You dont have javascript enabled! Please enable it! ধর্ষণ-একাত্তর ও সুজান ব্রাউনমিলার - সংগ্রামের নোটবুক
ধর্ষণ, একাত্তর ও সুজান ব্রাউনমিলার
নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ সুপ্রাচীন অপরাধ হলেও এটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ যে এই সমস্যা সরাসরি মােকাবিলার প্রবণতা একান্ত হালের। ‘ ‘ঘটনা সমাজে পুরুষের যে আধিপত্য যুগ যুগ ধরে চলে আসছে সেটা নারীর ওপর এক সার্বিক কর্তৃত্ব কায়েম করেছিল, নারীদেহের ওপর পুরুষের অধিকার ছিল তারই অনুষঙ্গ এমন দেখা গেছে গােত্রের সঙ্গে গােত্রের কিংবা রাজ্যে রাজ্যে যখন যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে বিজয়ী পক্ষ পরাজিতের সম্পদ লুণ্ঠন করবার সাথে সাথে পাইকারিভাবে নারীর সম্রমও হরণ করেছে এবং এসব ইতিহাসের স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
উনিশ শতকের বিশ্বে নারী মুক্তির প্রয়াস যখন দেখা দিতে থাকে তখন নারীর অধিকারের মৌলিক কতক দাবি প্রধান হয়ে উঠেছিল, তবে তখনও ধর্ষণ বিষয়টি বরাবরের মতাে কারপেটের নিচে ঠেলে দেয়া ছিল। আইনের শাসনের বিকাশের ফলে ধর্ষণ বিষয়টি বিচারের এখতিয়ারভুক্ত হয় ঠিকই, কিন্তু ফৌজদারি দণ্ডবিধি অনুযায়ী ধর্ষণের অপরাধের প্রমাণ সাবুদ হাজির করা ধর্ষিতের পক্ষে এক অপমানজনক ও প্রায় অসম্ভব বিষয় হয়ে থাকে। এই অপরাধ যে নিছক আরেকটি ক্রিমিনাল অ্যাক্ট নয়, এর সঙ্গে যে সামাজিক বহুবিধ সংস্কার, দৃষ্টিভঙ্গি, রীতি-আচার ও ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে এবং এমনি অপরাধকে সমগ্রতার নিরিখে বিচার না করলে এর যথাযথ বিহিত করা দুষ্কর, সেই উপলব্ধি বিশেষ ছিল না। সমাজে ধর্ষণ নিয়ে আলােচনা কিংবা আলােচনার অনুপস্থিতিতে ঐতিহ্যের এক বিশাল প্রভাব রয়েছে। ধর্ষণকে জরায়ুর ওপর নারীর অধিকারের লংঘন হিসেবে উপস্থাপন না করে এক্ষেত্রে অপ্রত্যক্ষ ইঙ্গিতময় ভাষা হয়ে ওঠে সমাজের অবলম্বন। এহেন পরিস্থিতি যেমন আমাদের সমাজের জন্য ছিল সত্য, তেমনি ছিল বিশ্বসমাজের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। তাই আমরা দেখি ১৯৪৮ সালে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ অবসানের পর, জাতিসংঘ যখন সর্বসম্মতভাবে ‘জেনােসাইড কনভেনশন’ প্রণয়ন করে, তখন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে জনগােষ্ঠীর ওপর পরিচালিত হত্যা, পীড়ন, উত্থাত, বলপূর্বক শিশু অপহরণ ইত্যাদি নানা কিছু চিহ্নিত করা হলেও ধর্ষণের কোনাে উল্লেখ সেখানে ছিল না।
 
যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত নুরেমবার্গ ও টোকিওর আন্তর্জাতিক আদালতে উত্থাপিত অভিযােগ-নামায় ধর্ষণের বিষয়টি স্থান পায় নি। বহু পরে ১৯৯৮ সালে এসে জাতিসংঘের আওতায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট বা আইসিসি গঠিত হলে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে ধর্ষণকেও চিহ্নিত করা হয় এবং বলা হয়, ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, বাধ্যতামূলক যৌনবৃত্তিগ্রহণ, বাধ্যতামূলক গর্ভধারণ, জবরদস্তি তার সঙ্গে নিবীর্যকরণ ও অন্যান্য ধরনের গুরুতর যৌনজুলুমও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ধর্ষণ সম্পর্কে সামাজিক ধারণা ও অবস্থানে মােড় ফেরা সূচিত হয় বিশ শতকের ষাটের দশক থেকে এবং এর উৎসভূমি ছিল পশ্চিমা দুনিয়ায় বিশেষভাবে মার্কিন দেশে অগ্রণী নারীগােষ্ঠীর অবস্থান ও উচ্চারণ সেই আলােচনায় বিস্তারিতভাবে না গিয়ে আমরা কেবল এটুকু বলতে পারি পশ্চিম দুনিয়ায় তরুণ সমাজ ও নারীদের মধ্যে এক নতুন জাগরণ সূচিত হয়েছিল যার প্রকাশ ঘটেছিল ১৯৬৮ সালের যুব বিদ্রোহে এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধ-বিরােধী আন্দোলনে এই পরিস্থিতি প্রচলিত জড়বৎ মূল্যবােধের প্রত্যাখ্যান ঘটিয়ে সমাজের নবীন অংশের মধ্যে নানা জিজ্ঞাসা ও আলােড়ন জাগিয়েছিল। এর ফলে নারীবাদী চিন্তায় যে নতুন ঢেউ জাগে সেখানে অনেকগুলাে নাম বিশেষ পরিচিতি অর্জন করে, তাদের সামাজিক অবস্থান, আন্দোলন-সংগঠন এবং বইপত্র ম্যানিফেস্টো ভাবজগতে বিপুল প্রভাব সঞ্চার করে। এদের মধ্যে জেরমাইন গ্ৰীয়ার, কেট মিলেট, গ্লোরিয়া স্টেইনেম, বেটি ফ্রিডান প্রমুখ উল্লেখযােগ্য। এরই পাশাপাশি আমরা পাই সুজান ব্রাউনমিলারকে এবং তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অ্যাগেইন্সট আওয়ার উইল- মেন, উইমেন অ্যান্ড রেপ, ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত যে গ্রন্থ আলােড়ন তুলেছিল বিশ্বময় এবং ধর্ষণের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে বিশেষ অবদান রেখেছে সুজান ব্রাউনমিলার পরে যে আত্মস্মৃতি প্রকাশ করেছেন তা থেকে সেই সময়ের নারীমুক্তি আন্দোলন বিষয়ে আরাে কিছু কথা আমরা জানতে পারি।
 
রাজপথে নেমে আসা নবীন নারীরা বিভিন্নমুখী আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, এর একটি ছিল WAR বা Women against Rape গােষ্ঠী পরিচালিত কর্মকাণ্ড। তারা ১৯৭০ সালের আগস্টে নিউইয়র্কে প্রথম ধর্ষণ-বিরােধী সভার আয়ােজন করে। উদ্যোক্তারা। চেয়েছিলেন ধর্ষিত নারী তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা সভার সামনে মেলে ধরুক। প্রথমে তাদের মধ্যে দ্বিধা ছিল এমন নারী কতজন পাওয়া যাবে। পরে দেখা গেল সাদা-কালাে, ধনী-গরিব, উচ্চ পেশাদার থেকে সাধারণ নারী সমাজের সর্বস্তরে রয়েছে ধর্ষণের ঘটনা এবং এর ব্যাপ্তি বিশাল এই সময় থেকে ধর্ষণকে সামাজিক ও ঐতিহাসিক