সিন্ধিদের নেতাও শেখ মুজিব
পাকিস্তানের একটি প্রদেশ সিন্ধু। সেখানকার মানুষদের সঙ্গেও বন্দু ছিল পাঞ্জাবিদের। জয় সিন্ধু’ বলে তারাও স্বাধীন বা সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন করেছেন বহুদিন। আমরা জয় বাংলা’ আন্দোলন করে স্বাধীনতার পথে চলছি তা ‘জয় সিন্ধের অনেকে চেয়েছিলেন। মার্চের দিকে তারা একটি চিঠি লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে। ঢাকার সদর ডাকঘরে চিঠিটি পৌঁছেছিল কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌছেনি। উর্দুতে লেখা সেই চিঠি নিয়ে এক শরণার্থী চলে যান আগরতলা। সেখানে আনন্দবাজারের প্রতিনিধি অনিল ভট্টাচার্য চিঠিটি সংগ্রহ করেন এবং বঙ্গানুবাদ করে পত্রিকায় ছাপান। যারা এই চিঠিটি লিখেছিলেন তাদের মূল বক্তব্য ছিল, পূর্ব বঙ্গ ও সিন্ধুকে নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনে যেন নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু। তা হলে তারা পাঞ্জাবী ও মোহাজেরদের পরিবর্তে বাঙালি ভাইদের বুকে তুলে নেবেন । চিঠিটি এখানে উদ্ধৃত করছি। শুরুতে লেখা হয়েছে, “হজরত শেখ মুজিবর রহমান সাহেব সমীপেষু আসসালামু আলায়কুম, অত্যাচারিত সিন্ধুবাসীদের তরফ থেকে বাঙালি ভাইদের সালাম। শৃঙ্খলা বন্ধ সিন্ধু বাংলাদেশকে অভিবাদন জানাচ্ছে।আমাদের প্রিয় নেতা শেখ সাহেব, গত কয়েক দিনের ঘটনায় জালেম সরকার যে কঠোরতার সঙ্গে বাঙালি ভাইদের উপর নির্মম গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে সিন্ধুর মজলুম জনসাধারণ তাতে অসম্ভব সমবেদনা প্রকাশ করছে এবং পরম করুণাময়ের দরবারে বাঙালি শহীদান ভাইদের আত্মীয়স্বজনদের ধৈর্যশক্তি দেবার জন্য ও শহীদানদের স্বর্গ বাসের জন্য প্রার্থনা জানাচ্ছে। সরকারের এই বর্বরতার ইতিহাস শহীদানের রক্তে লিখিত হয়েছে।হে প্রিয় মহান নেতা, আপনি আমাদের এই সিন্ধুবাসীদের পিতা, আমাদের পথপ্রদর্শক। আমরা আপনার মতো একজন নেতা পেয়ে গর্ব বোধ করছি। জুলুম ও শোষণের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম করে যেভাবে আপনি ছয় দফাকে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তার জন্য আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা বিশ্বাস করি যে, আপনার ছয় দফা কর্মসূচি আমাদের সিন্ধুবাসীদেরও কল্যাণের জন্য। বেলুচিরাও মনে করে, আপনার ছয় দফা তাদের কল্যাণে। আমরা সিন্ধী ও বেলুচিরা একযোগে আপনার ছয় দফা কর্মসূচিকে স্বাগত জানাচ্ছি। শেখ সাহেব, সত্যি আমাদের দুঃখ হয় যে, এ পর্যন্ত আমরা একজনও খাটি সিন্ধী নেতা পেলাম না।
যদিও দু-একজন আছেন, ধনসম্পদের লোভ দেখিয়ে তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। নবাবশাহের মধ্যে জাফর আলী শাহ ছিলেন একজন বিশ্বস্ত জনদরদী নওজোয়ান। কিন্তু পি-পি- পির জতুই টাকার জোরে তাকে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে হারিয়ে দিলেন। আমাদের অভিযোগ, জতুই সাহেব একেবারে জীবনের শুরু থেকে শাসনব্যবস্থায় অংশ গ্রহণ করে আসছেন; কিন্তু নিজের জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তিনি