You dont have javascript enabled! Please enable it! মার্চ ২৮ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে কারা এগিয়ে এসেছিলো? - সংগ্রামের নোটবুক

মার্চ ১৯৭১
ভারত ১৯৭১ সালে আমাদের সর্বতোভাবে সহায়তা করেছে। কিন্তু সেই সহায়তার পরিধি কতোটুকু আমরা জানি না।২৬ মার্চ গণহত্যা শুরু হয়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের আগে গণহত্যা সম্পর্কে সুস্পষ্ট চিত্র বিশ্ববাসী পায়নি। কিন্তু, আমরা দেখি ৩০ মার্চের মধ্যেই সারা ভারত জুড়ে মানুষজন বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে এগিয়ে এসেছেন। মার্চ ২৮ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যেই দেখা যাক কারা এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশের সাহায্যার্থে।
১. ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা আই এন টি ইউ সির সাধারণ সম্পাদক জিরামানুজম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে বলেন, “অতি সত্ত্বই বাংলাদেশের জনগণ তাদের ইস্পিত লক্ষ্যে পৌঁছাবে।”২৭.৩.১৯৭১
২, আগরতলায় বন্ধ পালিত হয়।
৩, পাটনায় স্থানীয় ছাত্ররা মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে এবং ইয়াহিয়া খানেরকুশপুতুল দাহ করে।
৪, এস এস পি নেতা এস এম জোশী স্পেনের গৃহযুদ্ধের সঙ্গে বাঙালিদেরলড়াইকে তুলনা করে শ্রীমতী গান্ধীকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, তারপিত পভিত নেহরু স্পেনের জনগণের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন।”
৫. জয়পুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের প্রতিসংহতি জানানোর জন্য এবং ইয়াহিয়া খানের সামরিক সন্ত্রাসেরপ্রতিবাদে ২৭ মার্চ একদিনের ধর্মঘট পালন করে।”
৬. সারা ভারত ছাত্র পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক বরিজেন্দ্র কুমার জৈন “নিরস্ত্রজনসাধারণের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর বর্বর অভিযানের প্রতিবাদে সারা দেশবাসী সভা সমাবেশ গড়ে তোলার জন্য ছাত্রদেরপ্রতি আহ্বান জানান।
৭, ২৭ মার্চ এস এস পি দলের যুগ্ম সম্পাদক ডেঙ্কটরমন ভারত সরকারেরপ্রতি আহ্বান জানান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য।
৮, দিল্লি নাগরিকরা বাঙালিদের সমর্থনে একটি সংহতি কমিটি গঠন করেজনসভা আহ্বান করেন।
৯. দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ শিক্ষক ২৭ তারিখেই বিশ্বের স্বাধীনতা প্রিয়জনগণের কাছে আহ্বান জানান বাংলাদেশকে সমর্থন করার জন্য।
১০, ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন বি পি টি ইউসির সম্পাদক ভবানী রায় চৌধুরী ওটি এন সিদ্ধান্ত এক বিবৃতিতে জানান বাংলাদেশের মানুষের উপর বিনা প্ররোচণায় যে পাশবিক সামরিক হামলা শুরু হয়েছে বি পি টি ইউসি তার বিরুদ্ধে তীব্র ক্রোধ প্রকাশ করছে। বাংলাদেশ [এর বীর জনগণ যে সাহসিকতার সাথে সামরিক বাহিনীর হামলা প্রতিরোধ করছেন তার জন্য আমরা তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা পশ্চিমবাংলার শ্রমজীবী মানুষের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি যে তারা বাংলাদেশের সংগ্রামরতজনগণের উদ্দেশ্যে অবিলম্বে সংহতি জ্ঞাপন করেন।
১১, জীবন বীমা কর্মচারী সমিতি (পূর্বাঞ্চল) বিবৃতি প্রদান করে বাঙালিদেরসমর্থন জানায় ।।
