চিম পাকিস্তানের হিস্যায় এতে সংসদে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব দাঁড়াবে ৪৪ + ৬ = ৫০ ভাগে। এটাই হচ্ছে “সংখ্যাসাম্য” প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাসাম্য বিষয়টি হচ্ছে সম্পূর্ণ গণতন্ত্রবিরােধী কিন্তু পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, এতসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকেই ছিল প্রতিবাদমুখর প্রথমে পঞ্চাশ দশকে ভাসানী-মুজিবের নেতৃত্বে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন এবং এরপর ষাট দশকে শুধুমাত্র মুজিবের নেতৃত্বে ৬ দফার। দাবিতে রক্তাক্ত আন্দোলন এর সাক্ষ্য বহন করে। ফলে অখণ্ড পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর পক্ষে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে দুই দশক সময়ে একটা সংবিধান প্রণয়ন সম্ভব। হয়নি। এমনকি জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি করেও এর কোন সুরাহা হয়নি।
বরং বুমেরাং হয়েছে। শেষ অবধি ৬ দফা দাবি এবং তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের আন্দোলন চরম আকার ধারণপূর্বক গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হলে, ডিক্টেটর আইয়ুব খানকেই পদত্যাগ করতে হয়। এবার ক্ষমতায় এলেন জঙ্গী। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। আবার সেই সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্ন কেননা একটা গ্রহণযােগ্য সংবিধান ছাড়া কোন রাষ্ট্র চলতে পারে না। অতএব ইয়াহিয়া খান এক্ষেত্রে নতুন করে উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে তিনি এ মর্মে ঘােষণা দিলেন যে, “এক মাথা এক ভােটের ভিত্তিতে ৩০০ সদস্যবিশিষ্ট গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পরে পরােক্ষ ভােটে আরও ১৩ জন মহিলা নির্বাচিত হবেন। রাজনৈতিক মহলের মতে, সেদিন এই একটিমাত্র ঘােষণায় অখণ্ড পাকিস্তানে রাজনৈতিক মঞ্চের আমূল পরিবর্তন সাধিত হলাে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রস্তাবিত গণপরিষদে পূর্ববঙ্গের হিস্যা দাঁড়াল ১৬২ + ৭ = একুনে ১৬৯ আসন। আর পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ১৩৮ + ৭ =১৪৫টি; অর্থাৎ প্রস্তাবিত গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়ােজন হলাে ১৫৭টি আসনের। এ সময় আওয়ামী লীগের বাঙালী জাতীয়তাবাদ এবং ৬ দফা শ্লোগানের মােকাবিলায় “ইসলাম বিপন্ন” প্রভৃতি স্লোগান উচ্চারণ করে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ৫ দলীয় “ইসলাম পছন্দ গােষ্ঠী”। এছাড়া মার্কসিস্টরাও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়েছিল। ন্যাপ-মােজাফফর ও কমিউনিস্ট পার্টি সম্মিলিতভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে ৪০টি এবং প্রাদেশিক পরিষদে ১০০টি আসনে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭০ সালে সামরিক প্রহরায় অনুষ্ঠিত নির্বাচন অন্তে দেখা গেল যে, প্রস্তাবিত জাতীয় পরিষদে প্রতিক্রিয়াশীল “ইসলাম পছন্দ গােষ্ঠী” এবং মার্কসিস্টরা কোন আসনেই বিজয় লাভ করতে পারেনি। তখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের শক্তি হচ্ছে ১৬০ + ৭ = একুনে ১৬৭টি আসন; অর্থাৎ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ফলে ভুট্টোর সমর্থনপুষ্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তার সামনে তখন ভয়ঙ্কর সমস্যা। জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রকাশ্যেই বললেন যে, আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করায় প্রস্তাবিত গণপরিষদ কসাইখানায় পরিণত হয়েছে। তাই গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই প্রস্তাবিত সংবিধান সম্পর্কে একটা ফয়সালা করতে হবে। আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির মধ্যে “সংসদের বাইরে বৈঠক করে প্রস্তাবিত সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করে সেটাকেই সংসদে পাস করাতে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কথা হচ্ছে, তা কেন হবে? গণতন্ত্রের মূলনীতি অনুসারে সংসদই হচ্ছে সর্বেসর্বা। তাই সংসদের ফ্লোরেই সংবিধান প্রণীত হবে। আর যেহেতু আওয়ামী লীগ ৬ দফা নির্বাচনী ওয়াদা দিয়ে জয়লাভ করেছে এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে, সেহেতু প্রস্তাবিত সংবিধান রচিত হবে ৬ দফার ভিত্তিতে, ৬-দফার প্রশ্নে কোন রকম আপােস সম্ভব নয়।
