ঘাতকের মানসিকতা ও বুদ্ধিজীবী হত্যা
মমাদের শিক্ষক শওকত ওসমানের রসবােধ নিয়ে খ্যাতির অন্ত ছিল না। রসসৃষ্টির এই প্রবণতায় তিনি কোনাে সীমারেখা টানতে চাইতেন না। তাই শিষ্যের সঙ্গে আদিরস ভাগ করে নিতেও তাঁর আপনি হতাে না। তিনি যথাযথ প্রসঙ্গক্রমেই বলতেন যে, এভরি হাট ওয়াজ এ ভার্জিন ওয়ান্স। কথাটা হালকা-চালে বলা হলেও এর গূঢ় তাৎপর্য মােটেই উপেক্ষণীয় নয়। মানুষ জীবনে যে পরিণতিই অর্জন করুক, তার যাত্রা শুরু হয় অমিত সম্ভাবনা নিয়ে। এই সত্যটি মনে রাখলে নৃশংস ঘাতকের মানসিকতা বিবেচনার প্রশ্ন আমাদের কাছে বিশেষ জটিল হয়ে ওঠে। মানুষ ঘাতক হয়ে জন্মায় না, মানুষকে ঘাতক করে তােলা হয় এবং এই প্রক্রিয়াটি যখন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিক রূপ গ্রহণ করে তখন আমরা দেখি হত্যা পায় সংগঠিত রূপ এবং পরিণত হতে পারে ভয়ঙ্কর গণহত্যায়। এই যে বিশেষ এক গােষ্ঠীকে মানবহত্যায় অবতীর্ণ হওয়ার মতাে মানসিকতায় সংগঠিত করা যায় এটা একটি আদর্শগত প্রক্রিয়া কিংবা বলা যায় আদর্শকে অবলম্বন করে অন্ধতা সৃষ্টির প্রক্রিয়া। গণহত্যার পেছনে সংঘবদ্ধ গােষ্ঠী সক্রিয় থাকলেও এই হত্যাকাণ্ড প্রায় স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে সচেতনভাবে অনেকের সম্মিলিত অথচ পৃথক পৃথক একক সিদ্ধান্তে পরিচালিত হয়। তাই গণহত্যার ঘাতকদের আমরা শনাক্ত করতে পারি, যদিও অনেক ক্ষেত্রেই তারা থেকে যায় প্রচলিত আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে বস্তুত আইন এখনও গণহত্যার বিচার সাধনের মতাে ভিত্তি অর্জন করে উঠতে পারে নি এবং বিশ শতকের ইতিহাসের প্রধান গণহত্যাসমূহের খতিয়ান নিলে আমরা দেখবাে গণহত্যাকারীরা আইনের দীর্ঘ হাতের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। বিশ শতকের ইতিহাসে গণহত্যার ঘটনা অনেক ঘটেছে, কিন্তু গণহত্যাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে দোষীদের বিচার করার প্রথম উদ্যোগ আমরা দেখি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর গঠিত আন্তর্জাতিক আদালত নুরেমবার্গ ও টোকিও বিচারশালায়, যথাক্রমে জার্মান ও জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রয়াসে।
এই প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক ফাক রয়ে গিয়েছিল এবং অচিরেই বিশ্ব যুদ্ধ উত্তর রাজনীতিক ও মতাদর্শগত বিরােধ নৈতিক মানবিক বিবেচনাসমূহ আচ্ছন্ন করে ফেলে। জাপান পশ্চিমা পুঁজিবাদী শক্তির ঘনিষ্ঠ সহযােগী হয়ে ওঠায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদনকারী চীনের নানকিংয়ে সংঘটিত গণহত্যার বিচার তাে হলােই না, এই গণনিধনকে বিস্মৃতির আড়ালে ঠেলে দেয়া হলাে। নানা ঘাতপ্রতিঘাতের পর প্রায় পঞ্চাশ বছর বিরতির পর বিরতির পর আবারও শুরু হয় গণহত্যার বিচার রুয়ান্ডায় সংঘটিত গণহত্যার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে এবং এই প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে। এরপর পূর্বতন যুগােশ্লাভিয়ায় সংঘটিত গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচারশালা প্রতিষ্ঠা করা হয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্বারা। গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ আইনগতভাবে রােধ করার লক্ষ্যে বিশ্বসমাজের ক্রমবর্ধমান