জেনােসাইড নিছক গণহত্যা নয়
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল সেই মাত্রার বর্বরতা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। এই হত্যাকাণ্ডকে আমরা বলেছি গণহত্যা, ইতিহাসে যা চিহ্নিত হয় ‘জেনােসাইড’ হিসেবে। জেনােসাইড নিয়ে ভাষাগত একটি সমস্যা বাংলায় রয়ে গেছে। ইতিহাসে জেনােসাইডের ঘটনা একেবারে দুর্লক্ষ্য নয়; তবে এটা বেশ বিস্ময়কর যে জেনােসাইড’ কথাটি ইংরেজি অভিধানে এসেছে খুব বেশি দিন আগে নয়, দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী কোনাে এক সময়ে আইন বিশারদ রাফায়েল লেমকিন। এই শব্দবন্ধ তৈরি করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে জা পল সার্তে ‘অন জেনােসাইড’ নিবন্ধে ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনীর যথেচ্ছ হত্যাকাণ্ডের প্রতি ধিক্কার উচ্চারণ করে রাফায়েল লেমকিনের এই অবদানের কথা উল্লেখ করেছিলেন। লেমকিনের নব্যউদ্ভাবিত এই শব্দবন্ধ ‘জেনােসাইড’ খুব দ্রুতই বহুল ব্যবহৃত ও আলােচিত শব্দ হয়ে ওঠে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে এর বিভিন্ন ধরনের প্রকাশ মানবসভ্যতা প্রত্যক্ষ করে, সবচেয়ে হিংস্র ও বেদনামণ্ডিতভাবে যা প্রকাশ পেয়েছিল ইহুদি জনগােষ্ঠীর প্রতি নাৎসি হিটলারের অনুসৃত নীতি ও কর্মে কিন্তু ইতিহাসে প্রবেশের আগে আমরা বরং রাফায়েল লেমকিনের অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি বিচার করে বােঝার চেষ্টা নিতে পারি কেন তিনি জেনােসাইড’ কথাটির প্রবর্তন ঘটিয়েছিলেন এবং কোন্ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি তা করেছিলেন। রাফায়েল লেমকিনের জন্ম ১৯০০ সালে পূর্ব পােল্যান্ডের এক কৃষিজীবী পরিবারে। নাম থেকে বােঝা যেতে পারে তারা ছিলেন ইহুদি, পােল্যান্ডের বড় শহরে ইহুদি জনগােষ্ঠীর সংখ্যা বিপুল হলেও গ্রামাঞ্চলে তাদের সংখ্যাগত লঘুত্ব ও সাম্প্রদায়িক বিভেদচিন্তার তীব্রতার দরুণ তাদের জীবন খুব সহজ ছিল না।
কৈশােরে একটি উপন্যাস পড়ে বিপুলভাবে আলােড়িত হন। লেমকিন, নােবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী পােলিশ লেখক হেনরিক সিনকেসিৎজের উপন্যাস ‘কুয়াে ভ্যাদিস ছিল এই বই যেখানে আদি যুগের খ্রিষ্টানদের ওপর রােম সাম্রাজ্যের অধিপতি নিরাের পীড়নের কাহিনী বিধৃত হয়েছে। বই পড়ে বালক লেমকিন মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিল খ্রিষ্টানরা তখন পুলিশের কাছে সাহায্য চায়নি কেন? জীবনের প্রান্তে এসে রচিত আত্মস্মৃতিতে লেমকিন লিখেছিলেন : “জাতিগত, ধর্মীয় ও বর্ণগত গােষ্ঠীদের ধ্বংস করবার আরাে বিভিন্ন প্রচেষ্টা সম্পর্কে আমি পড়তে শুরু করি। শীঘ্র আমি বুঝতে পারি এই অন্যায় রােধের জন্য স্থানীয় পুলিশের সহায়তার চাইতেও বড় কোনাে ব্যবস্থা দরকার, যেজন্য পরে আমি ‘জেনােসাইড’ কথাটি তৈরি করি। ইতিহাসে জেনােসাইডের বিভিন্ন ঘটনা আমার