কিছু করেননি। তিনি এ পর্যন্ত কাউকে একটা চৌকিদারির চাকরি পর্যন্ত করে দেননি। পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য তিনি মাঝে মাঝে লাহোর যেতেন, কিন্তু কোনোদিন পরিষদে টু শব্দটি পর্যন্ত করেননি। লাহোরের মওজ খানার আস্বাদ নিয়ে দেশে ফিরতেন। শুধু পরিষদের সদস্য বলে পরিচয় দেওয়ার মধ্যেই তার বাহাদুরি। রাষ্ট্রনায়ক যিনিই থাকুন না কেন, তার পদলেহন করাই তার স্বভাব। একবার আইয়ুব মরহুম ফিল্ড মার্শালকে তিনি দাওয়াত দিয়ে ছিলেন। তাতে লাখ টাকা খরচ হয়েছিল এবং ডােজ শেষে তিনি আইয়ুব খাঁকে একখানা মূল্যবান গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। এখন জনাব, আপনিই চিন্তা করুন, যে লোক নিজের স্বার্থ ও আয়েশের জন্য এভাবে ধনসম্পদ ব্যবহার করতে পারে, সে কি কোনো দিন জাতির উপকারে আসতে পারে? এ লোকের ঈমান নেই। সে সব সময় উদীয়মান সূর্যকে সেলাম করে, করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। | জতুই সাহেব ছাড়া আর একজন আছেন, তাঁর নাম তালের মওলা। তিনি এক বিরাট জমিদার। প্রায় সব নির্বাচনে তিনি অংশ নেন এবং নির্বাচিত হন। কিন্তু তার ঘরে সব সময় তবলা বাজতে থাকে। পরিষদের অধিবেশনে যদি কখনও যোগদান করেন, চুপচাপ বসে থাকেন। যে লোক সব সময় বলা নিয়ে মশগুল থাকে সে আর কী-ই বা করবে? একবার পিডির এক জনসভায় যোগদানের জন্য তিনি হায়দরাবাদ থেকে রওনা হয়েছিলেন গাড়ি-ভর্তি তবলচিদের নিয়ে। লাহোরে এক হোটেলে উঠে তবলার মাহফিল বসিয়ে ছিলেন। এই তবলাবাজ লোকটি কী কাজ করবেন? সমাজতন্ত্র কী এবং তার পরিণাম কী, এ সম্বন্ধে তাঁর কোনো ধারণা নেই।এ ছাড়া পিপিপির যত নেতা আছেন তারা শুধু সমাজতন্ত্রের ছত্রছায়ায় দাড়িয়ে জয়লাভ করেছেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন গরিব জনসাধারণ ভুট্টোর সমাজতন্ত্রের জালে আটকা পড়েছে এবং সংগ্রামের প্রতীক তলোয়ারকে তারা পছন্দ করে। তাই ভুট্টো তলোয়ারকে নির্বাচনী প্রতীক হিসাবে বেছে নিলেন।
সেদিন যারা ভূট্টোর সঙ্গে সুর মিলিয়ে সমাজতন্ত্রের ধ্বনি দিয়েছিলেন, তাঁদের কণ্ঠে আজ কান্নার সুর। ভুট্টো জনসাধারণকে মুফতে জমি দেবার এবং খাজনা মাফ করার প্রলোভন দেখিয়ে লোট হাসিল করেছিলেন। কিন্তু জনসাধারণ যখন দেখল, কেউ মুফত জমি ছাড়তে রাজি নয় এবং তাদের কুড়েঘরের চেহারার পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই তখন তারা কাঁদতে আরম্ভ করল। এখন ভুট্টো তার দলীয় সদস্যদের বলে বেড়াচ্ছেন, যদি কেউ ঢাকা অধিবেশনে যোগদান করে তাহলে তাকে কেতিল করা হবে।
নির্বাচনের পর যখন সিন্ধু নদের পানি কমতে শুরু করল তখন এখানকার লোকের চোখ খুলে গেল। পাঞ্জাব সিন্ধুকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি দিতে অস্বীকার করল। পরিণামে সিন্ধুদেশে হাহাকার পড়ে গেল। সিন্ধুনদ সিন্ধুর প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে খুবই উল্লেখযোগ্য। তার দৌলতে সিন্ধুর অববাহিকা অঞ্চল আবাদ হয়েছে। কিন্তু পাঞ্জাবের হঠকারিতার ফলে আজ সমগ্র সিন্ধু প্রদেশ মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। ফলে গম ও অন্যান্য ফসলের ফলন দারুণভাবে কমে গেছে। কিন্তু ভুট্টো সাহেবের এ নিয়ে মাথা ঘামাবার কিছু নেই। তিনি প্রতিদিন রাত্রে এক বোতল ব্ল্যাক ডগ’ ও একটি নারী নিয়ে সোস্যালিজম পরিকল্পনা, রূপায়নের চিন্তায় মশগুল। কাজ জাহান্নামে যাক, তাতে ভুট্টোর কিছু আসে যায় না। তার শুধু এক বোতল মদ ও একটি নারী দরকার। তিনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, ‘পাঞ্জাব আমাকে ভোট দিয়েছে, তাই পাঞ্জাবের খেয়াল আমি বেশি করব।’ এটাই তো স্বাভাবিক। যে নেতা নিজের জাতিকে লাথি মেরে অপর জাতিকে বুকে তুলে নেয়, সে অভিশপ্ত ।
পাঞ্জাবীদের শাসনের রীতিই হচ্ছে, বিজাতিদের সুযোগ দিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করা। ভুট্টো সিন্ধুর দানাপানি খেয়ে মানুষ হয়েছেন, কিন্তু পাঞ্জাবের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন আর সিন্ধুদের ধ্বংস-কার্যে সহায়তা করছেন। শিয়ালকোটের এক জনসভায় ভুট্টো বললেন, আমি শিয়ালকোটী। লাহোরে একবার বললেন, আমি ভাটী। তাহলে আসলে এ লোকটা কোথাকার? ভুট্টো সাহেব ধাপ্পাবাজিতেও ওস্তাদ। এক সময় তিনি বললেন, “তাসখন্দের রহস্য আমার কাছে আছে। এ নিয়ে সারা দেশে আলোড়ন পড়ে গেল। করাচী ও হায়দারাবাদে অবাধে হত্যাকাণ্ড চলতে লাগল। কিছুদিন পরে তিনি আবার বললেন, “তাসখন্দের কোনো রহস্য আমার কাছে নেই। যার জবান ঠিক নেই, সে তো বেঈমান। শস্তা জনপ্রিয়তার জন্য সে মিথ্যা বলতে পারে এবং বিশ্বাসঘাতকতাও করতে পারে। এই লোকটি মরহুম আইয়ুবের দালাল, আবার দুশমনও। আজ সমগ্র সিন্ধুর বুদ্ধিজীবীরা ভুট্টো লোকটাকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করেছে। পাঞ্জাবীরা আজ তার গলার উপর ছুরি বসিয়ে বলছে,নির্বাচনের বেলায় যে ওয়াদা করেছিলেন তা পুরণ করো।’ কিন্তু এতগুলো ওয়াদা তিনি কী করে পূরণ করবেন।লাহোরের এক জনসভার কথা মনে আছে। সেই সভায় ভুট্টো সাহেব মদ খেয়ে আবোল-তাবোল বকছিলেন এবং মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল তিনি যেন সিনেমায় অ্যাকটিং করছেন। হঠাৎ এক সময় তিনি বলে উঠলেন, ‘আমি দিলীপকুমার।’এখন আপনিই বলুন হুজুর, এই পাগল লোকটাকে দিয়ে আমাদের কি সর্বনাশই না হচ্ছে। সিন্ধুর অধিবাসীরা আজ সর্বহারা।মরহুম আইয়ুব একটি অর্থনৈতিক সংস্থা খুলেছেন, যার নাম কৃষি উন্নয়ন সংস্থা। সেটা শুধু পাঞ্জাবী অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার আর কর্মীদের আড়াখানায় পরিণত হয়েছে। অফিসারদের বয়েস ষাটের বেশি হলেও আপত্তি নেই, তবে তাদের পাঞ্জাবী হতে হবে।এ-ডি-সি থেকে কর্জ পাচ্ছে পাঞ্জাবীরা, চাকরি দেওয়া হচ্ছে অথর্ব পাঞ্জাবীদের; অথচ বহু বেকার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট সিন্ধী ছেলে পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সিন্ধু এলাকার সমস্ত এ-ডি-সি অফিসে ছোটো বড়ো সকল চাকুরি এখন পাঞ্জাবীদের জন্য সংরক্ষিত। সিন্ধীদের জন্য সামান্য পিওনের চাকরিও রাখা হয় না। পাঞ্জাবী অফিসাররা যখন অবসর গ্রহণ করেন তখন