এরই প্রেক্ষাপটে এ সময় উভয় পক্ষের রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলাে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। একদিকে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর শক্তি হচ্ছে, অবাঙালী শােষকগােষ্ঠী ও পাকিস্তানের সশস্ত্রবাহিনী এবং অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর শক্তি হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগােষ্ঠী এবং নির্বাচনী ফলাফল। অবস্থাদৃষ্টে একথা বলা যায় যে, ঠিক এমনি এক সময়ে পাকিস্তানী সামরিক জান্তাই প্রথমে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলাে। ভুট্টোর পরামর্শে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বেতার মারফত এক ঘােষণায় ঢাকায় আহূত ৩ মার্চের সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিলেন। প্রতিবাদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পূর্ব বাংলার জীবনযাত্রা অচল হয়ে গেল। পরিস্থিতির মােকাবিলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক হরতালের প্রােগ্রাম দিলেন। তিনি জানালেন যে, আগামী ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় পরবর্তী কর্মসূচী ঘােষণা করা হবে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে জঙ্গী সরকার প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি করল।
ফলে ঢাকা ছাড়া প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষুব্ধ জনতা ও পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর মধ্যে শুরু হলাে রক্তাক্ত সংঘর্ষ । এবার বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতালের আহ্বান জানালেন। “জয় বাংলা” ধ্বনিতে তখন আকাশ-বতাস মুখরিত। চারদিকে উচ্চারিত স্লোগান হচ্ছে, “বীর বাঙালী অস্ত্র ধরাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করাে।” এরপর দিন কয়েক ধরে রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং সৈন্যবাহিনী ও জনতার মধ্যে অব্যাহত সংঘর্ষ উল্লেখযােগ্য ঘটনার মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস, বিভিন্ন জায়গায় সশস্ত্র বিহারী কর্তৃক বাঙালীদের বসতি আক্রমণ এবং নয়া গভর্নর হিসাবে জেনারেল টিক্কা খানের নিয়ােগ। এরপর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তার ঐতিহাসিক ভাষণে সমগ্র বাঙালী জনগােষ্ঠীকে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানালেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বললেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবাে, তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বাে ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
এরপরই বঙ্গবন্ধু এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। সংখ্যাগুরু আওয়ামী লীগ দলের নির্বাচিত নেতা হিসাবে তিনি অসহযােগ আন্দোলনের আহ্বান জানালেন। পার্টির সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের মাধ্যমে দু’বারে ঘােষণা করলেন ৩৪ দফা কর্মসূচী। ফলে প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই পূর্ব বাংলার বেসামরিক প্রশাসন পরিচালিত হতে শুরু করল। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। প্রথমে জঙ্গী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও কিছুসংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ এবং পরে জুলফিকার আলী ভুট্টো সাঙ্গোপাঙ্গসহ ঢাকায় এলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলােচনার জন্য কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুব রহমান তার ৬দফা দাবি থেকে বিচ্যুত হলেন না। এক পর্যায়ে আলােচনা। অসম্পূর্ণ রেখেই জঙ্গী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় গােপনে করাচীতে ভেগে গেলেন। তবে ঢাকা ত্যাগের মুহূর্তে বেপরােয়াভাবে বাঙালী হত্যার দলিল “অপারেশন সার্চ লাইট”- এ দস্তখত করে গেলেন। ২৫ মার্চ রাত দশটা নাগাদ ঢাকা, চট্টগাম, সৈয়দপুরসহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান দখলদার বাহিনী বেপরােয়াভাবে নিরীহ বাঙালী নিধনে মেতে উঠলাে সমগ্র সভ্য জগৎ হলাে স্তম্ভিত।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ছিল দারুণ ঘটনাবহুল জঙ্গী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পরামর্শদাতারা পঁচিশে মার্চ অপরাহ্নের মুলতবি বৈঠকে অনুপস্থিত হলে বঙ্গবন্ধু সামরিক জান্তার চালাকি বুঝতে পারলেন। নানা সূত্র থেকে প্রাপ্ত খবরের ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সেদিন বিকাল থেকেই তিনি বাঙালী জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল নেতা-কর্মী এবং বুদ্ধিজীবীদের অনতিবিলম্বে আত্মগােপন আর সশস্ত্র লড়াই। সংগঠনের উপদেশ দিলেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে সীমান্ত অতিক্রম করে প্রবাসী সরকার গঠন ও স্বাধীনতাযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। বারবার করে এ কথাটিই স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, আমরাই হচ্ছি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং গণহত্যার মােকাবিলায় আমাদের সশস্ত্র লড়াইয়ের অধিকার রয়েছে। আওয়ামী লীগ পার্টির সহকর্মীদের আরও জানালেন যে, ঢাকাবাসীকে রেখে তার পক্ষে আত্মগােপন করা সম্ভব হবে না।