মন জুড়ে থাকে। আমার ভাবনা এতােই তীব্র ছিল যে আমি যেন চোখের সামনে সেইসব ঘটনা দেখতে পেতাম। আমি দেখতাম সপ্তদশ শতকের জাপানে ক্যাথলিকদের বাধ্য করা হচ্ছে ঘড় ঘড়া জলপান করতে, তারপর তাদের শরীর থেকে জলের সকল নির্গমন পথ একেবারে রুদ্ধ করে দিয়ে মাথায় চাপানাে হতাে ভারি বােঝা, পরিণামে ফেটে পড়তাে তাদের দেহ। আমি দেখতাম তীক্ষ সূর্যের নিচে নৌকার পাটাতনে গাদাগাদি করে রয়েছে স্পেনীয় মুসলিমরা, পাহারাদারদের উৎকোচ দিয়ে কেউ কেউ ছায়ার মধ্যে জায়গা নিয়েছে, সমুদ্রে তাদের ছুঁড়ে ফেলবার আগে হতভাগ্য এই জীবন যদি আর একটু প্রলম্বিত করা। যায়। আমি শুনতে পেতাম নিধনযজ্ঞে পতিত ইহুদির আর্তনাদ, যখন তার পেট চিরে পাখির পালক ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছিল আমি নিজেকে আরাে বেশি করে নিপীড়িতজনের সঙ্গে শনাক্ত করতে লাগলাম এবং ইতিহাস অধ্যয়ন অব্যাহত রাখলাম আমি বুঝতে পারলাম স্মৃতির কাজ কেবল অতীত ঘটনার লিপিবদ্ধকরণ নয়, বরং মানবচেতনাকে উস্কে দেয়া ।
এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, জাতি-ধর্ম-বর্ণের বৈচিত্র্য মানবসভ্যতার জন্য অতীব প্রয়ােজন, কেননা সংস্কৃতির নিরিখে প্রত্যেক গােষ্ঠীর রয়েছে। আলাদা অবদান রচনার সুযােগ, সম্পাদনের রয়েছে বিশেষ দায়িত্ব। আমি সিদ্ধান্ত নেই আইনজীবী হবাে এবং জেনােসাইড বেআইনি করতে কাজ করবাে, এর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ রচনায় সক্রিয় হবাে জাতিসমূহের মধ্যে সহযােগিতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, কাজ করবাে এমনভাবে যেন সবাই বুঝতে পারে তাদের কারাে ওপর আঘাত আসলে সকলের ওপর আঘাত।” আজীবন এই লক্ষ্যেই কাজ করেছেন রাফায়েল লেমকিন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত নুরেমবার্গ ট্রাইবুন্যালের মার্কিন বিচারপতি রবার্ট জ্যাকসনের তিনি ছিলেন উপদেষ্টা, তার নানামুখী চেষ্টা ও ভূমিকা পালনের ফলে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ গণহত্যা বেআইনি করে জেনােসাইড কনভেনশন’ গ্রহণ করে।
তবে রাফায়েল লেমকিনের জন্য এটা ছিল বড় দুঃখের ব্যাপার যে তার দ্বিতীয় স্বদেশ হিসেবে বরণ করে নেয়া আমেরিকা ‘জেনােসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষর দেয় নি। ১৯৫৯ সালে রাফায়েল লেমকিনের মৃত্যু হয়, লােকচক্ষুর অন্তরালে নিঃসঙ্গ ও অর্থনৈতিকভাবে নিঃশেষিত ব্যক্তি হিসেবে তিনি বিদায় নেন পৃথিবী থেকে, রেখে যান এক শব্দবন্ধ এবং ইতিহাস থেকে সেই পাপাচার বিলােপ করবার জন্য পরিচালিত বিরামহীন সাধনার পরিচয়। উনিশ শ’ একাত্তরে এসে আমরা বাঙালিরা লেমকিনের শব্দবন্ধের নিষ্ঠুর বাস্তব রূপের মুখােমুখি হলাম। আমাদের মধ্যে যারা সচেতন তারা এটাও জানলেন যে গ্রিক শব্দ জেনস (গােষ্ঠী বা জাতি অর্থে) এবং ল্যাটিন শব্দ সাইড (হত্যা অর্থে যেমন হােমিসাইড, ফ্র্যাট্রিসাইড) মিলে তৈরি হয়েছে ‘জেনােসাইড’ শব্দবন্ধ; কিন্তু একান্ত ভাবনাহীনভাবে আমরা জেনােসাইডের বাংলা করেছি ‘গণহত্যা’, ব্যাপক সংখ্যায় হত্যা অর্থে, তবে গণহত্যা কথাটি দিয়ে যে জেনােসাইড বোেঝানাে সম্ভব নয় সেটা বােধকরি বিস্তারিত ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। এটা লক্ষণীয় ২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ড শুরুর অল্পকাল পরেই একে ‘সিলেকটিভ জেনােসাইড’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড। তখনও যে খুব বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তা নয়, অন্তত নয় মাসের গণহত্যার তুলনায় শুরুর সেই সংখ্যা তাে নগণ্য। তাহলেও তিনি বােধকরি প্রথম ব্যক্তি যিনি বাংলাদেশে ঘটমান হত্যাযজ্ঞ যে আসলে জেনােসাইড সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। এরপর জুন। মাসে সানডে টাইমসের সম্পাদকীয় পাতার প্রায় সবটা জুড়ে প্রকাশিত হয়।
পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যাওয়া সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের রিপাের্ট এবং পত্রিকার সম্পাদক বড় বড় হরফে তার শিরােনামা দিয়েছিলেন, ‘জেনােসাইড’। প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান মুক্তিযুদ্ধের উত্তপ্ত মধ্যগগনে যে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন, তার নাম ছিল ‘স্টপ জেনােসাইড’। জেনােসাইড’ বলতে বােঝায় জাতি, ধর্ম-গােষ্ঠী বা বর্ণগােষ্ঠীকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে পরিচালিত কর্মকাণ্ড যার প্রধান অবলম্বন নৃশংস ও পাইকারি হত্যাভিযান। এই হত্যাকাণ্ড ঘটে যথেচ্ছভাবে, এটা সামরিক সংঘাত ছাপিয়ে বেসরকারি সাধারণজন, এমনকি নারী নির্মম হত্যা ও নিষ্ঠুর পীড়নের লক্ষ্য করে তােলে। জা পল সাত্রে তার পূর্বোক্ত রচনায় লিখেছিলেন, “ইহুদিদের উত্থাত করবার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হিটলার সরবে ঘােষণা করেছিলেন। জেনােসাইড ছিল তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের অবলম্বন এবং এ-নিয়ে তার কোনাে লুকোছাপা ছিল না।
একজন ইহুদি সে যেই হােক তাকে মরতে হবে, এজন্য নয় যে সে হয়তাে অস্ত্র বহন করার সময় ধরা পড়েছে কিংবা প্রতিরােধ যুদ্ধে যােগ দিয়েছে, বরং এজন্য যে সে একজন ইহুদি।” সাত্রে ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে এই কথাগুলাে বলেছিলেন; একাত্তরে অধিকৃত পূর্ববঙ্গে বাঙালিদের অবস্থা ছিল তার চেয়েও করুণ এবং ত্রিশ লক্ষ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে। এই ব্যাপক সংখ্যায় মৃত্যু গণহত্যা নিঃসন্দেহে তবে এখানে গণহত্যার চেয়েও অতিরিক্ত মাত্রা রয়েছে যা আমরা অনুবাদকালে হারিয়েছি, বলা যায় লস্ট ইন ট্রানস্লেশন। বস্তুত জেনােসাইডের বাংলা পরিভাষা গণহত্যা হতে পারে না, এটা প্রকৃত অর্থে জাতিনিধন কিংবা জাতিগােষ্ঠী নিধন এবং সেভাবে বললে আমরা বুঝবাে