সচেতনতার প্রকাশ ঘটে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল কোর্ট প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে, যা এখনও গঠনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং শক্তিধর দেশগুলাের প্রবল বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ বিচারের আইনগত ভিত্তি গড়ে তােলার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা অচিরেই চোরাস্রোতে হারিয়ে যায়। কিন্তু ইতিহাসের সেই ছিন্নসূত্র আবার নতুন করে গ্রন্থনার প্রয়াস লক্ষ্য করা গেল শতাব্দীর বিদায় লগ্নে এসে। তবে বিলম্বিত এই প্রক্রিয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুই বৃহত্তম গণহত্যা বাংলাদেশ ও কাম্বােডিয়ায় সত্তরের দশকে সংঘটিত গণহত্যা। কিন্তু আড়ালে চলে গেলেও ইতিহাস থেকে হারায় না কিছুই, থাকে কেবল উদ্ভাসনের অপেক্ষায়, প্রত্নতাত্ত্বিক যেমন মাটি খুঁড়ে বের করে আনেন। বিস্মৃত নগরী, কোনাে দূর-অতীতের মানুষের জীবনযাত্রার কাহন, সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনার কথা, তেমনিভাবে পর্দার অন্তরালে অপেক্ষায় থাকে ইতিহাসের সত্য। আর বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম, সে তাে এখনও ইতিহাসের অন্তর্গত হয় নি, রয়ে গেছে প্রত্যক্ষদর্শীদের স্মৃতি ও ভাষ্যের আধারে, এই বাস্তবতা পরাক্রমী আন্তর্জাতিক ও বিভ্রান্ত জাতীয় রাজনীতির ডামাডােলে ধামাচাপা পড়েছে বটে; তবে সেই ইতিহাস তাে কিছুতেই মুছে যাওয়ার নয়। বাংলাদেশের গণহত্যায় নিহতজনের সংখ্যা নিয়ে কৌতুক করার প্রবণতা কোনাে কোনাে মহলে লক্ষ্য করা যায়।
বব ডিলানের গানের পঙক্তি টেনে তাদের জিজ্ঞাসা করা যায়, কতােটা সংখ্যা হলে তাকে আপনি গণহত্যা বলবেন? বাংলাদেশে গণহত্যার শিকার মানুষজনের সংখ্যার হিসেব নিয়ে সবাই একমত হবেন না সেটা বােধগম্য; কিন্তু একাত্তরের নয়মাস দেশজুড়ে যে গণহত্যা ঘটেছিল সেটা নিয়ে তাে কোনাে সংশয়ের অবকাশ নেই। বাংলাদেশে এমন কোনাে পরিবার পাওয়া যাবে না যাদের সম্প্রসারিত পারিবারিক পরিধিতে একাত্তরে শাহাদাত্বরণকারী কোনাে সদস্য নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনী যে বেসামরিক লোেকদের যথেচ্ছভাবে হত্যা করেছিল সেটা নিয়েও তাে সন্দেহ পােষণ করার কোনাে উপায় নেই। অর্থাৎ একটি সংগঠিত সামরিক বাহিনী বিশাল ভূখণ্ড জুড়ে দীর্ঘ নয় মাস নানাভাবে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করেছে। কোনাে দেশের সেনাবাহিনীকে দিয়ে সে দেশের সাধারণ নাগরিকদের ওপর এমনি হত্যাভিযান পরিচালনা সহজ নয়। হুকুম তালিমে সেনাবাহিনী যতাে পারঙ্গম হােক কেন, কেবল হুকুম দিয়ে এই কাজ হয় না। সেনাবাহিনীর গঠন ও আদর্শগত ভিত্তিতে বিকৃতির জন্ম নিলে সেই সেনাবাহিনীর দ্বারা এমন ঘৃণ্য কাজ সম্পাদন সম্ভব।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী কখনােই সর্ব-পাকিস্তানভিত্তিক বাহিনী ছিল না। যে বৈষম্য নিয়ে পূর্ববাংলার নাগরিকজনেরা ছিল সােচ্চার তার চরম প্রকাশ ছিল সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের উচ্চতর স্তর। এহেন গঠনকাঠামাে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাঙালিদের বিরুদ্ধে জাতিগত বৈরিতার আদর্শবাহী হওয়ার উপযােগী করে রেখেছিল। তদুপরি পঁচিশে মার্চের গণহত্যা ও বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ সূচিত হওয়ার পরপর সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের একাংশ তথা পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত প্রায় সর্বাংশ সদস্য বিদ্রোহ ঘােষণা করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত অবশিষ্টাংশকে সেনাবাহিনীতে ব্রাত্য করে রাখা হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরপর এদের পাইকারিভাবে আটক করার মধ্যেও সেনাবাহিনীর এই অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতির প্রকাশ ঘটে। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বস্তুত পাকিস্তানি ছিল না, ছিল এক কোটারির আধিপত্যাধীন মূলত পাঞ্জাবি বাহিনী, যার অফিসাররা ছিলেন ভূমিভিত্তিক অভিজাত শ্রেণী থেকে আগত এবং জওয়ানরা বংশানুক্রমে গ্রামের অভাবী প্রজাকুলের সন্তান। এই বিকৃত-গঠন সেনাবাহিনীকে গণহন্তারক বাহিনীতে রূপান্তর করা খুব কঠিন কাজ ছিল না। এহেন সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের মানসিকতার পরিচয় গ্রহণ করলে আমরা তাদের জাতিগত অজ্ঞতা, মূঢ়তা ও বৈরিতার গভীরতর নিদর্শন দেখতে পাই। বাঙালি জাতি সম্পর্কে যে চরম অবজ্ঞাসুলভ মনােভাব তারা লালন করতেন সেটা তাদের চেতনাগত কূপমণ্ডুকতার পরিচয়বহ।
এখানে লক্ষণীয়, যেকোনাে গণহত্যা পরিচালনাকালে গণহত্যাকারীদের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করি জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ এবং সেইসঙ্গে মিশে থাকে অপর জাতি, গােষ্ঠী কিংবা ধর্মের মানুষদের প্রতি ঘৃণা ও অবজ্ঞা। জার্মান জাতির আর্য রক্তের শ্রেষ্ঠত্ব এবং ইহুদী-বিদ্বেষ থেকে জন্ম নিয়েছিল নাৎসি বর্বরতা, পাকিস্তানেও তেমনিভাবে প্রচলিত ছিল বাঙালিদের প্রতি অবজ্ঞা, ঘৃণা ও অজ্ঞতা। পাকিস্তানের তথাকথিত লৌহমানব’ আইয়ুব খান তার আত্মজীবনীতে বাঙালিদের প্রতি যে অবজ্ঞা দেখিয়েছেন তা’ সুবিদিত। একাত্তরে পাকবাহিনীর নেতৃস্থানীয়দের বক্তব্য থেকেও একই মানসিকতার প্রকাশ খুঁজে পাওয়া যায়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, বুদ্ধিজীবী নিধনের যিনি প্রধান হােতা, তাঁর স্মৃগ্রিন্থে এমনি মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন বিভিন্নভাবে। মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খান স্বীয় বিকৃত চিন্তার পরিচয় দিয়ে লিখেছেন, “স্বাধীনতার সময় পূর্ববঙ্গের ১২৯০টি হাইস্কুল ও ৪৭টি কলেজের ৯৫ শতাংশই ছিল বেসরকারি এবং হিন্দুদের অর্থে পরিচালিত। নবীন প্রজন্মের যারা পাকিস্তানে বড় হচ্ছিল তারা এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তাে হিন্দু শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ভারতীয় পাঠ্যবই ব্যবহার করে।” পূর্বাঞ্চলে পাকবাহিনীর প্রধান জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজি আরাে এক কাঠি এগিয়ে লিখেছেন, “দেশভাগের সময় পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসরত হিন্দুদের বেশির ভাগই ভারতে চলে যায়। পূর্ব পাকিস্তানে এমনটা হয় নি। ধনী ও ক্ষমতাবান হিন্দুরা থেকে যায়। মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হিন্দু জমিদার ও ব্যবসায়ীদের অধীনস্থ ছিল। হিন্দুদের মধ্যে শিক্ষার প্রচলন বেশি