কেননা সেক্ষেত্রে পাকিস্তানী দখলদার সৈন্যরা ঢাকা নগরীতে নাজী জার্মানির অনুরূপ হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রাখবে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের জঙ্গী সরকারের এ মর্মে হিসাব ছিল যে, শেখ মুজিব যদি ৬ দফার প্রশ্নে আপােস না করেন, সেক্ষেত্রে সামরিক শক্তির দাপট প্রদর্শন করা হবেপ্রয়ােজনবােধে গণহত্যা। আর অপরিসীম রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বঙ্গবন্ধুর স্থির। বিশ্বাস ছিল যে, বাঙালী জনগােষ্ঠী যেখানে চরম আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে, তখন এরা শুধুমাত্র নেতার নির্দেশ ও দিকনির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে। সেক্ষেত্রে ৬ দফার প্রশ্নে কোন আপােসের প্রশ্নই ওঠে না। ৬ দফা থেকে একদফা অর্থাৎ পূর্ব বাংলার। স্বাধীনতার সময় সমাগত। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে তিনি যে ধাপে ধাপে রাজনীতি করেছেন, তারই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে গেছে। কোন রকম হটকারিতা হবে আত্মঘাতী। তবে চূড়ান্তভাবে প্রথম আঘাতটা শত্রুপক্ষ থেকে হলে তা হবে লাভজনক। সেক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক বিশ্বের নৈতিক ও সক্রিয় সমর্থন হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি। অন্যদিকে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর এ মর্মে ধারণা ছিল যে, পূর্ব বাংলায় বেপরােয়াভাবে গণহত্যা এবং ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বরে ‘আর্মি এ্যাকশন’ করে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
কিন্তু বাস্তবে তা হলাে না। প্রতিটি জেলায় শুরু হলাে প্রতিরােধ লড়াই। ২৬ মার্চের ঘটনাবলী সম্পর্কে পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক রবার্ট পেইনের সাড়া জাগানাে ‘ম্যাসাকার’ (ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড) গ্রন্থে বেশ কিছু বিবরণ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, মাঝ রাত নাগাদ মুজিব বুঝতে পারলেন যে, ঘটনার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। তার ফোনটা অবিরাম বেজে চলেছে। পাশাপাশি কামানের গােলার আওয়াজ শােনা যাচ্ছে, আর দূর থেকে চিল্কারের শব্দ ভেসে আসছে। তিনি বুঝতে পারলেন যে, পিলখানায় ইপিআর-এর ব্যারাকগুলাে এবং রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার। আক্রান্ত হয়েছে। এর একমাত্র অর্থ হচ্ছে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে বাঙালী সশস্ত্র বাহিনীর ঘাটিগুলাে নিশ্চিহ্ন করতে বদ্ধপরিকর। তাই ২৬ মার্চ রাতেই তিনি দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। সর্বত্র বেতারযােগে পাঠাবার জন্য ঢাকার সেন্ট্রাল টেলিগ্রাম অফিসে টেলিফোনে নিম্নোক্ত বাণীটি পাঠাবার জন্য ডিকটেশন দিলেন ? “THE PAKISTAN ARMY HAS ATTACKED POLICE LINES AT RAJARBAGH AND EAST PAKISTAN RIFLES HEAD QUARTERS AT PILKHANA AT MIDNIGHT STOP GATHER STRENGTH TO RESIST AND PREMPARE FOR A WAR OF INDEPENDENCE.” (“পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী মাঝ রাতে রাজারবাগে পুলিশ লাইন এবং পিলখানায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এর হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করেছে। সর্বাত্মক প্রতিরােধের লক্ষ্যে এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য শক্তি সঞ্চয় করুন।) ম্যাসাকার’ ঃ রবার্ট পেইন, পৃষ্ঠা ২৪ : দি ম্যাকমিলান কোম্পানি, নিউইয়র্ক।
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানের কাছে এই বাণী। যথাসময়ে পৌছেছিল। তবে এখানে লক্ষণীয় যে, সংখ্যাগুরু আওয়ামী লীগ দলের নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার এই বাণী যখন চট্টগ্রাম পৌছল, তখন রাত ১২টা বেজে গেছে। অর্থাৎ ইংরেজী ক্যালেন্ডারের তারিখ পরিবর্তন হয়ে ২৬ মার্চ। এজন্যই ২৬ মার্চ হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। সেদিন ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাটস্থ “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে এই হান্নান সাহেব সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর প্রেরিত স্বাধীনতা ঘােষণার বাণী পাঠ করলেন। বাংলায় অনুবাদ পাঠ করলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দীপ। একই বেতার কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে দ্বিতীয় দফায় স্বাধীনতার বাণী পাঠ করলেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান আরও একদিন পরে। সেদিনের তারিখটা ছিল ২৭ মার্চ। ইংরেজীতে প্রদত্ত। ANNOUNCEMENT-a foA OCTA” “…. ON BEHALF OF OUR GREAT LEADER, THE SUPREME COMMANDER OF BANGLADESH SHEIKH MUJIBUR RAHMAN, WE HEREBY PROCLAIM THE INDEPENDENCE OF BANGLADESH AND THAT THE GOVERNMENT HEADED BY SHEIKH MUJIBUR RAHMAN HAS ALREADY BEEN FORMED. IT IS FURTHER PROCLAIMED THAT SHEIKH MUJIBUR RAHMAN IS THE SOLE LEADER OF THE ELECTED REPRESENTATIVES OF 75 MILLION PEOPLE OF BANGLADESH AND THE GOVERNMENT HEADED BY HIM IS THE ONLY LEGITIMATE GOVERNMENT OF THE PEOPLE OF THE INDEPENDENT SOVEREIGN STATE OF BANGLADESH….”