১২. লোক সভায় ২৭ মার্চ কমিউনিষ্ট নেতা হীরেন মুখোপাধ্যায় একআবেগাপ্লুত ভাষণ দেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন,“পূর্ববঙ্গ থেকে যে আক্রন্দন ভেসে আসছে তার প্রতি কর্ণপাত করতে সরকারকে আবেদন করে শ্রী মুখার্জি বলেন যে পূর্ববঙ্গের প্রতিরোধকে চূর্ণ করতে সত্তর হাজার সৈন্য নিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু যারা আমাদেরই আপনার লোক তাদের অনুভূতি সম্বন্ধে কোন প্রকৃত অনুভূতি সরকারের বিবৃতিতে প্রকট হয় নি, সরকারের এটা পরিষ্কার করে বলা উচিত যে সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযান চলতে দেওয়াহবে না।”
১৩, ২৭ মার্চ সংসদে আরো অনেকে আলোচনা করেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীবলেন, “এটা কেবল আন্দোলন দমনের ঘটনা নয়-নিরস্ত্র জনতাকে ট্যাঙ্কের সাহায্যে মোকাবিলা করার ঘটনা বলে তিনি পরিস্থিতির বিশ্লেষণকরেন।”
১৪, জনসংঘ সদস্য জে, আর যোশী এবং সিন্ডেকেট কংগ্রেস সদস্য এসএন মিশ্রও প্রতিবাদ জানান।
১৫, উত্তর প্রদেশ বিধান সভা ২৯ মার্চ সর্বসম্মতভাবে যে প্রস্তাবটি গ্রহণ করেতা হলো “এই সভা বাংলাদেশের জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সহানুভুতি জানাচ্ছে এবং ভারত সরকারকে তাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত রকম সাহায্য পাঠাবার জন্য আশ্বাস জানাচ্ছে। শুধু তাই নয় আরেকটি সংশোধনীও গৃহীত হয় “ভারত সরকার যেন অবিলম্বে বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি দেন।”

১৬, রাজস্থান বিধান সভা সর্বসম্মতভাবে আহ্বান জানায় কেন্দ্রীয় সরকারকেযেন নতুন প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। “মুখ্যমন্ত্রী শ্রী মোহন লাল সুখাদিয়া সদস্যদের পক্ষ থেকে জানান যে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতেরসমগ্র জনসাধারণ রয়েছেন।”
১৭. নতুন দিল্লিতে পাকিস্তানী হাইকমিশনের সামনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ১৫০ জন সংসদ সদস্য বিক্ষোভ প্রদক্ষিণ করে। তারা শ্লোগান দেয় “ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশ ছাড়। বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ কর। বাংলারবন্ধু মুজিব জিন্দাবাদ”।
১৮. সারা ভারত মহিলা সম্মেলন, ভরিষ্টীয় জাতীয় মহিলা ফেডারেশন, ইয়ংউইমেন্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া ও ইন্ডিয়ান ফেডারেশন অব উইমেন ল ইয়ার্স সিংহল ও বার্মা সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলে-“বাংলাদেশের অসহায় নারী ও শিশুসহ নিরস্ত্র জনগণকে হত্যার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারকে আপনাদের দেশের বন্দর ও বিমানবন্দর ব্যবহার করতে দেবেন না।”
১৯, ৩০ মার্চ কেরালা বিধান সভা ও বিহার বিধান সভা বাংলাদেশকে সমর্থনজানিয়ে ও অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানায়।উল্লেখ্য, বাংলাদেশে কী হচ্ছে সে সম্পর্কে তখনও সম্পূর্ণ চিত্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরের মানুষজনই জানতে পারেনি।বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়ার ঘোষণা ও সাংবাদিকদের সাথে তখন মাত্র কিছু কিছু খবর বিশ্ববাসী জানছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখা গেছে, ভারতের বিন্নি সংস্থা, বিধান সভা শুধু যে বাংলাদেশ সমর্থন জানাচ্ছে তাই নয়, অস্থায়ী সরকার বা প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। তখনও বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়নি এবং বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণাও দেওয়া হয়নি, আবেগ এমনই জিনিষ!
সূত্র : দৈনিক কালান্তর, ২৮-৩-১৯৭১; ৩১-০৩-১৯৭১