থাকাতে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের বড় অংশ ছিল তারা। যুবকদের কাঁচা বয়সে, চিন্তাভাবনা প্রভাবিত করতে শিক্ষকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।” এই তিন গ্রন্থকারের বক্তব্য পাঠকালে স্মরণ রাখা দরকার যে, তারা সবাই একাত্তরের অনেক পরে নিজেদের সাফাই গাইবার জন্য গ্রন্থ রচনা করেছেন, ফলে ভাবনা অনেকটা শশাধিত হয়ে বইয়ে পরিবেশিত হয়েছে। এহেন শােধনের পরেও অজ্ঞতাপ্রসূত বিদ্বেষের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে শিহরিত না করে পারে না। বাঙালির জাতীয় চেতনার যে আকুতি ক্রমে শক্তি-সঞ্চয় করছিল সেজন্য দায়ী। যে প্রধানত হিন্দুরা সে বিষয়ে পাক সেনাপ্রধানদের মধ্যে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ ছিল না।
এই হিন্দুদের মধ্যে আবার অধিকতর অপরাধী হিন্দু শিক্ষকমণ্ডলী যারা মুসলমান শিক্ষার্থীদের মগজ ধােলাইয়ের কাজ করছে। এদের কারসাজিতে ইসলামের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ভাঙার যে ষড়যন্ত্র প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল তাকে ঠেকাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী চরম জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণায় জর্জরিত হয়ে তার প্রবল সংহার ক্ষমতা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র নিরপরাধ বাঙালি জনগােষ্ঠীর ওপর। তাদের আক্রোশের কেন্দ্রবিন্দু ছিল হিন্দু সম্প্রদায় এবং তাদের বিকৃত ও বুদ্ধিভ্রষ্ট বিবেচনায় হিন্দু শিক্ষককুল। পড়াশােনা, জ্ঞান আহরণ ও যৌক্তিক চিন্তার প্রতি বিদ্বেষ থেকেই জন্মেছে শিক্ষককুলের প্রতি ঘৃণা। এমনি বিকৃত মানস দ্বারা যারা প্রভাবিত তারা মুসলমান হতে পারে, তবে সে-কারণে তাদের অপরাধ কমে যায় না। পঁচিশে মার্চের গণহত্যার প্রধান লক্ষ্যের মধ্যে তাই ছিল বস্তিবাসী সাধারণ নিম্নবিত্ত বাঙালি সম্প্রদায় এবং ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত শিক্ষক ও দুটি ছাত্রাবাস জগন্নাথ হল ও ইকবাল হল। অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালিরা এই হত্যাযজ্ঞের লক্ষ্য হয়েছিল। এই যে সুপরিকল্পিত হত্যাভিযান তা’ যারা ঠাণ্ডা মাথায় প্রণয়ন করেছিলেন তাদের পক্ষে এটা সম্ভব হয়েছিল ধর্ম চেতনাভিত্তিক জাতিগত অন্ধতায় আচ্ছন্ন থাকার দরুণ।
যারা হত্যা করে তারা সেই ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডকে যৌক্তিক রূপ দিতে সবসময়ে উদগ্রীব থাকে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের হত্যাভিযানকে তাই অলিখিতভাবে ইসলাম তথা পাকিস্তান-রক্ষার ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং ডেভিড রাসৃফিল্ড যেমন ইরাক যুদ্ধের সূচনায় প্রবল শক্তিমান শক অ্যান্ড অ’ দিয়ে যুদ্ধে বাজিমাৎ করতে চেয়েছিলেন তেমনি পাকবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট’ আক্রমণ-অভিযান পরিচালনা করে ভেবেছিল তাদের কর্তৃত্ব পুনপ্রতিষ্ঠিত হলাে। বাঙালির প্রতিরােধ সংগ্রামের মুখে তাদের সেই আশা দুরাশায় পরিণত হলে শুরু হয় সেনাশক্তি বাড়িয়ে দেশের সর্বত্র কর্তৃত্ব কায়েমের চেষ্টা। এক্ষেত্রে চলে অপারেশনের পরবর্তী পর্যায়, সেনাবাহিনীর ‘সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয়’ অভিযান, যা মৃত্যুমিছিলকে