You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.12.15 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | চা রপ্তানিতে ঘাটতি | এ সময় বেড়াল পোষা কি সম্ভব? | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৫ই ডিসেম্বর, রোববার, ২৯শে অগ্রহায়ন, ১৩৮১

চা রপ্তানিতে ঘাটতি

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান দ্রব্য চা। প্রতিবছর চা রপ্তানি করে আমরা এক উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকি। বিদেশে বাংলাদেশের চায়ের চাহিদাও প্রচুর। গতকাল প্রকাশিত বাংলার বাণীর বিশেষ খবরে জানা গেছে, এবার ৫০ লাখ পাউন্ডেরও বেশি পরিমাণ চা রপ্তানি করা সম্ভব হয়নি। গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত যে পরিমাণ চা রপ্তানি করা হয়েছিল সেই তুলনায় এবারের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৫০ লাখ ৪৫ হাজার ৩২৩ পাউন্ড চা কম রপ্তানি হয়েছে। গতবছরের উল্লেখিত ৭ মাস সময়ের মধ্যে দুই কোটি ৩৩ লাখ ৪৯ হাজার ৬২০ পাউন্ড চা বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছিল, সে ক্ষেত্রে বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবরেই সাত মাসের মধ্যে রপ্তানি করা হয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ ৪ হাজার ২৯৩ পাউন্ড। অক্টোবর মাস চা রপ্তানির মৌসুম। গত বছর অক্টোবর মাসে যে পরিমাণ চাল রপ্তানি করা হয়েছিল সেই তুলনায় এবারের অক্টোবরের ১৩ লাখ ৯৩ হাজার ৪৩৬ পাউন্ড চা কম রপ্তানি হয়েছে। গত চার বছরের তুলনায় এ বছর আমাদের চা উৎপাদন হয়েছে সবচেয়ে বেশি। অথচ সে তুলনায় এবার এই আমাদের রপ্তানির পরিমাণ কম। গত বছর মোট চা উৎপন্ন হয়েছিল পাঁচ কোটি ১০ লাখ ২৯ হাজার ৫৫২ পাউন্ড। আর এবার হয়েছে ৫ কোটি ৮৩ লাখ ১০ হাজার পাউন্ড। কর্তৃপক্ষ আশা পোষণ করেছিলেন এবার তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণ চা রপ্তানি হবে। কিন্তু তা হয়নি। জানা গেছে, চা রপ্তানির জন্য যে প্যাকেট বা বান্ডিলের প্রয়োজন হয় তা সময়মতো সরবরাহ করা হয়নি এবং অফিশিয়াল ঘাপলার দরুন রপ্তানি ত্বরান্বিত করা সম্ভব হয়নি। বস্তুতঃ চা রপ্তানিতে বিরাট পরিমাণ ঘাটতি আমাদের আর্থিক জীবনের দারুন বিপর্যয় আরও তীব্র করে তুলবে। ৫০ লাখ পাউন্ডের ও বেশি পরিমাণ চা রপ্তানি না হওয়ার পেছনে প্রাকৃতিক কোনো কারণ নেই। নিতান্তই কৃত্রিম কারণ এর জন্য দায়ী। আর