You dont have javascript enabled! Please enable it! যুদ্ধাপরাধ বিচারে আন্তর্জাতিক প্রয়াস - সংগ্রামের নোটবুক
যুদ্ধাপরাধ বিচারে আন্তর্জাতিক প্রয়াস
বিশ্ব রাজনীতিতে নৈতিকতার স্থান খুব জোরদার নয়। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক  ঘিরে পরিচালিত কর্মকাণ্ডকে যে বলা হয় কূটনীতি, ইংরেজিতে ডিপ্লোম্যাসি, সেখানেও নৈতিকতার অধস্তন ভূমিকার স্বীকৃতি রয়েছে নৈতিক বিবেচনাকে জাতীয় স্বার্থের ওপরে স্থান দেয়াটা কূটনীতিতে প্রধান বিবেচ্য হিসেবে কখনাে গণ্য করা হয় না। বরং জাতীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য ন্যায়নীতি বিসর্জন দেয়াটা রেওয়াজ হিসেবে প্রচলিত রয়েছে এমন কাজে যারা পারঙ্গম, তাদের ঝানু কূটনীতিক হিসেবে সাধুবাদ জানানাে হয়। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, সমাজের সঙ্গে সমাজের সম্পর্কের চেয়ে আরাে অনেক উপরে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের স্থান তাই এখানে নীতির প্রতি মৌখিক শ্রদ্ধাভক্তি জ্ঞাপনের প্রাবল্যের অন্ত নেই। নীতি বিসর্জন দেয়ার সময়েও নীতিনিষ্ঠতার আপ্ত বাক্য উচ্চারণে কোনাে ঘাটতি থাকে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে যারা বর্বরতার পরিচয় দেয় তারা সেটাকে মানবকল্যাণের আদর্শের বুলি দিয়ে ঢেকে রাখতে কখনাে অন্যথা করে না হিটলার যখন ইউরােপকে পদানত করতে উদ্যত হন তখন তাকে কূটনীতির ভাষায় তত্ত্বের আবরণ তৈরি করতে হয়। লেবেনভ্রাম বা নিশ্বাস ফেলার মতাে পরিসর তিনি দাবি করেছিলেন, যা ভার্সাই চুক্তিতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা জার্মানিকে কিছুটা স্বস্তি এনে দেবে। সবাইকে হতচকিত করে স্ট্যালিন যখন নৎসি জার্মানির সঙ্গে অনাগ্রসন চুক্তি করে পােল্যান্ড ভাগাভাগি করে নেন তখন শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার নিরঙ্কুশ করার কথাই বলা হয়েছিল।

আমেরিকা যখন ভিয়েতনামে গ্রামের পর গ্রাম ঝলসে দিয়েছিল নাপাম বােমার আগুনে তখন সুভাষিত বুলিতে পারঙ্গম সজ্জন মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছ থেকে শােনা গিয়েছিল মুক্ত পৃথিবীকে নিরঙ্কুশ করার বাণী। এর পাশাপাশি আমরা দেখি মানুষের প্রতি মানুষের কৃত অন্যায় রােধ ও দোষীর শাস্তিবিধানের জন্য তৈরি হয়েছে যথােচিত সমাজ কাঠামাে তথা রাষ্ট্র, প্রণীত হয়েছে আইন ও তার প্রয়ােগ সম্পর্কিত সবিস্তার ব্যাখ্যা, রাষ্ট্রের সংবিধানে লিপিবদ্ধ হয়েছে নাগরিকের অধিকার কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থা স্বয়ং যখন অপরাধী আচরণ করে তখন কী বিহিত আমরা নিতে পারি সেটাই আজ হয়ে পড়েছে জরুরি প্রশ্ন বিশ শতকের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় প্রথম মহাযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞে বিমূঢ় সমাজ লীগ অব নেশনস গঠন করে এমনি চেষ্টাই গ্রহণ করেছিলেন। একদিকে উপনিবেশিক পীড়ন বহাল রাখা হবে, অপরদিকে রাষ্ট্রের আচরণ মানবিক করা হবে—এই বৈপরিত্য আদি প্রচেষ্টাকে গােড়াতেই পঙ্গু করে দিয়েছিল।