পটভূমিকায় বিশ্লেষণের তাগিদ বিস্তৃতি লাভ করে এবং সুজান ব্রাউনমিলার এ-বিষয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনায় বিশেষভাবে মননানিবেশ করেন। তার পাঁচ বছরের শ্রম ও সাধনার ফল হিসেবে ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয়। ‘অ্যাগেইন্সট আওয়ার উইল, যেখানে সুজান বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন যে, ধর্ষণ প্রসঙ্গটি কখনও সমাজবিজ্ঞানীদের বিশেষ মনােযােগ পায় নি। অবদমিত যৌন চেতনা ও সুপ্তচেতনা বিষয়ে তত্ত্ব দাঁড় করালেও সিগমন্ড ফ্রয়েড ধর্ষণ বিষয়ে কিছু লেখেন নি। মার্কস-এঙ্গেলসের বিশাল রচনায় সমাজের অনেক সমস্যার পেছনে ক্রিয়াশীল অর্থনৈতিক তত্ত্ব মেলে ধরা হয়েছে, সম্পত্তির অধিকার নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে, কিন্তু ধর্ষণ নিয়ে বিশেষ কিছু লেখা হয় নি। এঙ্গেলসের যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘পরিবার, ব্যক্তিমালিকানা ও রাষ্ট্রের উদ্ভব গ্রন্থেও প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয় নি। 
ধর্ষণকে বড় পটভূমিকায় বিচারের ক্ষেত্রে সুজান ব্রাউনমিলারের অবদান পর্যালােচনায় আমরা অগ্রসর হচ্ছি না, বরং দেখতে চাই তার গ্রন্থে বাংলাদেশে একাত্তর সালে নারী নির্যাতন কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সুজান ব্রাউনমিলার বােধ করি পথিকৃৎ পশ্চিমী নারী যার লেখায় একাত্তর সালে বাঙালি নারীর দুর্গতি গুরুত্ব সহকারে বিশ্লেষিত হয়েছে। এর একটি কারণ অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একদল নারী। সেই সময় ধর্ষণ বিষয়টি ঘিরে বিভিন্ন ধরনের সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেছিলেন এবং সমস্যার বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাইছিলেন এর মানসিক-ব্যক্তিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক পটভূমি। সুজান ব্রাউনমিলার তাঁর স্মৃগ্রিন্থে লিখেছেন, “১৯৭১ সালে বেশ কয়েকটি শহরে WAR বা উইমেন অ্যাগেইন্সট রেপ গােষ্ঠী গড়ে ওঠে। ডেট্রয়েটে ক্যাথি বেরি, জোয়ান পারেন্ট, কেট স্টাডলমান ও আরাে আটজন নারীবাদী মিলে প্রণয়ন করেন স্টপ রেপ নামক পঞ্চাশ-পৃষ্ঠার একটি হ্যান্ডবুক যেখানে সন্নিবেশিত হয়েছিল তত্ত্ব ও বাস্তব উপদেশ।

 
মিশিগানের উইমেন্স লিবারেশন গােষ্ঠী প্রতি কপি পঁচিশ সেন্ট হারে ডাকযােগে স্টপ রেপ বিক্রি করে, এক বছর পর এর চতুর্থ। মুদ্রণকালে দাম দাড়ায় ষাট সেন্ট। বােস্টনে ওয়ারিয়র অব সেল সিক্সটিন সংস্থা ধর্ষণ-বিরােধী আন্দোলনের সবচেয়ে প্রভাবশালী পােস্টার প্রকাশ করে যেখানে দেখা যায় একজন নগ্নপদ নারী হামলাকারী পুরুষের যৌনাঙ্গ লক্ষ্য করে কষে লাথি লাগিয়েছে এবং শ্লোগান