সেই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে আমাদের কতৃপক্ষেরই অদূরদর্শী ও দায়িত্বহীন কাজকর্মের জন্য। সময়মত চা রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় বান্ডিল এর অভাবে যদি রপ্তানি ব্যাহত হয়ে থাকে তার জন্য অবশ্যই কর্তৃপক্ষ দায়ী। কচি পক্ষের এই দায়িত্বহীনতার খেসারত গোটা জাতিকে দিতে হবে। উল্লেখিত বিরাট পরিমাণ চা রপ্তানি করতে না পারার রপ্তানি বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেবে তার দরুন বৈদেশিক মুদ্রার নিদারুণ সংকট আরো তীব্র হয়ে উঠছে। বিদেশের সঙ্গে এ পর্যন্ত বাণিজ্য খাতে যে সকল দ্রব্য আমরা রপ্তানি করার জন্য বিভিন্ন সময় চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম তাঁর অধিকাংশই আমরা সময়মতো বা চুক্তি মোতাবেক রপ্তানি করতে পারিনি। বরাবর আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে ঘাটতি হয়েছে। ১৯৭২-৭৩ সালেও আমরা চুক্তি মোতাবেক পাট রপ্তানি করতে পারিনি। ভারতের সঙ্গে যে সকল বাণিজ্যিক চুক্তি হয়েছিল তাও রক্ষা করতে পারিনি। ঠিক একইভাবে ১৯৭৩-৭৪ সালেও আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য ঘাটতি থেকে গেছে। চুক্তি মোতাবেক কোন দ্রব্য আমরা রপ্তানি করতে পারিনি। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের সঙ্গে চুক্তিতে স্থির হয়েছিল যে, ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত একে অপরের নিকট ৩০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করবে। কিন্তু এ বছরের সেপ্টেম্বরের মাস পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশের মাত্র ১২ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে মাত্র ৬ কোটি টাকার মূল্যের পণ্য বিক্রি করেছে। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের এটাই হল আসল চেহারা। সরকারের আরো দক্ষতা নিয়ে এবং বাস্তব পরিকল্পনা নিয়ে রপ্তানির লক্ষ্য পূরণের জন্য এগিয়ে আসা উচিত। দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার যে নিদারুণ অভাব রয়েছে তার মোকাবিলার জন্য রপ্তানি বাণিজ্যের লক্ষ্য পূরণ করা কতৃপক্ষের অপরিহার্য কাজ। চা রপ্তানিতে এই ঘরটির পেছনে যথার্থ অর্থ কি কি পরিস্থিতি এবং সংকট সমূহ ক্রিয়াশীল রয়েছে তাও কতৃপক্ষের খুঁজে বের করে রপ্তানির লক্ষ্য পূরণের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