দেশের। আনাচে-কানাচে সম্প্রসারিত করে। যে সেনাবাহিনী ঢাকা থেকে সমস্ত বিদেশি। সাংবাদিকদের বিতাড়ন করে পঁচিশে মার্চের গণহত্যা ঘটিয়েছিল তারা যখন সমস্ত প্রকার আন্তর্জাতিক নজরদারির বাইরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হানা দিলাে তখন। যথেচ্ছ হত্যা ও অত্যাচার করার ক্ষেত্রে তাদের ওপর কোনাে বাধা ছিল না। একমাত্র যে বাধা থাকতে পারতাে তা ছিল স্ব-আরােপিত বাধা, অর্থাৎ সেনাবাহিনীর নৈতিকতা উদ্ভূত নিয়ম-নীতির বাধা; কিন্তু অমুসলিম ও মন্দ মুসলিমদের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে ‘খাঁটি’ ইসলাম রক্ষার অভিযানে নেমেছে যে সেনাবাহিনী তাদের কাছে সেই ধরনের বাধার কোনাে অবকাশ ছিল না। এর ফলে। একাত্তরের নয় মাস জুড়ে গােটা বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল বধ্যভূমি এবং মৃত্যুর মিছিল ছিল অন্তহীন।
বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাথমিক প্রতিরােধ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। পাকিস্তানের কাঠামাে ভেঙে বেরিয়ে আসা সেনাসদস্য, সীমান্ত রক্ষীদল, পুলিশ ইত্যাদি সশস্ত্র সংগঠিত গােষ্ঠী যে যেখানে যেভাবে পারে বিচ্ছিন্নভাবে সামরিক প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিল। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ব্যাপকতম সক্রিয় জনসমর্থন। এই প্রতিরােধ ভেঙে অগ্রসর হতে উন্নত সমরাস্ত্রে সজ্জিত সংগঠিত পাকিস্তানি বাহিনীর বেগ পেতে। হয়েছিল বটে, তবে জুন মাসের মধ্যে তারা কাজটি মােটামুটি সম্পন্ন করেছিল এবং সারা দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী প্রতিপক্ষ কোনাে সেনাবাহিনীর মুখখামুখি হয় নি, তারা নিষ্ঠুরভাবে ঝাপিয়ে পড়েছিল বিশাল এক বেসামরিক জনগগাষ্ঠীর ওপর। তবে এই অভিযান তথা হত্যাযজ্ঞ সীমিত ছিল সুনির্দিষ্ট কতক এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ছাউনি শহর এবং সড়ক ও নদী যােগাযােগের পথ জুড়ে চলে নিষ্ঠুরতার প্রথম পর্ব। মােটামুটিভাবে বলা চলে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকে হত্যালীলার এই প্যাটার্ন। দ্বিতীয় পর্যায়ে জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চলে ‘সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয়’ অপারেশন, সারা দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও তা বজায় রাখার সামরিক তৎপরতা। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছিল বাঙালির সশস্ত্র প্রতিরােধের দ্বিতীয় পর্যায়। দেশ থেকে বিতাড়িত রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব প্রতিবেশি ভারতে আশ্রয় নিয়ে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে শুরু করে।
পাকিস্তানি বাহিনী বিশেষ তৎপর থাকে মুক্তাঞ্চল সৃষ্টি প্রতিরােধ করা এবং প্রতিটি সীমান্ত চৌকি রক্ষায়। ফলে পাকবাহিনী দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে এবং খোজ ও খতম করাের প্রক্রিয়া ব্যাপক হয়ে ওঠে। এই কাজে পাকবাহিনী তাদের দোসর হিসেবে গড়ে তােলে রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনী এবং স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে ওহাবী-পন্থী জঙ্গি ও হিংস্র ক্ষুদ্র এক রাজনৈতিক গােষ্ঠী দখলদার পাকবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে সামরিক বাহিনীর সহযােগী হিসেবে গঠন করে আল বদর গােষ্ঠী। রাজাকার ও মুজাহিদদের মূলত রিক্রুট করা হয় সমাজের নিম্নবর্গের লুম্পেনদের কাতার থেকে, পক্ষান্তরে আল-বদর সদস্যরা ছিল শিক্ষিত তরুণদের সেই ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে আগত যারা মতান্ধতা ও ধর্মান্ধতার কারণে গােটা জাতির মুক্তিসগ্রামের বিরুদ্ধতা করেছিল। ‘সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয়’ অপারেশন বাস্তবে কি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা বয়ে এনেছিল সেটা বােঝার জন্য পাকিস্তানি সমর-ইতিহাসবিদ মেজর জেনারেল শওকত রিজার ‘পাকিস্তান আর্মি : সিক্সটি-ফাইভ টু সেভেন্টি ওয়ান’ গ্রন্থ থেকে একটি উদ্ধৃতি দেয়া যায়। তিনি লিখেছেন : “অপরিচিত ও বৈরী বিশাল এলাকা জুড়ে আমাদের সৈন্যদের ছড়িয়ে দেয়ার ফলে (তাদের মধ্যে) এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা জন্ম নিয়েছিল। স্থানীয় জনসাধারণ আমাদের এই ভয়ে আরাে ইন্ধন যুগিয়েছিল। আমাদের দুর্গতির মধ্যে প্রতিটি গুজবই আমরা সঠিক বলে মেনে নিয়েছিলাম এবং এই মানসিক আলােড়ন পথ খুঁজে পেয়েছিল সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় অভিযানে।” শওকত রিজা বাকবিভূতির মাধ্যমে সার্চ আন্ড ডেস্ট্রয়ের নিষ্ঠুরতার একটি বিশ্লেষণ দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছেন এরপর তিনি লিখেছেন : “জুন মাস থেকে পাকবাহিনী ভূতের পেছনে ছােটা শুরু করেছিল।
ব্যাটালিয়ন কিংবা উচ্চতর হেডকোয়ার্টারে খবর আসতাে মুক্তিবাহিনীর জড়াে হওয়া কিংবা আসন্ন আক্রমণ সম্পর্কে এইসব খবর উপেক্ষা করলে আমাদের মুখরক্ষা হবে না, কিংবা স্থানীয় মানুষজনের আস্থা আমরা হারাববা অথবা মুক্তিবাহিনীকে উৎসাহিত করা হবে। অথবা অলীকের পিছুতাড়া করতে আমাদের সৈন্য প্রেরণ করতে হবে কিংবা হয়তাে সৈন্যদের মুক্তিবাহিনীর অ্যাম্বুশের জাতাকলে পাঠিয়ে দেয়া হবে। ভয় থেকে উদ্ভূত হয়েছিল সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় অভিযান। ক্লান্ত ও অতিরিক্ত টানটান বাহিনীকে দিনের পর দিন পাঠানাে হয়েছে বিষাক্ত প্রাণী অধ্যুষিত ঘন সবুজ ঝোপে-জঙ্গলে। প্রতিটি ঝোপ, প্রতিটি কুঁড়েঘর, প্রতিটি সচল বস্ত্র ছিল সন্দেহের বস্তু। ইস্টার্ন কম্যান্ড এমন এক দানবকে বাঁচা-ছাড়া করেছিল যাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কারাে ছিল না।” এই শেষ বাক্যে পাকিস্তানি জেনারেল স্বীকৃতি প্রদান করেছেন গণহত্যার সাংগঠনিক ভিত্তির। তবে তখনও নিষ্ঠুরতার আরাে এক কৃষ্ণ অধ্যায় বাকি ছিল, যেটা ঘটেছিল যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে নভেম্বরের শেষাশেষি থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীকে সরাসরি সহায়তা প্রদান করতে আরম্ভ করে এবং অনেক সীমান্ত চৌকি পাকিস্তানিদের জন্য ভিপি বা ভানরাবেল পয়েন্ট হয়ে ওঠে, এবং তা পরিত্যক্ত হয়। দেশের ভেতরেও মুক্তাঞ্চলের পরিসর বাড়তে থাকে। ৩ ডিসেম্বর থেকে ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয়। বাহিনীর যৌথ অভিযানের সামনে পাকবাহিনীর প্রতিরােধ তাসের ঘরের মতাে লুটিয়ে পড়তে থাকে ৯ ডিসেম্বর থেকেই ইস্টার্ন কম্যান্ড আত্মসমর্পণের পথ। খুঁজতে শুরু করে। সামরিক নেতৃত্ব ভালােভাবে বুঝেছিল তাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে যুদ্ধ করার মতাে বীরত্ব-শৌর্য তাদের ছিল না, মুখে যতাে ইসলামের কথা বলুক না কেন। দীর্ঘ নয় মাস রক্তের হােলি খেলায় যারা মেতে ছিল তারা ততদিন আর মানুষ পদবাচ্য ছিল না।