সিন্ধু এলাকায় উপহারস্বরূপ তাঁদের জায়গা দেওয়া হয়। | সি-এস-এস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সিন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক সময় ভ্যাকান্সিথাকার জন্য বেকার বসে থাকতে হয়। অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ সামরিক অফিসারদের নিয়ে কাজ না চালিয়ে যদি এইসব তরুণদের নিয়োগ করা হতো তাহলে বেকার সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়ে যেত।এ-ডি-সির নামের সঙ্গে কর্পোরেশন কেন লাগানো হলো তা আমরা বুঝতে পারছি না। কর্পোরেশনের মধ্যে তো জনসাধারণের শেয়ার থাকে। কিন্তু এ-ডি-সি একটি সরকারি সংস্থা, যার মূলধন আসে সরকারের বাজেট অনুদান এবং বৈদেশিক রাষ্ট্রলি থেকে। এর নাম কপোরেশন করার কারণ, পাঞ্জাবী হোমরাচোমরাদের এই সংস্থাকে যাতে তারা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো পরিচালনা করতে পারে।| এই সংস্থার চাকরি-বাকরির দিক দিয়ে সরকারের নিয়মকানুন মেনে চলার কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত এখানে কখনও কর্ম-খালির নোটিশ দিয়ে লোক নেওয়া হয়নি, যদিও সরকারি সংস্থায় তা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু নিয়ম মেনে চললে পাঞ্জাবীদের টেকানো যাবে কী করে? | ০৬.০৩.১৯৭১ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে আইনশৃঙ্খলাহীন অবস্থা বিরাজ করছে। একথা বলার আগে তার কি উচিত ছিল না তার নিজের ঘরের অব্যবস্থা ও শৃঙ্খলাহীনতার দিকে তাকানো?
যদি এ-ডি-সি, এন-এস-সি ও টি সি পিতে সামরিক ব্যক্তিদের না নিয়ে অসামরিক জনসাধারণকে সুযোগ দেওয়া হতো তাহলে উচ্চ শিক্ষিত বেকার সমস্যার একটা সমাধান নিশ্চয়ই হয়ে যেত। | এ বছর এ-ড়ি-সি সিন্ধু সরকার থেকে ৪৭ লক্ষ টাকা নিয়েছে, যার উদ্দেশ্য একটা বাজে পরিকল্পনা নিয়ে পাঞ্জাবীদের একটা সংস্থান করে তাদের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স স্ফীত করা। আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।এখন আপনার কাছে মজলুম সিন্ধুবাসীর সবিনয় নিবেদন, আপনি পত্রিকায় একটি বিবৃতি দিয়ে সিন্ধু এলাকায় সরকারি সংস্থাগুলি থেকে পাঞ্জাবী সামরিক ব্যক্তিদের বার করে দিয়ে স্থানীয় লোকদের নিয়োগ করার দাবি জানান। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আপনার দাবি কেউ অবহেলা করতে পারবে না। এতে করে আমাদের বেকার সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়ে যাবে। | সিন্ধু এলাকার শতকরা ৯৯ জন সি-এস-পি অফিসার পাঞ্জাবী। তাঁরা বড়ো বড়ো পদ নিয়ে বসে আছেন। পাঞ্জাব থেকে কৃষক আমদানি করে এখানে জমি দেওয়া হচ্ছে, টাকা-পয়সা, সার ইত্যাদি দিয়ে তাদের পোষা হচ্ছে। কিন্তু স্থানীয় সিন্ধী কৃষকরা ছিন্নমূল হয়ে রাস্তায় ঘুরছে। কেন এই অবিচার? এটা কি পাকিস্তান, না পাঞ্জাবীস্থান? কিন্তু সিন্ধী নেতারা একেবারে চুপচাপ। ভুট্টোর মতো সিন্ধী নেতার উপর খোদার অভিশাপ, সে কোনোদিন নিজের জাতির দিকে একটিবার তাকালো না। তার জায়গায় আমরা আপনাকে গ্রহণ করছি আমাদের প্রিয় নেতা হিসাবে। আপনি কয়েক হাজার মাইল দূরে থেকেও আমাদের কথা স্মরণ করেছেন। আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।