বঙ্গানুবাদঃ “আমাদের মহান নেতা এবং বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করলাম। ইতােমধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটা সরকার গঠন করা হয়েছে। এ মর্মে আরও ঘােষণা করা হচ্ছে যে, শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগােষ্ঠীর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একমাত্র নেতা এবং তার নেতৃত্বে গঠিত সরকার হচ্ছে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জনগণের একমাত্র আইনসম্মত সরকার । ১৯৭১ সালের সম্পূর্ণ মার্চ এবং এপ্রিল মাস ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ইতিহাসে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতাে আওয়ামী লীগ এবং প্রগতিশীল দলগুলাের নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা ছাড়াও বিপুলসংখ্যক সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারী, পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবী সীমান্ত অতিক্রম করা সত্ত্বেও রাজনীতিবিদদের মধ্যে ডঃ কামাল হােসেন এবং ওবায়দুল্লাহ মজুমদার জনাকয়েক ভিন্ন ধরনের ভূমিকা পালন করেছেন। এদের মধ্যে যুদ্ধকালীন সময়ে ওবায়দুল্লাহ সাহেব ইয়াহিয়ার তাবেদার ডাঃ মালেক মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন। আর মুজিবনগরে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ডঃ কামাল হােসেন পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। এ ধরনের এক চাঞ্চল্যকর প্রেক্ষাপটে আমরা ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় অবলােকন করলাম। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত সংখ্যাগুরু দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে স্বাধীনতা ঘােষণার মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে নিম্নোক্তভাবে গঠিত হলাে প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। এটি ছিল নিম্নরূপ :
১. রাষ্ট্রপতি ও সুপ্রীম কমান্ডার ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তানের কারাগারে আটক)
২.উপ-রাষ্ট্রপতি এবং অস্থায়ী ও সুপ্রীম কমান্ডারের দায়িত্বে : সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
৩. প্রধানমন্ত্রী ও তাজউদ্দীন আহমদ
৪. অর্থমন্ত্রী ও এম মনসুর আলী
৫. স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান
৬. পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী : খন্দকার মােশতাক আহমদ
৭. প্রধান সেনাপতি ঃ কর্নেল (অবঃ) এম এ জি ওসমানী
৮, চীফ অফ ষ্টাফ ঃ কর্ণেল (অবঃ) আব্দুর রব।
৯, বিমানবাহিনী প্রধান ও উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার এই প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হলাে ৯ মাসব্যাপী সফল স্বাধীনতাযুদ্ধ। চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় ৯১,৫৪৯ জন পরাজিত পাকিস্তানী সৈন্যের পক্ষে আত্মসমর্পণের দলিলে দস্তখত করল লেঃ জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় হলাে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বিজয়ী নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এলেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। তা হলে দেখা যাচ্ছে যে, দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে যে আন্দোলনের রাজনীতি করেছিলেন এবং ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগুরু আওয়ামী লীগ দলের নেতা হিসাবে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর বেপরােয়া গণহত্যার মােকাবিলায় পঁচিশে মার্চ দিবাগত রাতে তিনি বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন এবং তাঁরই নির্দেশিত পথে সফলভাবে যে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, সেই ফসল হচ্ছে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই আজ ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের বার্ষিকীতে- ‘হে মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব, লহ সালাম’।
সূত্রঃ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা – এম আর আখতার মুকুল