ছিল ডিসাম। রেপিস্ট/স্ম্যাশ সেক্সিজম। ১৯৭২ সালের গােড়ায় দেশের রাজধানীতে একটি নতুন ধারণার জন্ম নেয় যখন সচেতনতা প্রসারক গােষ্ঠীর আট সদস্যা ধর্ষণের শিকার নারীদের সহায়তাদানের জন্য বিশেষ গােষ্ঠী গঠন করেন।” এমনি আরাে অনেক দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায় সুজান ব্রাউনমিলারের গ্রন্থ থেকে, তবে মূল কথা হলাে এক নতুন চেতনা ও আন্দোলন যখন দানা বাঁধছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তখন বাংলাদেশে চলছিল অসম এক লড়াই, দেশের মানুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিল যে পাক-সামরিকবাহিনী তারা হত্যা, লুট, অগ্নিসংযােগের সঙ্গে যথেচ্ছ ধর্ষণে মেতে উঠেছিল কিন্তু এইসব খবর তাে পত্রিকার পাতা বা টেলিভিশনের পর্দায় চকিত দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়, আর ধর্ষণ তাে উল্লেখ হয়  মাত্র, এর তাে কোনাে ছবি নেই, এর পেছনের বেদনার কাহিনীর তাে কোনাে প্রকাশ নেই।
তাহলে ধর্ষণ কীভাবে স্থান পাবে জনচিত্তে, এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল কীভাবে মােকাবিলা করবে সমাজ? মেন, উইমেন অ্যান্ড রেপ গ্রন্থ রচনার জন্য নিউইয়র্কের লাইব্রেরিতে বসে বইপত্র তথ্য ঘাটাঘাটির কাজ যখন করছেন সুজান ব্রাউনমিলার তখন, ১৯৭১ সালের ক্রিসমাস উৎসবের কয়েকদিন আগে, লস এঞ্জেলস টাইমসের একটি সিণ্ডিকেটভুক্ত সংবাদ বিবরণী তিনি পাঠ করেন নিউইয়র্ক পােস্ট পত্রিকায়। তিনি লিখেছেন, “রিপাের্টে বলা হয়, শেখ মুজিবর রহমানের বাংলাদেশ সরকার, পাকবাহিনীর হাতে বাংলাদেশের নারীদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার প্রেক্ষিতে, সকল ধর্ষিত নারীকে দেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধের বীরাঙ্গনা’ হিসেবে অভিহিত করেছে। বিবরণীর শেষ দিকে রয়েছে এমনি এক পীড়াদায়ক বাক্য, ‘ঐতিহ্যবাহী বাঙালি গ্রামসমাজ, যেখানে নারী অবগুণ্ঠিত জীবন যাপন করেন, ধর্ষণ-পীড়িতরা প্রায়শ সমাজচ্যুত বিবেচিত হন।” সুজান ব্রাউনমিলার জানাচ্ছেন, ক্রিসমাসের দুদিন পর সাংবাদিক জোশেফ ফ্রাইড কর্তৃক যশাের থেকে প্রেরিত এক বিবরণী নিউইয়র্ক ডেইলি নিউজ-এ প্রকাশিত হয়।
 
এতে শহরের পথে আবার মেয়েদের পদচারণার উল্লেখ করে ধর্ষণের ব্যাপকতার বিবরণ দেয়া হয়। এইসব সংবাদপাঠে বিচলিত সুজান আরাে খবরাখবর নেয়ার জন্য উদ্যোগী হন। তাঁর সেই অভিজ্ঞতা খুব সুখকর ছিল না। তিনি লিখেছেন, “অন্যান্য পত্রিকায় ছাপা খবরাখবর আমার হয়তাে চোখে পড়ে নি তেমন শঙ্কা থেকে আমি নিউইয়র্ক টাইমসের বৈদেশিক বিভাগে কর্মরত আমার এক বন্ধুকে ফোন করি। বাঙালি নারীদের ধর্ষণ?’ তিনি হাসলেন, আমার মনে হয় তেমন কিছু আমাদের নেই। বিষয়টা টাইমসের সংবাদ হওয়ার মতাে মনে হচ্ছে না।’ নিউজউইকে আরেক বন্ধুও ছিলেন একই ধরনের সংশয়পীড়িত। উভয়ে জানান তারা খেয়াল রাখবেন, কোনাে সংবাদ চোখে পড়লে আমাকে পাঠাবেন। আমি স্পষ্ট ধারণা পেলাম এই দুই পুরুষ, উভয়ে দক্ষ সাংবাদিক, ভেবেছে আমি কোনাে অবান্তর কাজে লিপ্ত হয়েছি, বারকিং আপ অ্যান অড ট্রি।” তবে সুজান ব্রাউনমিলার আগ্রহ হারান নি, তিনি তথ্য সগ্রহে লিপ্ত ছিলেন এবং জানিয়েছেন ১৯৭২ সালের জানুয়ারির মধ্যভাগে বিষয়টি গ্রহণযােগ্যতা পায় যখন ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চেস-এর একজন সচিব দুই সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ ঘুরে এসে জেনেভায় আয়ােজিত সংবাদ সম্মেলনে তার সরেজমিন অভিজ্ঞতা মেলে ধরেন। সুজানের গ্রন্থ থেকে আবারও উদ্ধৃতি দেয়া যায়, “রেভারেন্ড কেনটারাে বুমা জানান যে, নয় মাসের সংঘর্ষকালে দুই লক্ষেরও বেশি বাঙালি নারী ধর্ষিত হয়েছে পাকিস্তানি সৈনিকদের দ্বারা।
তিনি বলেন, হাজার হাজার নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে। এবং প্রচলিত রীতি অনুসারে, কোনাে মুসলমান তার স্ত্রীকে ঘরে ফিরিয়ে

নেবে না যে অপর পুরুষ দ্বারা লজ্জিত হয়েছে, তা যতাে জবরদস্তিতার কারণেই সেটা ঘটুক না কেন বুমা সাংবাদিকদের আরাে জানান যে, বাংলাদেশের নতুন সরকার এই ঐতিহ্য ভাঙার চেষ্টা করছে। তারা স্বামীদের বলছে এই নারীরা পরিস্থিতির শিকার এবং তাদের জাতীয় বীরাঙ্গনা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কোনাে কোনাে স্বামী স্ত্রীদের ফিরিয়ে নিয়েছেন, তবে এই সংখ্যা খুবই কম।” এই। খবর পৃথিবীর নানা দেশে প্রচার পায় এবং সমস্যার মােকাবিলায় অনেক সংগঠন। এগিয়ে আসে, যার মধ্যে ছিল আই পি পি এফ বা ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ড পেরেন্টহুড ফেডারেশন’ বাংলাদেশ সরকার এই সংস্থার প্রতি সহযােগিতার হাত বাড়ালে ধীরে ধীরে আরাে তথ্যপ্রমাণ উদঘাটিত হতে থাকে।
 
আইপিপিএফ যেসব। ডাক্তারদের পাঠিয়েছিল বাংলাদেশে তারা নারীদের দুর্গতির আরাে নানা দিক তুলে। ধরেন। নিউইয়র্ক টাইমসে সাক্ষাঙ্কারে এক ডাক্তার জানান যৌন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে নির্যাতীত অনেক নারী, “প্রায় সবাই কোনাে না কোনাে যৌন ব্যাধিতে ভুগছেন।” লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল অ্যাবরশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের ডা, জিওফ্রে ডেভিস কয়েক মাস যাবৎ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কাজ করেছেন। তিনি অগণিত আত্মহত্যার কথা শুনেছেন বলে জানিয়েছেন। ইদুরের নাশকপান ও পানিতে ডুবে মৃত্যু ছিল আত্মহননের দুই বহুল ব্যবহৃত উপায়। মাদার তেরেসার ক্যাথলিক কনভেন্ট ঢাকায় শিশুদের দত্তক নেয়ার