একাত্তরে পাকবাহিনী কী করতে চেয়েছিল এবং কেন এমন বিপুল রক্তপাত ঘটাবার পথে তারা ধাবিত হয়েছিল। আরাে বুঝবাে জেনােসাইডের সঙ্গে যে যুদ্ধাপরাধের প্রশ্ন জড়িত তার মদদদাতা কোন্ অপরাধে অপরাধী, বিদেশি এবং দেশীয়রা তাে বটেই। সেই মদদদাতারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে দোষী, প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী, তাদের হাতে রক্তের ছােপ না লেগে থাকলেও কিছু যায় আসে না, তাদের দাড়ির সফেদ ভাবও দূর করতে পারবে না অন্তরের এই গভীর কালিমা, তাদের গাড়িতে পতাকা ঝুললেও তারা ইতিহাসের বিচার থেকে রক্ষা পাবে না। জেনােসাইডের একটি আদর্শগত ভিত্তি থাকে, কিংবা বলা যায় থাকে বিকৃত আদর্শের ওপর নির্ভর বিকৃত চেতনা। এর একদিকে আছে নিজের গােষ্ঠী, সম্প্রদায় বা জাতিগত পরিচয় সম্পর্কে শ্রেষ্ঠত্বের অহং এবং একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতাে থাকে অপর সম্প্রদায়, গােষ্ঠী বা জাতি সম্পর্কে চরম অবজ্ঞা, অবহেলা ও ঘৃণা এর ফলে একটি গােষ্ঠীকে লেলিয়ে দেয়া যায় অপর গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে, আক্রান্ত গােষ্ঠী নিরীহ নির্বিবাদী হলেও তাতে কিছু যায় আসে না।
পাকিস্তান আমলে বাঙালি জাতিগােষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর কোনােরূপ পীড়ন কিংবা হামলা চালায় নি, পাকিস্তানের অর্থনীতিতে তারা কোনাে অন্যায় অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে এমন কথা পশ্চিমী কোনাে শাসকই কখনাে করতে পারে নি তবু যে বাঙালিদের প্রতি এমন বর্বর ও নৃশংস আচরণ পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী এবং সামরিক বাহিনী করতে পারলাে তার কারণ ঐ বিকৃত মানসচেতনা। বাঙালিদের তাদেরই মতাে সমমর্যাদার মানুষ হিসেবে গণ্য করেনি পাকিস্তানি সামরিক ও রাজনৈতিক শাসকবৃন্দ। নিজেদের সীমাহীন অজ্ঞতাকে প্রচণ্ড অহমিকা দিয়ে ঢেকে রেখে তারা এক ধরনের মেকি জীবনবোেধকে আশ্রয় করেছিলেন। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পাপিষ্ঠ হােতা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী তার স্মৃতিকথার সূচনাবাক্যেই লিখেছেন যে, “ছােটবেলায় আমরা বাংলা সম্পর্কে শুনেছি তিন রকমের কথা : বাবু বাঙালি, জাদু বাঙালি ও ভুখা বাঙালি।” তারপর তিনি এই তিন বাঙালি বলতে কী বােঝায় তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বাবু বাঙালিরা লেখাপড়া শিখে কেরানি হতে আগ্রহী, জাদু বাঙালিরা ডাকিনী আর ভুখা বাঙালি তাে চির ক্ষুধার্ত।