এ সময় বেড়াল পোষা কি সম্ভব?

সমগ্র ঢাকা শহরে এখন অস্বাভাবিক লবণ আতঙ্ক বিরাজ করছে। আধাপোয়া লবণ সংগ্রহের জন্য হন্যে হয়ে যে মানুষকে একসময় এ গলি সে গলি, এ বাজার সে বাজার দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা গেছে, সে মানুষকে লবণ দিয়ে রান্না করা সুস্বাদু তরকারি শাকসবজির নির্বিচারে আস্তাকুড়ে বিসর্জন দিতে দেখা গেছে গতকাল এবং তা সম্পূর্ণভাবে প্রাণের মায়ায়। অথচ লবণ না হলে কারও একটা দিনও চলে না এবং গতকাল এমনও হয়েছে দুপুরে খাওয়ার জন্য সকাল বেলার রান্না তরকারির হাড়িটা মাটিতে ঠেলে দেয়ার পর আবার রাতের বেলায় খোদা ভরসা করে বাজার থেকে কিনে আনা ওই একই লবণ দিয়ে পারিবারিক রান্নাবান্না ও ভোজন পর্ব সমাধা করতে হয়েছে। কারণ,লবণ না হলে কারো চলে না বলেই এই বাংলাদেশে এক মণ ধানের বিনিময় কৃষককে লবণ কিনতে হয়েছে, এবং সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারছে একশ্রেণীর অধিক মুনাফাখোর ব্যবসাদার।
গতপরশু ভেজালকর্মে খ্যাত জিঞ্জিরাতে এক এটাক নূতন সাবাড় করেছে সাতটি তরতাজা প্রাণ। আরো দুজন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা কষে চলেছে। বলাবাহুল্য, এ খবরটি সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় গতকাল প্রকাশিত হবার পরেই শহরে অস্বাভাবিক লবণাতঙ্ক নেমে আসে। অথচ এই আতঙ্ক কে সামনে রেখে প্রতিটি পরিবারকে বাজারের লবণ গলাধঃকরণ করতে হচ্ছে। রেশনের কার্ড প্রতি লবণ সরবরাহের পরিমাণ হল আধাপোয়া এবং কারো পরিবারের লোক সংখ্যা ১০ হলেও সর্বাধিক একসের লবন দেয়ার স্বতঃসিদ্ধ নিয়মের মারপ্যাঁচে বড় বড় পরিবারগুলোকে সপ্তাহের অর্ধেকটা সময় খোলা বাজারের লবণের উপর নির্ভর করতে হয়। এ তো গেল বিধিবদ্ধ রেশনিং এলাকার কথা। সারা দেশের শতকরা ৯০ ভাগ লোকও রেশনিং এলাকায় বাস করে না। এবার তাদের কথা ভাবা যাক। খোলাবাজারে অন্যান্য প্রতিটি জিনিসের মত ভেজাল মেশানো লবণও দেশের মানুষ চেখে চলেছে প্রতিনিয়ত। অথচ এই জিনিসটিতেই ভেজাল দেয়া সোজা। ধুলাবালি, কাঁচের গুড়া আর সার! ইউরিয়া কিংবা এমোনিয়া ত সোনায় সোহাগা! ১২ ছটাক সার আর ৪ ছটাক নুনের একসের লবণ এই সস্তার (!) বাজারে তড়িঘড়ি করে ৬ টাকা থেকে ৮ টাকায় বিক্রি করা যাবে। এবং আমাদের মুশকিল হয়েছে ওইখানেই। বাছারা যত ভেজাল মেশাক, ট্যাক থেকে নগদ পয়সা ঢেলে হাসিমুখে মৃত্যুবাণ অঞ্জলি ভরে বাড়িতে নিয়ে আসতে হয় রোজ। খোদ ঢাকা শহরে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের পনেরোটা করে বেওয়ারিশ লাশ দাফনের খবরের শীতল হয়ে যাওয়া অনুভূতিতে জিঞ্জিরায় সার মেশান নূন খেয়ে সাত জনের অকাল মৃত্যু সংবাদে আমাদের ততটা বিচলিত না হবারই কথা। তবে অসুবিধাটা হলো মাঝেমধ্যে থেকে থেকে হঠাৎ করে ‘ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’ নামক আশ্বাসবাণী শুনলেই আমরা নগরবাসী বা দেশবাসীর যেনো খানিকটা সম্ভাবনার স্বর্ণ পাথর বাকির লোভে চমকিত হই। কিন্তু না। বাছাধনেরা ঠিক ঠিক মতোই নাগালের বাইরে চলে যায়। খাদ্যে ভেজাল দেয়ার দায়ে কারো গুরুতর শাস্তি হয়েছে তেমন সুসংবাদ বড় একটা শোনা যায় না।
সুতরাং খাদ্যে ভেজাল হচ্ছেই এবং পরশুর সাতজন বা পুরনো ঢাকায় সপ্তাহ খানেক আগে বিষাক্ত নূন খেয়ে আরও দু’জনের মৃত্যু; এটা ঘটবেই। এখন দেশবাসী কি ঘরে ঘরে মার্জার পালন করবে? খেতে বসার আগে প্রতি তরকারি থেকে একটু একটু নিয়ে ভাত মেখে আগে মার্জার সেবা ঘন্টাখানেক দেখার পর আপন জঠরাগ্নি নিবারণ। কিন্তু তা কি সম্ভব, বিশেষতঃ এই দুর্মূল্যের বাজারে? আপন শিশুর মুখে দু’বেলা অন্ন জোগাতে যেখানে প্রাণান্ত; খাবারের ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য একটা চতুষ্পদ প্রাণী কে অল্প দিয়ে প্রতিপালন করা কি সেখানে সহজ কথা? আর শখ করে সে বিড়াল পোষার যুগ কি আছে? তাহলে ভেজালে ভেজালে আমরা কি মরে যাব?

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন