যুদ্ধাপরাধীর বিচার : ইতিহাসের সঙ্গে বােঝাপড়া
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিপুল রক্ত, আত্মদান ও ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হলেও এই অভ্যুদয়ের সত্য ইতিহাসে এখনও স্বতঃসিদ্ধ প্রতিষ্ঠা অর্জন করে নি। নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস-বিচারের কথা এখানে। হচ্ছে না। যারা ইতিহাসের কাটাকে অগ্রসর হতে দিতে নারাজ, যারা ক্ষমতা ও হিংস্র বলপ্রয়ােগ দ্বারা ইতিহাসের অগ্রগতিকে দমিত করতে উদগ্রীব, যারা ইতিহাসকে তাদের তাবেদার ও আজ্ঞাবহ রূপদানে ব্রতী তারা বাংলাদেশের অ্যুদয়কে তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যার বেড়াজালে অদ্যাবধি আটক করে রাখতে সচেষ্ট রয়েছে এবং বহু ক্ষেত্রে সক্ষমও হচ্ছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক অভ্যুদয় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হলেও এর যৌক্তিক অভ্যুদয় নিয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ এখনও রয়ে গেছে এর মূল কারণ স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে এই যৌক্তিক অভ্যুদয়ের নৈতিক পরিসমাপ্তি আমরা ঘটাতে পারি নি। আমরা বিচারানুষ্ঠান করে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তিবিধান করতে পারি নি। লক্ষ মানবের নিধন, কোটি মানবের বিতাড়ন ও অগণিত নারী ধর্ষণনিপীড়নের মতাে জঘন্য মানবতাবিরােধী অপকর্মের জন্য যারা দায়ী তাদের আমরা ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করানাে থেকে অব্যাহতি দিয়েছি এর ফল হিসেবে ইতিহাস বস্তুনিষ্ঠ ও সত্যনিষ্ঠ স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, বিকৃতির প্রয়াসগুলাে লাভ করেছে ইন্ধন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত বিবদমান গােষ্ঠীদ্বন্দ্ব অস্তিত্বমান করে তুলে একটি বড় গােষ্ঠী এখনও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধের বিরুদ্ধাচরণে সক্রিয় থাকতে পেরেছে। পরিণামে অতীতের সঙ্গে, ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের বােঝাপড়া অসম্পন্ন থেকে যাচ্ছে এবং মুক্তিযুদ্ধ যে জাতিকে ভবিষ্যত্মখী করে তুলবে সেই জাতি যেন আরাে বেশি করে অতীত নিয়ে বিতর্কজালে জর্জরিত থাকছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনায় পীড়িত এক বিশ্ব পটভূমিকায় গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিপুল গণরায়ে বিজিত পক্ষকে অস্ত্রের শক্তিতে নিশ্চিহ্ন করার বর্বর সামরিক অভিযান রুখে দাঁড়াবার প্রয়াস থেকে এর সূচনা। দানবের বিরুদ্ধে মানবের এই লড়াইয়ের ন্যায়-অন্যায় নিয়ে বিশ্ববাসীর খুব একটা সংশয় ছিল না। তদুপরি, লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী। রাজনৈতিক গােষ্ঠী ছিল একান্ত গণতন্ত্রমনা এবং ভােটের জোরেই তারা ক্ষমতার দাবিদার হয়েছিল। কোনাে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামী দল তারা ছিল না, যেমন ছিল তৎকালীন বিশ্বে ভিয়েতনামে, অথবা আফ্রিকার কতক পদানত রাষ্ট্রে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের দল।
ফলে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক শিবির বিভাজনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, মার্চের অসাধারণ অসহযােগ আন্দোলনের পর নৃশংস পাক-সামরিক হামলা মােকাবিলায় যা সশস্ত্র মুক্তি। সগ্রামের রূপ ধারণ করলাে, সেটা ছিল এক ব্যতিক্রমী মুক্তিসংগ্রাম। ব্যতিক্রমী এই অর্থে যে, জাতীয় অধিকার আদায়ে সংঘবদ্ধ জনগণ গণতান্ত্রিক পথেই লক্ষ্যে পৌছতে সচেষ্ট ছিল। তাদের নীতি ও লক্ষ্যমালায় মূল কতক শিল্প জাতীয়করণের কথা বলা হলেও প্রচলিত সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি সেটা ছিল না এবং সমাজতান্ত্রিক শিবিরভুক্ত আন্দোলনও ছিল না। অন্যদিকে পশ্চিমী ধাঁচের গণতন্ত্রের লক্ষ্যমালা অভীষ্ট হলেও কোনােভাবেই বাঙালির মুক্তি আকাক্ষা পশ্চিমী দেশের সরকারের আনুকূল্য লাভ করতে পারে নি। তকালীন উপমহাদেশের তথা এশিয়ার শক্তিভারসাম্যের রাজনীতিতে ভারতের বিপরীতে পাকিস্তানকে বড় অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী বিশ্ব। তাই নিজেরা গণতন্ত্রের পূজারী হলেও পাকিস্তানে সামরিক শাসন তাদের মন-পসন্দই ছিল। তাে এমনি পটভূমিকাতেই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম সশস্ত্র মুক্তিযুবে রূপ গ্রহণ করে বিশ্ব মানচিত্রে এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দিল, যে রাষ্ট্রের অভ্যুদয় মেনে নিতে রাজি ছিল না পশ্চিমী দুনিয়া ও আরব জগতের বহু দেশ। অন্যদিকে এই মুক্তিসংগ্রামকে প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে অচিরেই ব্যাপক সমর্থন যুগিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ সর্বোপরি এই মুক্তিসংগ্রামে ভারতের ত্যাগী ও সার্বিক সমর্থন এর বিজয় দ্রুততম সময়ে সম্ভব করে তুললাে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর উপনিবেশবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ছাড়া আর কোনাে নতুন রাষ্ট্রের জন্মকে সর্বতােভাবে নিরুৎসাহিত, এমন কি প্রতিহত করা হচ্ছিল।
রাষ্ট্রের সীমানা ও অস্তিত্ব অলংঘনীয় গণ্য করে কোনাে রাষ্ট্র ভেঙে নতুন রাষ্ট্র গড়া কেউ তখন অনুমোেদন করে নি। সাধারণভাবে এক্ষেত্রে মার্কিন-সােভিয়েত একটি পরােক্ষ মতৈক্য ছিল। এর ফলে শক্তি ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে পারমাণবিক উত্তেজনায় টানটান পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে উঠতে পারে এমন একটা ভয় সবার ছিল। আজকের সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিলােপ-পরবর্তী বিশ্ব পটভূমিকার সঙ্গে ঐ পরিস্থিতির কোনােই মিল নেই। এখন বরং যেসব রাষ্ট্রের ঐক্য নিয়ে টেনশন রয়েছে সেক্ষেত্রে বলপূর্বক ঐক্য বজায় রাখাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে আপােসে ভাগ হয়ে গেল চেকোশ্লোভাকিয়া, জন্ম নিল চেক প্রজাতন্ত্র ও শ্লোভাকিয়া বিশাল সােভিয়েত সম্রাজ্যের স্থলে কোনাে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছাড়াই জন্ম নিল একাধিক রাষ্ট্র। একেবারে হালে আন্তর্জাতিক তদারকিতেই বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের বুক চিরে জন্ম নিল পূর্ব তিমুর এবং এই রাষ্ট্র ভেঙে রাষ্ট্র গড়ায় মুসলিম বিশ্বে তেমন কোনাে উত্তেজনাই দেখা গেল না। অথচ একাত্তরে পরিবেশ পটভূমি ছিল কতই না আলাদা!