এই যদি হয় জেনারেলের জ্ঞান আহরণের পরিধি এবং সেই জ্ঞানের ফলে ভারতবর্ষে হাজার বছরের ঐতিহ্যসম্পন্ন একটি জাতির মানুষজন সম্পর্কে এই যদি হয় ধারণা তবে বােঝা যায় পাকিস্তানে সামরিক ক্ষমতা কোন্ ধরনের মানুষের হাতে জড়াে হয়েছিল। পাকিস্তানে গঠিত বিচারপতি হামুদুর রহমান কমিশন রিপাের্ট থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির বাঙালি সম্পর্কিত ধারণার পরিচয় পাওয়া যায় যেখানে তিনি বলেছিলেন যে, বাঙালিরা হলাে নিচু এলাকার মানুষ, শয্যায় নিচে শায়িত হওয়াটা তাদের অভ্যাস এক জাতিগােষ্ঠীর সদস্য যখন আর জাতিগােষ্ঠী সম্পর্কে এমন বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি বহন করে তখন সংঘাতের সূত্র ধরে নানা কারণে জোননাসাইডের ভয়ঙ্কর ঘটতে পারে এই ধরনের জেনােসাইডে সবসময়ে আক্রান্ত পক্ষ সম্পর্কে ঘৃণার তীব্রতা, লক্ষ্য করা যায় এবং হত্যাকাণ্ডের মধ্যে বিকৃত চেতনার নানা ধরনের প্রতিফলন দেখা যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে এমনি বিকৃতির পরাকাষ্ঠা আমরা দেখেছি যখন ইহুদি নিধনের জন্য তৈরি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কম্যান্ডাররা মানুষের চামড়া দিয়ে টেবিল ল্যাম্প তৈরি করেছে এবং ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছে নারী ও শিশুদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালেও পাকবাহিনীর নানারকম নৃশংসতার পরিচয় আমরা পাই এবং চরম এক নিষ্ঠুর খেলার অবতারণা তারা করেছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে, বিকৃতির চরম পর্যায়ে না পৌছলে অবধারিত আত্মসমর্পণের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এমন নৃশংসতার পরিচয় দেয়া যেত না। জেনােসাইড যেমন বিকৃত মানসের ফসল, তেমনি জেনােসাইডের অঙ্গাঙ্গী অংশ হিসেবে আমরা দেখি চরম নৃশংসতা একাত্তরে জাতিগােষ্ঠী নিধনের যারা মদদদাতা তাদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে অভিযােগ আবারও নতুন করে উঠছে।
২০০১ সালে আমেরিকার হারপার্স’ সাময়িকীর দু-সংখ্যা জুড়ে ক্রিসটোফার হিচেন্স লিখেছেন বিভিন্ন অপরাধে হেনরি কিসিঞ্জারের বিচার চেয়ে। কিসিঞ্জারের এইসব অপরাধের মধ্যে বড় জায়গা নিয়েছে একাত্তরে বাংলাদেশে সংঘটিত জেনােসাইডের সঙ্গে তার যােগসাজশ। আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভেন জ্যাকব লিখেছেন নিবন্ধ, বিষয় রাফায়েল লেমকিন যদি বেঁচে থাকতেন তবে কোন্ কোন্ অপরাধে কিসিঞ্জারকে অভিযুক্ত করতেন। এই তালিকায় বাংলাদেশে জেনােসাইড ঘটানােতে যােগসাজশের অভিযােগও রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা বিস্মৃত লেমকিনের নাম অধুনা আবারও সম্রমের সঙ্গে উচ্চারিত হতে শুরু করেছে এবং অপরাধ যতাে আগেই সংঘটিত হােক সেই দায় থেকে কারাে মুক্তি নেই সেটা প্রকাশ পাচ্ছে। যে আর্চার ব্লাড মার্কিন প্রশাসনের নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কিসিঞ্জারের চরম বিরাগভাজন হয়েছিলেন, হারিয়েছিলেন পদোন্নতির সুযোেগ এবং পরিত্যক্তভাবে জীবন কাটিয়েছেন, ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস আমেরিকান সেন্টার লাইব্রেরিকে তার নামে উৎসর্গ করলাে, তিনি আবার পেলেন সম্মানের আসন। জেনােসাইড ঘটানাের কাল হয়তাে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে কিন্তু জাতিনিধন | বর্বরতার সঙ্গে সভ্যতার আপােষের কোনাে সুযােগ নেই।