 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আরাে বড় ধাক্কা খেয়েছিল মানবচৈতন্য, এবং নতুন এক বিশ্ব কাঠামাে দাঁড় করানাের প্রয়ােজনীয়তা আগের যে-কোনাে সময়ের চেয়ে অনেক বেশি তীব্র হয়ে উঠেছিল। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল জাতিসংঘ, এবং উপনিবেশ বহাল রাখা যে স্বাভাবিক রাষ্ট্রধর্মের ব্যত্যয়, সেই স্বীকৃতি বি-উপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিল। সবচেয়ে বড় কথা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরপর গঠিত হয়েছিল নুরেমবার্গ বিচারশালা, মহাযুদ্ধকালে গণহত্যা সংঘটনের জন্য যারা দায়ী তাদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালত। মানবসভ্যতার ইতিহাসে অভিনব এই পদক্ষেপ কেবল নৎসি অপরাধীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করায় নি, রাষ্ট্র নামক অবয়বহীন জড় কাঠামােকেও তারা দায়বদ্ধ করলেন এবং রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে কিংবা রাষ্ট্রের হয়ে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করলে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রনায়ক তথা অপরাধের হােতারা যে রেহাই পেতে পারেন না, সেটা এই প্রথম উচ্চারিত হলাে। আরাে একটি বিষয় লক্ষণীয়, নুরেমবার্গ বিচারশালা প্রথমবারের মতাে সংজ্ঞায়িত করলাে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, সাধারণ ফৌজদারি দণ্ডবিধানের বাইরে থেকে যাচ্ছে যে বিশাল মাত্রার অপরাধ, রাষ্ট্রের আবরণে সংগঠিত বাহিনীর শক্তিতে যে অপরাধ ঘটানাে হচ্ছে, তার বিচারের জন্য বিশ্বমানব এই প্রথম পদক্ষেপ নিল। গণহত্যার যে অপরাধ, তা ব্যক্তির বিরুদ্ধে শক্রতা কিংবা আক্রোশ থেকে কৃত অপরাধ নয়। অনেক ক্ষেত্রে। ব্যক্তিটির সঙ্গে অপরাধীর কোনাে যােগই থাকে না। ব্যক্তির জাতিপরিচয়, ধর্মপরিচয় অথবা বর্ণ-পরিচয় এক্ষেত্রে তাকে চরম নিগ্রহের শিকার করে তোল। 
নুরেমবার্গ বিচারসভার পরপর গঠিত হয়েছিল টোকিও ট্রাইবুন্যাল, জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। কিন্তু এরপর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য বিশ্বসমাজ আর কোনাে বিচারশালা গঠন করতে পারে নি। ইতিমধ্যে গণহত্যা যে ঘটে নি তা তাে নয়, কিন্তু বিশ্বসমাজের সম্মিলিত ভূমিকা পালনের কোনাে সুযােগ ছিল না স্নায়ুযুদ্ধের কারণে। রুশ-আমেরিকা দ্বন্দ্বে পৃথিবী দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং প্রতিটি ঘটনাকে দুই শিবির দেখেছে দুই পৃথক রাজনৈতিক অবস্থান থেকে। ফলে মানবিক প্রশ্নে সকলের এক হয়ে অবস্থান গ্রহণ ছিল অসম্ভব। ভিয়েতনামে মার্কিন বর্বরতা ছাড়িয়ে গিয়েছিল সকল সীমা। লেফটেন্যান্ট ক্যালি মাইলাই গ্রামের সাধারণ চাষী নারী-পুরুষকে দড়িতে বেধে এনে যেভাবে হত্যা করেছিল সেই দৃশ্য বিশ্ববিবেককে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।
 
নাপামের আগুনে ঝলসে যাওয়া নগ্ন কিশােরীর দৌড় পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়ে অযুত হৃদয়কে বেদনামথিত করেছিল। এই অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে খােদ আমেরিকার নাগরিকসমাজ প্রতিবাদে গর্জে উঠলেও যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি-বিধানের কোনাে প্রক্রিয়া শুরুর কথা ভাবা যায় নি। এমন কি শান্তিসংগ্রামী বার্ট্রান্ড রাসেলের নাগরিক বিচারসভা গঠনের পরও বিশ্বসভায় কোনাে পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয় নি।  ১৯৯১ সালে আকস্মিকভাবে রাতারাতি সােভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং তার আগে-পরে পূর্ব ইউরােপের সমাজতন্ত্রী শিবিরে ধস নামার ফলে বিভাজিত দুই বিশ্বের এক অংশ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়লাে এবং স্নায়ুযুদ্ধ বলে আর কোনাে কিছু রইলাে না। দুঃখজনকভাবে ঘটলেও পূর্বের সর্বগ্রাসী দ্বন্দ্বমুক্ত হলাে নতুন বিশ্ব। তার পরও দেখা গেল আরেক প্রবণতা, শান্তির বদলে বরং নতুন নতুন সংঘাতের প্রসারই ঘটতে লাগলাে জাতিগত বিদ্বেষের পুরনাে ক্ষতগুলাে আবার জেগে উঠলাে বিশ্বের নানা অংশে, এবং অভাবনীয় রক্তপাত ও সংঘাতের জন্ম দিল। কোথাও কোথাও এই সংঘাত গণহত্যার ভয়ঙ্করতা নিয়ে দেখা দিল, যেমনটা ঘটেছে রুয়াণ্ডায় ও বলকান অঞ্চলে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ নিরসনের জন্য বিশ্বসমাজের উদ্যোগও সেই সাথে অনেক সংহত হয়েছে। তাই রুয়াণ্ডা ও সাবেক যুগােশ্লাভিয়ায় যুদ্ধাপরাধ তথা গণহত্যার বিচারের জন্য গঠিত হয়েছে পৃথক দুই আন্তর্জাতিক আদালত। এই প্রক্রিয়াকে স্থায়ী সাংগঠনিক রূপ। দেয়ার জন্য দীর্ঘ-আলাপ-আলােচনা শেষে আইসিসি বা আন্তর্জাতিক ক্রিমিন্যাল কোর্ট প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশই আইসিসি সনদে স্বাক্ষর দিয়েছে, তবে দেয়নি পাকিস্তান। আইসিসি চূড়ান্তকরণে এখনও কিছু কাজ বাকি রয়েছে, পরাশক্তির সমর্থন অর্জন সম্ভব হলে আনুষ্ঠানিকভাবে আদালত তার কাজ শুরু করতে পারবে। আইসিসি গণহত্যাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে এর উদগাতা, পৃষ্ঠপােষক ও প্রতিপালকদের শাস্তিবিধানের ধারা সন্নিবেশিত করেছে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্ট তার প্রতিষ্ঠার পূর্বে সংঘটিত অপরাধের বিচারে অপারগতা সনদে অন্তর্ভুক্ত করেছে। তারপরও আইনের কিছু ফাঁক-ফোকর আইনজ্ঞরা খুঁজে বের করতে পারেন এবং কেউ কেউ মনে করেন বিশেষ ধরনের যুদ্ধাপরাধ, যেমন যথেচ্ছ গণ-ধর্ষণ-এর শিকার যারা হয়েছেন তারা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য এই আদালতের শরণ নিতে পারেন এবং সেই সূত্রে পূর্বতন যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রসঙ্গ আইসিসিতে টেনে আনা যায়। আইসিসি-তে একাত্তরের গণহত্যার বিচার প্রার্থনার সুযােগ থাকুক কি না থাকুক, সনদ অনুযায়ী এই সুযােগ নেই বলেই প্রতীয়মান হয়, তবুও নির্দ্বিধায় বলতে হয় আইসিসি প্রতিষ্ঠা বিশ্ব-ইতিহাসে অত্যন্ত ইতিবাচক এক ঘটনা।
 
আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে নৈতিকতার অবস্থান যে সভ্যতার এক জরুরি অঙ্গ সেটা এখানে বিশ্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করেছে স্নায়ুযুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীতে এই অর্জন অনেক সহজসাধ্য হয়ে উঠেছে। অথচ এর থেকে কত আলাদাহ না ছিল। একাত্তরের পৃথিবী বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য গণতান্ত্রিক অধিকার অস্বীকার করে যে নিষ্ঠুর গণহত্যার অবতারণা করলাে পাকিস্তানি সামরিক নেতারা তার বিরুদ্ধে প্রতিরােধকে মানবতার পদক্ষেপ হিসেবে না দেখে বিবেচিত করা হয়েছিল সােভিয়েত প্রভাব বলয় বৃদ্ধির আরেক অপচেষ্টা হিসেবে বাংলাদেশ প্রশ্নকে এমনি বৈশ্বিক জিও-পলিটিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে পশ্চিমী রাষ্ট্রশক্তি এর উত্থান ঠেকাতে সম্ভাব্য সব পন্থাই অবলম্বন করেছিল এমন কি এক পর্যায়ে আমেরিকা পারমাণবিক অস্ত্রবাহী সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে মহাযুদ্ধের ঝুঁকি নিতেও পিছ-পা হয় নি। আর ভারতের উত্তর-পূর্ব কোণে চীনা বাহিনী আক্রমণ শুরু করবে, এমন প্রত্যাশা নিয়ে ঢাকায় জেনারেল নিয়াজি গং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হিংস্র আঘাত করে চলেছিল সাধারণ মানুষের মরণপণ লড়াই এবং ভারত ও রাশিয়ার সর্বাত্মক সমর্থনের জোরে শেষাবধি বাংলাদেশের অভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছিল  স্নায়ুযুদ্ধ-পীড়িত বিশ্বে মানবতার এক মহান উত্থান ছিল বাংলাদেশ পৃথিবীর দেশে দেশে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অযুত মানুষ সংহতি প্রকাশ করে রাজপথে নেমেছিল বলে আন্তর্জাতিক বাধা অতিক্রম বাংলাদেশের পক্ষে সহজতর হয়েছিল রক্তাক্ত বিধ্বস্ত বাংলাদেশের অভ্যুদয় বিশ্বসভায় প্রাথমিক অনুমােদন পায় নি। এই স্নায়ুযুদ্ধের কারণেই। গােড়ায় রাষ্ট্র হিসেবে সাধারণ স্বীকৃতিটুকু আদায় করতেই বাংলাদেশকে বহু কাঠখড় পােড়াতে হয়েছে ১৯৭৪ সালের আগে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদটুকুও পায় নি। তাই ৩০ লক্ষ নারী-পুরুষের হত্যার জন্য দায়ী যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রার্থনা করার সুযােগটুকু বাংলাদেশের ছিল  বাংলাদেশ ১৯৫ জন্য যুদ্ধবন্দিকে শনাক্ত করেছিল যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য সংসদে যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য বিশেষ আইনও প্রণয়ন করেছিল।
কিন্তু যুদ্ধাপরাধ হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ এবং আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ছাড়া এই বিচার সম্পন্ন হতে পারে না। তাই সত্তরের দশকে বিচারের বাণী নিভৃতেই কেঁদে ফিরেছিল, সুবিচার প্রার্থনা করার মতাে ন্যূনতম সুযােগটুকুও বাংলাদেশের ছিল। তিরিশ বছর ধরে বুকের গভীরে পুষে রাখা দুঃখবােধ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার আকাক্ষাকে উথলে তুলে বিশ্বসমাজের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবি আবার উত্থাপন করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভাষণদানকালে তিনি যুদ্ধাপরাধের মাত্রাটুকু তুলে ধরেন এবং বলেন, “১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমরা মানবতার ওপর যুদ্ধ ও সংঘাতের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছি। এ সময় ২ লাখ নারী ধর্ষিত ও ত্রিশ লাখ মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছে। নিউইয়র্কে অবস্থানকালে সি.এন.এন-এর সঙ্গে প্রশ্নোত্তর আলােচনাকালে তিনি পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি তুলে ধরেন। ঢাকায় ফিরে এসে বিমানবন্দরের সাংবাদিক সম্মেলনে যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার প্রশ্নটি পাকিস্তানের নৈতিক বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে জনমত গড়ে তােলার দিকটিতে তিনি গুরুত্ব আরােপ করেন। ত্রিশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের কোনাে সরকার-প্রধান আন্তর্জাতিক