এদিকে আবার মোহাজের সাহেবরাও আমাদের উপর রাজত্ব করার খায়েশ করে বসে আছেন। এঁরা সিন্ধুকে মোহাজেরস্থান করতে চান। এটা লিয়াকত আলী খানেরও মতলব ছিল এবং তিনি একটি নকশাও তৈরি করেছিলেন। সেটা এর সঙ্গে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি এসব দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবেন যে, কীভাবে সিন্ধীদের উপর অত্যাচার হয়েছে । আলাদা হয়ে যেতে বাধ্য করে তাহলে দয়া করে আপনি সিন্ধুকে আপনার সঙ্গে রাখবেন। নইলে পাঞ্জাবীদের জুলুম ও অত্যাচারে সমগ্র সিন্ধু ধ্বংস হয়ে যাবে। আপনি যদি পূর্ব বাংলা ও সিন্ধুকে নিয়ে আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠন করেন তাহলে আমরা সানন্দে তা মেনে নেব এবং পাঞ্জাবী ও মোহাজেরদের পরিবর্তে বাঙালি ভাইদের বুকে তুলে নেব।ভুট্টো জনসাধারণকে কাশ্মীরের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। দু’টো যুদ্ধই তো সে বাধিয়েছে। ফল হয়েছে, বহু লোক হতাহত, অনেক নারী বিধবা এবং অনেক সন্তান এতিম। যেভাবে কাশ্মীর জয় করার জন্য যুদ্ধ বাধিয়ে গণহত্যার পথ প্রশস্ত করা হয়েছে, ঠিক সেইভাবে আমাদের বাঙালি ভাইদেরও খতম করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। পাঞ্জাবী ও মোহাজেররা বাঙ্গালিদের হিন্দু বলে মনে করে। | গত সর্বনাশী ঘুর্ণিবাত্যায় যখন লক্ষ লক্ষ বাঙালি ভাই মারা গেল তখন কোনো পশ্চিম পাকিস্তানী পাঞ্জাবী ও মোহাজেরকে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখিনি। বরঞ্চ তারা বলেছিল, বাঙালিদের উপর খোদার আরও গজব নাজেল হওয়া উচিত।
এখন যখন পূর্ব পাকিস্তানে গণআন্দোলনের সাড়া পড়ে গেছে তখন কতজনকে তারা শহীদ করেছে, কত নারীকে বেঈমান ইয়াহিয়া সরকার বিধবা করেছে, কত মা-বাবাকে তারা সন্তানহারা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার জন্য এখন থেকে যাদের পাঠানো হয়েছিল তাদের অনেকে মারা গেছে। কিন্তু এ পর্যন্ত তাদের অসহায় মা-বাবা পরিবার পরিজনের জন্য জালেম সরকার কিছু করেনি।| মেজর জেনারেল টিক্কা খাকে পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল।শেখ সাহেব, এটা পরিতাপের বিষয় যে, পূর্ব পাকিস্তানী সামরিক ব্যক্তিদের এখানে বদলি করে বন্দি করে রাখা হয়েছে এবং পাঞ্জাবীদের দিয়ে বাঙালিদের হত্যা করা হচ্ছে। এখন পাঞ্জাবী সৈন্যরা আমাদের রক্ষক নয়, ভক্ষক।| ০৭,০৩,১৯৭১ তারিখে আপনার ভাষণের মধ্যে ২৫,০৩,১৯৭১ তারিখের অধিবেশনে যোগদানের যে শর্তগুলি দিয়েছেন তাতে আমরা খুব খুশি হয়েছি। আপনাকে আমাদের মোবারকবাদ জানাচ্ছি। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল। শুধু পাঞ্জাবীদের আজাদী ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। ইকবাল পাকিস্তানের কোনো স্বপ্ন দেখেননি। তিনি শুধু শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেরণা দিয়েছিলেন।