পরিস্থিতি যতাে বৈরীই হােক না কেন, বাংলাদেশের জনগণের রক্তাক্ত সম্রামের ফল হিসেবে বাঙালির স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের উদ্ভব কেউ ঠেকাতে পারে নি। কিন্তু বড় বেশি মূল্য দিতে হয়েছিল বাংলার জনগণকে এই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে। তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তধারা ইতিহাসের অন্যতম বর্বরতম ও জঘন্য গণহত্যার ইতিহাস তৈরি করেছিল বাংলার বুকে। পঁচিশে মার্চের রক্তখেলা দিয়ে যে হত্যাকাণ্ডের সূচনা হয়েছিল, ঘৃণ্যতম বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে তা পরিণতি পেয়েছিল। এইসব হত্যা ছিল সর্বাংশে বেসামরিক নাগরিকজনের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ। মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধের জন্য যারা দায়ী তাদের বিচার বাংলাদেশ করে উঠতে পারে নি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে জরুরি ও সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অসমাপ্ত অধ্যায় হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠান। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের মধ্যে গণহত্যার জন্য অভিযুক্তদের আলাদাভাবে বাছাই করেছিল। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নাজি যুদ্ধাপরাধী বিচারের জন্য আন্তর্জতিক নুরেমবার্গ আদালতের আদলে কোনাে কিছু করার মতাে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও অবস্থান বাংলাদেশের ছিল না। বাংলাদেশের প্রধান সমর্থক ভারত উপমহাদেশের শান্তি প্রক্রিয়ার স্বার্থে যুদ্ধাপরাধের ইস্যুটিকে বিস্মৃত হতে দ্বিধা করে নি। সিমলা চুক্তির বিনিময়ে যুদ্ধবন্দিদের প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া ভারত শুরু করে। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী কাজটি সম্পন্ন করার জন্য ভারতের ওপর চাপও ছিল যথেষ্ট। সমাজতান্ত্রিক শিবির এককভাবে এমন আন্তর্জাতিক আয়ােজন করার সামর্থ্য রাখে না, তেমন ইচ্ছাও তাদের ছিল না। উপমহাদেশের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিকীকরণ ছিল তাদের লক্ষ্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইস্ (ট্রাইবুনাল) অ্যাক্ট জারি করে সেই অনুযায়ী আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী বিচারের কাজটি সম্পাদনে আর এগােতেই পারে নি। এরপর তাে আসে সাধারণ ক্ষমার প্রশ্ন এইসব ঘটনাধারায় কাদের কেমন দায়িত্ব ছিল সে বিচারে না গিয়ে কেবল একটি বড় সত্যের দিকে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি।
তা হলাে সত্তরের দশক বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে একেবারেই অনুকূল ছিল না। তদুপরি ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর থেকে তাে ঘাতক-দালালরাই ক্ষমতার অংশী হয়ে উঠলাে, যুদ্ধাপরাধীর আর বিচার করবে কে? রাতারাতি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি মিললাে চীন ও অন্যান্য আরব দেশসমূহের কাছ থেকে। একটি নির্মম জাতীয় হত্যাকাণ্ড যে এরকম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির উৎস হতে পারে সেটা যেমন নির্দয় তেমনি রুচিহীন ঘটনা তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসেব-নিকেশ সবসময়েই খুব নিষ্ঠুর। আর নিষ্ঠুরতার অনুসারীদের কাছ থেকে মানবিক রুচিবােধ তাে খুব প্রত্যাশিত নয়। এই যে পার পেয়ে গেল বাংলাদেশের গণহত্যার জন্য দায়ী যুদ্ধাপরাধীরা, এর। ফলে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা সঠিক প্রতিফলন ও স্বীকৃতি অর্জন করতে পারে নি। আন্তর্জাতিক বিচার-বিশ্লেষণে বাংলাদেশের গণহত্যা ক্রমেই ধুলােচাপা পড়েছে এবং এর বিরােধী পক্ষ যেহেতু ছিল পরাক্রমশালী এবং সমর্থকপক্ষ সােভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শিবির