ব্যবস্থা শুরু করে। সুজান ব্রাউনমিলার আরাে নানা উদ্যোগের বিবরণ দিয়েছেন। বাংলাদেশের। নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র তার বিশেষ মনােযােগ ও প্রশংসা অর্জন করেছে। তার ভাষায় এটা ছিল বীরােচিত প্রণােদনামূলক উদ্যোগ। তিনি আরাে লিখেছেন, “যে দেশে পেশাদার নারীর সংখ্যা খুব কম সেখানে যাদের এমনি। দক্ষতা রয়েছে তারা এগিয়ে এসেছেন সহায়তা প্রদানে। একজন ডাক্তার হেলেনা পাশা জানিয়েছেন যে, আগে তিনি ছিলেন গর্ভপাতের ঘােরতর বিরােধী, আর এখন । ধর্ষিত নারীদের গর্ভপাতের জন্য তিনি স্বেচ্ছায় শ্রম ও সময় দিয়ে চলেছেন।
নারী সমাজকর্মী তাহেরা শফিক সাংগঠনিক দায়িত্ব নিয়েছেন এবং ধর্ষিত হতবিহ্বল। নারীদের মানসিক নির্ভরতা যােগাতে সচেষ্ট রয়েছেন, যে-নির্ভরতা তারা পুরুষদের। কাছ থেকে পেতে পারে না।” সুজান ব্রাউনমিলারের গ্রন্থে বিশ শতকে যুদ্ধকালীন ধর্ষণের উদাহরণ হিসেবে। দুই বিশ্বযুদ্ধ, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের ঘটনা পর্যালােচনা করা হয়েছে। স্বল্পতম । সময়ে ব্যাপক ধর্ষণ হিসেবে একাত্তরের বাংলাদেশের বাস্তবতাকে তিনি চীনের। নানকিং-এ জাপানি পীড়নের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সবশেষে সুজান ব্রাউনমিলার লিখেছেন “বিশ্ব মানচিত্রের এক ধূসর কোণে এক ধূসর যুদ্ধ এভাবে, পশ্চিমের। চোখে, ‘অকথিত’ এক অপরাধ পর্যালােচনার পটভূমি তৈরি করে দেয়। সশস্ত্র পুরুষদের মুখােমুখি নিরস্ত্র নারীদের এই বিশেষ সন্ত্রাসের ভােগান্তি একবারের জন্য। হলেও একটি পূর্ণাঙ্গ শুনানি লাভ করলাে।”
বিশ্ব পটভূমিকায় যুদ্ধকালীন ধর্ষণের বিষয়টি বাংলাদেশ ঘিরে প্রথম বিবেচনা লাভ করেছিল ঠিকই এবং সুজান ব্রাউনমিলারদের মতাে নারীবাদী লেখকদের বিশ্ববীক্ষণ গড়তে তা সহায়ক হয়েছিল তবে সেই ধূসর প্রান্তের মানুষদের কাছে। তাদের নারীদের এই বিপুলা দুঃখভােগ ও পরবর্তী জীবনসাধনা, বিরূপ ভাগ্যের বিপক্ষে নিঃসঙ্গ সংগ্রাম, থেকে গেছে প্রায় সবরকম বিবেচনার বাইরে। আমাদের কাছে একাত্তরের নারী ধর্ষণ নিছক একটি সংখ্যা, সেই সংখ্যা নিয়েও আবার চলে নানা তর্ক-বিতর্ক, কিন্তু সংখ্যার পেছনের অগণিত মানুষের কাউকে আমরা বিশেষ | চিনি না, চেনার চেষ্টাও বিশেষ নেই নি। একাত্তরে পাকবাহিনী কৃত ধর্ষণের সমগ্র বাস্তবতা জানা এবং ধর্ষিত নারীদের বেদনা ও সংগ্রামের হদিশ না করতে পারলে আমাদের সমাজ মানবিক হয়ে উঠতে পারবে না। এই বিশাল কাজ এখনও আরব্ধ। রয়ে গেছে, বাংলামায়ের আঁখিজল মােছাতে হলে ধর্ষিত নারীর শুকিয়ে যাওয়া চোখের পানির নােনা স্বাদ সমাজকে গ্রহণ করতে হবে। কারা করবেন এই কাজ?
(পাক্ষিক অনন্যা, ডিসেম্বর ২০০৮)

সূত্রঃ  জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয় – মফিদুল হক