হিন্দুস্থান আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। সুতরাং উভয়ের স্বার্থে ইন্দো-পাক সম্পর্ক সুখের হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাহলে কাশ্মীর এবং পানি সমস্যার একটা আপোষ মীমাংসা হয়ে যাবে। যারা নির্বোধ তারাই শুধু ভুট্টোর কাশ্মীর সমস্যার আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করে। অধিকাংশেরই এই আলোচনার প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই এবং কাশ্মীরি যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ মনে করাও মহাপাপ বলে জনসাধারণ বিশ্বাস করে। পাকিস্তান এবং হিন্দুস্তানের মধ্যে সদ্ভাব থাকলে যে কোনো সমস্যা আপোষ মীমাংসায় হয়ে যাবে। এ যুগে যুদ্ধ সমস্যা সৃষ্টি করে, কোনো সমাধান দিতে পারে না।হিন্দুস্থান পাকিস্তানের উপর কোনো সময় হামলা করেনি। ১৯৬৫ সালে | আইয়ুব-ভুট্টো চক্রান্ত করে কাশ্মীরের মধ্যে সশস্ত্র গেরিলা বাহিনী ঢুকিয়ে দেওয়ার ফলে এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। হিন্দুস্থান গেরিলাবাহিনীকে ফেরৎ নেবার দাবী করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান তাতে অস্বীকৃতি জানায়। এর জবাবে হিন্দুস্তান বাধ্য হয়ে লাহোরে হামলা চালায়।
হিন্দুস্তানের সঙ্গে আমাদের কোনো দুশমনি নেই। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকলে আমাদের উন্নতি দ্রুততর হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। প্রতিরক্ষা খরচ আমাদের পরিকল্পনার সিংহভাগ নিয়ে নেয়। এটাও কমে যাবে। আমরা তখনই পূর্ণ নিরাপত্তা অনুভব করতে পারবো, যখন হিন্দুস্তানের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব সুদৃঢ় হবে। যদি কোনোভাবে আপনি হিন্দুস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করতে পারেন, তাহলে আমরা আপনাকে সহায়তা করতে রাজী আছি।হে মহান নেতা, আপনি এক ইউনিট বাতিল করে আমাদের যথেষ্ট উপকার করেছেন। আপনি সিন্ধুবাসীদের প্রিয় নেতা। নেমকহারাম সিন্ধী নেতাদের ত্যাগ করে আমরাআপনাকে আমাদের নেতা হিসাবে স্বাগত জানাচ্ছি এবং আশা করছি বাঙালি ও | সিন্ধীদের মধ্যে মধুর সম্পর্ক আরও মধুর হবে। এতদসংলগ্ন নকশাটা লিয়াকত আলী খাঁর তৈরি এবং কষ্টে সরকারি অফিস থেকে ধার করেছি। এই নকশাটা দেখে আপনি অবাক হয়ে যাবেন, কী করে লিয়াকত আলী খাঁ সিন্ধুকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন এবং কোন উদ্দেশ্যে প্রণােদিত হয়ে মোহাজেরদের সিন্ধুর মধ্যে এনেছিলেন। অবশ্য খোদার ফজলে কোনো এক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি লিয়াকত আলী খাঁকে গুলি করে হত্যা করে তাঁর অশুভ পরিকল্পনার কবর রচনা করেছেন। | এখন আপনিই আমাদের দরদী নেতা। আমাদের মতো মজলুম সর্বহারাদের ললাট আপনিই পরিবর্তন করতে পারেন। জয় সিন্ধু জয় বাংলা। বাঙালি-সিন্ধী ভাই-ভাই।“হে পবিত্র সোনার বাংলা তোমার উপর| সিন্ধুদেশ কোরবান। স্বদেশপ্রেমিক শহীদানদেরকরছে সালাম। সিন্ধুদেশের অধিবাসীরনেই কোনো জবান নাহি কোনো নেগাবান।”
সূত্র : দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯.৫.১৯৭১।