পরিসরে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও তার বিচার সাধনের নৈতিক দাবির কথা এই প্রথম উচ্চারণ করেছেন। বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ব পটভূমিকায় এর তাৎপর্য অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। এশিয়াউইক সাময়িকীর ২২ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় লেখা হয়েছে, “এই প্রথমবারের মতাে একজন বাংলাদেশী প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা-যুদ্ধকালে পাকবাহিনী কৃত নৃশংসতার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানিয়েছেন।
১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা ফিরে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘একাত্তরে আমার দেশে তারা যা করেছে সেটা আমরা ভুলব না।” অতীতকে পেছনে ফেলে একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব যে এক নতুন পর্বে প্রবেশ করতে চলেছে হাসিনা-মােশাররফ বিরােধেও তার প্রকাশ ঘটেছে। স্নায়ুযুদ্ধের বিশ্বে সামরিক শাসকদের দেখা মিলতাে গণ্ডায় গণ্ডায়। ল্যাটিন আমেরিকার শাসকদের সম্পর্কে এক গ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছিল রুলার্স অন হর্সব্যাক’জ্যাক লণ্ডনের বিখ্যাত জীবনীগ্রন্থ ‘সেইলর্স অন হর্সব্যাক’ অনুকরণে। কেবল তৃতীয় বিশ্বে নয় ইউরােপের বুকে গণতন্ত্রের পীঠস্থান গ্রীসেও সামরিক বাহিনী দখল করেছিল ক্ষমতা। এদের বেশির ভাগ ছিল মার্কিন-অনুগত, কমিউনিজমরােধের জেহাদি শপথের আড়ালে গােষ্ঠীস্বার্থ হাসিলের ‘মহৎ’ কর্মে অবতীর্ণ। আবার এদের অনেকেই উড়িয়েছিল সমাজতন্ত্রের পতাকা, অবৈধ দখলকে নীতিবাক্য দিয়ে আড়াল করার অপচেষ্টায়।

একবিংশ শতকের বিশ্বে সামরিক কর্তাদের অবৈধ ক্ষমতা দখলের অসারতার মুখােশ প্রায় পুরােপুরিই উন্মোচিত হয়েছে। চিলির প্রাক্তন লৌহমানবকে পিটিয়ে তক্তা বানাবার আয়ােজন করতে স্পেন এক পায়ে খাড়া। চিলির সাংবিধানিক বিধি-বিধানে জেনারেল পিননাশের আত্মরক্ষার যে-সব রক্ষাকবচ যুক্ত করা ছিল সেসব এখন অপসারিত হচ্ছে। দুই দশক আগে যা ছিল কল্পকথা আজ তা বাস্তব হয়ে উঠছে। পঁচাত্তরে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করলে ঘাতকদের বিরুদ্ধে কোনাে রাষ্ট্র সামান্য নিন্দাবাক্যও উচ্চারণ করে নি। বরং চীন সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়েছিল। লিবিয়া ক্ষমতাচ্যুত ঘাতকদের আশ্রয় দিয়েছিল (ব্রাদার গাদ্দাফির অমন জঙ্গি সমাজতন্ত্রের বাণী উচ্চারণ সত্ত্বেও), আর পাকিস্তান তার উল্লাস মােটেই অপ্রকাশ্য রাখে নি। আজ আন্তর্জাতিকভাবে পিননাশের হাতে চিলিবাসীর নিগ্রহের ঘটনার বিচারের দাবি উঠেছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার হচ্ছে স্বদেশের আদালতে  বিশ্ব পরিস্থিতির এই পরিবর্তনের প্রকাশ শেখ হাসিনার নিরাপত্তা পরিষদের  বক্তৃতায় স্থান খুঁজে পেয়েছে এবং তিনি অবৈধ ক্ষমতাদখলদারদের বিরুদ্ধে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, জাতিসংঘ এ ব্যাপারে কমনওয়েলথের অনুরূপ ব্যবস্থা নিতে পারে। এই বক্তব্য উত্থাপনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবিংশ শতকের বিশ্বে নৈতিকতার পুনর্জাগরণ প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থনই কেবল ব্যক্ত করেন নি, সেই ধারাকে জোরদারও করেছেন।