বিশ্বরঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েছে, তাই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস সঠিক বিবেচনা-লাভে অসমর্থ হয়েছে। মার্কিন সাময়িকী ‘টাইম’শতাব্দীর রাজনীতি বিশ্লেষণকালে এশীয় নেতাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে উল্লেখে ব্যর্থ হলে সরকার ও দেশবাসীর মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চারণ আমরা লক্ষ্য করেছি। কিন্তু পাশাপাশি যে বিষয়টা কারাে নজরে পড়ে না, টাইম’ সাময়িকীর ঐ সংখ্যাতেই বিশ শতকের নির্মম গণহত্যার বিবরণ দিতে গিয়ে কাম্বােডিয়ার বিশদ উল্লেখ ঘটলেও বাংলাদেশ একেবারেই অনুল্লেখ্য থাকে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা কিংবা অন্যান্য আকর গ্রন্থে তাই।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে গৃহযুদ্ধের ফল হিসেবে উল্লেখ করা হয়। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পরিণতিতে নয়, ভারত-পাক যুদ্ধের ফলেই যেন বাংলাদেশের উদ্ভব। বাংলাদেশের গণহত্যার অনুল্লেখ এতােই ব্যাপক যে বাংলাদেশ সংগ্রামের বড় সমর্থক পশ্চিমা বামপন্থী বুদ্ধিজীবী মহলেও এই ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণত ১৯৯৯ সালের মে-জুন সংখ্যা নিউ লেট রিভিউতে দেখা যায় ১৯৪৫-উত্তর জাতিগত নিধনের বিবরণীতে কসােভাে ও বলকান রাজ্য, রুয়াণ্ডা, কাম্বােডিয়া স্থান পেলেও বাংলাদেশের কোনাে উল্লেখ ঘটে না। গণহত্যার ইতিহাস প্রসঙ্গে শতাব্দীর শুরুতে আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে পরিচালিত তুর্কি গণহত্যা অভিযানও জায়গা পেয়েছে, কিন্তু কখনােই বাংলাদেশ নয়। এমনি বাস্তবতায় বাংলাদেশের গণহত্যা অস্বীকার করার লােকও ক্রমে গজিয়ে উঠেছে। পাকিস্তানি জেনারেলরা সম্প্রতি যেসব স্মৃতিকথা লিখেছে তাতে এই অস্বীকারের প্রয়াস বেশ প্রকট। তবে গণহত্যাকারীদের কাছ থেকে এমনটা আশাই করা যায়। খােদ জার্মানিতে দেখা গেছে, ক্ষুদ্র হলেও একটা গােষ্ঠী রয়েছে যারা মনে করে হােলােকাস্ট বা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ও অন্যান্যভাবে ইহুদি-নিধন ঘটেনি, এসব বানােয়াট কাহিনী নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের সন্ধানকারী সাইমন ভিজেনথাল তার আত্মস্মৃতিতে লিখেছিলেন যে, একদল তরুণ জার্মান তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, যুদ্ধের শেষে মিত্রবাহিনী কর্তৃক মুক্ত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে কঙ্কালসার মৃত মানুষের পাহাড়ের যেসব ছবি তােলা হয়েছিল সেগুলাে নাকি আসল মানুষের নয়, কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি মানুষ। মিথ্যাচারের মাত্রাহীনতা বেশ অবলীলায় পেশ করা হচ্ছে। তাই বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের নায়ক মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী তার গ্রন্থে লিখেছেন যে, আত্মসমর্পণের ঠিক আগে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের পাকবাহিনী হত্যা করে নি, এটা ভারতীয় বাহিনীর কাজ, পাকিস্তানকে হেয় করার জন্য তা করা হয়েছে। যেন পাকিস্তানিদের হেয় হওয়ার আরাে কিছু বাকি ছিল!
বাংলাদেশ গণহত্যাযজ্ঞের নায়ক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়ায় সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে দেশের ভেতরে মৌলবাদী ধর্মান্ধ ঘাতক দালালগােষ্ঠীর পুনরুত্থানের সুযােগ করে দেয়ার মাধ্যমে ক্ষতি হয়েছে ইতিহাসে বিভ্রান্তির সুযােগ সম্প্রসারিত করে দিয়ে। বড় ক্ষতি হয়েছে দেশপ্রেমিক মানুষদের নৈতিক মানকে অবমূল্যায়ন করে। এর ফলে অতীতের সঙ্গে বােঝাপড়ায় বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়েছে এবং তা ভবিষ্যত্মখী করার বদলে দেশকে অতীতের মধ্যে টেনে রাখছে কিন্তু নৈতিক প্রশ্ন যদি নৈতিকভাবে মােকাবিলা না করা হয় তবে কখনাে তার। নিরসন ঘটবে না। আন্তর্জাতিক প্রতিকূলতা যতাে তীব্ৰই হােক না কেন, দেশের ভেতরে যুদ্ধাপরাধী গােষ্ঠীর হাত যতাে সম্প্রসারিত হােক না কেন, মাটিচাপা দিয়ে রেখে যুদ্ধাপরাধের প্রশ্নটি চিরতরে বাতিল করে দেয়া যাবে না। জাতীয়ভাবে আমরা এর প্রকাশ দেখেছি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির আন্দোলনে এই আন্দোলন পাকবাহিনীর সহযােগী জামাত নেতা গােলাম আজমের যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঢেউ জাগিয়ে তােলে যে প্রশ্ন মনে হয়েছিল বুঝি ধামাচাপা পড়ে গেছে, তা আবার জেগে উঠেছিল বিস্মৃতির অতল থেকে। কেবল বিস্মৃতি নিরসনই নয়, যে তরুণ প্রজন্ম জন্ম নিয়েছিল স্বাধীনতার পরে কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামকালে যারা ছিল নিতান্তই শিশু জাহানারা ইমামের পেছনে বিপুলভাবে সমবেত হয়ে নৈতিকতার পতাকা তারা তুলে নিয়েছিলেন হাতে। দেশের ভেতরে বড়মাপের নৈতিক জাগরণ ঘটিয়ে জাহানারা ইমাম প্রমাণ করলেন মানবতার শক্তিময়তা। নৈতিকতার পুনর্জাগরণের মধ্য দিয়েই তার আন্দোলন সফলতা অর্জন করেছিল এবং যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রশ্নটি দুই দশকেরও অধিককাল পরে আবারাে বাঙালির এজেণ্ডায় পরিণত হলাে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই নতুন নৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি বিশ্ব পটভূমিকাতেও বিপুল পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। পূর্ব ইউরােপে সমাজতান্ত্রিক শাসনের অবসান এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন স্নায়ুযুদ্ধকালীন দ্বন্দ্বময়তার অবসান ঘটালাে। এর ফলে পারমাণবিক ধ্বংসের শঙ্কা বহন করে বিশ্বব্যাপী ছােট-বড় প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিলােড়নের সঙ্গে দুই বিরােধী শিবিরের প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়ার যােগসূত্র স্থাপনের অবসান ঘটে। রুশ-মার্কিন দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি অবশ্য আমেরিকার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অভিলাষ কিংবা অন্য কোনাে রাষ্ট্রের নিজস্ব প্রভাব বলয় তৈরির আকাক্ষার অবসান ঘটায় নি। তবে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী তার গ্রন্থে লিখেছেন যে, আত্মসমর্পণের ঠিক আগে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের পাকবাহিনী হত্যা করে নি, এটা ভারতীয় বাহিনীর কাজ, পাকিস্তানকে হেয় করার জন্য তা করা হয়েছে। যেন পাকিস্তানিদের হেয় হওয়ার আরাে কিছু বাকি ছিল! বাংলাদেশ গণহত্যাযজ্ঞের নায়ক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়ায় সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে দেশের ভেতরে মৌলবাদী ধর্মান্ধ ঘাতক দালালগােষ্ঠীর পুনরুত্থানের সুযােগ করে দেয়ার মাধ্যমে। ক্ষতি হয়েছে ইতিহাসে বিভ্রান্তির সুযােগ সম্প্রসারিত করে দিয়ে। বড় ক্ষতি হয়েছে দেশপ্রেমিক মানুষদের নৈতিক মানকে অবমূল্যায়ন করে এর ফলে অতীতের সঙ্গে বােঝাপড়ায় বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়েছে এবং তা ভবিষ্যত্মখী করার বদলে দেশকে অতীতের মধ্যে টেনে রাখছে। কিন্তু নৈতিক প্রশ্ন যদি নৈতিকভাবে মােকাবিলা না করা হয় তবে কখনাে তার নিরসন ঘটবে না। আন্তর্জাতিক প্রতিকূলতা যতাে তীব্ৰই হােক না কেন, দেশের ভেতরে যুদ্ধাপরাধী গােষ্ঠীর হাত যতাে সম্প্রসারিত হােক না কেন, মাটিচাপা দিয়ে রেখে যুদ্ধাপরাধের প্রশ্নটি চিরতরে বাতিল করে দেয়া যাবে না। জাতীয়ভাবে আমরা এর প্রকাশ দেখেছি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির আন্দোলনে। এই আন্দোলন পাকবাহিনীর সহযােগী জামাত নেতা গােলাম আজমের যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঢেউ জাগিয়ে তােলে।