মুক্তিকামী বাঙালিদের বিরুদ্ধে তাদের অন্তরে যে বিষ সঞ্চিত হয়েছিল, বাঙালি জাতিকে যে অন্ধতা নিয়ে তারা বিচার করেছিল সেই। মূঢ়তার হাতে নিষ্ঠুর অস্ত্র হিসেবে উঠে এসেছিল আল বদর বাহিনী হিন্দু শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা পাকিস্তানি সামরিক কম্যান্ডের মধ্যে সহজাত সেই একই মানসিকতার সম্প্রসারিত রূপ হয়ে উঠেছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রতি ঘৃণা ৯ এবং ১০ ডিসেম্বর পিলখানার ইপিআর হেডকোয়ার্টারে ইস্টার্ন কম্যান্ডের উচ্চ পর্যায়ের সভায় যে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়টি আলােচিত হয়েছে সেটা ফারমান আলী কিংবা নিয়াজির লেখা কিংবা হামিদুর রহমান কমিশন রিপাের্ট থেকে জানা যায়। লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি, মেজর জেনারেল ফারমান আলী এবং মেজর জেনারেল জামশেদ গােয়েন্দা সংস্থার সরবরাহকৃত নামের ব্যক্তিদের। সম্পর্কে যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ নিয়ে আলােচনা করেন। আলােচনায় কে কি বললেন এবং কি সিদ্ধান্ত হলাে সে-বিষয়ে অবশ্য তারা পরস্পরবিরােধী বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন এবং নিজেদের সাফাই গেয়ে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়েছেন তবে ৯ এবং ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি কম্যান্ড সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রসঙ্গ আলােচনা করেছেন এবং এই আলােচনার সঙ্গে গােয়েন্দা সংস্থা তথা আল বদরদের যে যােগ ছিল সেটা পাকিস্তানি জেনারেলরা তাদের বক্তব্যে নির্দ্বিধায় কবুল করেছেন।
এরপর ১৪ ডিসেম্বর সংঘটিত হলাে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি এবং বিশ শতকের ইতিহাসের এক নির্মমতম ও পাশবিক হত্যাকাণ্ড এই হত্যাকাণ্ড ঘটানাে হয়েছে হিংস্র এক ইসলামী মতাদর্শের নামে, যে মতাদর্শের সঙ্গে শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামের কোনাে সম্পর্ক নেই এই বর্বরতার সংগঠক পাকিস্তানি জেনারেলদের আমরা চিনতে পেরেছি; কিন্তু তাদের। সহযােগী কসাই হিসেবে কারা কারা কাজ করেছে সেই নামগুলাের কতক জানা গেলেও অনেকেই রয়ে গেছে আড়ালে, অনেকে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে আড়াল তৈরি। করে নিয়েছে। তবে এটা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় কোন্ মতাদর্শ থেকে এমন। ঘৃণ্য বর্বরতা জন্ম নিয়েছে। ধর্মের বিকৃত ব্যবহার ঘটিয়ে যে নিষ্ঠুরতার জন্ম দেয়া হয়েছিল তার স্বরূপ বােঝাটা তাই সবিশেষ গুরুত্ববহ। গণহত্যার সংগঠনকাঠামাে জানবার মতােই গুরুত্বপূর্ণ গণহত্যার মানসিকতা বোঝা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার বর্বরতা তাই দাবি করে ব্যাপক বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা কেননা ঘাতকতৈরিতে যারা ধর্মকে ব্যবহার করেছে তারা তাে এখনও সক্রিয়।
সূত্রঃ জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয় – মফিদুল হক