এক সময়ে মনে হয়েছিল বাংলাদেশের জেনােসাইড বুঝি ইতিহাস থেকে মুছে গেল, এই বিপুল হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাবার মানুষই নেই, এর জন্য বিচার চাওয়া বা ফরিয়াদি হওয়া তাে দূরের কথা বিশ শতক যখন শেষ হয়ে এলাে তখন শতাব্দীর মূল্যায়নধর্মী অনেক বই অনেক পর্যালােচনা বের হয়েছিল। তাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে। জেনােসাইড বলতে ১৯১০ সালের আর্মেনীয় গণহত্যা এবং তারপর ইহুদি-নিধন ও কম্বােডীয় গণহত্যার ফিরিস্তি দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশ জেনােসাইড বিশেষ উল্লেখ লাভ করে নি। এমন কি বৃটেনের খ্যাতমান আইনজীবী জিওফ্রে রবার্টসনের ‘ক্রাইমস এগেইনস্ট হিউম্যানিটি -তে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তী জেনােসাইডের বর্ণনায় বাংলাদেশ এক লাইনের উল্লেখ পেয়েছে কি পায় নি, অথচ আরাে অনেক ছােট আকারের জেনােসাইডও বিশদ বিবেচনা লাভ করেছে। অথচ তিনি সেই আইনজীবী যার প্রচেষ্টাতেই ইংলন্ড থেকে শমন জারি হয়েছিল চিলির প্রাক্তন স্বৈরশাসক পিননাশের নামে এবং সেই ঘটনা কিসিঞ্জারের শিরদাঁড়া দিয়েও ঠাণ্ডা জল বইয়ে দিয়েছে। পরিবর্তন ঘটছে আরাে নানাভাবে জানুয়ারি ২০০১ সংখ্যা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকা ছেপেছে দীর্ঘ নিবন্ধ ‘জেনােসাইড অ্যান্ড দা সায়েন্স অব ফ’, সেখানে বিশ শতকের জেনােসাইডের তালিকায় পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের পাশে আছে ত্রিশ লক্ষ দশ হাজার নিহত বাঙালির সংখ্যা। এই নরমুণ্ডের মালা পাকিস্তান তার গলা থেকে নামাবে কী করে? ২০০৪ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আরেক বই, অ্যাডাম জোন্স সম্পাদিত ‘জেনােসাইড, ওয়ার ক্রাইমস অ্যান্ড দি ওয়েস্ট। এখানে নতুন প্রজন্মের দুই তরুণ বাঙালি অধ্যাপক লিখেছেন নিবন্ধ : দি ওয়েস্টস রােল ইন হিউম্যান রাইটস ভায়ােলশন্স্ ইন বাংলাদেশ ওয়ার অব ইনডিপেন্ডেন্স জেনােসাইডের অভিজ্ঞতাবিহীন এই দুই তরুণের চমৎকার লেখা পড়ে প্রশ্ন জাগে জেনােসাইড কি কখনাে মাটিচাপা থাকতে পারে? মুনীর চৌধুরীর ‘কবর নাটকে মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে এসেছিল শহীদেরা, একাত্তরের জাতিনিধন যজ্ঞের হতভাগ্য বলী শতসহস্র নারী-পুরুষ-শিশু অপেক্ষায় আছে ইতিহাসের সত্যবিচারের জন্য, ন্যায়ের সঙ্গে বােঝাপড়ার জন্য, মাটি খুঁড়ে বের হয়ে আসার অপেক্ষায় আছে তারা, পরবর্তী প্রজন্মের মানুষেরা বুঝি লাগাবে জিয়নকাঠির ছোঁয়া। জেনােসাইডের মদদদাতা গােলাম আজম-নিজামী চক্রেরও তাই রেহাই নেই। আজ হােক কিংবা কাল।
(সমকাল, ২৬ মার্চ ২০০৬)
সূত্রঃ জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয় – মফিদুল হক