নতুন পৃথিবীকে বরণ করে নিতে বাংলাদেশের আগ্রহ এবং পাকিস্তানের ভীতি প্রকাশ পেয়েছে শেখ হাসিনা ও পারভেজ মােশারফের বক্তব্যে বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধের বিচার চায় অতীতের দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে বলে নয়। বরং অতীতের গ্লানি মােচন করে মানবিক চেতনাকে জোরদার করে আগামীর পথে এগােবার তাগিদ থেকেই তার এই অভিব্যক্তি। আর পাকিস্তান চায় বিস্মৃতির ধামার নিচে চাপা পড়ক অতীত, ঘাতকের হাতে শান্তির পতাকা তুলে দিয়ে অতীতের সকল বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতাকে সঙ্গী করে ভবিষ্যতের দিকে পা ফেলতে।এই অবস্থান কোনাে বিবেকবান মানুষের কাম্য হতে পারে না। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নৈতিকতার বিজয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে অভিযাত্রা জোরদার করবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সেই শান্তি ও ন্যায়ের আকাঙ্ক্ষা দীপ্ত হয়ে উঠেছে কিন্তু ন্যায় প্রতিষ্ঠার এই পথ এখনও দুস্তর, প্রতিবন্ধকতা আজো ব্যাপক, যদিও সম্ভাবনার দ্বারটুকু কেবল উন্মােচিত হয়েছে পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধের বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক আদালতে, এর কোনাে বিকল্প নেই কেননা যুদ্ধাপরাধ কোনাে ব্যক্তির বিরুদ্ধে কৃত অন্যায় নয়, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। মানবসমাজ একত্র হয়ে এর বিরুদ্ধে রায় ঘােষণা করবে এবং সেটা হবে সর্বজনমান্য। বাংলাদেশকে তাই জোর দাবি তুলতে হবে রুয়ান্ডা ও বলকান অঞ্চলের যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত বিশেষ আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যালের ন্যায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ বিচারার্থে জাতিসংঘের আওতায় ট্রাইবুন্যাল গঠিত হােক। এই লক্ষে আন্তর্জাতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অগ্রসর হতে হবে ধৈৰ্য্য ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে। আর নাগরিক সমাজের কাজ হবে দেশের ভেতরে সার্বিক ঐকমত্য গড়ে তােলা।
প্রতিটি গণতান্ত্রিক দলকে তাদের কর্মসূচিতে যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবি সন্নিবেশিত করতে হবে। রাজনীতিক মতপার্থক্য নির্বিশেষে এই নৈতিক প্রশ্নে সকলের একই জাতীয় অবস্থানে দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পক্ষে বিশ্ব নাগরিক সমাজের যে সক্রিয় শুভেচ্ছা। কার্যকর ছিল তা ব্যবহার করে বিশ শতকের ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্যতম গণহত্যার নায়কদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানাের দাবি প্রবল করে তুলতে হবে। ১৯৭৫-এর কাম্পুচীয় গণহত্যার বিচারের জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগ এখন বাস্তবায়ন হতে চলছে। একাত্তরের গণহত্যার বিচারকে করে তুলতে হবে। জাতিসংঘের পরবর্তী এজেণ্ডা। সেজন্য চাই সার্বিক সক্রিয়তা—সরকার, রাজনীতিক দল ও ব্যাপক জনগােষ্ঠীর।
(সংবাদ, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০০০)

সূত্রঃ  জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয় – মফিদুল হক