যে প্রশ্ন মনে হয়েছিল বুঝি ধামাচাপা পড়ে গেছে, তা আবার জেগে উঠেছিল বিস্মৃতির অতল থেকে কেবল বিস্মৃতি নিরসনই নয়, যে তরুণ প্রজন্ম জন্ম নিয়েছিল স্বাধীনতার পরে কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামকালে যারা ছিল নিতান্তই শিশু জাহানারা ইমামের পেছনে বিপুলভাবে সমবেত হয়ে নৈতিকতার পতাকা তারা তুলে নিয়েছিলেন হাতে। দেশের ভেতরে বড়মাপের নৈতিক জাগরণ ঘটিয়ে জাহানারা ইমাম প্রমাণ করলেন মানবতার শক্তিময়তা নৈতিকতার পুনর্জাগরণের মধ্য দিয়েই তার আন্দোলন সফলতা অর্জন করেছিল এবং যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রশ্নটি দুই দশকেরও অধিককাল পরে আবারাে বাঙালির এজেণ্ডায় পরিণত হলাে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই নতুন নৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি বিশ্ব পটভূমিকাতেও বিপুল পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। পূর্ব ইউরােপে সমাজতান্ত্রিক শাসনের অবসান এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন স্নায়ুযুদ্ধকালীন দ্বন্দ্বময়তার অবসান ঘটালাে। এর ফলে পারমাণবিক ধ্বংসের শঙ্কা বহন করে বিশ্বব্যাপী ছােট-বড় প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিলােড়নের সঙ্গে দুই বিরােধী শিবিরের প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়ার যােগসূত্র স্থাপনের অবসান ঘটে। রুশ-মার্কিন দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি অবশ্য আমেরিকার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অভিলাষ কিংবা অন্য কোনাে রাষ্ট্রের নিজস্ব প্রভাব বলয় তৈরির আকাক্ষার অবসান ঘটায় নি তবে এর প্রেক্ষিত হিসেবে আগের সেই টানটান পারমাণবিক উত্তেজনা আর রইলাে না। এই নতুন আবহে, বিস্ময়করভাবে, দেখা গেল জাতীয় সংঘাতগুলাে ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভয়াবহ রক্তপাত ও হত্যাযজ্ঞের অবতারণা করেছে সেইসঙ্গে এইসব সংঘাত নিরসনে আন্তর্জাতিক-মণ্ডলীর মানবিক পদক্ষেপ গ্রহণও জোরদার হতে শুরু করেছে।
এই নতুন চেতনার উন্মেষ হিসেবে আমরা দেখি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর ১৯৯৩ সালে প্রথমবারের মতাে গণহত্যার বিচার করার জন্য একটি বিশেষ আন্তর্জাতিক আদালত গঠন করা হয়। নাৎসি ও জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সেই ১৯৪৫ সালের নুরেমবার্গ ও টোকিও আন্তর্জাতিক আদালতের কার্যসম্পাদনের পর এই প্রশ্ন আর কখনও বিশ্বসভায় বিবেচিত হতে পারে নি। অথচ গণহত্যা তাে বন্ধ ছিল না। ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিস্ট হামলা প্রতিহত করার নামে হত্যা করা হয় লক্ষাধিক নাগরিককে বাংলাদেশ ও কাম্বােডিয়ার গণহত্যার তুলনীয় কোনাে কিছু আগে-পরে ঘটে নি কিন্তু ঐসব দেশে গণহত্যাকারীদের পেছনে স্নায়ুযুদ্ধের বিবদমান পক্ষের অবস্থান আন্তর্জাতিক বিচারসভা ডাকার প্রশ্ন অবান্তর ও অসম্ভব করে তুলেছিল। অথচ ১৯৯৩ সালে সাবেক যুগােশ্লাভিয়ায় জাতিগত নিধন বিশ্বসভার বিবেকের জাগরণ সম্ভব করে তুললাে আন্তর্জাতিক রাজনীতি সেভাবে আর বাধা হয়ে দাঁড়াল না। ১৯৯৪ সালে রুয়াণ্ডাতে হুটু মিলিশিয়াদের হাতে পাঁচ লক্ষাধিক নাগরিক নিহত হলে গঠিত হয় গণহত্যার বিচারের জন্য দ্বিতীয় আরেকটি আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল বিশ্ব পটভূমিতে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ মােকাবিলায় যে বর্ধিত উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা ইতিহাসের সঙ্গে সভ্যতার বােঝাপড়া তৈরির নতুন সুযােগ সৃষ্টি করছে। এই পথ বেয়ে মানবসভ্যতার অগ্রগতির নতুন সম্ভাবনা আগের তুলনায় অনেক বেশি করে। দৃশ্যগােচর হচ্ছে। সেটা ইতিহাসের ছায়ামােচনে নতুন আশা সঞ্চার করছে।
(বুলেটিন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ডিসেম্বর, ১৯৯৯)
সূত্রঃ জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয় – মফিদুল হক